শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

গায়ক রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সংরক্ষিত কন্ঠ

আমাদের একটি দুঃখ কোনোদিন যাবেনা, যে দাপুটে কণ্ঠে ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে বিডন স্কোয়ারে কংগ্রেসের অধিবেশনে যুবক রবীন্দ্রনাথ বিনা মাইক্রোফোনে শুধু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিয়ানো বাদনের সঙ্গে ‘বন্দে-মাতরম’ গানটি গেয়ে প্রায় দশহাজার দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ এবংউদ্দীপ্ত করেছিলেন, সেই কন্ঠটিকে কোনো প্রযুক্তি দিয়ে ধরে রাখা যায় নি।
কিম্বা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে যে কণ্ঠের গান শুনে ’রবিরশ্মি’ বইয়ের লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সভা ছেড়ে উঠে যেতে যেতে সভাগৃহের দরজায় আটকে গিয়েছিলেন, আর পরে সেই দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছিলেন – “ হঠাৎ আমার কানে অশ্রূতপূর্ব মধুর কণ্ঠের স্বরমূর্ছনা ভেসে এসে প্রবেশ করল, আমি অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত এক অতীন্দ্রিয় রাজ্যে নীত হয়ে চট করে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখলাম রবিবাবু গান আরম্ভ করেছেন। … দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েই মন্ত্রমুগ্ধ স্তম্ভিতের মতন গান শুনিতে লাগলাম। সে যেন মনুষ্যের কণ্ঠস্বর নয়। যেমন মধুর, তেমনি তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট আর গানের ভাষা সুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। তিনি সেদিন গাইলেন – আমায় বোলোনা গাহিতে বোলো না।” চারুবাবুর শোনা সেই কন্ঠটিও যন্ত্র দিয়ে ধরে রাখা যায়নি।

