রবি ঠাকুর তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি, চোখে নিয়ে দীপক খুব সন্তর্পনে কথা বলছে, যেমন করে প্রিয় মানুষকে মনের কথা বলা হয়, তেমনই অন্তরঙ্গ স্বর, “তোমার সাজানো পথেই আমার চলা। সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের মুখে শিশু আর শিশু ভোলানাথ শুনতে শুনতে জীবনের সোপানে পা রেখেছি। তারপর এতকাল পেরিয়ে এলাম। নিজের কাজে, ভাবনায়, স্বপ্নে কিম্বা গার্হস্থে তোমাকেই ছুঁয়ে থাকার এই অনন্ত অভ্যাস।”
ধূপের ধোঁয়া ঘুরে বেড়ায়। মিশে আছে এক গোছা রজনীগন্ধার নম্র অস্তিত্ব। পরিপাটি করে সাজানো দীপক আর মানসীর গেরস্থালি। সাজসজ্জায় উচ্চকিত আড়ম্বর নেই, আছে কেবল শান্ত স্নিগ্ধতা। এক পাশে একটি খাট, সেখানে মানসী শুয়ে আছে। অন্যদিকে কুরুশ করা, সাদা পর্দা ঢাকা আয়না সম্বলিত, ড্রেসিং টেবিল। তার ওপর সামান্য কিছু প্রসাধনী, আতর, বিলিতি এসেন্সের শিশি। মানসী তেমন মেকআপে বিশ্বাসী নয়, কেবলমাত্র দীপকের কাছ থেকে উপহার পাওয়া সুগন্ধীগুলো, ওর খুব পছন্দের। আপিসের কাজে দীপক বিভিন্ন দেশে গিয়ে, ফেরার পথে বিমানবন্দরের নিঃশুল্ক বিপণী থেকে, মানসীর জন্য সংগ্রহ করে এনেছে। অন্যদিকে, একটা ছোট টেবিল চেয়ার আর বইয়ের তাক, সেখানে সারি দিয়ে সাজানো বই। বাকি ফর্সা দেওয়ালে, না আছে কোন ক্যালেন্ডার, কিম্বা পরলোকগত পূর্ব পুরুষদের ছবি। তবে শুধু আছেন রবীন্দ্রনাথ। কবির পরিণত বয়সের এক ছবি। সাদা কালো এই ছবির সামনেই প্রতিদিন ফুল জল দেয়, শাঁখ বাজায় মানসী।
দু-কামরা-র এই ছোট্ট ভুবন ওদের দুজনের। একমাত্র পুত্র অমিত, কর্মসূত্রে অন্য দেশে।
দীপকের স্বীকারোক্তির মতো একক সংলাপ চলতেই থাকে,
“শিলং নয়, থিম্ফুতে মানসীকে পেলাম। আমি তখন লাবণ্য, কৃষ্ণকলি, বিনোদিনী, সুচরিতা-কে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আমি ছিলাম আপিসের কাজে, আর ওঁরা এসেছিলেন বেড়াতে।
প্রকৃতি সাজিয়ে রাখে, পাহাড়ের কোল। যেকোন বাঁকে শতরঞ্জী বিছিয়ে বসে পড়লেই, বনভোজন। সাধারণ পর্যটক ধরাবাঁধা কয়েকটি জায়গাতে যেতে পারলেই বেড়ানো সম্পূর্ণ মনে করে। এঁদের দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, এমনভাবেও বেড়ানো যায়!
চার পাঁচজনের একটি দল, বসে গান গাইছে, সে গানে ব্লুটুথ স্পিকারের আর্তনাদ নেই। পাশে ছড়িয়ে আছে খাবারের টুকরি, বই, টুপি, মাফলার ইত্যাদি। গাঢ় পাতার আড়াল থেকে ওদের সম্মিলিত গানের কথা ভেসে আসছিল, “তোমার বাস কোথা হে পথিক ওগো, দেশে কি বিদেশে।”
একটু চমকে উঠেছিলাম বাংলা শব্দ শুনে। দলটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একজন, গানের সুরটিকে শরীরে জড়িয়ে, এক পাহাড় সবুজ, পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে। কথাগুলো কি আমায় উদ্দেশ্য করে বলা? সেই জবাব, না তুমি দিয়েছো, না দিয়েছে গায়িকা। শাড়ির ওপর লাল শাল জড়ানো ওকে প্রথম দেখে, কেমন শিহরিত হয়েছি! ঠিক যেন ‘আলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল একা!’
