শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

আঠারো তলার ব্যালকনিতে বসলে, পৃথিবীটা অন্য রকম লাগে।দূর থেকে মেঘেরা ছুটে আসে, গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে পাক দিয়ে ওঠে অন্ধকার। তারপর অজস্র জলের ফোঁটা নামতে থাকে। উঁচু থেকে বোঝা যায়না, কোথায় তাদের ঠাঁই হল? চোখের সামনে ধারাপাতের পর্দা দুলতে দুলতে বলে বেঁচে থাকার গল্প। আরও একবার প্রমিত ভালোবেসে ফেলে। দুঃখের ছবিগুলো ঝাপসা হয়, বিলীয়মান গন্তব্যের দিকচক্রবাল। প্রমিতের চা জুড়িয়ে যায়, নিজের জীবনের গতানুগতিকের বাইরে বেরিয়ে উপলব্ধি করে অস্তিত্বের আস্বাদন। অথচ কয়েকদিন আগে এই ব্যালকনি থেকেই দুইহাত বাড়িয়ে পাখির মতো ডানা মেলতে চেয়েছিল। জীবনের রঙ জ্বলে, পড়েছিল ছাই। পাখির ডানায় যেন মুক্তির স্বাদ। এই শরীর থেকে, এই মন থেকে ছুটি নিতে চেয়েছে প্রমিত।

ছোট টালির ঘরে জল মানেনা। বিশেষ করে বৃষ্টি যখন তিনদিন পেরিয়ে যায়। জামাকাপড় শুকোচ্ছে না। গলিতে জল ছপছপ করছে। নর্দমা উপচে কালচে রঙ পাক খেয়ে চলেছে। তার ভেতর দিয়ে যাতায়াত। জল পাড়িয়ে ঘরে আসতে সরস্বতীর ভালো লাগেনা। ঘরের মধ্যেও শামুক কেঁচো বিড়াল ঢুকে বসে থাকে। শামুক আর কেঁচো ফেললেও, বিড়ালটাকে তাড়াতে মায়া লাগে। জলের ভিতর যাবেইবা কোথায়? শান্তনুর চাকরি যাওয়া ইস্তক এই কমদামি বসত-এ ভাড়া এসেছে ওরা। খরচে লাগাম পড়াতে, যতটা কষ্ট করা সম্ভব। অনেক ভাগ্যে ছেলেটাকে আশ্রমে দিতে পেরেছে। সেও সম্ভব হয়েছে প্রমিতের জন্য। প্রমিতের সাথে আশ্রমের একটা ভালো যোগাযোগ আছে। শান্তনু এখন বাবুর গদিতে খাতা লেখে আর প্রমিতসহ দুই বাড়িতে রান্নার কাজ করে সরস্বতী। এক মুখ ঘেন্না নিয়ে রাস্তায় নামে, বৃষ্টি হলে তো পেট বসে থাকবেনা, তার ইন্ধন যোগাতে কাজে বেরতেই হয়।

“এত জলেও রস মরেনা?”

পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চু কথাগুলো ছুঁড়ে দেয়। শরীর পাকিয়ে ঘেন্না ওঠে। এইসব কেঁচোদের কথা হজম করার ধৈর্য সরস্বতীর নেই। এ পাড়াতে নতুন হলেও ও যে ছোবল মারতে জানে, বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

– সকাল থেকে পোঁদ চাখতে বেড়িয়েছো? কোনটা মিষ্টি আর কোন পোঁদ নোনতা?

বাচ্চু বোধহয় এতটা আশা করেনি। আশেপাশে ভাগ্যিস কেউ ছিলনা। গুটখারঞ্জিত দাঁত বার করে, “ও বাবা আমি তাই বলেছি নাকি?”