তরুণ রবীন্দ্রনাথ

কিম্বা ১৮৭৫ সালে হিন্দু মেলায় নবীন চন্দ্র সেন যে বালক রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আবৃত্তি ও গান শুনে তাঁর জীবনীতে লিখেছিলেন – ‘মধুর কামিনীলাঞ্ছন কন্ঠ এবং কবিতার মাধুর্যে ও স্ফুটোন্মুখ প্রতিভায় আমি মুগ্ধ হইলাম; তাহার দুই একদিন পরে বাবু অক্ষয় চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার চুঁচুড়ার বাড়িতে লইয়া গেলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে ন্যাশানাল মেলায় গিয়া একটি অপূর্ব নবযুবকের গীত ও কবিতা শুনিয়াছি এবং আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে তিনি একদিন একজন প্রতিভাসম্পন্ন কবি ও গায়ক হইবেন। অক্ষয়বাবু বলিলেন – “ কে ? রবি ঠাকুর বুঝি? ও ঠাকুরবাড়ির কাঁচামিঠে আঁব। “
নবীন চন্দ্রের শোনা সেই কামিনীলাঞ্ছন কন্ঠও আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে।
অবশ্য একটু অন্যরকম ভাবে ভাবলে এটাও মনে হতে পারে , আমাদের বঙ্গদেশের অনেক প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত ব্যাক্তিত্ব যাদের কন্ঠ নিয়ে নানান মিথ চালু আছে, তাঁদের কন্ঠ তো রেকর্ডে ধরাই যায়নি। যেমন কমলাকান্ত, রামপ্রসাদ, দাশরথী রায়, শ্রীধর কথক, মধু কান, নিধুবাবু, কালীমির্জা, গোপালউড়ে, লালন ফকির, যদুভট্ট ইত্যাদি ।
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অন্তত আমরা খানিকটা তো রেকর্ডে ধরতে পেরেছি। হয়ত তাঁর কন্ঠ সেই সময়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল না। যদি থমাস এডিসন তাঁর শব্দ ধরার প্রযুক্তি আবিস্কার করতে আরো কয়েকবছর দেরী করে করে ফেলতেন, অথবা গেইসবার্গের দলবল এ দেশে রেকর্ডের ব্যবসা খুলতে যদি আরো কয়েক বছর পরে আসতেন তাহলে হয়ত আমাদের সেই প্রাপ্তিটুকুও ঘটত না ।
আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ তাঁর মধ্য বয়সের কোনো একটা সময়ে কোনো কারণে জখম হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেই বিষয়ে অনেকবার আক্ষেপ করেছেন। তবে ঠিক কি ভাবে এবং কোন সময়ে তাঁর কন্ঠের অবমনন ঘটেছিল তা আমরা জানতে পারি না ।
রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতিতে তিনি একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। তিনি জানাচ্ছেন – “একবার তিনি এক জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন – সভাপতি স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । সভায় তিল ধারণের জায়গা ছিল না , লোকে লোকারণ্য। দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে গিয়ে গলার উপর বিস্তর অত্যাচার করতে হল । বক্তৃতার পর সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী “গান’ গান’ বলে বিস্তর চেঁচামিচি শুরু করে দিলেন। দেঢ় ঘন্টা ধরে চেঁচিয়ে বক্তৃতা দেবার পর, বাবার গান গাইবার মত অবস্থা ছিল না। কিন্তু বঙ্কিমবাবু স্বয়ং যখন অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাবার গান শোনবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন তিনি কী করে আর না বলেন । বাবার গান গাওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ – যেমন সুরেলা গলা তেমনি তার জোর । কিন্তু এবারকার অত্যাচারে গলা এমন জখম হল যে আর কখনো সম্পূর্ণ সেরে উঠল না। কিছুদিন হাওয়া বদল ও বিশ্রামের জন্য বাবা সিমলা গেলেন, কিন্তু তাঁর সেই গানের গলা আর ফিরে পেলেন না। “
এখানে একটা প্রশ্ন জাগে বঙ্কিমচন্দ্র যখন প্রয়াত হন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স তেত্রিশ । তা হলে কি ধরে নেওয়া যাবে তেত্রিশ বছর বয়সের আগেই রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ জখম হয়ে ছিল ?
অথচ এর আগে এই নিবন্ধে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যের ইউনিভারসিটি ইন্সটিটিউট সভাগৃহে রবীন্দ্রনাথের গান শোনার যে অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখিত হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স পয়ঁত্রিশ বছর ।
আবার প্রতিমা দেবীর একটি স্মৃতিচারণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ একবার একটু দুঃখ করে বলেছিলেন –
‘আমার অল্প বয়সের সে গলা আর নেই । তোমাদের এখন আর কি শোনাব? পেয়েছিলাম বটে একটা গলার মত গলা। কিন্তু ভগবান কেড়ে নিয়েছেন, এখন কি আর গাইতে ইচ্ছে করে ? সেই শেষ গেয়েছিলাম তারকবাবুর বাড়িতে কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে । সেদিন বলতে কি নিজের দেশ ও জাতির উপর ধিক্কারে রাগ করেই । সেই সভাতেই সুর বসিয়ে গলা ছেড়ে দিয়েছিলুম –
“আমায় বোলোনা গাহিতে বোলোনা !
একি হাসি খেলা প্রমোদের মেলা
শুধু মিছে কথা ছলনা !”
গলার মত গলা সর্বসাধারণকে সেই শুনিয়েছি । তখন মধ্যম ধরে ছেড়ে দিতুম সুর । পাখির মত সে উড়ে চলত সুরের ধাপে ধাপে পর্দায় পর্দায় ।’
এই ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স তিরিশের ঘরে ।
কিন্তু এর পরেও তাঁর গান শুনে দেশে বিদেশে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন তা আমরা নানান স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারছি ।
একেবারে ছোটোবেলায় তাঁর কন্ঠ কেমন ছিল তার উল্লেখ পাচ্ছি শ্রী অমল হোমের স্মৃতিকথায় । – “…মনে পড়ছে সেই যেদিন প্রথম রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তাঁর গান শুনেছিলুম। আজ থেকে ৫৫ বছর আগে । সেদিন ছিল তাঁর পিতৃদেব মহর্ষির জন্মদিন। তখন প্রতি বৎসর সেই বিশেষ দিনটি তাঁর পুত্র-কন্যারা তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উৎসব সমারোহে পালন করতেন। …জ্যেষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর দুই কনিষ্ঠ সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে দু-পাশে নিয়ে বসেছেন আচার্যের আসনে। আর গায়কদের মধ্যে অর্গানে বসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। উপাসনা শেষে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন গিয়ে অর্গানের কাছে। গান ধরলেন, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।’ …যিনি সেই ১৯০৩ এর রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, তাঁর সে-কন্ঠের গান শুনেছেন, তাঁরাই শুধু মনে করতে পারবেন তাঁর সেদিনের রূপমূর্তি, তাঁর সেকালের গানের কথা। …মনে হল, দিব্য জ্যোতির্ময় পুরুষের সে-গান প্রাঙ্গণশীর্ষে বিস্তৃত চন্দ্রৎতপের বাধা ভেদ করে কোথা যে উধাও হল ঊর্ধ্ব আকাশে। …”
সতেরো বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ‘ঘরোয়া’ বইতে সেই স্মৃতি ধরা আছে -“আমরা তখন ছোট ছোট ছেলে। এক-একদিন বেড়াতে যেতুম ফরাশডাঙার বাগানে যেমন ছেলেরা যায় বুড়োদের সঙ্গে। সেই একদিনের কথা বলছি। তখন মাসটা কি মনে পড়ছে না, খুব সম্ভব বৈশাখ। আমের সময়। বসে আছি বাগানে। খুব আম-টাম খাওয়া হল। রীতিমত পেটের সেবা করে তারপর গান। জ্যোতিকাকামশায় বললেন, ‘রবি গান গাও।’ গান হলেই রবির গান হবে। আমি তখন সাত-আট বছরের ছেলে, রবিকাকার দশ বছরের ছোট। ওঁর তখন সতেরো বছর। সেই গানটা হল –‘ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’ গঙ্গার ধারে জ্যোতিকাকামশায় হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, প্রথম সেই গান শুনলুম, সে-সুর এখনো কানে লেগে রয়েছে। কী চমৎকার লাগলো। … “

