শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

দিনান্তবেলায় শেষের ফসল…

Somen Dey

পাহাড়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রেম তো সেই ছোটোবেলা থেকেই । তাই পাহাড় খুব টানতো তাঁকে। আর মংপু ছিল রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় পাহাড়ি জায়গা। সেখানে তাঁর স্নেহের মৈত্রেয়ীর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করছেন এইবার নিয়ে চতুর্থবার। ১৯৪০শের ৫ই মে তারিখে সেখানে একটি ছোটো উৎসবের আয়োজন করা হল। রবীন্দ্রনাথের আশি-তম জন্মদিনের অনুষ্ঠান। জন্মদিন দুদিন আগেই সেরে নেওয়ার কারন, দু’এক দিনের মধ্যেই রথীন্দ্রনাথ এসে নিয়ে যাবেন কবিকে। সেদিন সকালবেলা কবি স্নান করে একটি কালো রঙের কুর্তা পরে একটি বুদ্ধ মুর্তির সামনে এসে বসলেন। কবি ঈশোপনিষদ থেকে খানিকটা পাঠ করলেন। তারপর পাঠ করলেন বৌদ্ধ স্তোত্র থেকে খানিকটা। আর সেদিন দুপুরে তিনি লিখলেন তিনটি কবিতা। সেদিন বিকেল বেলায় একটা ঠেলায় চেপে তিনি যখন বাইরে বেরোলেন, তখন স্থানীয় পাহাড়িরা তাঁকে একে একে ফুল দিয়ে প্রণাম করল, কয়েকজন তিব্বতী তাঁর গলায় পরিয়ে দিল খর্দা গাছের সুতো দিয়ে বোনা একটি স্কার্ফ, যা তারা একমাত্র তিব্বতি লামাদেরই পরায়। এর পর কবিকে ঘিরে সবাই মিলে এক ধরণের স্থানীয় নাচ নাচল। তার পর সবাই মিলে কবিকে ঘিরে হৈ হৈ করে পাতা পেতে খাওয়া দাওয়া করল। এ’ভাবেই হল কবির আশি বছরের জন্মদিন পালন।

মংপু-র বাড়ি

কিন্তু এ দিকে একটা দুঃসংবাদ এসে পড়েছে মংপুতে সেদিনের একদিন আগেই। জন্মদিন পালন করা হবে বলে তাঁকে সে খবর দেওয়া হয়নি। পরের দিন তাঁকে সে খবর দেওয়া হল। তাঁর পুত্রবৎ ভাইপো সুরেন ঠাকুর মারা গেছেন। তাঁর সারাজীবন ধরে প্রিয়জনদের হারানোর শোকের যে স্রোত চলেছে তাতে আরো একটি সংযোজন। এই সময়টাতে এমনিতেই সারা পৃথিবীতে চলতে থাকা হানাহানির খবর পেয়ে তিনি খুব ব্যথিত ছিলেন। তাঁর খুব আদরের সুরেনের মৃত্যু তাতে আরো এক নতুন মাত্রা যোগ করল। আগের দিন ‘জন্মদিন’ বলে একটি কবিতা লিখেছিলেন। পরের দিন লিখলেন ‘মৃত্যু’ বলে আর একটি কবিতা। দু’দিন পরে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি চললেন কালিম্পং। যাবার সময় মৈত্রেয়ীকে বলে গেলেন জামা কাপড় অনেক কিছু রেখে যাচ্ছি, আবার সামনের সেপ্টেম্বর মাসে চলে আসব।

কালিম্পঙে রবীন্দ্রনাথের বাসস্থান গৌরীপুর লজ

কদিন পরে তিনি কালিম্পংয়ে বসে খবর পেলেন ইয়োরোপে তুমুল যুদ্ধ চলছে। জার্মানির নাৎসিরা হল্যান্ড আর বেলজিয়াম দখল করেছে, আক্রমণ করেছে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে দখল করতে চলেছে। এতটাই বিচলিত বোধ করলেন যে ওখান থেকেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি বড় তার করে বসলেন। আমেরিকা তখনো যুদ্ধে নিজেকে জড়ায় নি। তাই তিনি আবেদন করলেন যাতে আমেরিকা যুদ্ধ থামাবার ব্যাপারে একটা সদর্থক ভূমিকা নেয়। কিন্তু বলা বাহুল্য তাঁর আবেদনে কোনো ফল হয় নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