– তুমি কি বলছো জানিনা। আমি এ ভাবেই বলি।

স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতে এমনিই মেজাজ বিগড়ে আছে, তার ভেতর এইসব পরগাছাদের উৎপাত! পায়েপায়ে ‘আকাশকুসুম’-এর গেটে এসে পৌঁছয়। সেখান থেকে লিফ্টে চেপে প্রমিতের ফ্ল্যাটে। এই উত্তরণ সাময়িক হলেও সরস্বতী উপভোগ করে। ওর নিজস্ব পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ অন্য জগত। একেই কি স্বর্গ বলে?

– কিরে আজও এসেছিস? কী করে এলি?

এমন বৃষ্টি ডিঙিয়ে সরস্বতী আসবে, প্রমিত ভাবতে পারেনি।

– না এলে চলবে? হাত পুড়িয়ে খেতেও তো জানোনা।

– ওই শুরু হল তোর শাসন।

– শাসন কি আমি করতে পারি? শাসনের লোকটাকে তো তাড়িয়ে ছাড়লেন।

– আমি তাড়ানোর কে? সে স্বাধীনতা চেয়েছে। আমি জোর করতে পারি?

– কী জানি বাপু। আমি বেগড়বাই করলে, আমার বর কেলিয়ে পাট করে দেবে।

প্রমিত কিছু বলেনা, শুধু হাসে। সরস্বতী দিনের কাজে হাত দেয়। প্রমিত সরস্বতীর হাতে ঘর ছেড়ে, প্রস্তুত হয়ে আপিস বেরিয়ে যায়।

প্রমিত বেরিয়ে গেলে, দুহাজার স্কোয়ার ফুটের আকাশ ছোঁয়া বিরাট ইমারতের একক সম্রাঞ্জী সরস্বতী। একা মানুষের জন্য কাজও তেমন নেই। সেসব চটপট সেরে, বসার ঘরের নরম গালচের ওপর টান হয়ে শুয়ে পড়ে। সরস্বতীর টিভি দেখার অভ্যাস নেই। ফ্রিজ খুলে ভালো মন্দ খাওয়ারও ইচ্ছে করেনা। শুধু মাঝে মাঝে সত্যি রাণী সাজার ভাবনা পেয়ে বসে।

আলমারি ভরা রাশিকৃত পোশাকের সম্ভার। সবই প্রমিতের স্ত্রী নীলাঞ্জনার। “বৌদি” থাকার সময় থেকেই সরস্বতী এ বাড়িতে বহাল। যেমন প্রতিমার মতো দেখতে, তেমন মিষ্টি স্বভাব ছিল নীলাঞ্জনার। সাথে বড় চাকরিও করে। কেন যে ওরা একসাথে থাকতে পারলনা, সরস্বতী আজ অবধি বোঝেনি। বাচ্চাকাচ্চা না হলে সম্পর্কতে আঁট আসেনা, সরস্বতী এইসব ভাবে আর আলমারি ছেনে একটা গাঢ় নীল রঙের বক্ষবন্ধনী বার করে আনে। শোওয়ার ঘরের বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই যেন চিনতে পারছেনা। বুকের মাপে খানিক ছোটই হবে। জামাটা শ্যামলা ত্বকে চেপে বসে, সরস্বতীর নেহাত আটপৌরে শরীরটাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নিজের বুকের গড়ন দেখে নিজেই লজ্জায় মিশে যায়। ওর সস্তার জামাতে বুকদুটোকে কেমন গোবরের তালের মতো দেখায়, আর এই নীল রঙের অন্তর্বাসটিতে ও যেন অবিকল প্যান্ডেল আলো করে থাকা সরস্বতী ঠাকুর! খানিক ঘোর লাগা অবস্থা কাটিয়ে, জামা জায়গা মতো রেখে দেয়। বিকেল হতে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে। সেখানে নর্দমার জলে ডোবা রাস্তার পাশে বাচ্চুদের ঠেক। ছিটকে আসা শিসের শব্দ। একটু ভয়ভয় পায়, ছেলেটাকে সকালে একচোট ঝেড়েছে। এখন বদলা নিতে না আসে।

