শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রাঘবপুর লোকালে আজ মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। সন্ধের পর শহর থেকে বাড়ি ফেরা যাত্রীরা, ঢেউএর মতো আছড়ে পড়ে। ট্রেন তখনও প্ল্যাটফর্মে সম্পূর্ণ ঢোকেনি, নামার জন্য গেটের মুখে সবাই দাঁড়িয়ে, তার মধ্যেই একঝাঁক লোক, চলন্ত অবস্থায় লাফিয়ে ওঠে। পা-দানি, দরজার হাতল, দরজার ওপরের অংশ, যে যেখানে সামান্য একটু হাতের বা পায়ের আঙুল আটকাতে পেরেছে কি পারেনি, সেই অবলম্বন করে শূন্যে দেহটা ছুঁড়ে দেয়। যারা নামতে চাইছে, তারা বাধা প্রাপ্ত হয়ে নানা রকম উত্তেজক কথা বলছে। যারা উঠতে চাইছে তারাও কম নয়, সমান তালে প্রত্যুত্তর দিয়ে চলেছে। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনের প্রতিটি দরজা ছোটখাটো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আর রণে প্রেমে সব অনিয়মই নিয়ম।

জনার্দন আজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ট্রেনের দরজাগুলো দেখে মানুষ নয়, যেন রাশি রাশি পোকা মনে হচ্ছে। মৃত পশুর দেহাবশেষে যেমন সব ছেঁকে ধরে, ঠিক তেমনই। অন্যদিন এই রকম আক্রমণাত্মক ভাবে ট্রেনে উঠে জায়গা দখল না করলেও, একটু আধটু ঠেলাঠেলি করে উঠতেই হয়। না হলে বাড়ি ফেরাই হবে না। আজ ওর উপায় নেই। গত রবিবার বাড়িতে পড়ে গিয়ে বাঁহাতে চিড় ধরেছে। ডাক্তার হাতে প্লাস্টারের গয়না করে দিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ বাড়িতে থেকে, আজই প্রথম শহরে এসেছে দোকান খুলতে। কর্মচারীদের হাতে আর কতদিন ছেড়ে রাখা যায়? তা ছাড়া, ঘরে বসে থাকলেও মন পড়ে থাকে দোকানেই। এক হাত বুকে ঝুলিয়ে, অন্যহাতে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে, এমন করে ট্রেনে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সারারাত স্টেশনেই কাটাতে হবে।

ট্রেনটা তখনও দাঁড়িয়ে, ওঠানামার যুদ্ধের পর সামান্য স্থিতাবস্থা এসেছে। তখনই ওদের পাড়ার রতনকে দেখতে পায়। ট্রেনের জানালার ধারে বেশ চমৎকার জায়গা করে নিয়েছে। রতনও জনার্দনকে দেখতে পেয়ে ডাকে, “জনা, উঠে আয়। এখানে বসবি।”

রোগা গাল ভাঙা রতনের বাজারে দুর্নাম, অন্ধকার জগতের সঙ্গে ওর বেশ মেলামেশা আছে। কয়েকবার চিটিংবাজি কেস-এ জেলের ভাতও খেয়ে এসেছে। অন্য সময় রতনকে একটু এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজ রতনের এই উপকারের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারে না। 

রাক্ষুসে ভিড়ে পরিচিত গলার ডাক শুনে আশ্বস্ত হয় জনার্দন। দরজার কাছে ঝুলন্ত লোকেদের অনুনয় করে ব্যাগ নিয়ে ঠেলে ওঠে। ঠিক তখনই ট্রেন ছেড়ে দেয়। কোনক্রমে ঠেলেঠুলে রতনের কাছে পৌঁছতে, রতন ওর ব্যাগ ওপরে বাঙ্কে তুলে ওকে বসতে দেয়, “এই হাত নিয়ে, দোকান করছিস?”

“কী করব? ঘরে বসে থাকলে উনোন জ্বলবে?”

