শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

পরানের সাথে খেলিব আজিকে-১

মৃত্যুরাখালের গর্বের শেষ নেই। যে জীবন নিয়ে মানুষের এতো অহমিকা, স্বজন-পরিজন সংসারের তৃপ্ত আবহ, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতার উত্তুঙ্গ মিনার, তা’কে এক ফুঁয়ে সে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। তার সামনে নত হয়ে থাকে রাজার রাজা, ভিখারির ভিখারি, সম্মান-অসম্মানের ভিতে গড়া অনন্ত নক্ষত্রবীথি, পাবকের পবিত্র অগ্নি থেকে মৃত্যুরাখাল কাউকে রেহাই দেয়না। সে তো ভাবতেই পারেনা একটা রক্তমাংসের মানুষ সদানন্দ হয়ে নিজেকে ঘিরে রেখেছে আনন্দের সমুদ্রে। রাখাল তার নাগাল কখনো পাবেনা। তার কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই। সদানন্দের আশি বছরের দীর্ঘ জীবন জুড়ে বারম্বার হননপ্রয়াস চালিয়ে গেছে সে। কিন্তু ঐ সমুদ্রটা কখনও পেরোতে পারেনি। সে হেরে যায় সদানন্দের কাছে। জগৎ সংসার জানে সে হলো জীবনের শেষ কথা । সদানন্দ বলে সে হলো অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার।

”…. বস্তু জগৎ যদি অটল কঠিন প্রাচীরে আমাদের ঘিরে রেখে দিতো এবং মৃত্যু যদি তার মধ্যে মধ্যে বাতায়ন খুলে না রেখে দিতো, তাহলে আমরা যা আছে তারই দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত হয়ে থাকতুম। এ ছাড়া যে আর কিছু হতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতুম না। মৃত্যু আমাদের কাছে অনন্ত সম্ভবনার দ্বার খুলে রেখে দিয়েছে।”
(২০শে জুলাই ১৮৯৩ সালে ইন্দিরা দেবী’কে লেখা চিঠি)
এই চিন্তাটি আরো সন্নিবদ্ধ হয়েছিলো পরবর্তীকালে।
” জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি সত্য। কষ্ট হয় মানি। কিন্তু মৃত্যু না থাকলে জীবনেরও কোনো মূল্য থাকেনা। যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই। তাই শোককে বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়। অনেক সময় আমরা শোকটাকে ঘটা করে জাগিয়ে রাখি পাছে যাকে হারিয়েছি তার প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি ঘটে। কিন্তু এটাই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে। মৃত্যু চেয়ে জীবনের দাবি বড়ো।”
মৃত্যু সম্পর্কে কবি’র এই মানসিকতাটি তৈরি হওয়ার পিছনে আশৈশব কিছু প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কোনো মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় অনিচ্ছুক ছিলেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিন তলার যে ঘরে তিনি থাকতেন, মৃত্যুর পরে সেই ঘরে তাঁর কোনো প্রতিকৃতি বা অন্য স্মৃতিফলক রাখতে তিনি মানা করেছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই প্রসঙ্গে কবিকে যখন এক ঘনিষ্টজন প্রশ্ন করেন, কবি বলেন, ” সদর স্ট্রিটের বাড়িতে বাবামশায়ের তখন খুব অসুখ। কেউ ভাবেনি তিনি আবার সেরে উঠবেন। সেইসময় একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি কাছে যেতেই বললেন- আমি তোমাকে ডেকেছি, আমার একটা বিশেষ কথা তোমাকে বলবার আছে। শান্তিনিকেতনে আমার কোনো মূর্তি বা ছবি বা এইরকম কিছু থাকে আমার তা ইচ্ছা নয়। তুমি নিজে রাখবে না, আর কাউকে রাখতেও দেবেনা। আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি এর যেন কোনো অন্যথা না হয়।” তার পর কবি আরো বলেছিলেন, রামমোহন রায় বিদেশে মারা গিয়ে খুব বুদ্ধির কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশকে কোনো বিশ্বাস নেই। হয়তো মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়েও একটা কাণ্ড আরম্ভ হতো। কবির নিজেরও মনে হতো যদি তিনি বিদেশে প্রয়াত হ’ন তবেই ভালো। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা মানুষ হয়তো মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন দেশের লোকের হাতে তাঁর শেষ অমর্যাদা।
মীরাদেবী ও রথীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় মহর্ষির ছবি রাখতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কবি কখনও অনুমতি দেননি। তিনি নিজে কোনও পরলোকগত মানুষের ছবি নিজের কাছে রাখতেন না। অবশ্য অন্য কেউ যদি তাঁর ছবি নিজের কাছে রাখতে চাইতো, তিনি বাধাও দিতেন না। ছবিতে সইও করে দিতেন নির্বাধ। তিনি তো বৈরাগী ছিলেন না। কিন্তু চলে যাওয়া প্রিয়জনদের যে ছবি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা থাকতো, তাই ছিলো চূড়ান্ত। কাগজকলমের রেখায় তাঁদের খুঁজতে যেতেন না তিনি।
এই ‘ছবি’ দেখা নিয়ে একটা ঘটনা আজ ইতিহাসের অংশ। ১৩২১ সালের কার্তিক মাসে কবি বেড়াতে গিয়েছিলেন এলাহাবাদ, ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ গাঙ্গুলির বাড়িতে। সেখানে পুরোনো অ্যালবাম দেখতে দেখতে নতুন বৌঠানের একটা পুরোনো ছবি তাঁকে ট্রিগার করে। এভাবেই জন্ম হয় বলাকা কাব্যের সেই অতিখ্যাত কবিতা ‘ছবি’। ”…. হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি… ।” এই স্মৃতিঘনঘোর প্রেরণা থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লেখেন আর একটি বিশ্রুত কবিতা, ‘শাজাহান’।
”ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। … কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।” (জীবনস্মৃতি)

তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ

দ্বারকানাথের আশ্রিত ঠাকুর পরিবারের ‘সন্দেশ পরীক্ষকে’র পৌত্রী যখন মোকাম কলকাতার সম্ভবত সব চেয়ে উপযুক্ত অভিজাত বিবাহসম্ভব পুরুষের পরিণীতা হিসেবে স্বীকৃত হতে চায়, তখন তার জন্য যে চ্যালেঞ্জটি অপেক্ষা করে, তা এককথায় হিমালয়প্রতিম। ভাসুর সত্যেন্দ্রনাথ একেবারে চান’নি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভার্যা হিসেবে এতোটা অনভিজাত সাধারণ এক পরিবারের কন্যাকে স্বীকার করে নিতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, যিনি যে কোনো শিক্ষিত, সাধিত, মার্জিত অভিজাত নারীর স্বপ্নপ্রতিম পুরুষ হতে পারেন, তাঁর সঙ্গে ‘মাতঙ্গিনী’? কিন্তু বিবাহের পর কালক্রমে ‘মাতঙ্গিনী’ রাশনামের এই নারীটি নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জ্যোতিরিন্দ্রের উপযুক্ত ‘সহধর্মিণী’ করে তুলতে সফল হয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামের যে বোধিবৃক্ষটি পরবর্তীকালে এক সমগ্র সভ্যতাকে নিজের ছায়ায় লালনপালন করে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, সেই বৃক্ষের অংকুরোদ্গম থেকে নিজস্ব শরীর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কাদম্বরী জল-মাটি-অক্সিজেন দিয়ে তাকে পোষণ করে গেছেন। কবির জীবনে নতুন বৌঠানের ভূমিকা নিয়ে এতো চর্চা হয়েছে, যার পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। কবি তাঁর বিকাশকালের প্রথম স্তরে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার সব কিছুই এই নারীকে মুগ্ধ করার জন্য। উত্তরসূরি কবি যেভাবে বলেছিলেন, ” আমার সকল গান, তবুও তোমারে লক্ষ্য করে”। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। এতো সার্থক ভাবে প্রযুক্ত কবিবাক্য খুব সুলভ নয়। কাদম্বরীর মৃত্যুর দিন দশেক পরে প্রকাশিত কবির ‘প্রকৃতির পরিশোধ’ ‘নাট্যকাব্য’টির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, ‘উৎসর্গ-/ তোমাকে দিলাম।’ মাসখানেক পর প্রকাশিত ‘শৈশবসঙ্গীত’ কাব্যসংকলনের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছিলেন, ”…. উপহার/ এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লিখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।” তারও মাসখানেক পরে প্রকাশিত ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’র উৎসর্গপত্রে একই আকূতি, ”ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।” সেই অসামান্যা নারীর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বেদনাতুর অকালমৃত্যুর শোক কবির মধ্যে বাকি জীবন ধরে ক্রমাগত তীক্ষ্ণতর মৃত্যু আঘাত নিয়ে এসেছে। তাকে প্রত্যাখ্যান করে এগিয়ে যাবার শক্তিই কবিকে ‘রবীন্দ্রনাথ’ করে তুলেছিলো। পরবর্তী জীবনে মৃত্যুর মিছিল হয়তো তাঁকে ভিতর থেকে বিদীর্ণ করেছে। কিন্তু মৃত্যুরাখালের কাছে নত করতে পারেনি। শুধু ইন্দিরা দেবীর লেখা থেকে পাই, ”… নতুন কাকিমার মৃত্যু আমাদের জোড়াসাঁকোর বাল্যজীবনে প্রথম শোকের ছায়া ফেলে বলে মনে হয়। তখন আমরা তো বিশেষ কিছু বুঝতুম না। তবে রবিকাকাকে খুব বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখতুম….”
”হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, ……. এ সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না।” (পুষ্পাঞ্জলি)

