শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

চিরন্তন সত্যজিৎ

Somen Dey

বৈশাখ যেন একটা উগ্রপন্থী স্বভাবের মাস। বসন্ত ঋতুর যা কিছু পেলব কোমল হাবভাব চৈত্রশেষে অবশিষ্ট ছিল, তাকে যেন এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে একেবারে মিলিটারি মেজাজে বৈশাখের আবির্ভাব। সুর্য্য হঠাৎ খেপে লাল, বাতাস সহসা আগুন পারা। তার মধ্যে আবার মাঝে মাঝে আকাশ দেখায় ঝড়বাদলের চোখরাঙানি। এই মাস ঠিক শান্তির নয়, স্বস্তির নয়।

তবুও এই বৈশাখের কাছে বাঙালিকে আগামী বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ঋণী হয়ে থাকতেই হবে। কারণ এই বৈশাখ বাঙালিকে দিয়েছে দু-দুটি বঙ্গজ জিনিয়াস। জিনিয়াস শব্দটি মানুষ না বুঝে শুনে বড় বেশি অপপ্রয়োগ করে থাকে। পৃথিবীতে প্রতিভাবানের কমতি নেই, কিন্তু জিনিয়াস হাতে গোনা যায়। জিনিয়াস শব্দের আমরা যে আধুনিক কালের সংজ্ঞাটি পাচ্ছি তাতে বলা হচ্ছে তিনিই জিনিয়াস যিনি হবেন একটি বা দু’টি বিষয়ে প্রশ্নাতীতভাবে পারদর্শী এবং সেই সঙ্গে একাধিক বিষয়ে গবেষকের মত কৌতূহলী। সত্যজিৎ রায় যে ঠিক তাই ছিলেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বিশ্ব তাঁকে শুধু একজন চিত্র-পরিচালক বলে চেনে। কিন্তু চলচ্চিত্রের সব কটা বিভাগে তো বটেই, তার বাইরে শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তাঁর কাজের যে বিশাল ব্যাপ্তি ছড়িয়ে আছে, তা পাশ্চাত্যের কাছে তেমন ভাবে পৌঁছায়নি। যদি সঠিকভাবে পৌঁছত, তাহলে হয়ত ফরবেসের জিনিয়াসদের তালিকাতে, যাতে আছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, গ্যেটে, বিঠোফেন , নীৎসে, এডিশন, ভ্যান গগের মত মানুষেরা সেই তালিকাতে তাঁকেও জায়গা দিতেন ।

তবে সেই তালিকাতে তিনি থাকুন বা না থাকুন, আমরা বাঙালিরা জানি, তিনি শুধু আমাদের কয়েকটি ক্ল্যাসিক ছায়াছবিই উপহার দিয়ে গেছেন তা নয়, তিনি বৈশাখ মাসের অবদান আর এক জিনিয়াস রবীন্দ্রনাথের মতই আমাদের বাংলা সংস্কৃতির অনেকানেক ধারাতেই চিরকালীন আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

প্রথমে ধরা যাক শিল্পকলার ক্ষেত্রটিকে। সকলেই জানি, তিনি শান্তিনিকেতনে কলাভবনে যান ছবি আঁকা শিখতে। সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন নন্দলাল বসু, যামিনী রায় এবং বিনোদ বিহারীকে। তবুও সেখানকার পাঠ্যক্রম অসমাপ্ত রেখে চলে আসেন বিশ্বভারতী থেকে। ফিরে এসে তিনি বেছে নেন কমার্শিয়াল আর্টের জগৎকে। সে সময় যাঁরা বড় শিল্পী হবার স্বপ্ন নিয়ে আর্ট শিখতে আসতেন, তাঁরা সাধারণত কেউ কমার্শিয়াল আর্ট বেছে নিতেন না। যাদের শিল্পের সাধনার চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্থিত হওয়ার ইচ্ছে থাকত, তারাই কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে যেত। হয়ত এর কারণ, যে সময়ে তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন, সে সময় তাঁর কাছে অর্থ উপার্জনের একটা দায় প্রবলভাবে ছিল। আসলে সত্যিকারের বড় প্রতিভার জন্যে কোনো কিছুই বাধা হয় না। তাঁরা যেখান থেকে যতটুকু ভাল তা আত্মস্থ করে নিতে পারেন। সত্যজিতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। নন্দলাল বোস, যামিনী রায় এবং বিনোদবিহারী তাঁর ভিতরে থাকা স্বকীয়তাকে একটা পথ দেখিয়ে ছিল।