গায়ক রবীন্দ্রনাথ ও এস্রাজ বাদক অবনীন্দ্রনাথ

এর কিছুকাল পরে আবার অবনীন্দ্রনাথ আর এক জায়গায় লিখেছিলেন – তখন ‘খামখেয়ালি’র যুগে রবিকাকাকে দেখেছি কবিত্বের ঐশ্বর্য্য ফুটে বের হচ্ছে, চারিদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়িতেও তিনি সবার আদরের । কাকামশায় (গুণেন্দ্রনাথ) যখন সভার মজলিশে ‘রবির গান হোক’ বলতেন, তখন সে যে কী স্নেহের সুর ঝরে পড়ত। তখন রবিকাকার গাইবার গলা কী ছিল চারিদিক গমগম করত । বাড়িতে একটা কিছু হলে ‘রবির গান’ নাহলে চলত না । আমি ছিলুম রবিকাকার অ্যাডমায়ারার।”
প্রতিমা দেবী (তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হননি) একটি পারিবারিক বিয়েবাড়িতে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের গান শোনার অভিজ্ঞতার এক মনোরম বর্ননা আমরা পাই তাঁর ‘স্মৃতিচিত্র’ গ্রন্থে ।
“ – সন্ধ্যার সময় সেদিন ছিল অভিনব আয়োজন । ছোটো ছেলেদের কৌতূহলী দৃষ্টি জিজ্ঞাসা করছিল , ‘আজ আবার কি হবে ‘ । বড়দের মুখে শোনা গেল ‘আজ রবিকাকার গান হবে । ‘ বাড়ির মেয়েরা ও প্রতিবেশিনীরা একদিকে জালের পর্দার আড়ালে এসে উঁকি মারছে সকৌতুকে । সকলেই গান শোনবার জন্যে উৎসুক । আসর ক্রমে ক্রমে ভরে উঠছে দেখা গেল একজন দীর্ঘকায় বিশিষ্ট চেহারার ব্যাক্তি কালো ফিতের ঝোলানো চশমা পরে সভায় এসে বসলেন । তাঁর বিশিষ্টতা সভার আবহাওয়ার মধ্যে যেন সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলল । সকলের অনুরোধে তিনি যে গান শুরু করলেন সেটি যতদূর মনে পড়ে ‘যামিনী না যেতে জাগালি না কেন ’ । গানের সুরের ধারা শ্রোতাদের অন্তর গভীর ভাবে স্পর্শ করল। স্তব্ধতায় তাদের চিত্ত হল নম্র। শিশুরা অবাক হয়ে রইল থমকে, এতো যে সে গলা নয়, যা তারা কদিন ধরে শুনে আসছে। এ যেন নতুন স্বর তারা প্রথম শুনল এই পৃথিবীতে যেন তাঁদের কাছে মর্ত্যলোকের নতুন পরিচয় উৎসবের শেষ সন্ধ্যায় সার্থক হল। এমনি করেই সেদিন বিবাহের উদ্দাম উৎসব-স্রোতে কেমন যেন অনির্বচনীয়র স্পর্শ লেগেছে অকস্মাৎ।“

রবীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী

প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধুস্থানীয় ছিলেন । তাঁর কন্যা সীতা দেবী রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন । কলকাতায় এবং শান্তিনিকেতনে তিনি কবির সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন । সেই সব স্মৃতি তিনি ‘পুণ্যস্মৃতি’ নামের একটি গ্রন্থে লিখে যান । এক জায়গায় তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন , যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি । এক জোৎস্না রাত্রে শান্তিনিকেতনে এক পারুলবনে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে তাঁর প্রায় পথভ্রষ্টই হয়ে গিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব দিলেন এখানে বসে গান ধরা যাক , তাহলে অন্যরা বুঝবে আমরা কোথায় আছি । সেখাণে যে সব মহিলারা ছিল , তারা কেউ গান গাইতে রাজী না হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি হিন্দি গান ধরলেন । এই গান সম্মন্ধে সীতা দেবী লিখছেন – ‘যাঁহারা সেকালে তাঁহার গান না শুনিয়াছেন তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন না যে তাঁহার কণ্ঠ কতখানি মধুর ও শক্তিশালী ছিল। সেই দিগন্তবিস্তৃত মাঠ তাঁহার একার কণ্ঠস্বরে কাঁপিয়া উঠিতেছিল’।
পঞ্চাশ পেরিয়েও রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের খবর পাওয়া যায় রামগড় পাহাড়ে, রথীন্দ্রনাথের কথায়, ‘বাবার তখনো গান গাইবার গলা ছিল। ঘরের বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে গাইতেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে গাছপালা পাহাড় যেন কেঁপে উঠত’।

ফাল্গুনী নাটকে অন্ধবাউলের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ যখন ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ষাট পেরিয়েছে । রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় তার বিবরণ দিয়েছেন এই ভাবে –
“দর্শকদের সবচেয়ে অভিভূত করে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় বাবার গান ও অভিনয়। বাবার গানের গলায় তখনো বেশ জোর ছিল , ‘ধীরে বন্ধু , ধীরে ধীরে’ এই গান গাইতে গাইতে বাবা অন্ধকার গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন , গানের রেশ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, তখন দর্শকদের আত্মসম্বরন করা কঠিন হয়ে উঠল।”
এ পর্যন্ত যাঁদের কথা উল্লেখ করা হল তারা সবাই রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ এবং গুণমুগ্ধ, এবার এক বিদেশিনীর কথা শোনা যাক । উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে ডেম ক্লারা বাট নামের একজন অত্যন্ত খ্যাতিময়ী এবং জনপ্রিয় কনসার্ট গায়িকা ছিলেন, যাঁর গান রবীন্দ্রনাথ খুব পছন্দ করতেন । ১৯২৮ সালে তিনি যখন প্রাচ্য দেশে যখন একটি কনসার্ট ট্যুর-এ আসেন তখন তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যান । তিনি সে সময় রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসে তাঁর গান শোনান । রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গানের ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন, তখন ক্লারা রবীন্দ্রনাথের গান শুনবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন । প্রাথমিক আপত্তি থাকা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ এই বিদেশিনীকে গান শুনিয়েছিলেন । ক্লারা বাট তাঁর স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথের গান শোনার অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে লেখেন – “কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই তিনি তাঁর নিজের দু-তিনটি গান শোনালেন। …তাঁর কণ্ঠস্বর কিছুটা অপ্রশিক্ষিত মনে হলেও তাঁর গানের মতন প্রাণঢালা স্নিগ্ধ উপস্থাপনা আমি তার আগে তেমন শুনিনি।”