বিবিএস টেলিভিশন টাওয়ারে ওঠার পথে সচরাচর কেউ থাকে না। এই দলটি বনভোজনের জন্য, এমন নিস্তরঙ্গ জায়গাটিই বেছে নিয়েছে।
রডোডেনড্রনকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘এতো মেতো’। মানসীকে আমার তখন ‘এতো মেতো’-ই মনে হল। পাইনের ঠান্ডা বাতাসকে ছুঁয়ে উজ্জ্বল কালচে লালরঙা শাল গায়ে নিয়ে ফুটে রয়েছে।
তুমি শুনছো তো? এ যেন তোমারই কোন কাহিনীর অক্ষর-বৃন্ত থেকে ফুটে উঠে হাত বাড়ালো।”
কাচের ভিতর রবীন্দ্রনাথের চোখদুটিতে যেন একটু কৌতুক। দীপক আরও উৎসাহ পায়, “ভেবো না, কোন দুর্ঘটনা, ঘটিয়েছিলাম! নির্জন পাহাড়ে একা একা থাকি, আপিস থেকে ফিরে এসে; বই পড়ে, গান শুনে, আর কত সময় কাটানো যায়? অনেকেই অবশ্য গ্লাস সাজিয়ে বসে পড়ে, আমি ওই পথে যাইনি। তাই বিদেশ বিভূঁই-এ, হঠাৎ শাড়ি দেখে এবং তোমার সৃষ্ট গান শুনে এগিয়ে যাই।
‘নমস্কার, খুব সুন্দর গলা আপনার। এই প্রকৃতির মাঝখানে আরও যেন মানানসই হয়ে গেছে।’
আমায় কী ভাবলে? গায়ে পড়া গোবিন্দ? পরে মানসীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জানো তো? অবলীলায় বলেছিল,
‘তা, নয় তো কি?’
শুনে মনে হয়, ও মেয়ে নিজেই পারে নিজের দায় মেটাতে। কতকটা সে রকমই।
কলকাতায় দুই পরিবার কাছাকাছি আসে, আমিও চলে এলাম। ততদিনে প্রজেক্টের কাজ শেষ। পাহাড়ের পালা সাঙ্গ হল বটে, পাহাড়কে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম। জীবনের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছি, ট্র্যাজেডি হতে দিইনি। মোটেই বলিনি ‘হে বন্ধু বিদায়’।
বিয়ের দু বছর পর, মানসীর কোল আলো করে সন্তান এলো। নাম ঠিক করাই ছিল। পুত্র হলে অমিত আর কন্যা লাবণ্য। শিশু অমিত নতুন ভাবে সেই অমোঘ প্রশ্ন নিয়ে ফিরে আসে, ‘কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?’ আমি আর মানসী দুজনেই বুকে বেঁধে, স্বপ্নে জড়িয়ে সন্তানের উত্তর হয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম।
আমাদের মাঝখানে অমিত এসে, নতুন করে শৈশবের চাক ঘুরিয়ে, দুজনের যৌথ জীবনের কাদার তাল-কে, সার্থক মৃৎপাত্রের পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। একটু একটু করে সে বড় হতে লাগল।
অতঃপর একদিন সহসা আমাদের ডালপালা উতলা হয়ে উঠল। কৃতী সন্তানকে তার অভীষ্টের পথে এগিয়ে দিয়ে, এই ছোট দু-কামরার ফ্ল্যাটে আবার দুজনে একা। সেই নিজস্ব পরিসরে যেটুকু ফাঁক ছিল, ভরাট করে দিলে তুমি।
মানসী নিয়মিত ভিডিও কনফারেন্স করে ছেলেকে দেখে, আর কী যেন এক অব্যক্ত বেদনায় নীল হয়ে যেতে থাকে। সে এক ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে’, আমি কতকটা দূর থেকে দেখি। মাঝেমাঝে অমিত যে, আসে না তা নয়, ওটুকুতে মায়ের মন ভরে না। অমিত অনেকবার চেয়েছে আমাদের নিয়ে যেতে। আমাদেরই মন টানেনি, কোথাও এক শিকড় গেঁথে যাওয়ার অনুভব।
একদিন ওকে বলেই ফেললাম, ‘সারক্ষণ মুখ ভার করে থাকো, আমার ভালো লাগে না।’
‘আমি কী নিয়ে থাকব? বলতে পারো?’
