শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রবীন্দ্রনাথের গান ও সত্যজিৎ রায় – কিছু কথা

অতি সম্প্রতি ‘রবিচক্র’-এর আন্তর্জালিক পত্রিকার পাতায় শ্রীমতী পূর্ণা মুখোপাধ্যায়ের সুলিখিত প্রবন্ধ ‘সত্যজিতের মননে রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে কিছু মন্তব্য করতে বসে দেখছি তার আকার একটা স্বতন্ত্র লেখার দাবি করছে। কারণ সত্যজিৎ রায়ের সংগীত-ভাবনা সম্পর্কে তাঁর বলা আর অনেক না-বলা কথাও আমার ভাবনায় উঠে আসছে। সেই কারণেই বিষয়টি নিয়ে দু-চার কথা বলতে এই পোস্টের অবতারণা। সংগীত সম্পর্কে আদৌ কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার স্পর্ধা আমার নেই, ও পথে আমি যাব না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান তো আমার প্রাণের আরাম আর মনের আনন্দ! সেই তৃপ্তির আচ্ছন্নতায় জমে ওঠে নানা কথা, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসতে চায়, তা গুণীজনের মান্যতা পাক বা না-পাক।। পূর্ণা তাঁর লেখাটির সূত্রে আমাকে দু-একটি কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যজিৎ রায়ের ফেলা আলো আমাদেরও ভাবনার রসদ যোগায়, ঋদ্ধ করে। কিন্তু তাঁর অমূল্য ভাবনার মধ্যে কিছু স্ববিরোধ এবং ফাঁক সেদিনই অনেক বিশেষজ্ঞেরই নজর কেড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অতটা তলিয়ে ভাবাটা সময় ও সুযোগের অভাবে সত্যজিতের হয়ে ওঠেনি; এমনকি তার তাগিদও যে তিনি অনুভব করেননি, এ-কথা সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারে স্পষ্টই হয়ে যায়। কিন্তু সত্যি কথাটা হল, মানুষটা যেহেতু সত্যজিৎ রায়, সেদিন এ-বিষয়ে চুপ করে থাকাটা অনেকের কাছেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হয়েছিল।

‘রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলছেন, “তাঁর সহজাত ক্ষমতার বাইরে কোনও কিছু শিখে আয়ত্ত করায় তাঁর চিরকালই আপত্তি ছিল। তাঁর শিক্ষায়তনের বিরুদ্ধে আপত্তিটা অ্যাকাডেমিক সবকিছুর বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য ছিল। তাঁর শিল্পবোধ ছিল সহজাত, instinctive।” পূর্ণার বিবেচনায় এটা সত্যজিতের একটা সাহসী ও মৌলিক মন্তব্যের দৃষ্টান্ত। কিন্তু সত্যি কি সত্যজিতের এমন উক্তি তাঁর রবীন্দ্র-ভাবনায় অভিনবত্বের সন্ধান দেয়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বারবার নিজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় জ্ঞানগর্ভ বিদ্যাচর্চা নয়, বরং তাঁর কবিধর্মকেই মান্যতা দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে মনে পড়ে তাঁর ‘The Religion of Man’ শীর্ষক বক্তৃতামালায় ‘The Vision’ অধ্যায়টি, যেখানে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি – “I have already made the confession that my religion is a poet’s religion. All that I feel about it is from vision and not from knowledge.” গান সম্পর্কে তাঁর এই অনুভব আমার মতো আনাড়ী মানুষকেও তাড়িত করে বেড়ায়।


রবীন্দ্রনাথের ‘সংগীতচিন্তা’ বইটির ছত্রে-ছত্রে যত না আছে সংগীত সম্পর্কীয় তত্ত্বের কথা তার থেকে অনেক বেশি আছে তার ভাবের কথা। কী সেই ভাব, কেমন সেই ভাব? তাঁর এমন ভাবনার পরশ দিয়েই তো সৃষ্টি হয় তাঁর গান – “ভৈরোঁ যেন ভোর বেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ; পরজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহ্বলতা; কানাড়া যেন ঘন অন্ধকারে অভিসারিকা নিশীথিনীর পথবিস্মৃতি; ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদনা; মুলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনান্তের ক্লান্তিনিশ্বাস; পূরবী যেন শূন্যগৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন।”