রেকর্ডিং যন্ত্র

এ দেশে রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে । ১৯০২ সালে ফ্রেডরিক গেইসবার্গ নামের এক সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ভারতীয় সংগীত রেকর্ড করার অভিপ্রায় নিয়ে ভারতে আসেন এবং গউহর জান , পিয়ারা সাহেব এই রকম কয়েকজনের গান রেকর্ড করে নিয়ে জার্মানির হ্যানোভার থেকে রেকর্ড আকারে প্রকাশিত করে এ দেশে বিক্রির ব্যবস্থা করেন । তবে এর অনেক আগেই অবশ্য ফোনোগ্রাফ যন্ত্র এ দেশে এসেছিল ।
১৮৭৯ সালে এ এদেশে প্রথম ফোনোগ্রাফ যন্ত্রটি নিয়ে আসেন জনৈক স্যামুয়েল হারাডেন । ১৮৯১ সালে জগদীশচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি ফোনোগ্রাফ যন্ত্র স্থাপন করেন । সেই যন্ত্রে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডিং করেছিলেন । সে রেকর্ডিং-এর যে কণ্ঠ ধরা হয়েছিল সেটি রবীন্দ্রনাথের আঠাশ উনত্রিশ বছর বয়সের গলা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই রেকর্ডিং নষ্ট হয়ে যায়।
এই নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে একটি মজার গল্প পাওয়া যায় যা ‘পরিচারিকা’ পত্রিকাতে বেরিয়েছিল যেটি উদ্ধার করে প্রশান্ত পাল মশাই রবিজীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । ঘটনাটি এই রকম –
“ প্রেসিডেন্সি কলেজে যে যন্ত্রখানি (ফোনোগ্রাফ) আসিয়াছে., বিজ্ঞানের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত জগদীশ চন্দ্র বসু তন্মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের গায়ক গায়িকা কয়টি নরনারীর গীত সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছেন । … এ সম্বন্ধে একটি বড়ই তামাসা ঘটিয়া গিয়াছে । কোন বাবু কুকুর, বিড়াল পাখীর ডাক ডাকিয়াছিলেন, একটি নলে তাহা রক্ষিত ছিল। পরে ঐ নলে বাবু রবীন্দ্রনাথ কণ্ঠস্বরে শুদ্ধ ঈশ্বরের মহিমা প্রতিপাদক একটি গান রাখা হয়। একদিন যন্ত্রটি ঐ গান গাইতেছিল । শ্রোতাগণ শুনিতেছিল । গান গাইতে গাইতে হটাৎ তাহার ভিতর হইতে ঘেউ ঘেই রবে কুকুরের শব্দ বাহির হইয়া পড়িল । কোথায় ঈশ্বরের মহিমা সঙ্গীত আর কোথায় কুকুরের শব্দ । পূর্ব রক্ষিত কুকুরের ডাক ভালো করিয়া মুছিয়া ফেলা হয় নাই , এই জন্য কুকুর ডাকিয়া উঠে।
এদিকে সাহেব কোম্পানিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে কয়েকজন বাঙালি রেকর্ড ব্যবসায় তখন নেমে পড়েছিলেন তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেমেন্দ্র কুমার বোস । ১৯০৬ সালে তিনি ফোনোগ্র্যাফ রেকর্ডিং যন্ত্র এবং সিলিন্ডার রেকর্ডিং বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন , দি টকিং মেশিন নামের একটি সংস্থা খুলে।

হেমেন্দ্র কুমার বোস

তাঁর রেকর্ডের ব্র্যান্ডের নাম দেন প্যাথিফোন । প্যাথিফোন রেকর্ডের প্রথম যে রেকর্ডের তালিকা আমরা পাচ্ছি তাতে প্রথম নাম – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
তখন রেকর্ড হত ১১ ইঞ্চি সাইজের । রবীন্দ্রনাথের দুটি রেকর্ডে একটিতে তিনি বন্দেমাতরম গানটি গেয়েছিলেন অন্যটিতে ‘সোনার তরী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।
এই রেকর্ডের বিজ্ঞাপনে এইচ এল বোস যা লিখেছিলেন সেটিও বেশ প্রণিধানযোগ্য । “স্বনামধন্য কবিকুলশ্রেষ্ঠ সুকণ্ঠ রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আর কি দিব? বঙ্গের গৃহে গৃহে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই রবিবাবুর সর্বতোমুখী প্রতিভা ও যশোরাশির বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন । কোন সভায় বা সাধারণ উৎসব ক্ষেত্রে তাঁহার কন্ঠনিঃসৃত সঙ্গীতলহরী শ্রবণ করিবার আশায় লোকে এককালে উন্মত্ত হইয়া ছুটিত । আমরা যে সেই রবীন্দ্রনাথের কলকণ্ঠ রেকর্ড করিয়া চিরস্থায়ী করিতে পারিয়াছি এই আমাদের পরম সৌভাগ্য । তাঁহার কণ্ঠ গৃহে বসিয়া শুনিবার কাহার না লালসা হয় ? আমাদের কাছে তাঁহার দুটি মাত্র রেকর্ড আছে।“