‘এতদিন যা নিয়ে ছিলে?’
‘এতদিন আমার ছেলে ছিল।’
‘না, ছেলে তোমার কখনোই ছিল না। অমিত, তুমি, আমি, এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রাণীই একা এবং একক। পৃথিবীতে সরাসরি আসার পথ নেই, তাই আমাদের পিতা মাতার অবলম্বন নিতে হয়, আদতে আমরা প্রত্যেকে আলাদা সত্তা। হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য আমাদের চলার পথ মিলে যায়। রেলগাড়িতে বা অন্য গণমাধ্যমে চলার পথে কত সহযাত্রীদের সঙ্গেই তো আলাপ হয়, যখন যার গন্তব্য আসে তাকে নেমে যেতে হয়। তোমার অমিতেরও গন্তব্য এসে গিয়েছে, তাই আমাদের পথের থেকে, ওর পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।’
‘এ সব সাহিত্যের কথা।’
‘জীবনের সত্য আর সাহিত্যের সত্য কি আলাদা?’
‘আমি জানিনা, কোনটা সত্য? এটুকু জানি, আমার কষ্টের চেয়ে, এই মুহূর্তে আর কোন বড় সত্য, আমার অন্ততঃ নেই।’
‘নিজেকে ইনডিফারেন্ট করে ফেল। দুঃখজয়ের এর চেয়ে ভালো উপায় হয় না।’
মানসী উত্তর দেয় না। শামুকের মতো নিজের খোলের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বেশ কিছুদিন পর, আমি ওকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করি, ‘তোমার ছেলে কৃতী। তাই তো সে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এতে কোথায় গর্ব অনুভব করবে? তা নয়, শুধু কষ্ট পাচ্ছো।’
‘এখন আর কষ্ট পাই না।’
‘কষ্ট চেপে রাখাও, এক প্রকার কষ্ট।’
মানসী অল্প করে হাসে, ‘তোমারই কথা, অমিত আমাদের অলোর মতো হয়েছে।’
‘তা তো হয়েইছে।’
‘আলোকে আলগা দিলে, আলো ছড়িয়ে পড়ে।’
‘আলগা দেবই বা কেন?’
‘দিতে পারিনি তো। আলোর, বাধা ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। অমিতও সব বন্ধন টপকে চলে যেতে পেরেছে অনায়াসে।’
‘এ তোমার অভিমানের কথা।’
‘অভিমান করতেও, মানুষের প্রয়োজন।’
এভাবেই আমাদের কথা থেমে যেত। ঘরে বাতিও জ্বালানো হতো না। আমি অপেক্ষায় থাকতাম কখনও যদি একটা আলোকিত জানালা খুলে যায়! ঘুমের ভেতর কতদিন ঘন অন্ধকারে জানলা খোলার আওয়াজ পেতাম। পাশ ফিরে খুঁজতাম, দেখি কেউ নেই।
এভাবেই সংসারের বাঁধাগৎ-এ হোঁচট খেতে খেতে এগোতে থাকি। সেখানে আটপৌরে ঠেলাঠেলিতে একমাত্র তুমিই বাঁচিয়ে রেখেছ। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ বলে কখনও আর্জি জানাইনি। সেই অন্ধকারের ভেতরই খুঁজে নিতে চেয়েছি আলোকিত আনন্দের ঘ্রাণ।
সে সব কি খুব মসৃণ? আমাদের শান্তিপূর্ণ যৌথ যুদ্ধে তুমিই রইলে অবলম্বন। ছেলের চলে যাওয়া মানসী মেনে নিতে পারেনি। পরের দিকে মুখে আর স্বীকার করত না, আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। অতিরিক্ত নীরবতা অথবা হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আছড়ে পড়া। আমায় দুটোই সহ্য করতে হয়েছে।
পথচলার শুরুর দিন থেকেই পূর্ণিমা অমাবস্যার মতো আমাদের মিলন আর বিরহ। জীবনের এই পর্বে এসে আরও বৃদ্ধি পেল। ওই দিকে তাকিয়ে দেখ। একদিকে লাল আর অন্যদিকে নীল রঙের বাতি। রেলের সিগন্যালিং সিস্টেম-এর মতো, আলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল মানসীর ওপরই। আমার তো সব সময়ই প্রিয়, মিলনের লাল রঙ। মানসীর পছন্দ ছিল নীল। বেশিরভাগ সময়ই সেই নীল রঙ মেখে সাঁতার দিত একক সাগরে, সেখানে ভেসে থাকে একমাত্র তোমার গান, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’
এখনও দেখো, নীল আলো জ্বলে রয়েছে। এ আমার বিচ্ছেদ? নাকি চির মিলন?”