গানের এই ভাবনার জগতে যখন প্রধানত কথাকে আত্মস্থ করেই তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলতে চেয়েছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব বা শঙ্খ ঘোষের মতো ধীমান ভাবুকেরা, তখন সত্যজিৎ রায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বা কবীর সুমনের মতো সংগীতবেত্তাদের কাছে সুরই হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কীয় ভাবনায় মূল উৎস। বটেই তো, গান তো গানই – যা প্রধানত দাঁড়িয়ে থাকে সুরের উপর – যার জন্য গান সমাদৃত বা জনপ্রিয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের সেই জনপ্রিয়তা বা জনপ্রিয় শিল্পী সম্পর্কে সত্যজিৎ তো বেশ দ্বিধাগ্রস্থ। কেন? ভবিষ্যতেও তাঁর গান বাঙালি গাইবে এমন আশা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন কি সাহানা দেবী – রাজেশ্বরী দত্ত – কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি আর শান্তিনিকেতনের কতিপয় আশ্রমিকদের ওপর ভরসা করে? এমনকি ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথে গান পৌঁছে দিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রের থেকেও অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা নিয়েছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-দেবব্রত বিশ্বাস – যতই তাঁদের ‘সাদামাটা’ গায়কি বা উচ্চারণের অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠুক। আদর্শ উচ্চারণের প্রসঙ্গে সত্যজিৎ সুচিত্রা মিত্রের প্রসঙ্গটা ছুঁয়েছেন। সুচিত্রার উদাহরণ যথাযথ, যদিও তাঁর উচ্চারণে দেওয়ালে পেরেক ঠোকার মতো স্পষ্ট আওয়াজ অনেকে কাছে অস্বস্তিকর। এমন মন্তব্যকে বড় বাড়াবাড়ি বলেই উপেক্ষা করা ভাল; হয়তো কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে উচ্চারণের পেলবতা তাঁদের বেশি স্বস্তি দেয়। এই প্রসঙ্গে ‘সাদামাটা’ রবীন্দ্রসংগীতের গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও উচ্চারণের প্রসঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের নামটা প্রায় এড়িয়ে যাওয়ার মতো খুবই আলতো করেই ছুঁয়েছেন সত্যজিৎ।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজকুমার মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস

এখানে সামান্য একটু কথা বলতেই হয়। রবীন্দ্রসংগীত বলতে আমরা শুধু ‘মন্দিরে মম কে’ বুঝি না, যাকে সত্যজিৎ বলতে চেয়েছেন বাংলা খেয়াল গান। তুলনায় ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘যৌবনসরসীনীরে’ বা ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’র মতো অসংখ্য ‘সাদামাটা’ গান আছে যেগুলো প্রতি রবীন্দ্রনাথের দরদ বা মমতা কিছু কম ছিল না। পঙ্কজকুমার মল্লিকের আক্ষেপ, গান্ধীজির সামনে ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’ গাইতে বসে ‘মা’ ডাকটা হেমন্তের মতো হয়নি। আর উচ্চারণ? আধুনিক বাংলা গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত জগতের অনেক দিকপাল গুণীজন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলোর গায়কি বা উচ্চারণের কোনো সমালোচনা নয়, প্রশংসাই করেছেন। হেমন্ত-গীত আর একটি অসাধারণ গান –‘গ্রাম-ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানটি নিয়ে অন্য প্রেক্ষিতে সত্যজিৎ প্রশ্ন তুলেছেন–“সুর লোকসংগীতের, কিন্তু ভাষা ভদ্র, মার্জিত। প্রশ্ন ওঠে – এ সংগীতের স্থান কোথায়? পদ্মার বুকে পান্সিতে নয় নিশ্চয়, কারণ কর্তার হাতে বৈঠা দেখলে মাঝি যে হাসবে। এ গানে যদি গ্রাম-প্রকৃতির সম্বন্ধে শিক্ষিত দরদি নাগরিক মনোভাবের সংগীতরূপ বলা হয়, তা হলে প্রশ্ন হবে – সে গানে লোকসংগীতের সুর কেন, ছন্দ কেন?”। বুঝলাম না, এখানে তো বিশেষ অর্থে কোনো লোক সংগীত নির্মাণের উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের ছিল না। সিনেমার চিত্রনাট্যের দাবিতে এই গানের সৃষ্টি নয়; স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ এক বিশ্বজনীন ভাবনায় প্রকৃতি ও জীবন থেকে সুরকে আত্মস্থ করে তিনি গানকে দিয়েছেন স্বাধীনতা আর নতুন এক dimension। আর একটা কথা। তাঁর চলচিত্রে কিশোরকুমারের নির্বাচন নাটকের দাবি কিছুটা মিটিয়েছে বটে, কিন্তু জনপ্রিয়তা ব্যতিরেক তাঁর নির্বাচনের পিছনে বিশেষ সেই যুৎসই উত্তরটা আমার জানা নেই।