তিনি যে সময়ে কমার্শিয়াল আর্ট শিখে বিজ্ঞাপনের জগতে এসেছিলেন, তখন ঐ জগৎটা ছিল ইংরেজ সাহেবদের দখলে। সেখানে কোনো ভারতীয়ত্ব ছিল না। এ দেশে visual communication এর কোনো দেশজ জমি ছিল না।

অন্যদিকে অভিজাত বাঙালিরা তখন বিজ্ঞাপন-শিল্পকে দেশলাই বাক্সের লেভেল ভেবে নাক সিঁটকোতো। কিন্তু সেইরকম একটা সময়ে, মোটামুটি ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের জগতে থেকে যে কাজের নমুনা তিনি রেখে গেছেন তাতে ভারতীয় বিজ্ঞাপন শিল্পকে নিঃসন্দেহে তিনি একটি নতুন দিগন্ত দিয়েছিলেন।

তাঁর গ্রাফিক্সের মধ্যে যে কোনো কলাভবনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, এমনটা নয়। তবে সত্যজিৎ মূলত একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী ছিলেন । হয়ত ঠাকুর্দা এবং বাবার সৃজনশীলতার প্রভাব তাঁর রক্তে ছিল । তবে আলাদা করে নন্দলাল বোসের সহজপাঠের ইলাস্ট্রেশনের স্টাইল সত্যজিতের প্রথম দিকের কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু পরে তা তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে ওঠে।

সিগনেট প্রেসে কাজ করার সময় সত্যজিৎ যে সব প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সেগুলি আজ অবধি বাংলা বইয়ের জগতে সেরা কাজগুলির মধ্যে জায়গা দখল করে আছে । সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’ , জীবনানন্দের ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ , জিম কর্বেটের ‘কুমায়ুনের মানুষ খেকো বাঘ’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ‘ বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেঁপু’, এই সব প্রচ্ছদে চেনা গেল কয়েকটি সাধারণ রেখা এবং রঙের আঁচড়ে কি ভাবে অনির্বচনীয় কিছু সৃষ্টি করা যায়। পরবর্তী কালে তাঁর নিজের গল্পের ইলাশস্ট্রেশনে তিনি যে অসাধারণত্বের ছাপ রেখেছেন, তার সমকক্ষ কোন কাজ আজ অবধি আমরা দেখতে পাইনি। তাঁর করা পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ, ইলাশস্ট্রেশন, ক্যালিগ্রাফি, বিজ্ঞাপনের নক্সা, নিজের ছবির জন্য পোস্টার, টাইটেল কার্ড, লোগো এই সবের মধ্যে ছিল তাঁর অনন্য নিজস্বতার ছাপ, যা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের ।

এর পরে আসি তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টির জগতে। প্রথম দিকের ছবি ক’টিতে তিনি নির্ভর করেছিলেন অন্যান্য সুরকারদের উপর, যাঁরা মূলত মার্গসঙ্গীত জগতের মানুষ। যদিও সেখানেও সিনেমার ভাষার সঙ্গে আবহসঙ্গীতের যে অসামান্য সাযুজ্য দেখা গিয়েছিল, সেখানে তাঁর সুরকারদের সঙ্গে সত্যজিতের নিজস্ব সাঙ্গীতিক মেধার ছাপ ছিল।

১৯৬১ সালে ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে এবং ‘তিনকন্যা’ চলচ্চিত্রে তিনি সম্পূর্নভাবে নিজে সঙ্গীতের দায়িত্ব নিয়ে নেন। তারপর তিনকন্যা থেকে আগন্তুক, প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনি তাঁর নিজের চলচ্চিত্রে এবং দু একটি অন্য পরিচালকের চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। পিতৃকুল এবং মাতৃকুল দুই দিক থেকে একটি সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। তাতে জমিটা হয়ত তৈরি ছিল, কিন্তু তিনি আবহসঙ্গীতের ক্ষেত্রে যে ভাবে পূর্ব ও পাশ্চাত্যের মিলন ঘটিয়েছিলেন, তাতে বোঝা গেছে, এ দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতেও তিনি একজন উঁচুদরের কম্পোজার ছিলেন। প্রায় কৈশোরকাল থেকে তাঁর পাশ্চাত্যের মার্গ সঙ্গীতের প্রতি একটা গভীর অনুরাগ গড়ে উঠেছিল। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্টাফ নোটেশনের বই পড়ে তিনি ক্লাসিসিস্ট কম্পোজারদের বোঝবার চেষ্টা করতেন নিজে নিজেই। তাঁর ছবির আবহ সঙ্গীতে মূলত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কাঠামোটিকে ব্যবহার করেছেন । কিন্তু সেই সঙ্গে ভেঙে ভেঙে রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকগান, কীর্তন, রামপ্রসাদী সুর প্রয়োগ করেছেন খুব সুচারুভাবে।