তবে এই অস্থিরতার মধ্যেও তিনি লিখে চলেছেন নানান রঙের কবিতা, প্রবন্ধ, গান। শান্তিনিকেতনে বসে শুরু করেছিলেন ‘সানাই’ কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলি। বাকি কবিতাগুলি লেখা সারলেন মংপু আর কালিম্পংয়ে বসে। একটা জিনিস লক্ষ করলে আশ্চর্য বোধ হয় এই সময় যেন তাঁকে পেয়ে বসেছে বহুকাল আগে ফেলে আসা তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনের স্মৃতি। এখান থেকে সানাইয়ের জন্যে লেখা বেশিরভাগ কবিতায় ছায়া ফেলেছে বৌঠাকুরাণী কাদম্বরী দেবী। আবার এখানে বসে লিখছেন ‘ছেলেবালা’র অনেকটা অংশ যাতে শুধুই ছোটোবেলার নির্ভেজাল ব্যাক্তিগত স্মৃতি । আশি বছর বয়সেও কী আশ্চর্য detailing সে সব লেখায়।
১৯৪০ এর ২৯শে জুন কালিম্পং থেকে ফিরে আসছেন কলকাতায়। ফিরেই সেদিনই সন্ধায় কলকাতায় একটি সভায় গেলেন। সেখানে এমন একটা বিষয়ে কথা বললেন যা নিয়ে কোনোদিনই সে রকম ভাবে এতকাল কিছু বলেন নি। বললেন, তাঁর নিজের গান গাওয়ার গায়নরীতি নিয়ে। যদিও খুব স্বল্প কথায়, তবুও যা বোঝাবার যেন বুঝিয়ে দিলেন এবং আগামী পৃথিবীর জন্যে রেখে গেলেন এক নির্দিষ্ট ইঙ্গিত। সেখানে খুব অল্প মানুষের একটি জমায়েতে তিনি বললেন – আমার গান যাতে আমার বলে মনে হয়, এইটে তোমরা কোরো। … স্টীম রোলার চালিয়ে তাকে চেপ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে দরদ থাকবেনা।
১লা জুলাই, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন সুভাষ চন্দ্র বোস । কিছুদিন আগে সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে বাংলাদেশে একটি ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস দল ত্যাগ করার পর রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা একটি পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল, যা পড়ে মনে হয়েছিল এ লেখায় নাম না থাকলেও, সুভাষচন্দ্রের দল ত্যাগ নিয়েই কবি যেন একটু তিরস্কার করেছেন।

সুভাষচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ

সেদিন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে এই সাক্ষাতের পর রবীন্দ্রনাথ একটি বিবৃতি দিয়ে বুঝিয়ে দেন সুভাষচন্দ্রের উপর তাঁর পুর্ণ আস্থা আছে । তিনি বিশ্বাস করেন সুভাষের দেশ সেবা সার্থক হবে।
কিছুদিন পর সানাই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হল। এর সব কবিতাই ঊনআশি থেকে আশি বছর বয়সের লেখা। এর মধ্যে অনেকগুলি গানও আছে যে গুলি পরবর্তীকালে বাঙালির কাছে প্রেমের চিরকালীন আইকনিক গান হয়ে গেছে। যেমন – ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে’,’যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’, ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’, ‘এসেছিলে তবু আস নাই’। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, এই সময়েতেই লিখেছেন – ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা/ মনে মনে’, যা কিনা একেবারে চিরন্তন শিশুমানসের এক অপূর্ব প্রতিফলন।
কলকাতায় ক’দিন চরম ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেই ঢুকে পড়লেন প্রবল ব্যস্ততার মাঝে। সেখানে অক্সফোর্ড থেকে একটি দল এসে পড়ল কবিকে ‘ডক্টরেট অফ লিটারেচর’ উপাধি দেওয়ার জন্য। ৭ই আগস্ট। কী আশ্চর্য, সেদিন বাংলা তারিখ ছিল বাইশে শ্রাবণ। আর সেদিনও খুব বৃষ্টি হয়েছিল।

