শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

ও জোনাকি কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ : ব্যতিক্রমী সৃষ্টি

শিরোনাম দেখে বন্ধুরা হয়তো বিস্মিত বোধ করছেন। উক্ত গানটির সুর বা ভাববস্তুর মধ্যে এমন কোন বৈশিষ্ট্য আছে যা রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে তাকে অনন্য স্থান দিতে পারে ? এই অতিপরিচিত গানটি রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমীদের পছন্দের শীর্ষতালিকায় থাকার কথাই নয়। বরং যেসব গান সচরাচর “বাচ্চাদের গান” অভিধায় চিহ্নিত হয়ে থেকে, এই গানটি সেই শ্রেণির অন্তর্গত ; সাধারণভাবে যেসব গান দিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের গান শেখানো শুরু হয়, এই গানটি তাদের অন্যতম।

না, এর সাঙ্গীতিক বা কাব্যরূপের নিরিখে গানটিকে ব্যতিক্রমী বলছি না, বলছি গানরচনার পটভূমির বিচারে। সেই প্রসঙ্গে প্রথমে আসছি। তারপর এই গানটি সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। এই অতিপরিচিত গানটির আমার কাছে এক বিশেষ আবেদন আছে।

ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ॥
তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে,
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।
তুমি আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো,
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ॥

বিচিত্র পর্যায়ের এই গানটির রচনাকাল ১৯০৫ সাল। তবে গানরচনার সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ নেই, যেমন উল্লেখ নেই এই গানটির অব্যবহিত পূর্বে ও পরে রচিত একাধিক গানের তারিখের। গানগুলি রচিত হয়েছিল ওই বছর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। গানগুলির অধিকাংশই “ভাণ্ডার” পত্রিকার ভাদ্র ও আশ্বিন সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের আলোচ্য গানটির ব্যতিক্রমী চরিত্রটি অনুধাবন করতে হলে গানটির ঠিক আগে ও পরে লেখা গানগুলির এবং তৎকালীন রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

সেইসময় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল কলকাতা। পয়লা সেপ্টেম্বর (১৬ই ভাদ্র) সিমলা থেকে ১৬ই অক্টোবর (৩০শে আশ্বিন) বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার ঘোষণা আন্দোলনে নূতন গতি সঞ্চার করে। এই সময় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভাসমিতিতে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকেন, সভাপতিত্ব করেন, বক্তৃতা দেন, প্রবন্ধ পাঠ করেন।এই সময় তাঁর ভূমিকা ছিল চারণকবির। বাঙালির স্বদেশচেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে তিনি একের পর এক স্বদেশী গান রচনা করেন । উল্লিখিত ওই দুইমাসের মধ্যে তাঁকে গিরিডিতে আসতে হয়েছিল, এবং গিরিডিতে অবস্থানকালেও তিনি একাধিক গান রচনা করেন। এক একটি গানরচনা শেষ হতেই তা কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হত সভাসমিতিতে পরিবেশন করার জন্য।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান রচনার ইতিহাসে ওই বছরের ভাদ্র আশ্বিন এক ব্যতিক্রমী পর্ব। ওই সময় প্রকাশিত মোট গানের সংখ্যা পঁচিশ — তার মধ্যে চব্বিশটি গানই স্বদেশী গান (স্বদেশ পর্যায়ের গান ২২টি, জাতীয় সঙ্গীত ২টি)। বাকি একটি গান হল আমাদের আলোচ্য গানটি — বিচিত্র পর্যায়ের “ও জোনাকী কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ” প্রশান্তকুমার পাল গানগুলির সম্পূর্ণ তালিকা দিয়েছেন । শেষ চারটি গান ছাড়া অন্য গানগুলির রচনার স্থানকাল অনুল্লিখিত থাকলেও যে খাতায় লেখা হয়েছিল তার পৃষ্ঠার ক্রম অনুসারে রচনার ক্রম নির্ধারণ করা যায়। প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, “খেয়া”র পাণ্ডুলিপিতে গানগুলি লেখা হয়েছিল, এবং লেখা হয় খাতাটি উলটে নিয়ে। গানগুলি হল :

১) ও আমার দেশের মাটি ২) মা কি তুই পরের দ্বারে ৩) এবার তোর মরা গাঙে ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে ৬) যে তোরে পাগল বলে ৭) তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে ৮) সার্থক জনম আমার ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না ১০) ওরে তোরা নেইবা কথা বললি ১১) ছি ছি চোখের জলে ১২) বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস ১৪) ও জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ ১৫) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে ১৬) আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে ১৭) আপনি অবশ হলি ১৮) যদি তোর ভাবনা থাকে ১৯) আমাদের যাত্রা হল শুরু ২০) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি ২১) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ২২) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে ২৩) ওরে ভাই মিথ্যা ভেব না।

এছাড়া ওই খাতাতে আরও দুটি স্বদেশ পর্যায়ের গান পাওয়া যায়, কিন্তু পূর্বোক্ত গানগুলির মত খাতার উল্টোদিকে লেখা নয়। গান দুটি হল : “বাংলার মাটি বাংলার জল” (১২ই সেপ্টেম্বর) এবং “ঘরে মুখ দেখে গলিস নে”।
( প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ ২৫৯ – ২৬১)