সত্যজিতের বেশির ভাগ ছবিতেই গান নেই। থাকলেও সম্পূর্ণভাবে নেই, টুকরো ভাবে আছে । অপু ট্রিলজিতে গান নেই। পরশপাথরে একটি পুরাতনী গানের অংশ বিশেষ এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি অংশ প্রয়োগ করেছেন। মণিহারাতেও তাই। পোস্টমাস্টার এবং দেবীতেও গানের খণ্ডাংশ ব্যবহার করেছেন। চারুলতাতে কিশোরকুমারের কণ্ঠ ব্যাবহার করা হলেও সেখানেও রবীন্দ্রনাথের গান মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েছেন তিনি । জলসাঘর গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে যেহেতু গান আছে সেই হেতু এখানে রাগাশ্রয়ী, মজলিশি গান টুকরো টুকরোভাবে স্মৃতির বাহন হয়ে এসেছে। বেগম আখতারের কণ্ঠের ব্যাবহার করেছেন তিনি। মাঝে মাঝে তাঁর ছবিতে লাবণ্যময় সাঙ্গীতিক শব্দের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন নগর জীবনের টুকরো টুকরো শব্দও। তা থেকে এমন এক একটি মুড তৈরি করেছেন, যা শত সংলাপ দিয়েও করা যেত না।

পরবর্তী সময়ে দুটি পুরোপুরি মিউজিক্যাল ছবি করেছেন। প্রথমে ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবিতে এবং পরে ‘হীরকরাজার দেশে’ ছবিতে সত্যজিৎ যে ভাবে গল্পের সঙ্গে গানকে বুনে দিয়েছেন এবং গানের সুরে হিন্দুস্থানি এবং কর্নাটকী রাগ সঙ্গীতের নির্যাসকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন, তার কোন তুলনা ভারতের সিনেমা জগতে নেই।

সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি কয়েক সেকেন্ডের মিউজিক্যাল পিসের মধ্যে এমন একটা নিজস্ব স্টাইলের ছাপ থেকেছে, যা থেকে একটু শুনলেই বোঝা যায় যে এই সুর সত্যজিতের রচনা। তাঁর আগে ভারতীয় চলচ্চিত্রে আবহসঙ্গীতের ব্যবহারের যে ধারণাটি ছিল, উনি প্রায় তাকে আমূল বদলে দেন। অর্থাৎ এখানেও তিনি পথ প্রদর্শক ।

আমরা জানি, রায়চৌধুরী পরিবার বাংলার শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডারকে অকৃপণ দানে ভরিয়ে দিয়েছেন। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার, পূণ্যলতা চক্রবর্তী, এঁরা সকলেই শিশুদের জন্যে অনন্য সব গল্প লিখেছেন। অতএব সত্যজিৎ সেই ঐতিহ্য বহন করবেন, এটা খুব আশ্চর্যের নয়। কিন্তু সত্যজিৎ ঠিক হুবহু এঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন না। সত্যজিৎ কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর বা সুখলতা রাও, লীলা মজুমদারের মত ‘স্কুল স্টোরি’ লিখলেন না। তাঁর গল্পে কোন উপদেশ দিলেন না। কিন্তু গল্পের মধ্যে দিয়ে খুব সুক্ষভাবে বলে দিলেন কিছু মানবিক সম্পর্কের কথা, কর্তব্যের কথা, আচরনের কথা। কিন্তু সে সব গল্পের এমনই জোর যে শুধু গল্পের টানেই তা যে কোনো বয়সের পাঠককে টেনে রাখতে পারে ।