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস গ্যয়ের, ১৯৪০ সালে বিশ্বভারতীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে

এদিকে কবির শরীর ক্রমশ ভেঙে আসছে। লিখতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনই প্রচুর দর্শনার্থী আসেন কবিকে দর্শন করতে। কাউকেও ফিরিয়ে দিতে পারেন না। আর লিখতেও হচ্ছে কিছু কিছু।
তখন বাংলাদেশে এটা প্রায় দস্তুর হয়ে গিয়েছিল, যে যা কিছু বিষয়েই বই লিখে ফেলে, তার একটা কপি কবির কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁর লিখিত মতামত চাওয়া। কবি কাউকেই বিমুখ করতে পারেন না। তাই সব বই পড়তে হয়, লিখতেও হয় কিছু মতামত।
এরকম সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় লেখার জন্যে একটি অনুরোধ এলো, অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দিয়ে ।
রবীন্দ্রনাথ যে গল্পটি লিখলেন সেটির নাম ‘ল্যাবেরটরি’। গল্পটি শেষ হলে শান্তিনিকেতনে অনেককে ডেকে পড়ে শোনালেন। কিন্তু এই গল্পটির আধুনিকতায় শ্রোতারা এতটাই হতচকিত হলেন তাঁরা কেউ পরিষ্কার মতামত দিতে পারেন নি।
কিছুদিন শান্তিনিকেতনে থাকার পর আবার তাঁর মন টিঁকছিল না। সেই চিরকালের ‘অন্য কোনোখানে’ যাবার তাগিদ আবার পেয়ে বসল। আসলে মংপুতে থেকে আসার সময় তাঁর গরম জামা সব রেখে এসেছিলেন সেখানে। বলে গিয়েছিলেন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আবার ফিরে আসবেন মংপুতে।