এরপর, ডাক্তার কী বলল? কতদিনে প্লাস্টার কাটবে? ওরও কতবার হাতে পায়ে প্লাস্টার হয়েছিল, ইত্যাদি কথা বলে, দুটো স্টেশন পর রতন নেমে যায়।

জনার্দন আবার ভাবতে থাকে এই ভিড় ঠেলে নামবে কী করে? আর তিনটে স্টেশন পরেই জনার্দনের গন্তব্য। একজন সহযাত্রী ওর ব্যাগটা ওপর থেকে নামিয়ে দেয়। পকেট থেকে পার্সটা বার করে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। মোবাইলটা বুক পকেট থেকে সরিয়ে প্যান্টের পকেটে চালান করে, আবার এক বুক মানুষ ঠেলে ঠেলে গেটের দিকে এগোতে থাকে। ব্যাগ নিয়ে ঠেলাঠেলিতে কয়েকজন বিরক্ত হচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু বলতে গিয়ে, হাতের ব্যান্ডেজ দেখে একটু নরম হয়ে বলছে, “আস্তে আস্তে যান।”

ক্রমে গেটের কাছে পৌঁছয় জনার্দন। একহাতে ব্যাগ আর অন্য হাত, বুকে ঝোলানো। ট্রেনের হাতল ধরার মতো অবস্থা নেই। চতুর্দিক থেকে আসা মানুষের চাপ, কোনও ক্রমে ওকে পড়ে যেতে দিচ্ছে না। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই আবার আরেক দফা হুড়োহুড়ি শুরু হয়। শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে, ভারি ব্যাগটা নিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর প্রায় মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে রক্ষা পায়। ট্রেনের যাত্রীরা হইহই করে ওঠে। কেউ বিরুপ মন্তব্য করতেও ছাড়ে না। লম্বা ভোঁ বাজিয়ে ট্রেন পরবর্তী স্টেশনের পথে এগিয়ে যায়।

পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছতে গিয়ে বুঝতে পারে, মোবাইল ফোনটা নেই। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। খুব বেশি দামী না হলেও, এই স্মার্ট ফোনটা দিয়ে জনার্দনের অনেক কাজ হয়। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের একটা চা-য়ের দোকানে নিজের ব্যাগটা গচ্ছিত রেখে, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের আর-পি-এফ-এর অফিসে যায়। সব শুনে কর্তব্যরত আধিকারিকটি বলে, “আপনার ফোনের বিল বা আই-এম-ই-আই নম্বর লাগবে।”

জনার্দন আকাশ থেকে পড়ে। দু বছর আগে কেনা ফোনের বিল কোথায় আছে? আর কী নম্বর বলছে, সেটাই বা কী? লোকটি জনার্দনকে সাহায্য করার চেষ্টা করে, “আপনার ফোনের বাক্সটাও যদি থাকে, নিয়ে আসুন। আমি রিপোর্ট লিখে নেবো।”

“এতদিন পর কি সে বাক্স জমিয়ে রাখা আছে?”

এসব ছাড়া কিছুই হবে না শুনে, মুখটা তেতো হয়ে গেল। আবার ওভারব্রিজ পার হয়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে। ব্যাগ সংগ্রহ করে, বাড়ি ফেরার টোটো ধরে, তখন রাত গড়িয়ে এগারোটা।

এর মধ্যে জনার্দনের স্ত্রী তৃপ্তি বার পাঁচেক ফোন করেছিল। ঘরে ঢুকতেই চিৎকার করে ওঠে, “কতবার করে ফোন করছি। সুইচ অফ করে রেখেছো কেন?”

Sourav Story

জনার্দনের তখন ঘামে ভেজা জামা, একহাতে প্লাস্টার অন্যহাতে ভারি ব্যাগ। কোন রকমে, ঘরে ব্যাগ রেখে সোফার ওপর এলিয়ে পড়ে।         

তৃপ্তি জনার্দনকে দেখে বোঝে, আজ কিছু একটা হয়েছে। অন্যান্য দিন বাড়ি ফিরেই সারাদিনের গল্পের ঝুলি খুলে বসে। আজ পুরো মুখটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। সেখানে ক্লান্তির চেয়ে আরও বেশি কিছু। চট করে এক গেলাস জল গড়িয়ে এনে সামনে ধরে, “এটা খেয়ে নাও।”