এমন সিদ্ধান্ত তো আমাদের নেওয়া হয়েই আছে যে, রবীন্দ্রসংগীত সৃষ্ট কথা ও সুরের যুগলবন্দীতে। কিন্তু এই সরলীকৃত সিদ্ধান্তে রবীন্দ্রনাথের নিজের মনই যে ভরে না! নচেৎ তাঁর গানে গুরুত্ব কোনটা বেশি পাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরই চিত্ত এতটা দোদুল্যমান কেন? প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আমি গানের কথাগুলিকে সুরের উপর দাঁড় করাইতে চাই”। ভাল কথা। জীবনস্মৃতি পর্বে এসে তাঁর মনে হল, কথার থেকে সুরের মূল্যই বেশি। এটাও বুঝলাম, চিন্তায় তাঁর ভাঙার পর্ব চলছে। কিন্তু জীবনের একেবারে শেষ পর্বে সিদ্ধান্ত বদল করে ফিরে যাচ্ছেন ভাবনার আদি পর্বে; বলছেন যে, কথার ভূমিকা অনেক বড়, সুরের দাসত্ব করা তার কাজ না। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে যে, গানটা রবীন্দ্রনাথের এবং তজ্জনিত কোনো সমস্যা সৃষ্টির দায়টাও তাঁকেই নিতে হবে। তাই এই নিয়ে এত কথা শুধু অর্থহীন বলে মনে হয়। দেখছি, স্বয়ং শঙ্খ ঘোষেরও মনে হয়েছে, – “এ-সব তর্ক কখনো-কখনো হয়তো একটু নিস্ফল বাগ্-বিস্তারের দিকে এগিয়ে গেছে, কখনো-কখনো যে-বিরোধ কল্পনা করা হয়েছে তা হয়তো আপাতবিরোধ, দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়তো সম্ভব ছিল।” সম্ভব ছিল কেন, আমরা তো সেই সামঞ্জস্যের সন্ধান পেয়েছি; শেষ পর্যন্ত ঘুরেফিরে তাঁর সেই কথাতেই স্থিত হয়েছি – ‘বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর সম্পর্ক; অনুভব করে চলেছি তাঁর গানের অপার আনন্দ!

অনেকদিন আগে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক মূল্যায়নে সত্যজিৎ রায়ের এমন একটি মন্তব্য পড়েছিলাম (আজকাল/৯।৫।২০১০) – “As a poet, dramatist, novelist, short story writer, essayist, song composer, philosopher and educationist, Tagore is obviously more versatile than Shakespeare” এবং তাঁর গান সম্পর্কে খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছেন, “I know that as a composer of songs he has no equal even in the west.” তাই তো রবীন্দ্রনাথের গানে কখনও-কখনও এই কথা ও সুরের দ্বন্দ্ব, কখনও-বা তাঁর সুর-সঙ্গতি নিয়ে কুটকচালিতেই শুধু সীমাবদ্ধ নয় সত্যজিতের ‘রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা’। এ-কথা তো অনস্বীকার্য, সত্যজিতের সামগ্রিক শিল্পকর্ম – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁকে প্রাণিত করেছে বারবার। এ-কথাও অবশ্য মনে রাখার, ভারতীয় রাগ-সংগীত আর বিশেষ করে পাশ্চাত্য় -সংগীত নিয়ে তাঁর যেমন গভীর অনুধ্যান, রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তেমন তলিয়ে ভাবাটা তাঁর হয়ে ওঠেনি; সেটা সময়, সুযোগ বা তাগিদ যারই অভাব থাক না কেন। তথাপি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আলোচনা করতে বসলে সত্যজিতের ভাবনাকে আমাদের যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেওয়ার আছে। এ-বিষয়ে তাঁর ভাবনার মধ্যে যে অনেক কিছুর প্রাপ্তি আমাদের জুটেছে তা কতটা মৌলিকতায় বিশেষিত হবে জানি না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আমাদের অনেক গর্বের কারণকে তা চিহ্নিত করেছে। এই বিষয়টা নিয়ে তাঁরই অতি গুরুত্বপূর্ণ কথন সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করি।