উথাল পাথাল ঝড়ের ভিতর খোলা মাঠে শুয়ে নীলাঞ্জনা আর দীপিকা। চারদিকে দেখার কেউ নেই। এমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিনে কুকুর বেড়াল চোখে পড়েনা, মানুষ তো দূর অস্ত। হঠাৎ একটা নারকেল গাছের পাতা উড়ে এসে শরীর ঘেঁষে আছড়ে পড়ে। নীলাঞ্জনা ভয় পেয়ে উঠে বসে, “দীপিকা, চল এবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে”।

– ভয় পেয়ে গেলি? নারকেল গাছের ডাল বা ফল মানুষের মাথায় পড়েনা।

– তুই সব জানিস?

– এবাবা? তুই জানিস না? বাড়ি গিয়ে মাসিমাকে জিজ্ঞেস করিস।

– ঠিক আছে। তার জন্য বাড়ি তো যেতে হবে। পুরো ভিজে গেছি।

– ব্যপক সেক্সি লাগছে।

– হয়ছে। আর তাতাতে হবেনা

কলেজের প্রথম ধাপে এসে দীপিকার সাথে আলাপ হয় নীলঞ্জনার। ছোট করে চুলকাটা, জিন্স আর টিশার্টে কোথাও গহনার কোন চিহ্নমাত্র নেই। বাইক নিয়ে রোদচশমা পড়ে, কলেজ থেকে ফেরার পথে ওকে পাকাড়াও করে। বাঁধাগতের জীবনে এক নতুন মাত্রা সংযোজন হল। উদ্দাম গতির বাইকে চড়ে নানা মুলুক পাড়ি দিয়ে কখন যেন জড়িয়ে পড়েছে নীলাঞ্জনা, নিজেও বোঝেনি। একটু আধটু শরীর খেলা হয়েছে, সেসব প্রথম যৌবনের কৌতুহল ভেবেছিল। ভুল ভাঙলো প্রমিতের সাথে বিয়ে হবার পর। বিয়ের সময়টা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিল দীপিকা। প্রতিরাতেই প্রমিতের সোহাগে সাড়া দিতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছে নীলঞ্জনা। মেয়েদের মেনে নিতে হয়, এই ভেবে দিন চলছিল, হঠাৎ ঝড়ের গতিতে বাইক নিয়ে আসে দীপিকা, সব তছনছ করে দেয়। “তুই আমার। এ রকম কেন্নোর মতো জীবন কাটাতে পারিস না। পৃথিবী শুধু পুরুষদের নিয়মেই চলবে?” তারপর সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেনি।

প্রমিত বাধা দেয়নি। বিয়ের দুবছরের মাথায়, নীলাঞ্জনা যখন স্বীকার করেছিল, ও লেসবিয়ান, প্রমিতের পায়ের তলার জমি সরে যায়। খানিক ছেলেমানুষের মতো তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টি নীলাঞ্জনা যে সহ্য করতে পারছিল, তা নয়। তবে এতকিছুর পরও যদি প্রমিতের সাথে থেকে যায়, ঠকাবে তিনজনকেই। নিজস্ব কাগজপত্র নিয়ে খুব অনাড়ম্বর ভাবে বেরিয়ে আসে ‘আকাশকুসুম’-এর থেকে। গেট পার হবার সময় সরস্বতীর সাথে দেখা। নিজের বটুয়া খুলে ফ্ল্যাটের চাবি বার করে দেয় নীলাঞ্জনা। এই চাবিটা ওর কাছে সর্বক্ষণ থাকতো। “তোর দাদাবাবুকে দেখিস, আমি চললাম”। কথাগুলো কানে লাগলেও তার গুরুত্ব প্রথমে বুঝতে পারেনি। বুঝলো আঠারো তলাতে উঠে। ব্যালকনির গ্রিলের তালা খুলে প্রমিত একটা ছোট টুলে ভর করে বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক মুহূর্তে বুঝে যায়। দৌড়ে পার হয় বসার ঘর। দুহাতে প্রমিতের পা দুটো ধরে বারান্দায় ঝুলে পড়ে সরস্বতী। সেই ইস্তক প্রমিতের কাছে রয়ে গেছে। প্রমিতের মা মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য এসে থেকেছেন। তিনিই প্রথম প্রমিতকে সাথে করে ওঁর গুরুদেবের আশ্রমে নিয়ে যান। শহর থেকে এত কাছে, এমন শান্ত নিভৃত একটা জায়গা থাকতে পারে, এখানে না এলে বোঝাই যায়না।