ঠিক তখন, ঘরের দরজা খুলে অমিত ভেতরে ঢোকে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, চোখে মুখে জেট ল্যাগের ক্লান্তি। ও গত রাতেই পৌঁছেছে। আজ সকালে বাবাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিয়েছিল। বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ওরা গীতা চাইছেন। ঘরে আছে?”
দীপক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বইয়ের তাক থেকে পেড়ে আনে একটা বই। অমিত হাতে নিয়ে দেখে, রবি ঠাকুরের নাম সই করা বিশ্বভারতী প্রকাশনার গেরুয়া মলাটের বই।
একে একে আরও কয়েকজন ঘরের ভেতরে আসে। ওরা মানসীকে যত্ন করে তুলে, ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে যায়।
দীপকও লিফটে ওঠে। নিচে, ফ্ল্যাটের সামনের বাগানে সবাই অপেক্ষায়। তাদের মাঝখানে মানসী, লাল শাল জড়িয়ে যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। দীপক অবাক চোখে লক্ষ্য করে, প্রশান্তি মাখা মুখটিতে, তিরিশ বছর আগেকার সেই অমলিন পাহাড়ি সৌন্দর্য লগ্ন হয়ে রয়েছে। বুকের ওপর রাখা আছে ‘গীতাঞ্জলি’।
দীপককে একজন একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। নিচু স্বরে দুয়েকজন কথা বলছে, বেশিরভাগ মানুষ চুপ করে আছে। সেই নৈঃশব্দের মধ্যে দীপকের মনের ভিতর ফ্ল্যাশব্যাকের মতো অনেক দৃশ্য পরপর সরে সরে যাচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে মিউনিসিপ্যালিটির স্বর্গরথ সামনে এসে দাঁড়ায়। অমিত বাবার কাছে এসে বলে, “এবার আমরা রওনা হব।”
দীপক আরও একটু চুপ করে থেকে, খালি গলায় গান শুরু করে, “সমুখে শান্তিপারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার…।”
সে গান ঘরের বারান্দা ছাড়িয়ে অনেক দূরে নিয়ে চলে যায়। তিরিশ বছর আগেকার হিমালয়ের সবুজ বাঁকে বাঁকে পাইন পাতার ভেতর দিয়ে গানের সুর, সত্যিই পৌঁছে যায় সুরলোকে। মানসীকে তার অভীষ্ট যাত্রাপথে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যায়।
[লেখকের অন্য রচনা]
আসলে আমরা সবাই কিছু কথা বলতে চাই, প্রকাশ করতে চাই নিজেকে। চাই অন্যেরা বুঝুক আমার আবেগের ভাষা। রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করলে নিজেকে উন্মোচনের কাজটা সহজ হয়। জীবনে এবং মরনে।
খুব সুন্দর বললেন। অনেক ধন্যবাদ
আজি রেমাল ঝড়ের রাতে গল্পটার সাথে ভালই অভিসার করলাম 😃
অনেক ধন্যবাদ
একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম গল্পটা।পড়লাম, না রবীন্দ্রনাথ কে বলা কথা গুলো পাঠক আড়াল থেকে শুনে নিল,সেটাই ভাবছি। চমৎকার।
আপনি পড়ছেন জেনেই সুখ