কাদম্বরী দেবী

এই লেখাটি কবির চব্বিশ বছর বয়সে লেখা। কিন্তু তার পরেও দীর্ঘ আশি বছরের যাত্রাপথে কবি বোধ হয় ‘প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া’ কৃত্যটি পালন করে গেছেন। কখনও ছেদ পড়েনি। এই নারীর স্মৃতি কবিকে দিয়ে এতো বিপুল পরিমাণ সার্থক সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছিলো যে আমাদের মতো ইতর রসগ্রাহীরা ব্যক্তি কাদম্বরী দেবীর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকি। তাঁর স্বল্পকালীন জীবন আর অনন্ত লোকোত্তর অস্তিত্ত্ব কবিকে সারা জীবন সৃজনশীলতার শ্রেয়ত্বে গরিমাময় করে রেখেছিলো।

একেবারে শেষ জীবনে এক স্নেহধন্যাকে কৌতুক করে কবি বলেছিলেন, ”নতুন বৌঠান চলে গিয়েছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে আজও গান বাঁধি। বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা করতুম” ।
”দেখিলাম খান কয় পুরাতন চিঠি
স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি
স্মৃতির খেলেনা-কটি বহু যত্নভরে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।“(স্মরণ)
কবিপত্নী মৃণালিনীর যে ঠিক কী ব্যাধি হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, ”…. বিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি অক্ষুণ্ণভাবে রক্ষা করার নিমিত্ত মৃণালিনী দেবী কঠোর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। ইহার তীব্র আঘাত তাঁহার অনভ্যস্ত শরীর সহ্য করিতে পারিল না। ফলে স্বাস্থ্যভঙ্গ দেখা দিল এবং ক্রমে সাংঘাতিক রোগে পরিণত হইল।” রথীন্দ্রনাথের লেখায় পাই, ”… শান্তিনিকেতনে কয়েকমাস থাকার পর মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। … আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ জানা ছিলনা, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি।” প্রভাতকুমার হেমলতা ঠাকুরের কাছে শুনেছিলেন, ” ….. মৃণালিনী দেবী বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়িতে বর্ষাকালে কোনো নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিলেন। সেখানে পড়িয়া যান ও আঘাত পান, তখন তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা।” ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে তাঁর অসুস্থতা খুব বেড়ে যায়। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারেরা অসুখ ধরতে না পারায় কবি বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক প্রতাপ মজুমদার, ডি. এন. রায় প্রমুখের শরণ নিলেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হলোনা। ইন্দিরা দেবী তো এমনও লিখেছেন, ”…. কাকিমার শেষ অসুখে (রবিকা) এক হোমিওপ্যাথি ধরে রইলেন ও কোনো চিকিৎসা বদল করলেন না বলে কোনো কোনো বিশিষ্ট বন্ধুকে আক্ষেপ করতে শুনেছি।”

কবিপত্নী মৃণালিনী

মীরা দেবীর স্মৃতিচারণে পড়েছি, মৃণালিনী দেবীকে রাখা হয়েছিলো কবির নিজস্ব লালবাড়ির দোতলায়। ”….. সে বাড়িতে তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না, তাই একমাত্র তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা ছাড়া গতি ছিল না। ঐ বাতাসহীন ঘরে অসুস্থ শরীরে মা না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু বড়ো বৌঠান হেমলতা দেবীর কাছে শুনেছি যে বাবা মার পাশে বসে সারা রাত তালপাখা নিয়ে বাতাস করতেন।”
অবস্থার ক্রম-অবনতি হতে থাকে। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতি কথনে , ”…. মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
তারপর কবির কাছে সমবেদনা জানাতে দীর্ঘ মানুষের সারি। সকলের সঙ্গে অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে কথা বলে গেলেন। শেষে রথীন্দ্রকে ডেকে তাঁর হাতে মৃণালিনী দেবীর নিত্যব্যবহার্য চটিজুতোটি দিয়ে বললেন, ” …এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।” এই কথা বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন।
হেমলতা দেবীর স্মৃতিকথায় আমরা পাই,” রাত্রে আমার স্বামী (দ্বিপেন্দ্রনাথ) এসে বললেন, ” খুড়ির মৃত্যু হয়েছে, কাকামশাই একলা ছাদে চলে গেছেন, বারণ করেছেন কাউকে কাছে যেতে।” প্রায় সারারাত কবি ছাদে পায়চারি করে কাটিয়েছেন শোনা গেল। কবির পিতা মহর্ষিদেব তখন জীবিত। পুত্রের পত্নীবিয়োগের সংবাদে তিনি বলেন, ” রবির জন্য আমি চিন্তা করিনা, লেখাপড়া নিজের রচনা নিয়ে সে দিন কাটাতে পারবে। ছোট ছেলেমেয়েগুলির জন্যই দুঃখ হয়.”