জনার্দন তীব্র মরুভূমির মতো জল শুষে ফেলে। এতক্ষণে বুঝতে পারে, ওর ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল। তৃপ্তি গ্লাসটা আবার ভরে দেয়। জনার্দন দ্বিতীয়বারও গ্লাসটা মুহূর্তে নিঃশেষ করে ফেলে।

তৃপ্তি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”

জনার্দন কী বলবে বুঝতে পারে না, হঠাৎ কোথা থেকে এক রাশ কান্না এসে গলায় ভর করে। হাপুশ নয়নে ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে থাকে। 

তৃপ্তি এই প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। জনার্দনকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে দেখে কী করবে বুঝতে পারে না। ওদের একমাত্র ছেলে বাবুন সদ্য চাকরি পেয়ে পুণে-তে গেছে ট্রেনিং নিতে। বাড়িতে আর কেউ নেই, যার কাছে পরামর্শ নেবে। তৃপ্তি সোফায় বসে জনার্দনের কপালে হাত রাখে, না জ্বর নেই। 

বেশ খানিক চোখের জল ফেলার পর, জনার্দন একটু ধাতস্থ হয়ে বলে, “আমার ফোন চুরি হয়ে গেছে।”

ফোন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটা খারাপ ঘটনা। কিন্তু তার জন্য এমন ভাবে ভেঙে পড়তে দেখে তৃপ্তির একটু অবাকই লাগে, “কী আর করবে? সিম ব্লক করে দাও। আর একটা নতুন কেনার ব্যবস্থা কর। ওটা বেশ পুরানো হয়ে গিয়েছিল।”

জনার্দন বলে, “হারানো বা খোয়া যাওয়া বড় নয়, আমি ভাবছি, আমার আজ এই রকম অসহায় অবস্থা দেখেও চুরি করল?”

কথাটা শুনে তৃপ্তি অবাক হয়ে যায়, “এ কী বলছো? চোর তো? তার আবার নীতিবোধ থাকে নাকি?”

“দেখতে পাচ্ছে আমার একহাতে বোঝা, আর অন্যহাত গলায় ঝোলানো, নিজেকে রক্ষা করতে পারছি না। তার মধ্যে এমন করল?”

“তুমি এখন, এই নিয়ে ভাবতে বসো না। যাও হাত পা ধুয়ে পোশাক পাল্টে এসো। আমি ভাত বাড়ি।”

সে রাতে জনার্দন ভালো করে খেতেও পারল না। ঘুরেফিরে ওর মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই চিন্তা, ওকে এমন অবস্থায় দেখেও চোরের চুরি করতে ইচ্ছে হল!

পরের কয়েকদিন জনার্দন আর দোকানে যায় না। তৃপ্তিও বলেছে, “হাত ঠিক হোক, তারপর আবার ট্রেন চড়বে।”

জনার্দন শুধু ট্রেনে চড়া নয়, বাইরের মানুষের মুখোমুখি হতেই ভয় পাচ্ছে। 

ইতমধ্যে ফোন চুরির ঘটনাটার কথা রতনের কানে যায়। একদিন সকালবেলায় সে এসে হাজির, “কীরে? তোর নাকি ফোন চুরি গেছে?”

জনার্দন সম্পূর্ণ ঘটনাটার বিবরণ দেয়, ট্রেনের কামরা থেকে আর-পি-এফ পর্যন্ত। সব শুনে রতন বলে, “পুলিশের কাছে ওইভাবে গেলে কোন লাভ হবে না। আমি দেখছি।”

“তুই আবার কী করবি?”

“কিছু না। তুই তো ফোনের শোকে ঘর বন্দি হয়ে বসে আছিস। দেখি কী করতে পারি? তবে কিছু খরচা আছে।”

“কত?”

“খোঁজ নিয়ে বলছি।”

এই বলে, রতন ফোন বার করে, কার সাথে যেন কথা বলে। তারপর ফোন রেখে জনার্দনকে বলে, “আজকাল কিছু সৎ লোক সিস্টেম ঢুকে গেছে, কাজ করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

জনার্দন বুঝতে পারে না।

রতন আবার বলে, “আগে সব লিঙ্ক করা থাকতো, কোন পকেটমার কোন লাইনে কাজ করছে? ওরা নিজেদের মতো অপারেশন করে, ঠিক জায়গা মতো পুজো পৌঁছে দিত। এখন কয়েকজন সতী এসে ব্যালেন্স নষ্ট করে দিচ্ছে।”

“কী বলছিস, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।”

“তোকে কিছু বুঝতে হবে না। পুলিশ ধরে চেষ্টা করলাম, হচ্ছে না। এবার রামবাবুকে ধরতে হবে।”

“রামবাবু কে?”