তাঁর গদ্যশৈলী একেবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর গল্প সব সময় ফেনাহীন, নির্ভার, সোজাসুজি, কিন্তু অমোঘ তার অভিঘাত। একই কৌতুকে যেমন ছোটরা মজা পায়, তেমনি বড়দের কাছে তা একটু অন্যরকমভাবে উপভোগ্য। ফেলুদা , তোপসে, জটায়ু, প্রফেসর শঙ্কু , তারিণী খুড়োর গল্প আট থেকে আশি সব বয়সের পাঠকের কাছে সমান আকর্ষনীয়। বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যের মান খুব উচ্চ এবং উঁচু দরের কথাসাহিত্যিকের সংখ্যাও প্রচুর। কিন্তু তাও বলতে হয় যে সব বয়সের পাঠককে যেমন করে সত্যজিতের লেখা এক আশ্চর্য কৌশলে নিবিষ্ট করে রাখতে পারে, তার তুলনা আর নেই। তাঁর গল্পে অ্যাডভেঞ্চার আছে, রহস্য আছে, বন্ধুত্ব আছে, কল্পবিজ্ঞান আছে, ভূত আছে, অলৌকিকতা আছে, খলতা আছে, ভয় আছে, কৌতুক আছে। কিন্তু খুব নিরুচ্চারভাবে একটি মানবিকতার ফল্গুধারা আছে। বাংলা কথাসাহিত্যে সত্যজিতের বিচিত্র সৃষ্টির ধারাটি হয়ত চিরকাল অননুকরণীয়ই থেকে যাবে ।

এবার আসি তাঁর শ্রেষ্ঠ দান চলচ্চিত্রের কথায়। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের আগমন তো হয়েছে মাত্র এক শতাব্দী আগে। সেদিক দিয়ে চলচ্চিত্র নবীনতম আর্ট ফর্ম। এই চলচ্চিত্র যে একটা শিল্প হয়ে উঠতে পারে, এটা বুঝতে আমাদের দেশে অনেকটা সময় লেগে গেছে। চলচ্চিত্র এমন একটা মাধ্যম, যে মাধ্যম দিয়ে কোন বস্তুকে বিরাটভাবে দেখানো যেতে পারে । শুধু আয়তনে নয়, শব্দ এবং গতি দিয়েও অনেক কিছু বোঝানো যেতে পারে। একটা মুভি ক্যামেরা যে ভাবে অনেক কিছুকে অনেকটা তলিয়ে দেখাতে পারে সে রকমটা আর কোন মাধ্যম পারে না। আর কোন শিল্প মাধ্যমের এই ক্ষমতা নেই। কিন্তু শুধু এই ক্ষমতা থাকলেই তো চলচ্চিত্র শিল্প হয়ে উঠতে পারেনা।তার জন্যে চাই সিনেমার পরিচালকের পারদর্শিতা এবং প্রতিভা ।

দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের দেশে চলচ্চিত্রও আগের চেয়ে কিছুটা স্বাধীন হল। পৌরাণিক গল্প থেকে সামাজিক গল্প বেশি করে দেখা যেতে লাগল। প্রযুক্তিগতভাবে নানা উন্নতি হল। তবে চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠল বিনোদন। নাচ গানের মোড়কে মূলত একটি গল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ দর্শকের ইচ্ছাপূরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, এটাই ছিল মূলধারার ভারতীয় সিনেমার প্রবণতা । চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা গল্প-বলিয়ে বা কথক ঠাকুরের। সত্যজিতের আগে কোন ভালো ছবি এ দেশে হয়নি এমনটা বললে ঠিক বলা হবে না। কিন্তু এটা বলা যায় যে, কোনো ছবি শিল্পের পর্যায়ে উঠে আসেনি। যা ‘পথের পাঁচালি’ করে দেখাল।

পথের পাঁচালীতে এমন কোনো অভাবনীয় নিসর্গ দৃশ্য নেই যা ভারতীয় দর্শকরা আগে দেখেনি। খুব অনাড়ম্বর, প্রতিদিনের গ্রাম্য জীবনের কিছু ছবিই তো তিনি দেখালেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, দরিদ্র পরিবারের একটি বোন তেঁতুল চুরি করে এনে তেল দিয়ে মেখে তার ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছে, তখন দৃশ্যটি এমন ভাবে বিন্যস্ত হল যেন দর্শকরা সেই তেঁতুলের স্বাদ পেলেন। টেলিগ্রাফের থামে দুর্গার কান দিয়ে গম্ গম্ আওয়াজ শোনা এবং তার পরেই হুইসিল দিয়ে সত্যিকারের ট্রেনের এসে পড়া। এই দৃশ্য দেখে দুর্গা এবং অপুর অপার বিস্ময় দর্শকদের সরাসরি স্পর্শ করল সহজেই । এবং সেই ইন্দিরা ঠাকরুনের মৃত্যুদৃশ্যটি, সেখানে সামান্য একটি ঘটিকে ব্যাবহার করা হয়েছিল অসামান্য একটু মুহূর্ত তৈরি করার জন্যে। ইন্দিরা ঠাকরুনের মৃত্যু দৃশ্যটি বিভূতিভূষন তেমন গুরুত্ব দিয়ে লেখেননি। সত্যজিৎ বিভূতিভূষণের বর্ণনায় না গিয়ে এই দৃশ্যটিকে একেবারেই অন্যভাবে দেখালেন।