নীলরতন সরকার ও বিধান চন্দ্র রায়

কিন্তু ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় এবং ডাক্তার নীলরতন সরকার দুজনেই বললেন এ’ অবস্থায় তাঁর পাহাড়ে যাওয়াটা উচিত হবেনা । কিন্তু কবি তো চিরকালই যেখানে যখন ইচ্ছে মনের টানেই ছুটে বেড়িয়েছেন। কোনো বারণ শোনেন নি। ১৯ই সেপ্টেম্বর সুধাকান্তকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েই পড়লেন। তবে মংপুতে যেহেতু ভাল ডাক্তার নেই, তিনি প্রথমে গেলেন কালিম্পংয়ে। তখন প্রতিমা দেবী সেখানে থাকেন।
কালিম্পংয়ে কয়েকদিন থাকার পরই, ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি অসুস্থই হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে মংপু থেকে মৈত্রেয়ী দেবী এসে পড়লেন। কালিম্পংয়ে তখন ভাল ডাক্তার খুব কম। অনেক চেষ্টা করে এক সাহেব সার্জনকে ধরে আনা গেল। তিনি দেখেই বললেন এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। এদিকে তখন কালিম্পংয়ের বাড়িতে তখন শুধু দুজন মহিলা, প্রতিমা দেবী আর মৈত্রেয়ী দেবী। ওঁরা খুব সঙ্কটে পড়লেন। কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। সেদিন ওখানে প্রচুর ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। পোস্টঅফিসে গিয়ে অনেক চেষ্টা করে কলকাতায় টেলিফোন করে খবর পাঠান গেল। পরের দিন প্রশান্ত মহালানবীশ গাড়িতে করে দুজন ডাক্তার নিয়ে আর কবি কন্যা মীরাদেবীকে নিয়ে এসে হাজির হলেন কালিম্পংয়ে। দুই ডাক্তারের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা সুস্থ করা গেল এবং খুব সাবধানে কলকাতায় নিয়ে আসা গেল। ২৯ শে সেপ্টেম্বর কবি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলেন। তবে কানে ভাল করে শুনতে পারেন না, চোখের দৃষ্টিও কমে গেছে। লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু তারই মধ্যে ‘রোগশয্যায়’ কাব্যগ্রন্থের দশটি কবিতা লিখে ফেললেন। ১৮ই নভেম্বর শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন। শরীর আগের মত আর হয়ে উঠল না। তবু যেদিন একটু ভাল থাকেন কিছু লিখে ফেলেন। আর এই সময় যা লিখতেন তা সযত্নে সংগ্রহ করে রাখতেন সুধীর চন্দ্র কর নামের এক ব্যাক্তি। যাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাট্টা করে ‘বাঙাল’ বলে ডাকতেন।
এই সময়েই লিখে ফেলেছেন ‘গল্পসল্প’ এর লেখাগুলি। ‘জন্মদিনে’ আর ‘আরোগ্য’র অনেকগুলি লেখা। কয়েকটা ছোটোগল্পের খসড়াও করে ফেললেন । দেখতে দেখতে শীত পেরিয়ে বসন্ত এসে পড়ল। শৈলজানন্দ মজুমদার আর শান্তিদেব ঘোষকে নির্দেশ দিলেন কিভাবে পালন করা হবে সেবারের বসন্তোৎসব। ‘নটির পূজা’ অভিনীত হল, কিন্তু কবি যেতে পারলেন না। বাড়িতে বসে লিখলেন –
“আর বার ফিরে এল উৎসবের দিন।
বসন্তের অজস্র সম্মান…
রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি –
এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।“
এর মধ্যে প্রহাসিনী কাব্যগ্রন্থের জন্য কিছু হালকা কবিতাও লিখে ফেলেছেন । যার মধ্যে একটি কবিতায় হালকা রসের মধ্যেই ছায়া ফেলছে মৃত্যুচিন্তা ।
“বিশ্ব থেকে ধার নিয়েছি তাই আমরা কবি
সত্য রূপে ফুটিয়ে তুলি অবাস্তবের ছবি।
ছন্দ ভাষা বাস্তব নয়, মিল যে অবাস্তব –
নাই তাহাতে হাট-বাজারের গদ্য কলরব।
হাঁ-য়ে না-য়ে যুগল নৃত্য কবির রঙ্গভুমে।
এতক্ষণ তো জাগায়ে ছিলাম এখন চলি ঘুমে।”

শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (১৯৪০)