রতন একটা ফিচেল হাসি দেয়, “রামবাবু একজন লাইফার।”

“লাইফার মানে?”

“আরে! লাইফার জানিস না? যবজ্জীবন খাটছে।”

“সেকী? কেন?”

“কেন আবার? মার্ডার!”

উত্তর শুনে জনার্দন বেশ ভয় পেয়ে যায়, “তুই ওকে চিনলি কী করে?”

“আমি একবার ওই জেল-এ ছমাস কাটিয়েছি।”

“ও বাবা! থাক! আমার ফোন পেয়ে কাজ নেই।”

রতন একটু বিরক্ত হয়। “এত ভীতু মাল! যে বলার নয়।” বন্ধুর কাছে একটু ওর হাত যশ দেখানোর সুযোগ এসেছে, সেটা নষ্ট করতে মন চাইছে না। আবার বলে, “তুই অত ভাবিস না। আমি দেখছি।”

রতন বাইরে এসে আবার কয়েকটা ফোন করে। তারপর খুব গম্ভীর হয়ে ঘরে আসে, “রামবাবুর সঙ্গে কথা হল।”

“সে তো জেল খাটছে, বললি।”

“হ্যাঁ, জেল-এই আছে।”

“তাহলে ফোনে পেলি কী করে?”

রতন হেসে ফেলে, “রামবাবুর কত ক্ষমতা তোর কোন ধারনাই নেই। পুলিশ যা করতে পারেনি, রামবাবু তিন মিনিটে তা করে দিয়েছে।”

জনার্দন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। রতন আবার বলে, “রাঘবপুরের ঠেক-এ সেদিন সাতটা মোবাইল জমা পড়েছে। এখনও সেগুলো বিক্রি হয়নি। তুই চাইলে তোরটা ফেরত পাবি, তবে আট হাজার টাকা লাগবে।”

টাকার অঙ্ক শুনে হাঁ হয়ে যায়, “দুই বছর আগে ওই ফোন কিনেছিলাম সাড়ে ন’হাজার টাকা দিয়ে, এখন সেই ফোন আবার আট হাজার দিয়ে যদি ফেরত নিতে হয়, তবে থাক।”

অগত্যা রতন আর কী করে! উপকারের সুযোগ হাতছাড়া হতে, ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।  

জনার্দনের সে রাতেও ঘুম আসে না। মাঝরাতে তৃপ্তি উঠে দেখে, একা একা বারান্দায় বসে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এখানে বসে?”

“ঘুম আসছে না।”

“কেন? ফোনের শোকে?”

সকালে রতন এসে যে ফোন উদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছিল, খুলে বলে। “জেলের ভিতর থাকা কয়েদীর কথায় ফোন ফেরত আসবে। তার মানে, পড়াশুনা জানা শিক্ষিত পুলিশের দাম কয়েদীর চেয়েও কম।”

তৃপ্তি বলে, “তুমি এতো ভেবো না তো। আমি ছেলেকে বলেছি। ও তোমার জন্য অ্যামাজনে ফোন বুক করে দিয়েছে। আজকালের মধ্যেই পেয়ে যাবে।”

“তুমি আবার বাবুনকে বলেছো কেন? শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করবে।”

“কিছু শুধু শুধু নয়। বাবার জন্য করবে না তো, কার জন্য করবে?”

“আমার, ওদের জন্যেই চিন্তা বেশি হয়। আমরা তো জীবন কাটিয়ে দিলাম। ওরা কাকে বিশ্বাস করবে?”