১) কোনো প্রচলিত রীতি যখন রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন, তখনও তার কথায় সুরে বা ছন্দে কিছু না কিছু বৈশিষ্ট এনেছেন। ফলে সেগুলিকে অনুকরণ না বলে নবীকরণ বলা চলতে পারে। বাংলা তথা ভারতীয় গানের এই নবীকৃত রূপই হল রবীন্দ্রসংগীত।
২) উনি (রবীন্দ্রনাথ) তো ধরেই রেখেছেন যে, তাঁর গান ঘরে ঘরে অনেকে গাইবে এবং সেখানে উনি এও ধরে রেখেছেন,ওটার(তানের)ওপর stress দিলে – ওটার সম্বন্ধে উল্লেখও তাই উনি করেননি কোথাও। আমি তো পাইনি যে, এটাতে শ্রুতি লাগাতে হবে বা লাগাতে হবে না। মেজাজটা – একটু classical মেজাজে গাইতে হবে, তাও তো উনি বলেননি।… উনি ভালো মানে যে যে মোটামুটি সুর বজায় রেখে গেয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ মিষ্ট ইত্যাদি – মোটামুটি মানেটা বুঝে গাইছে।
৩) লক্ষণীয় যে, গানই তাঁর একমাত্র সৃষ্টি যার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, কাব্য-উপন্যাসের তুলনায় বিবর্তনের মাত্রাটা এতে অনেক কম।
৪) যিনি একাধারে কবি ও সুরকার, তাঁর কাব্যপ্রতিভা যদি গীতি-প্রতিভার চেয়ে কোনও অংশে কম না হয়, তাঁর পক্ষে বোধহয় গানের খাতিরে সুরকে দাবিয়ে রাখতে হয়, অথবা কথার ছন্দ অতিমাত্রায় সুরে সঞ্চারিত হয়ে গানকে দুর্বল করে ফেলে।
৫) ইমন রাগে ‘মায়ার খেলার’র ‘পথহারা তুমি পথিক যেন গো’ গানটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এ গানে রাগের স্বচ্ছন্দ বিহার কথাকে তো ব্যাহত করেইনি, বরং রাগের লঘু রোম্যান্টিক মেজাজে কাব্যের স্পর্শ এনে দিয়েছে।… আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট সংগীত প্রতিভার বিকাশ ঠাকুরবাড়ির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার পরে। রাগরাগিণীর প্রভাব তিনি কোনওদিনই সম্পূর্ণভাবে কাটাতে পারেননি। কিন্তু যে জিনিসটা ক্রমে দেখা দিল, সেটাতে রাগ সংগীতের শুদ্ধতা আর বজায় রইল না, রইল কিছু রাগের পর্দা, এবং তার সঙ্গে যোগ হল বিশেষ একটা নতুন ঢঙ। ইমনেরই আর-একটা উদাহরণ দিলে এটা বোঝা যাবে।‘পরবাসী, চলে এসো ঘরে’ গানে ইমনের রঙ আছে, কিন্তু এ গান রাগসংগীতের কথা মনে করায় না। এ হল খাঁটি রবীন্দ্রসংগীত।