মায়ের সাথে এখানে আগেও এসেছে। কেমন মন ভালো হয়ে যায়। পরিধির ভেতর একটা স্কুল আর হাসপাতালও আছে। গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীরা দেখভাল করছে। প্রমিতের একটা বিষয়ে অবাক লাগত, এই লোকগুলো সব সময় যেন মজায় আছে! সংসার করেনি, তাই এত সুখ? প্রমিতের মা বড় মহাত্মাকে বলে রেখে ছিলেন। উনি ওদের আলাদা করে বসালেন। আশির ওপর বয়স, তবু প্রাণশক্তিতে ঝলমল করছেন। স্নেহার্দ্র গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “খুব মন খারাপ?”

– জানিনা। তবে অপমানিত লাগে।

– প্রত্যাখ্যাত হওয়া তো অপমানজনকই।

– তবে আমার কী করা উচিত?

– আমি কিছু বললে, তুমি কি মানবে?

– কেন?

– মনে ভাববে, সন্ন্যাসী মানুষ, সংসারের কী বুঝবে?

– না সেরকম নয়, তবে…

দুজনেই হেসে ফেলে। বড়ো মহাত্মা বলেন,

– তোমার কি কখনও মনে হয়েছে, এই আশ্রমের সব সন্ন্যাসীরা সবসময় আনন্দে কেন থাকে?

প্রমিত সত্যিই অবাক হয়! ভদ্রলোক নির্ঘাত থট-রীডার। এই কথাটা জানল কী করে? মুখে কিছু বলেনা।

– দেখো প্রত্যেকের একটা নিজের পৃথিবী থাকে, সেটা অন্যের সাথে নাও মিলতে পারে।

– তাহলে এই দুই বছর আমার সাথে অভিনয় না করলেও পারতো।

– হয়তো অভিনয়টা ছিল নিজের সাথে, তুমি তোমার জায়গা থেকে দেখছো। ভাবো, এই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মেয়েকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে কতটা সংগ্রাম করতে হয়।

– বাঃ আপনি তো ওর দিকটাই দেখছেন। এত স্বাধীনতা পেয়েছে বলেই এমন ভাবে যেতে পেরেছে।

– স্বাধীনতা শব্দটা বড় গোলমেলে। একদিন ‘স্বাধীন’ হয়েছিলাম বলে ভিটেমাটি ছেড়ে নিমেষে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। ভীড় রেলগাড়ির জানলা দিয়ে আমায় পুঁটুলির মতো ভেতরে চালান করে দিয়েছে বাবা। আর ভীড় ঠেলে নিজে উঠতে পারেনি, হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। আর আমি ‘স্বাধীন’ হলাম। সেই প্রথম তালগোল পাকিয়ে রেলগাড়ি চড়া। ভেবেছি, বোধহয় এভাবেই যাতায়াত করতে হয়। শেয়ালদা স্টেশনে এসে জানলাম, রেলের একটা দরজাও থাকে! তারপর ক্যাম্পের খাতায় শরণার্থী। সেখান থেকেই সেবা কার্যে নিয়োজিত সাধুদের সাথে আলাপ। ক্রমে এই সেবার কাজেই আবার স্বাধীনতা লাভ। সব কিছু ফেলে এসে, কিসে এত সুখ আসে? কাজ যখন অন্যের জন্য করবে, তখন দেখবে আনন্দ লাভ হয়। সেখানে ‘আমার কষ্ট’ ‘আমার বিপন্নতা’ ‘আমার পরাজয়’ কোনটাই আমার নয়। সৃষ্টির এই বিশাল যজ্ঞে ‘আমি’ ধূলির চেয়েও অকিঞ্চিতকর। যে মুহূর্তে এই উপলব্ধি হয়, তখন শুধু আনন্দই পড়ে থাকে।