পুত্র কন্যারা

মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়স, উনিশ বছর দাম্পত্য জীবন, পাঁচটি সন্তান, কবির ‘ভাই ছুটি’ চলে গেলেন। সেই সময় ঘনিষ্ট লোকজন বারম্বার কবিকে মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে তাঁর প্রিয় শ্লোকটি পুনরাবৃত্তি করতে শুনেছেন। ”সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি ব্যপ্রিয়ম।/ প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা”।
মৃত্যু সম্বন্ধে কবির লিপিবদ্ধ যে সব ধারণা উল্লেখ করেছি, তার উৎসে ছিলো ব্যক্তিজীবনে বারম্বার মৃত্যু দেবতার পদধ্বনি। মৃত্যুর হননঋতুকে কবি নীরব নিরাসক্তি দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। স্বকথিত ‘পরানের সাথে মরণখেলা’র ‘পুলক’ তাঁর শিল্পীসত্তায় ওতপ্রোত থেকেছে চিরকাল। তাঁর জীবনকালে ঘটে যাওয়া নানা ইতিবৃত্তে উপনিষদ-উক্ত আর্ষ লক্ষণের ইশারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। তারা হয়তো তাঁর উপলব্ধির আলোয় নব উপনিষদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালে তাঁর বড়ো মেয়ে বেলা ছিলেন রোগশয্যায়। থাকতেন তাঁর স্বামীগৃহ জোড়া গির্জার কাছে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়িতে। কবি তখন জোড়াসাঁকোয়। মেয়ে’কে দেখতে প্রতিদিন সকালে সেই বাড়ির দোতলায় যা’ন। একদিন বাড়িতে ঢুকেই বেরিয়ে এলেন। সহযাত্রী প্রশ্ন করলেন, কী হলো? তিনি বললেন, ”নাহ, আর দোতলায় উঠলাম না। সে আর নেই, আমি পৌঁছোবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।”

মাধুরীলতা

জোড়াসাঁকোয় ফিরে কিছুক্ষণ তিনতলার ঘরে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, ”কিছুই তো করতে পারতুম না। অনেকদিন ধরেই জানি ও চলে যাবে। তবু রোজ সকালে গিয়ে ওর হাতখানি ধরে বসে থাকতুম। ছেলেবেলায় যেমন বলতো বাবা গল্প বলো, অসুখের সময়ও অনেক সময় তাই বলতো। যা মনে আসে কিছু বলে যেতুম। আজ তাও শেষ হয়ে গেলো।” এতোটুকু বলেই শান্ত সমাহিত বিষাদমগ্ন কবি নিশ্চুপ বসে রইলেন।
সেদিন বিকেলে তাঁর নানা সামাজিক কাজ ছিলো । ঘনিষ্টজনেরা চাইলেন সে সব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিতে। কিন্তু কবি নিষেধ করলেন। বললেন, এরকম তো আগেও হয়েছে। তাঁর মেজো মেয়ে রানি’র চলে যাওয়ার গল্পটা জানতো কেউ কেউ। সেই সময়টাতে স্বদেশী আন্দোলন চলছিলো পুরো দমে। রানি খুব অসুস্থ। আলমোড়া থেকে কবি তাঁকে নিয়ে ফিরে এসেছেন। নিজের হাতে অক্লান্ত শুশ্রূষা করতেন। ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্র শোনাতেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মশায় রোজ সন্ধেবেলা আসেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে। যাবার সময় মেয়ের কুশলসংবাদ নিয়ে যান। সেদিনও যাবার সময় জানতে চাইলেন রানি কেমন আছেন? কবি শুধু বললেন, ”সে মারা গিয়েছে”। রামেন্দ্রসুন্দর কিছুক্ষণ কবির মুখের দিকে চেয়ে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।


(ক্রমশ)

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.