দুটি শিশু বোঝে না মৃত্যু কাকে বলে। তারা তাদের পিসিকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে একটা মৃদু ধাক্কা দেয়। ইন্দিরা ঠাকরুনের প্রাণহীন দেহটি পড়ে যায়, বেশ শব্দ করেই। অপু, দুর্গার চোখে বিস্ময়। তারা তখন অবধি জীবন মৃত্যুর তফাৎ বোঝে না। কিন্তু এটা বোঝে, যা ঘটেছে তা ভয়ঙ্কর কিছু একটা। দুর্গার পায়ে লেগে সেই ঘটিটি গড়িয়ে পড়ে যায় পুকুরের জলে। ইন্দিরার নিথর দেহ পড়ে থাকে। আতঙ্কিত অপু, দুর্গা পালিয়ে যায় সেখান থেকে। এই কয়েক সেকন্ডের মৃত্যু দৃশ্য এমন একটি অভিঘাত তৈরি করে, যা ভারতীয় দর্শক এর আগে কখনো দেখেনি । এখানেই সত্যজিৎ দেখিয়ে দিলেন ক্যামেরা দিয়ে কি করে শিল্প তৈরি করা যায়। অথবা একজন লেখক যেমন করে তাঁর কলম দিয়ে তাঁর দর্শনকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন, একজন সিনেমার পরিচালক কিছু শব্দ, কিছু নৈশব্দ্য, কিছু টুকরো দৃশ্য দিয়ে তাঁর নিজের দর্শনকে দর্শকের বোধের কাছে কি করে পৌঁছে দিতে পারেন।

পরের সব কটি চলচ্চিত্রেই তিনি এই ধারাটি বজায় রেখেছেন । তবে শুধু আর্ট সৃষ্টির নেশায় মগ্ন থাকেননি । তিনি তাঁর নিজস্ব একটি দর্শনকে পেশ করেছেন সব ছবিতেই, যার মধ্যে প্রতিবাদ আছে, সমালোচনা আছে, তিরস্কার আছে, যন্ত্রণা আছে, বিদ্রোহ আছে, স্বপ্ন আছে, আশা আছে, উন্মোচন আছে, উত্তরণ আছে, ভালোবাসা আছে, দুঃখ আছে, আনন্দ আছে। কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে কোনো কিছুই দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নেই। তাঁর সিনেমায় অন্য যে কোনো ক্ল্যাসিক সাহিত্যের মত সব যুগেই সমকালীন হয়ে ওঠার একটা জোর আছে।

সত্যজিতের প্রয়াণের পর তাঁকে অনেকেই বেঙ্গল রেনেসাঁসের শেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেছিলেন । এর উত্তরে উৎপল দত্ত যে কথাটি বলেছিলেন, তা বোধহয় তাঁর জন্যে এক কথায় সবচেয়ে উপযুক্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য। তিনি বলেছিলেন – রেনেসাঁস শব্দটি সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে যথেষ্ট নয় । তিনি ছিলেন মানবজাতির বিবেকের একটি মুহূর্ত।

[চিত্র ঋণঃ আন্তর্জাল]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
5 months ago

সত্যজিতের বহমুখী প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন। পড়ে খুব ভাল লাগল।

সোমেন দে
সোমেন দে
Reply to  Himadri Kumar Das Gupta
5 months ago

ধন্যবাদ।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
5 months ago

এত সহজ ভাষায় সত্যজিতের প্রতিভার সব দিকগুলোকেই তুলে এনে রীতিমত মুগ্ধ করলেন।

সোমেন দে
সোমেন দে
Reply to  Chandan Sen Gupta
5 months ago

ধন্যবাদ।

Ratul Mazumder
Ratul Mazumder
5 months ago

স্বল্প পরিসরে সত্যজিতকে চমৎকার আবদ্ধ করেছেন লেখক।

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
5 months ago

রবীন্দ্রনাথের পর যে মানুষটি তাঁর বিপুল বিচিত্রমুখী শিল্পপ্রতিভা নিয়ে বাংলার সংস্কৃতি জগৎকে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্বসভায় পৌঁছে দিয়ে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন, তিনি সত্যজিৎ রায়। আমাদের সকলের পক্ষ থেকে প্রচ্ছদ নিবন্ধটি সত্যজিতের সেই সামগ্রিক প্রতিভার বেদিমূলে যথার্থ প্রণাম। লেখককে
ধন্যবাদ।