প্রমিত কতটা বুঝল জানা নেই, তবে ভেতরের জ্বলুনিটা যেন অনেকটাই কম। সেদিন বাড়ি ফিরে দেখে, সরস্বতীর ছেলে সুমনও রয়েছে। স্কুলের বেতন বাকী পড়েছে বলে, পরীক্ষায় বসতে দেবে না। সদ্য সদ্য মহাত্মার কাছ থেকে আসায় মাথার ভেতর ওনার কথাগুলোই ঘুরছিল। পরের রবিবার ছেলেটি ও সরস্বতীকে সাথে নিয়ে আবার আশ্রমে যায় প্রমিত। ওর অনুরোধে আশ্রমের স্কুলে জায়গা পেয়ে যায়, আর খরচ বাবদ অনেকটা টাকা অঙ্গীকার করে প্রমিত। ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে প্রমিত।

রাতে শান্তনু ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ভকভক করে গন্ধ বের হচ্ছে। সরস্বতী বোঝে মানুষটার সময় ভালো যাচ্ছেনা। রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানির অ্যাকাউন্টস অফিসার থেকে সামান্য গদিতে খাতা লেখার কাজে যন্ত্রণা অনেক। পরাজয় ঢাকতে মদ গিলে আসে। তবে আজ যেন অন্য রকম! হিসহিস করে বলতে থাকে “সুমনকে কোথায় রেখে এলি?” সরস্বতী হেসে ফেলে,

– ও বাবা! এর জন্য এত রাগ? আমারও তো মন খারাপ, একমাত্র ছেলেকে ফেলে থাকা যায়?

– আশ্রমে এমনি এমনি নিল?

– ওমা! এমনি কেন নেবে? প্রমিতদাদা বলল, তবে না?

– সে বলল কেন?

– আমাদের কষ্ট দেখে দুঃখ পেয়েছে।

– মুখ ভেঙচে ওঠে শান্তনু। “দুঃখ পেয়েছে? দরদ উথলে উঠেছে? কেন আমি জানিনা?”

– কী জানো তুমি?

– ঢলানি মাগি তাকে কি দিচ্ছিস তুই? বুঝিনা?

– কী যা-তা বলছ? একটা ভালো মানুষের গায়ে কাদা ছিটাবে না।

– ভালো মানুষ না বাল, বৌ টা কেন পালিয়েছে, বুঝিনা? কাল থেকে ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ।

– তুমি একটা অমানুষ

বলে ছিটকে আসতে চায় সরস্বতী। শান্তনুর জোরের কাছে পেরে ওঠেনা। মোটা রোমশ হাতের থাবার নিচে বেআব্রু হয়। অন্ধকারে বোঝা যায়না। চোখের কোণ বেয়ে জল আর ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। উন্মত্ত শান্তনু টের পায়না। শুধু অস্ফুটে বলে “লাগছে”। কেউ শুনতে পায়না।

পরদিন দুপুরে হঠাৎ শান্তনুর ফোন। এই সময় সরস্বতীকে কখনও ফোন করেনা। অবাক হয়ে ফোন ধরে, জিজ্ঞেস করে “কী চাই?”

– তুমি কোথায়?

– কোথায় আবার? বাড়িতে

– কাজে যাওনি?

– বারণ করলে তো?

– বাব্বা! আমি বারণ করলে তুমি যাবে না? অতগুলো টাকা কী এমনি আসবে?

– জানিনা। আমার ভালো লাগছেনা।

– জানো প্রমিতবাবু কত টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়?

– কী করে জানব? বড়মানুষ। অনেকই হবে।

– আরে একটা আন্দাজ কর?

– কী হবে আন্দাজ করে? বিশ পঁচিশ লাখ হবে?