“অবিশ্বাসের কী হল? একটা চোরের জন্য তোমার এত অশান্তি কেন? লোকটা সৎ নয় বলেই তো অপরাধী।”

“আবার দেখো, অপরাধীর ক্ষমতা, শিক্ষিত পুলিশের চেয়েও বেশি।”

“চোর বা পুলিশ কাউকেই বিশ্বাস করতে হবে না।”

“কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো যে পাপ।”

“এত রাতে আর জ্ঞানের কথা বলতে হবে না। তুমি শুতে চলো।”

কয়েকদিনে মধ্যে নতুন ফোন এসে গেল। ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্লাস্টার কাটানোও হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে জনার্দন দৈনন্দিন রুটিনে ফিরছে। আবার দোকানে যেতে শুরু করেছে। রাতের ট্রেনে লড়াই করে ঘরে ফিরছে। 

সেদিন ট্রেনে গাছপাকা হিমসাগর দেখে প্রায় তিন কেজি মতো কিনে ফেলে। হকার ছেলেটি বেশ মজার মজার কথা বলছিল। কামরার অন্যান্য যাত্রীরাও উপভোগ করছিল। নানা কিসিমের গল্প করতে করতে কখন যে নিজের স্টেশন এসে গেছে, খেয়াল হয়নি। দুদ্দাড় করে ব্যাগ নিয়ে নিচে নামে। তারপরেই হুঁশ হয়, আমের থলিটা হকারের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি, ততক্ষণে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরে, আবার মুখ কালো করে বসে থাকে। তৃপ্তি বলে, “এতো মহা জ্বালা হল। দুদিন অন্তর তোমাকে কেউ ঠকিয়ে দেবে, আর তুমি ঘরে এসে মানুষের বিশ্বাস নিয়ে হা হুতাশ করবে। সময়টাই এমন, তোমাকে মেনে নিতে হবে। বাইরের পৃথিবী আমাদের ঠকানোর জন্য ওত পেতে রয়েছে। এটা মানিয়ে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।”

সে রাতেও জনার্দনের ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল। কিন্তু কষ্টের কথা আর তৃপ্তিকে বলতে ইচ্ছে করলনা। সকালে বসার ঘরে বসে কাগজে চোখ বোলাচ্ছে, তখন একজন উঠোনের গেট ঠেলে ঢুকে জানর্দনের নাম করে ডাকে। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে একটি বছর তিরিশের যুবক, হাতে একটা থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে। 

জনার্দনের চিনতে কিছুটা সময় লাগে। একজন মানুষকে তার পরিচিত জায়গার বাইরে, ‌অন্য পোশাকে দেখলে, প্রথমে চিনতে অসুবিধেই হয়। একটু পরেই বুঝতে পারে গতরাতে ট্রেনের সেই আম-এর ফেরিওয়ালা।

জনার্দনকে দেখে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে, “আরে! আপনি আম ফেলেই নেমে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে আমিও খেয়াল করিনি। তরপর অন্যান্য ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে কথা বলে, কত কান্ড করে আপনার খোঁজ পেলাম।”

জনার্দন কোন মতে বলে, “তুমি ভাই, ভেতরে এসো।” তারপর গলা উঁচিয়ে তৃপ্তিকে বলে, “আরেক কাপ চা পাঠিও।”

ভেতর থেকে তৃপ্তি বলে, “কে এসেছে?”

জনার্দন গদগদ স্বরে বলে, “মানুষ এসেছে।”

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


4.8 4 votes
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shouvik
Shouvik
3 months ago

সাধারণ কখন অসাধারন হয়ে যায়, কখন কি মোচড় দিতে হয় ঘটনায়, সে শিল্প সৌরভের করায়ত্ত। ঠিক যখন কেউ ভাবছেন এ গায়কের গলায় বাঁধা কিছু সরগম ছাড়া কিছু নেই … হঠাৎ সপাট টান মেরে দিলেন তিনি। করতালির হাত উঠে যায় অজান্তে।

Prasenjit Sinha
Prasenjit Sinha
3 months ago

খুব সুন্দর গল্প। ভরসা ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প। কলম চলতে থাকুক আপনার।

Saurabh Pal
Saurabh Pal
3 months ago

অন্ধকারে আলোর রেখা। ভালো লাগলো গল্পটি।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
3 months ago

গতানুগতিক দিনযাপনের মধ্যে কত যে আলোআঁধারির খেলা চলে তারই একটা খণ্ডচিত্র এই গল্প।হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে গল্পের পরিসমাপ্তি।খুব ভাল লাগল।