দেখতে দেখতে নববর্ষ চলে এলো। প্রত্যেক বছরই নববর্ষের দিন কিছু গান রচনা করে দিতেন। এ বছরও যথারীতি অনুরোধ এল, নতুন গান রচনা করে দেবার জন্য। এ বছর কবি খুব ক্লান্ত বোধ করছেন। প্রথমে নাই করে দিয়েছিলেন। তারপর জানালেন – সৌম্য (ঠাকুর) আমাকে বলেছে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি, মানুষের জয়গান গাইনি। তাই মানুষের জয়গান গেয়ে একটা গান লিখে দিচ্ছি। ‘ঐ মহামানব আসে’ কবিতাটি লিখলেন। কিন্তু কবিতাটি যেহেতু একটু বড় হয়ে গেল, তাই সেটাকে খানিকটা সংক্ষিপ্ত করে একটা গান তৈরি করে দিলেন। কয়েকদিন পরেই এসে গেল পঁচিশে বৈশাখ। কবি অসুস্থ বলে খুব অনাড়ম্বর ভাবে সে বছর জন্মদিন পালন করা হল। কিন্তু তারই মধ্যে পূরবী কাব্যগ্রন্থ থেকে’পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটিকে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে একটি গান রচনা করে শান্তিদেব ঘোষকে ডেকে তুলিয়ে দিলেন। ১৯৪১ সালের পঁচিশে বৈশাখে সেই গানটি গাওয়া হল, এবং সারা পৃথিবীতে যখনই কোথাও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হবে, সেই গানটি গেয়েই তা করতে হবে।
‘হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’।
কয়েকদিন পর বুদ্ধদেব বসু এলেন শান্তিনিকেতনে। কবি তখন অসুস্থ। বুদ্ধদেব বসু ভেবেছিলেন, এবার হয়ত আগের মত আর কবির নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করা হবে না। তা ছাড়া কেমন দেখবেন কবিকে, সে বিষয়েও সংশয় ছিল। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু লিখছেন – ‘মুখ তার শীর্ণ। আগুণের মত গায়ের রঙ ফিকে হয়েছে, কিন্তু হাতের মুঠি কি কব্জির দিকে তাকালে বিরাট বলিষ্ঠ দেহের আভাস এখনো পাওয়া যায়। কেশরের মত যে কেশগুচ্ছ তাঁর ঘাড় বেয়ে নামত তা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু মাথার মাঝখান দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত কুঞ্চিত শুভ্র দীর্ঘ কেশের সৌন্দর্য এখনো অম্লান। … এই অপরূপ রূপবান পুরুষের দিকে এখন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়, যেমন করে আমরা শিল্পীর গড়া কোনো মুর্তি দেখি । এত সুন্দর রবীন্দ্রনাথও আগে কখনো ছিলেন না…’ ।

রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসু


বুদ্ধদেব বসুর এই বর্ণনা পড়লে হয়ত মনে হতে পারে এটি একটি আবেগমথিত বর্ণনা। কিন্তু কিছুদিন আগেই কবি যখন কালিম্পঙয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন এক সাহেব সার্জেন কবিকে দেখতে এসেছিলেন, যিনি কবি সম্মন্ধে কিছুই জানতেন না, এবং সেই দুর্যোগের রাত্রে তাঁর ব্যাবহারে বেশ বিশ্রী রকমের রূঢ়তা ছিল। এই ইংরেজটিও যখন অচেতন কবিকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর বস্ত্র অপসারণ করেছিলেন, তখন আশি বছরের কবির শরীর দেখে চমকে উঠে বলেছিলেন – what a beautiful body । এ কথা আমরা মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা থেকে জানতে পারি।
প্রথম দিন কবির সঙ্গে কথা নাহলেও, পরের দিন বুদ্ধদেব বসুর দেখা হল কবির সঙ্গে। কথাও হল অনেক। সেই কথাবার্তার পর বুদ্ধদেব বসু লিখলেন – ‘সেদিন এক ঘন্টার উপরে প্রায় অনর্গল কথা বললেন, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা জীবনদর্শন হাস্যপরিহাস মেশানো এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ঝরনায় নেয়ে উঠলাম। এঁর অসুখ ভাবা যায় না।‘
এর পর থেকে যত দিন যায় ততই কবির শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। কিন্তু তবু সুযোগ পেলেই কিছু লেখেন। নিজে হাতে না পারলে তিনি বলেন, লিখে নেন প্রতিমা দেবী বা অন্য কেউ। এই অসুস্থ শরীরেও কবির প্রিয় বর্ষা ঋতু তার নিয়ম মেনেই এসে পড়েছে শান্তিনিকেতনে। আর বর্ষা এসে গেছে আর তিনি তার রূপ দেখতে পারছেন না তাই বা কেমন করে হয়। এই সময় তাঁকে নিয়ে আসা হল উত্তরায়ণ বাড়ির দোতলায়, যেখান থেকে আকাশ দেখা যায়। সেখান থেকে জানলা দিয়ে রোজ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একদিন দূর থেকে সাঁওতাল মেয়েদের মহুয়া ফল কোড়ানো দেখে বললেন রথীকে বলব আরো কিছু মহুয়া গাছ লাগিয়ে দিতে। যখন ফল পাকবে ওরা কুড়িয়ে খাবে।