৬) রবীন্দ্রনাথের গান আজকাল খুব ভালভাবে গাওয়া হচ্ছে না, তার একটা সোজা কারণ অবশ্য আছে এই যে, ভাল গাইয়ে ছাড়া ভাল গান ভালভাবে কেউ গাইতে পারে না। এইসব গাইয়েদের অধিকাংশই, রবীন্দ্রনাথের ভাষা্য়, মাঝারি দলভুক্ত। অথচ এই মাঝারিদের মধ্যেই রবীন্দ্রসংগীতের প্রচলন, এই মাঝারিদের মধ্যেই রবীন্দ্রসংগীতকে বিশুদ্ধভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এটুকুও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে স্বরলিপি ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। সুতরাং স্বরলিপির দিকটাই আগে দেখতে হবে।
৭) যাঁরা যন্ত্র ছাড়া গলায় সুর রাখতে পারেন, তাঁদের গলায় যদি দরদ থাকে, গানের ভাব যদি তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, তাঁদের উচ্চারণে যদি সংগীতোপযোগী বিশুদ্ধতা থাকে, তবে যন্ত্র ছাড়া গান গেয়েও রবীন্দ্রসংগীতের সমস্ত সৌন্দর্য তাঁরা প্রকাশ করতে পারেন।
৮) গানের তাল বুঝে মেজাজ বুঝে প্রত্যেক গানের জন্য আলাদা সংগত রচনা করা উচিত। কীর্তন-জাতের গানে সরাসরি খোল করতাল চলবে না, কিন্তু তাঁর ছোঁয়া থাকতে পারে, কারণ সে গান আসলে কীর্তন নয়, কীর্তনের ছায়া। লোক সংগীতেও এই একই পন্থা চলতে পারে।(‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানটি নিয়ে সত্যজিৎ মার্জিত বাণীর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন লোকসংগীতের প্রেক্ষিতে। তাই শুধু লোকসংগীতের ছায়ায় আবৃত কবির অসামান্য-স্বাধীন-স্বতন্ত্র এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য আদৌ লোকসংগীত ছিল না। সত্যজিৎ এখন যা বললেন, গানটি নিয়ে সামগ্রিক ভাবনার প্রেক্ষিতে এটাই আমার মূল বক্তব্য ছিল তখন।)
৯) গানে কথার মূল্য যাই হাক-না-কেন, উপযুক্ত সংগতে সে মূল্য বাড়ে বই কমে না।…যন্ত্রের ব্যবহারে দিশি-বিলিতি বাছবিচার না করাই ভাল, তবে হাওয়াইয়ান গিটার হারমোনিয়ামের চেয়েও অনেকগুণে বেশি অসহ্য। ওটা দূর না করা পর্যন্ত নিশ্চিন্তি নেই। তবলার সঙ্গতে ওস্তাদি মেজাজটা বড় চট করে এসে পড়ে। ওটা ব্যবহার করতে হলে তানবিস্তারের রাস্তাও খুলে দিতে হয়। কাজেই ওটার বদলে যন্ত্রকেই তালের কাজে লাগানো উচিত।(এটা সত্যজিত রায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা। তবে হারমোনিয়াম নিয়ে একটু বিস্তারিতই শুনতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহারে। কখনও বলেছেন নিশ্চয়, আমারই নজরে পড়েনি।)
১০) তিনি গান রচনার কাজে লেগে ছিলেন প্রধানত বিদ্রোহীর ভাব নিয়ে… হ্যাঁ, ওইটাই যে, এরকম, সকলে এক রাগ গেয়ে যাচ্ছে – একইরকমভাবে একই নিয়মে, তা না করে নিয়মের বাইরে দিকে চলে আসা যাক আর কী। সেখানে individual…ওখানে তো আপনি যতই করুন না-কেন…কিন্তু কোনো individual সে যখন গাইছে he is an individual, কিন্তু composer-এর individuality বলে তো সে রকম কিছু নেই শাস্ত্রীয় সংগীতে, সে তো থাকতেই পারে না, সেখানে composer কে কেউ জানেই না…কিন্তু সখানে সেইটাই হচ্ছে সেটার ধর্ম, সেইভাব গাওয়াটা সেই রীতি মেনে। রীতি মানছি বলেই যে আমি উদ্গার করছি তা তো নয়, সেখানেও তো প্রচণ্ড স্বাধীনতা রয়েছে এবং সেখানে বিস্তারের মধ্যে প্রচণ্ড স্বাধীনতা রয়েছে। সেইজন্যে সেখানে রবীন্দ্রনাথ যেটা আপত্তি করেছিলেন যে একই জিনিস করে যাব কেন – এইরকম একটা কথা।
১১) বিলিতি classical music-এ the performer is never greater than the music…রচনাগুলো যদি uninteresting হয়, যতবড় বাজিয়ে গাইয়েই হোক, আমি শুনতে যাব না। এখানে রবীন্দ্রসংগীত, আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের গান যদি কেউ গায়, যে কেউ গাইলে আমি যাব না, নিশ্চয় যাব না।