– আটষট্টি লাখ! কল্পনা করতে পারো? আটষট্টি লাখ!

সরস্বতী অঙ্কটা শুনে তেমন অবাক হয়না, যতটা অবাক শান্তনুর কথার বিষয় শুনে হয়েছে। খুব নির্লিপ্তির সাথে বলে, “লাখ বা কোটি যাই হোক। আমাদের কী এসে যায়?” সরস্বতীর উত্তর গায়ে না মেখে, শান্তনু বলে,

– আরে বুঝতে পারছো না? এত টাকা ট্যাক্স দিলে, রোজগারটা কত হবে? ও চাইলে শুধু তোমায় বা আমাদের ছেলেকে না আমারও একটা হিল্লে করে দিতে পারে। আজ আমাদের কোম্পানির অডিটরের কাছে গেছিলাম। ওদের কাছে প্রমিত বাবুরও ফাইল আছে। কথায় কথায় বলে ফেলেছে।

– ঠিক আছে

– আরে কী ঠিক আছে? কাল আমার কথাটা ওনাকে বলো

– আমি তো আর যাবনা

– ওফ। ন্যাকামি কোরনা। বাড়ি ফিরে বলছি। এমন শাঁসালো খদ্দের কেউ ছাড়ে?

সরস্বতীর গা গুলিয়ে ওঠে। কে কার খদ্দের? কথা বাড়ায় না। হ্যাঁ না করে রেখে দেয়। দুদিন বৃষ্টিটা ধরেছিল। আবার ঘনিয়ে এসেছে। বাইরের তারে কিছু জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া, ছুটে যায় সেগুলো তুলতে।

বাড়ি ফেরার সময় কয়েকজন হিজড়ে ওর গাড়ি ঘিরে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী করতে থাকে। অন্যদিন হলে, প্রমিত বিরক্ত হতো। আজ কেমন করুণা হল। হঠাৎ নীলাঞ্জনার কথা মনে পড়ল। একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর মানুষ, নিজের শারীরিক বা মানসিক চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণ করছে। নীলাঞ্জনার জন্য আহত হলেও মনের বিদ্বেষ ভাবটা যেন অনেক কম। জানালা নামিয়ে ওদের মধ্যে যে একটু বয়স্ক, তাকে ইশারায় ডাকে। কিছু টাকা দেয়, “আপনাদের কোন সমস্যা থাকলে, বলতে পারেন। আমি সাধ্য মতো সাহায্য করতে চেষ্টা করব। এখন রাস্তা আটকাবেন না, প্লিজ”। মানুষটি একটু হেসে টাকাটা নেয়, প্রমিতের মাথায় হাত রেখে সঙ্গীদের বলে, “বাবুকে ছেড়ে দে।” রাস্তা খালি পেতেই ড্রাইভার গাড়ি ছুটিয়ে দেয়।

ঘরে ঢুকে, বুঝতে পারে আজ সরস্বতী আসেনি। যেমন অগোছালো রেখে গেছে, তেমনই রয়েছে। ফ্রিজ খুলে কিছুমিছু বার করে, রাতের খাবারের জন্য। মেয়েটার কী হল ভেবে দুঃশ্চিন্তা হয়।

পরদিন ফোন করে খোঁজ নেবার আগেই সরস্বতী এসে হাজির। প্রমিত গতকালের না আসা নিয়ে কিছু বলেনা। শুধু বলে, “আগামী বুধবার স্বাধীনতা দিবসে আশ্রমে যাবো। তোর বরকেও নিয়ে যাস। ছেলেকে দেখে আসবে।” শান্তনুর কথা নিজে থেকে বলাতে, সরস্বতীর ভালো লাগে। কিছু চাইতে হলে নিজেই চেয়ে নেবে। সরস্বতী দেখা করিয়ে দিতে পেরেই খুশি।

সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা। মাঝেমাঝে ঝিরঝির বৃষ্টিও পড়ছে। আশ্রমে পৌঁছে অন্য অভিভাবকদের সাথে মিশে যায় সরস্বতী আর শান্তনু। খেলার মাঠ ছোট ছোট কাগজের পতাকা দিয়ে সাজানো। মাঠের একপাশে, একটা ইঁট সাজিয়ে বেদী করা হয়েছে, তার পাশে বাঁশ পুঁতে পতাকা তোলার ব্যবস্থা। তার পাশেই একটা ছোট শামিয়ানা, সেখানে অতিথিদের বসার চেয়ার পাতা। সরস্বতী লক্ষ্য করে প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে পতাকার বেদীটা ঢাকছে কয়েকটি ছেলে, তাদের মধ্যে সুমনও রয়েছে। নতুন রঙ, জলে ধুয়ে যেতে পারে। কনুই ছুঁয়ে শান্তনুকে দেখায়। শান্তনু বলে, “ছেলেটাকে ভেজাচ্ছে কেন?”

এই সবের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। পতাকা উত্তোলন হল, গান হল, কুচকাওয়াজও হল। অতিথিদের মধ্যে প্রমিত ছিল। মাইকে দুকথা বলতে গিয়ে আশ্রমের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা বলে। তার মধ্যে পতাকা উত্তোলনের একটা স্থায়ী বেদী তৈরীর কথাও বলে। সব শেষে বড় মহাত্মা বক্তব্য রাখেন। প্রথমে স্বাধীনতা কী আর তার অর্জনের ইতিহাস বলেন। তারপর বলতে থাকেন, “… যে অপরিসীম যন্ত্রণা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম পার হয়েছেন, স্বাধীন দেশে আমরা যাঁরা জন্মেছি, বড় হয়েছি, তাঁরা সহস্রভাগের একভাগও উপলব্ধি করতে পারব না। বইতে পড়া এক রকম, সেটা গল্পের মতই মনে হয়। ওই রকম কষ্টের যে কী অনুভূতি, কল্পনাও করতে পারিনা। এই যে ছেলেরা হাত হাতে পতাকার বেদী তৈরী করছে, রঙ করছে, তাকে জল থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেরা ভিজে বেদী ঢাকা দিচ্ছে। এর মধ্যে খানিক হলেও একটা অর্জন আছে। এই পতাকা আমাদের সেই অর্জনের প্রতীক। বহু রক্ত, স্বেদ, বেদনায় খন্ডিত স্বাধীনতা হলেও, এ আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার। পরের প্রজন্মকে সেই অধিকারের সম্যক গড়ে তোলাই প্রকৃত স্বাধীনতা।…”

এমন অনেক কিছু বলছিলেন। তার কিছু সরস্বতী বুঝল, কিছু শান্তনু। প্রমিত ঠিক করল, অন্য সাহায্য করলেও বেদীস্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মেঘ কেটে রোদ উঠেছে।শরতের নীল আকাশের পটভূমিকায় পতপত করে উড়ছে তেরঙ্গা।

[দেশ, ২০২০]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Angsuman Ghosh
Angsuman Ghosh
5 months ago

খুব ভালো লাগল।

Sourav Howlader
Sourav Howlader
Reply to  Angsuman Ghosh
5 months ago

আপনি পড়ছেন জেনেই সুখ

Sougata Dey
Sougata Dey
Reply to  Angsuman Ghosh
5 months ago

Ekta golpey anek gulo dik! Khub bhalo laglo.

Sourav Howlader
Sourav Howlader
Reply to  Sougata Dey
5 months ago

অনেক ধন্যবাদ

Sankha subhra nath
Sankha subhra nath
5 months ago

Chomotkar. Kothao ekta oriental philosophy, ekta brihottoro above gondi chariye chhoriye jaway je uttoron, e tar golpo. Besh ekta bhalo laga toiri hoy. Khanikta wish fulfillment o botek.

Sourav Howlader
Sourav Howlader
Reply to  Sankha subhra nath
5 months ago

অনেক ধন্যবাদ