হেমেন্দ্র কুমার বোসের রেকর্ডের বিজ্ঞাপন

তবে এইচ এল বোসের কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আর অনেকগুলি গান রেকর্ড করেছিল। তার মধ্যে বেশির ভাগ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত রবীন্দ্রনাথের গানগুলি । এর মধ্যে কিছু গান সিলিন্ডারে রেকর্ড করা হয়েছিল। বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সরকারের পুলিশ এইচ এল বোসের বাড়িতে হানা দিয়ে অনেক মূল্যবান রেকর্ড করা সিলিন্ডার নষ্ট করে দেয়। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ ধরে রাখা আছে এমন কিছু সিলিন্ডার এইচ এল বোস, তাঁর ফ্রান্সের সহযোগী কোম্পানি প্যাথিকে দিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করা করেছিলেন । কিন্তু প্যাথি কোম্পানি সেই সময় তাদের রেকর্ডের ব্যবসা গুটিয়ে সিনেমার ব্যবসা করতে শুরু করে দেয় । তাই রবীন্দ্রনাথের সে কণ্ঠ আর উদ্ধার করা যায় নি।
যে সব বাঙালি সেই সময়ে রেকর্ড ব্যবসায় নামে তার মধ্যে আরএকজন ছিলেন চন্ডী চরণ সাহা নামের এক যুবক , যিনি জার্মান এবং ইংল্যান্ডে গিয়ে রেকর্ডিং বিদ্যা শিখে এসে ১৯৩০ সালে একটি রেকর্ড কোম্পানি খোলেন যার নাম দেন হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যাণ্ড ভেরাইটিস সিন্ডিকেট লিমিটেড । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবীকে শান্তিনিকেতন থেকে লিখিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – ‘একজন ভদ্রলোক সুর ধরবার বিদ্যা ইয়োরোপে শিখে এসেছেন। তিনি এখানে এসেছেন আমার কন্ঠ থেকে কিছু আদায় করবার প্রস্তাব নিয়ে।’ এই ভদ্রলোকই হলেন চন্ডীচরণ সাহা ।
৫ই এপ্রিল ১৯৩২ সালে হিন্দুস্তান কোম্পানি তাদের রেকর্ড ব্যবসা প্রথম শুরু করেন রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে কবিতা এবং গান রেকর্ডিং দিয়ে। প্রথম রেকর্ডিং এ ছিলও একদিকে – ‘আমি যখন হব বাবার মত বড়’ এই কবিতাটি এবং অন্য পিঠে ছিল – ‘তবু মনে রেখো’ এই গান। এর পরেও হিন্দুস্থান কোম্পানি আরও কয়েকটি রেকর্ড করেন রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ ধরে।

রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড

১৯৩৯ সালে শেষ বার এই কোম্পানি কবির কন্ঠ রেকর্ড করেন । এই সময়ে হিন্দুস্থান কোম্পানির রেকর্ড করার যন্ত্রবিদ ছিলেন নীরদ বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর স্মৃতি কথায় তিনি এই রেকর্ডিং নিয়ে একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন ।
“আমার জীবনে সৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ দুটি আবৃত্তি রেকর্ড করার । এই দুটি আবৃত্তির মধ্যে, যতদূর মনে পড়ছে একটি হল ‘সোনার তরী’। আর একটি হল ছোট্ট বীরপুরুষের কাহিনী । ‘ ১৩৩৯ সনের নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি । আমাদের এই স্টুডিওতে (হিন্দুস্থান) কবি পদধুলি দিলেন । হেমন্তকালের বিষণ্ণ সময় । তাঁর সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সমস্ত পরিচালকবর্গ ছিলেন । আর রেকর্ড করার জন্যে আমিও ছিলাম । …’
কবি এলেন । শরীর অত্যন্ত অশক্ত । তিনি আমাদের কাছে এলেন … । এবং আমরা যখন রেকর্ড করি… তখন একটা অদ্ভুত রকম ঘটনা ঘটেছিল। তখনকার দিনে তো টেপ রেকর্ডার ছিল না এবং যেটা ফাইনাল রেকর্ড করা হল সেটা আর কোনোরকমভাবে আর বাজানো সম্ভবপর ছিল না । সমস্তটা কবি আবৃত্তি করলেন এবং আমরা তাঁকে আবার বাজিয়ে শোনালাম । শুনবার পর তিনি বললেন ‘বাঃ, বড় সুন্দর হয়েছে তো !’
তা শুনে বুলাদা (প্রফুল্লচন্দ্র মহালনবিশ ) বললেন আপনাকে ওটা আর একবার বলতে হবে । কবি বললেন, কেন , ভালোই তো হয়েছে । তখন কবিকে বুলাদা বললেন ওটা টেস্ট হয়েছে, এবার আমরা ফাইন্যাল রেকর্ডিং করব । তারপর কবি একটুখানি কপট ক্রোধের সঙ্গে বললেন – বুলা, আজ আমার আশি বছর বয়স হল । তা এই আশি বছর বয়সে আমাকে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমাকে ফাইন্যালে বসতে হবে। এ তুই কি করলি ! বুড়োর উপর এতখানি অবিচার করছিস কেন?”
তারপরে অবশ্য রেকর্ড করা ভালো ভাবেই শেষ হয়েছিল।

হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীর স্টুডিয়োতে রবীন্দ্রনাথ

আর একটি কৌতুকপদ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রখ্যাত গীতিকার হীরেন বসুর ‘জাতিস্মরের শিল্পলোক’ গ্রন্থে । এটি ১৯২৬ সালের ঘটনা । বেলেঘাটায় গ্রামাফোন কোম্পানীর ইলেক্ট্রিক্যাল রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হবার দিন সেখানে রবীন্দ্রনাথকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । হীরেনবাবু লিখছেন –
‘ রবীন্দ্রনাথ এসে হাজির হলেন । সবাই তাঁকে স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা করলেন । মিঃ কুপার ( জেনারাল ম্যানেজার) নিজে তাঁকে সঙ্গে করে ফ্যাক্টরি ঘুরিয়ে এনে রেকর্ডিং রুমে বসালেন । কবির সঙ্গে গেছেন শ্রীযুক্ত প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবিশ। কবি করবেন রেকর্ডিং মেশিনের উদ্বোধন নিজকন্ঠে আবৃত্তি দিয়ে । লাল আলো জ্বলে উঠতে ভট্টাচার্যি মশাই ইসারায় শুরু করতে জানান। রবীন্দ্রনাথ বললেন – ‘শুরু করি?’
ভট্টাচার্যি মশাই বললেন – এটা নষ্ট হয়ে গেল । লাল আলো জ্বলে গেলে আর আপনি কথা বলবেন না , একেবারে শুরু করে দেবেন ।
আবার সব রেডি। লাল আলো জ্বলে উঠল । রবীন্দ্রনাথকে ইশারা করে ভট্টাচার্যি মশাই জানিয়ে দেন।
রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন – ‘প্রশান্ত তুমি আমার পাশটিতে এসে বোসো।‘
লজ্জিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন এটাও নষ্ট করলেম তো? একটু নার্ভাস অনুভব করছিলাম, প্রশান্তকে কাছে ডাকলাম ।
আবার শুরু । এবার অনবদ্য ভাবেই কবি তাঁর আবৃত্তি শেষ করলেন। মাঝে একটু আধটু গলা খাকরি নম্রভাবে রেকর্ড হয়ে গেছল। তাতে কিছু আসে যায় না। “

প্রশান্ত মহালনবিশ ও রবীন্দ্রনাথ

আসলে মাইকের প্রযুক্তি যখন এ দেশে আসেনি তখন গায়ক গায়িকাদের কন্ঠ পুরোপুরি উন্মোচন করে গাইতে হত । ভোক্যাল কর্ডের উপর চাপ পড়ত । রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মসমাজে এবং নানান সভা সমিতিতেই গান গাইতে হত । এবং গান গাইতে যে তিনি নিজেও খুব ভালোবাসতেন এটা আমরা অনেকের স্মৃতিচারণ থেকেই বুঝতে পারি । তাতেই তাঁর কন্ঠ জখম হয়ে যায় । তবে তা সত্বেও গান গাইবার সুযোগ যখনই এসেছে তখন তাঁকে আর বিরত করা যায় নি ।
এ দেশে যখন কিছুটা উন্নত রেকর্ড করার প্রযুক্তি এ দেশে এলো তখন তাঁর বয়স ষাট পেরিয়েছে ।
প্রথম দিকে এই সব রেকর্ড কোম্পানিগুলি এসে যখন ব্যবসা শুরু করে তখন এই ক্ষেত্রটি একেবারেই অসংগঠিত ছিল । রয়ালিটি, কপিরাইট এ সবের বালাই ছিল না । রবীন্দ্রনাথের গান অনেকেই গাইতে শুরু করেন নিজের ইচ্ছা মত । সেই সব গান কিছু রেকর্ডও হতে থাকে । প্রধাণত প্রশান্ত মহালনবিশ মহাশয়ের উদ্যোগে গ্রামাফোন কোম্পানীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি চুক্তি পত্র সাক্ষরিত হয় । এটি ঘটেছিল ১৯২৬ সালের ৫ই অক্টোবর ।
এই চুক্তি পত্রের তিন নম্বর ধারায় বলা হল – “ The Company shall pay to the composer or his nominee royalty of eight annas for each double sided record of any of the Composer’s said songs or recitations manufactured or to be manufactured by the Company PROVIDED ALWAYS that the Company shall at all times be at liberty to determine the selling price for all records the subject of this Agreement.”
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা যদি গ্রামাফোন কোম্পানি রেকর্ড করে যে দামেই বিক্রি হোক না কেন, প্রতিটি রেকর্ডের জন্য কম্পোজার রবীন্দ্রনাথ আট আনা পয়সা পাবেন। এই চুক্তির নিচে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা আবৃত্তি যা গ্রামাফোন কোম্পানি রেকর্ড করে, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকাটি এই রকম ছিল –
গান আবৃত্তি
১) আমার শেষ পারানির কড়ি ১) আবির্ভাব
২) অন্ধজনে দেহ আলো ২) Reading from Getanjali
৩) তুমি যেওনা এখনি ৩) Reading from Crescent Moon
৪) অমল ধবল পালে লেগেছে ৪) আজি ঝড়ের রাতে
৫) আমারে কে নিবি ভাই ৫) আজি হতে শতবর্ষ পরে
৬) কখন যে বসন্ত গেল ৬) সোনার তরী
৭) আমি সংসারে মন দিয়েছিনু ৭) কৃষ্ণকলি
৮) নাই বা এলে যদি সময় নাই ৮) ভ্রষ্টলগ্ন
৯) গানের সুরের আসনখানি ৯) নৈবেদ্য
১০) অনেক দিয়েছ নাথ ১০) কর্ণ ও কুন্তী সংবাদ ( চারটি খন্ড)
১১) বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে
১২) ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে

এই তালিকাটি শুধুমাত্র গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করা গান ও আবৃত্তির । আগেই বলা হয়েছে এ ছাড়া এইচ বোসের নানান কোম্পানিতে , সি সি সাহার রেকর্ড কোম্পানিতে , সিলিন্ডারিক্যাল রেকর্ডিং- এ রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ ধরা হয়েছিল । এ ছাড়া বিদেশেও কিছু গান, আবৃত্তি এবং ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল । তার কিছু নষ্ট হয়ে যায়, কিছু উদ্ধার করা গেছে । যা উদ্ধার করা গেছে সবটাই রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে । বাংলা এবং ইংরেজীতে মিলে এই রকম রেকর্ড করা সম্পদের সংখ্যা প্রায় ষাটটি ।
যুগের পরিবর্তনে বাংলা ভাষার উচ্চারনে, গানের সামগ্রিক পরিবেশনায়, যন্ত্রসঙ্গীত এবং তালবাদ্যের প্রয়োগে রবীন্দ্রসংগীতের অবয়ব অনেকটাই বদলে গেছে । বিশেষ করে বিশ শতকের প্রথম দুই তিন দশক অবধি বাংলা গানের, বিশেষ করে রাগপ্রধান বাংলা গানের উচ্চারণে এক ধরণের ‘হেলে থাকা’ এবং চিবিয়ে বলার ব্যপার ছিল । সেই সময়ের বাচনভঙ্গীতেও এর প্রভাব ছিল । সেই সময়ে সেটাই স্বাভাবিক ছিল । তাই এই সময়ে গান শুনে অভ্যস্ত কানে রবীন্দ্রনাথের নিজের কন্ঠে গাওয়া গান এখনকার শ্রোতাদের কাছে একটু অনাকর্ষনীয় মনে হতে পারে ।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-গবেষক এবং প্রাবন্ধিক সমীর সেনগুপ্তের একটি উক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে ।
“রবীন্দ্রনাথের গান যাঁরা ভালো গেয়েছেন তাঁদের সকলেরই গানের মধ্যে দিয়ে তাঁদের ব্যক্তিত্ব কেমন আলাদা আলাদা করে চেনা যায় – যেমন অমলা দাশ, অমিতা সেন , সাহানা দেবী, মালতি ঘোষাল, কানন দেবী, রাজেশ্বরী দত্ত, যেমন দিনু ঠাকুর, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস । আর যাঁরা যেমন তেমন গেয়েছেন তাঁদের সকলেরই গলাতেই রবীন্দ্রনাথের গান কেমন একই রকম শুনতে লাগে। আর এঁদের গলায় অসাংগীতিক জোরটা বেশি বলে রবীন্দ্রনাথের গানের জগৎটা এঁরা এমন করে তুলেছেন যে আজ রবীন্দ্রনাথের নিজের গলায় রেকর্ড শুনলে মনে হয় , যাকে রবীন্দ্রসংগীত বলে সেটা যে কেমন করে গাইতে হয় রবীন্দ্রনাথ তা জানতেনই না ।”
আজ যেমন ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হচ্ছে, আগামীদিনে হয়ত তাও বদলে যাবে খানিকটা । কিন্তু ধ্রুবতারার তো কোনো আধুনিকীকরণ হয় না । যুগ থেকে যুগান্তরে গিয়ে তার নির্ভুল দিকনির্দেশ করার ভূমিকা কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না । রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে গাওয়া গাওয়া গান হল সেই চিরকালের ধ্রুবতারা।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
16 days ago

বেশ লিখেছেন

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x