শেষে একটা কথা বলি। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে তাঁর বিশেষ পছন্দের কোনো পুরুষ বা মহিলা শিল্পীর উদাহরণ খোলাখুলিভাবে যথাযথ রবীন্দ্রসংগীতের পরিবেশনা বলতে তিনি গ্রামাফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথেরই গাওয়া একটি গানের উদাহরণ দিয়েছেন – ‘তবু মনে রেখো’। এ ছাড়া কোনো পুরুষ কণ্ঠ তাঁর পছন্দের তালিকায় নেই। অবশ্য তাঁর বিশেষ পছন্দের কোনো মহিলা শিল্পীর উল্লেখও তিনি করেননি, যদিও উদাহরণ বলছে, তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে নিশ্চয় তাঁর পছন্দের গায়িকাদের কণ্ঠকেই তিনি মান্যতা দিয়েছেন। আমার তো মনে হয়, সত্যজিতের সৃষ্ট চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় অমিয়া ঠাকুরের কণ্ঠে ‘এ পরবাসে রবে কে’ শেষ্ঠ পরিবেশিত গান। আমার এটাও ধারণা যে, সম্ভবত অমিয়া ঠাকুরই তাঁর পথম পছন্দের শিল্পী। মনে পড়ে বহু বছর আগে তাঁর বৃদ্ধ বয়সে শেষ গান শুনেছিলাম টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। দমের অভাব, অথচ কী প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে দুহাতে ভর দিয়ে পিছনে সামান্য হেলে গেয়েছিলেন – ‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না’। সেদিন অনুভব করেছিলাম রবীন্দ্রনাথে গান কী আর তাঁর শেষ পারানির কড়িকে কেমন করেই বা কণ্ঠে নিতে হয়। সত্যি, রবীন্দ্রসংগীতের সমুদ্রে জীবন ভ’রে ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া’!

অমিয়া ঠাকুর

শেষ পর্যন্ত দায়টা বর্তেছে রবীন্দ্রনাথেরই ঘাড়ে। তাঁকে বলতে হয়েছে, “সাহানার মুখে যখন আমার গান শুনতাম তখন কি শুধু আমাকেই শুনতাম? না তো। সাহানাকেও শুনতাম। বলতে হত – আমার গান সাহানা গাইছে। তা হলে তাঁর গানের জগতের আদর্শ শিল্পী হিসাবে মান্যতা পেলেন সেই এক নারী-ই। সেই রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে বহুদিন ধরেই শান্তিনিকেতনের সংগীত শিক্ষা পুরুষ-তান্ত্রিক পরিচালনায় লালিত হলেও সেই সুফলের অংশীদার হয়ে চলেছেন প্রধানত নারীরাই। আজও অন্যথা হয়নি সেই ঘরানায়। অবশ্য পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর সংগীত-শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীদেরই অগ্রগণ্য ভূমিকা। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন পর্বের অনেকটা অংশ জুড়ে যে একজন পুরুষ শিল্পীর নামই বারে-বারে উচ্চারিত হয়েছে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন বটে সাহানা দেবীর নাম, কিন্তু সেখানেও কি সত্যি পূর্ণ হয়েছিল তাঁর তৃপ্তির ভাণ্ডার? যদি হয়েই ছিল, তবে দিলীপকুমার রায়ের কাছে তাঁর শেষ বয়সের এমন আক্ষেপ কেন – “গানের ভিতর দিয়ে আমি যে জিনিসটা ফুটিয়ে তুলতে চাই সেটা আমি কারও গলায় মূর্ত হয়ে ফুটে উঠতে দেখলুম না। আমার যদি গলা থাকত তা হলে হয়তো বা বোঝাতে পারতুম কী জিনিস আমার মনে আছে। আমার গান অনেকেই গায়, কিন্তু নিরাশ হই শুনে।” আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে – ‘আমার যদি গলা থাকত’ – কথাটা কী অর্থে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? স্মৃতি আমার আজ বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে। কোনো একটা প্রসঙ্গে কোথায় যেন পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের এমনই যন্ত্রনাবিদ্ধ উচ্চারণ – “আমার গানের আদর্শ শিল্পী খুঁজতে গেলে ঠগ বাছতে গা উজাড় হবে”!

(রবিচক্রের ১ মে সংখ্যায় প্রকাশিত শ্রীমতী পূর্ণা মুখোপাধ্যায়ের ‘সত্যজিতের মননে রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধের সংযোগ)

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
2 days ago

রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে সত্যজিতের ভাবনার নানা দিক নিয়ে আলোচনা পড়ে অনেক কিছু জানলাম।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x