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ

আর একদিন বললেন উদীচীর বকুল গাছে ফুল ফুটেছে, আমি কি কোনোদিনই আর দেখতে পাবো না?
এদিকে কোনো ওষুধেই তেমন কিছু কাজ হচ্ছেনা। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় কবিরাজী ওষুধ চেষ্টা করা হল। কিন্তু কিছুতেই কোনো ফল পাওয়া গেলনা। কলকাতা থেকে প্রশান্তচন্দ্র ও রাণী মহালনবিশ এসে পড়লেন। ওঁরাই ব্যবস্থা করে নিয়ে এলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, ইন্দুভূষণ বসু, ললিত কুমার বন্দোপাধ্যায় আর জ্যোতিঃপ্রকাশ সরকার। সবাই মিলে ঠিক করলেন, অপারেশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ঠিক হল, ২৫ শে জুলাই কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।
অথচ অপারেশনে কবির প্রবল আপত্তি। তিনি বললেন – আজকাল সায়েন্স বের হয়ে মুশকিল হয়েছে, আগের কালে রোগীর কী হত? তারা তো কথায় কথায় রোগীকে ছিন্নভিন্ন করত না। একবার হোমিয়োপ্যাথি বা কবিরাজি করিয়ে দেখলে হত। আমি রোগকে ভয় করিনে, ভয় করি চিকিৎসাকে।
কিন্তু চিকিৎসকরা বুঝে গিয়েছিলেন,কবির রোগ এখন আর হোমিওপ্যাথি-কবিরাজী চিকিৎসার আওতায় নেই।
দেখতে দেখতে চলে এল ২৫শে জুলাই।
সকাল থেকেই উত্তরায়নের চারিদিকে আশ্রমিকরা, ছাত্ররা, অধ্যাপকরা দাঁড়িয়ে আছেন। সকাল সাড়ে সাতটায় একটা বিশেষ ধরণের স্ট্রেচারে করে তাঁকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনা হল উত্তরায়ন থেকে। কবি একবার তাকিয়ে দেখলেন চারিদিকে। সেই আম্রকুঞ্জ, সেই শালবীথি, সেই গৌড় প্রাঙ্গণ, তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর সাধের শান্তিনিকেতন।

শান্তিনিকেতন থেকে শেষযাত্রা

আস্তে আস্তে করে গাড়ি বেরিয়ে গেল শান্তিনিকেতন থেকে। স্টেশনে একটি বিশেষ স্যালনের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল কবিকে নিয়ে যাবার জন্যে। রথীন্দ্রনাথ আগের দিনে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে স্টেশন থেকে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করতে। ব্যাপারটা প্রেস থেকে গোপন রাখা হয়েছিল বলে স্টেশনে বিশেষ ভিড় হয় নি। তাঁকে নির্বিঘ্নে নিয়ে যাওয়া হল, তাঁর জন্মের প্রথম শুভক্ষণ যে বাড়িটি দেখেছিল সেই জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে।
সেখানে পৌঁছে ডাক্তারদের তত্বাবধানে পুরোদমে চিকিৎসা চলতে লাগল। এখানে এসে পৌঁছানোর দু দিন পরে কাঁপা হাতে লিখলেন একটি কবিতা –
প্রথমদিনের সূর্য্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে-
কে তুমি।
মেলেনি উত্তর
বৎসর বৎসর চলে গেল
দিবসে শেষ সূর্য্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধায় –
কে তুমি
পেল না উত্তর।
তিরিশে জুলাই অপারেশনের দিন ঠিক হয়েছে। ২৬ থেকে ২৯ জুলাই তারিখ অবধি মোটামুটি একই রকম শরীরের অবস্থা থাকল। সকালের দিকে একটু ভাল থাকেন। ভাল থাকলেই তিনি দুনিয়ার খবরাখবর নেন। বিশেষ করে যুদ্ধের খবর। দুপুরের দিক থেকে একটু করে জ্বর আসে, কাঁপুনি দেয়। আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
২৯ তারিখ সকালে ডাক্তার জ্যোতিপ্রকাশ তাঁকে দেখতে এসেছেন। জ্যোতিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের অনেক দিনের চেনা। খুব স্নেহভাজনও বটেন। তাঁকে কবি জিজ্ঞাসা করলেন আচ্ছা, তোমাদের ঐ অপারেশন করার সময় কি খুব যন্ত্রণা হবে?
ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন – একেবারেই না। আমরা তো লোক্যাল এনেস্থেসিয়া করে দেব। আপনার জ্ঞান থাকলেও একটা স্ক্রিন দিয়ে আড়াল করা থাকবে তাই আপনি বুঝতেই পারবেন না, এই নিষ্ঠুর সার্জনগুলো ছুরি কাঁচি নিয়ে কী করছে। আমরা আশ্চর্য হব না, যদি দেখি আপনি অপারেশন চলতে চলতেই একটা কবিতা লিখে ফেলেন।
শুনে কবি মৃদু হেসে বললেন –বেশ, এই অপারেশনের কষ্ট যদি একটা কবিতা লেখার কষ্টের চেয়ে কম হয়, তা হলে আমি তৈরি আছি।
জ্যোতিপ্রকাশ আরও বলে ছিলেন আসলে আমরা একটু বেশি সাবধানতা নিচ্ছি, কারন সাবধানের মার নেই। কবি আবার হেসে বললেন – মারেরও কিন্তু সাবধান নেই।
সেদিন সন্ধেবেলায় রাণী চন্দকে ডেকে মুখে মুখে বললেন একটি কবিতা । সে কবিতা রাণী লিখেনিলেন – দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে এসেছে আমার দ্বারে…

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি

পরের দিন, ৩০শে জুলাই, ভোর বেলা থেকে লালবাড়ির বারান্দায় তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে, সেখানে তৈরি করা হয়ে গেছে একটা ছোটখাটো অপারেশন থিয়েটার। কবি তখনো জানেন না , কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ সেইদিন সকালেও একটি কবিতা ডিক্টেশন দিয়ে ফেললেন – ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ন করি / বিচিত্র ছলনা জালে’।
এ কবিতাটি লিখে নাকি পরে আবার চেয়েছিলেন কিছুটা সংশোধন করে দিতে। কিন্তু সে সুযোগ আর ঘটেনি।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সার্জন ডাক্তার এল এম ব্যানার্জি এসে কবিকে বললেন, আজ সব কিছুই ভাল আছে, অপারেশনটা যদি আজকেই করে দিই।
কবি বললেন, বেশ আমি তৈরি ।
অপারেশন হয়ে গেল। ডাক্তাররা জানালেন অপারেশন ভাল হয়েছে, উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সন্ধেবেলায় কবির জ্ঞান এল । ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, খুব বেশি কি যন্ত্রণা হয়েছিল আপনার?
কবি মৃদু হেসে বললেন – কেন আর আমাকে দিয়ে মিথ্যে কথা বলাতে চাও!
এর পরের দিনগুলো, একবার একটু ভাল আবার একটু খারাপ, এ ভাবেই কাটল। সারা দেশের লোক রোজ অপেক্ষা করে থাকে মেডিক্যাল বুলেটিনের জন্যে। সকলে আশা করে হয়ত কাল একটু ভাল হয়ে উঠবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না।

রবীন্দ্রনাথের-শেষযাত্রা

সাতই আগস্ট দুপুর বারোটা দশ মিনিটের সময় সেই সতত সৃষ্টিশীল মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। বাঙালির রবি অস্তমিত হল।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.