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের মোট গানের সংখ্যা ৪৬, তার মধ্যে ২২টি গান অর্থাৎ প্রায় অর্ধসংখ্যক গান রচিত হয়েছিল এই ভাদ্র –আশ্বিনে। বাকি চব্বিশটি গানের রচনাকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের অন্য কোন পর্বে এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এত সংখ্যক স্বদেশ পর্যায়ের গান লেখেন নি। উল্লিখিত ওই পর্বটি বাদ দিলে এক বছরে স্বদেশ পর্যায়ের গানরচনার সর্বোচ্চ সংখ্যা তিন। তেমন দৃষ্টান্তও অবশ্য পাওয়া যায় শুধুমাত্র ১৯৩৭ সালে— ওই বছর একই দিনে লেখা হয় “শুভ কর্মপথে” “চলো যাই” (২৪ জানুয়ারি/ ১০ মাঘ) তারপর “ওরে নূতন যুগের ভোরে” (১লা বৈশাখ)। এছাড়া অন্য কোন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বছরে একটি বা দুটির বেশি স্বদেশ পর্যায়ের গান লেখেন নি। এমনকি পরপর দুটি স্বদেশ পর্যায়ের গানরচনার দৃষ্টান্তও আর পাওয়া যায় না।

সুতরাং দেখা যায় সেইসময় সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র ভাবনাজগৎ অধিকার করে ছিল, এই পর্বে কবির সৃজনপ্রেরণা ছিল শুধুই স্বদেশ। তবু এরই মধ্যে কোন এক অবসরে সমস্ত সমকালীন বাস্তবতার প্রভাব পরিহার করে তিনি রচনা করেছিলেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের গান, বিচিত্র পর্যায়ের একটি গান : “ও জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ”। এই পর্বে রচিত গানগুলির মধ্যে এটিই একমাত্র গান যার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের ক্ষীণতম যোগসূত্রটুকুও নেই। এদিক থেকেই এই গানটি ব্যতিক্রমী চরিত্রের।

এবার আলোচ্য গানটি সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলি।

ভোগসর্বস্ব আজকের সভ্যতায় চারিদিকে যখন দেখি অলীক সুখের সন্ধানে মরীচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে, না পাওয়ার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত নিজেকে জর্জরিত করে তুলছে, তখনই এই অতিপরিচিত, আপাতসাধারণ গানটির তাৎপর্য সবচেয়ে গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করি। উপলব্ধি করি সুখী হতে গেলে সূর্য, চন্দ্র হওয়ার প্রয়োজন নেই, অমেয় বৈভবের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন নেই, অলোকসামান্য প্রতিভাধর হওয়ার প্রয়োজন নেই, অসাধারণ কর্মদক্ষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অতি সামান্য মানুষ আমিও জীবনের সর্বোত্তম আনন্দ অনুভব করতে পারি যদি গানের ওই জোনাকিকে পথের দিশারি করি। সূর্যের সঙ্গে জোনাকি অসম প্রতিদ্বন্দিতায় অবতীর্ণ হয় না, তার আলোয় বিশ্বজগৎ আলোকিত হয় না, শুধু বনের অন্ধকারের মধ্যে সে ক্ষীণতম আলোর উদ্ভাসটুকু ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু এই অতিক্ষুদ্র প্রাণীটির “আঁধার বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠা”র আনন্দ মহাজাগতিক জ্যোতিষ্কের আনন্দকেও ছাপিয়ে যায় কারণ এই আলো সে জ্বালিয়েছে “আপন জীবন পূর্ণ করে” এই আলো জ্বালার প্রয়াসে সে উল্লাসে প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। তাইতো সে “ছোটো হয়ে নও গো ছোটো”। তেমনিভাবে অতি সামান্য মানুষ আমি, আমিও যদি নিজের কর্মসামর্থ্যের সমস্ত সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের অতি তুচ্ছ, অতি অকিঞ্চিৎকর কাজ জোনাকির মত গভীরতম ভালোবাসায়, সমস্ত প্রাণমন উজাড় করে দিয়ে সম্পন্ন করি, তাহলে আমিও জীবনের মহত্তম আনন্দের সন্ধান পাব। যখন কোন কোন মুহূর্তে মনে হয়েছে নিবিড় ঘন আঁধারে প্রাণপণ প্রয়াসে আলোর চকিত আভাসটুকুও ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও পরম প্রাপ্তির অনুভবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছি — গোষ্পদে অনন্ত আকাশের ছায়া দেখার মতই সে অনুভূতি। খদ্যোতখচিত নৈশ কাননভূমির শোভার মধ্যে অন্তর্লীন মর্মবাণীটি এই গানেই খুঁজে পেয়েছি ; সেই বাণীকে যদি জীবনের মধ্যে গ্রহণ করতে পারি তখনই জীবন পূর্ণতম সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।

এই গানটিতে আমি খুঁজে পাই আমার রবীন্দ্রনাথকে, প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথকে। সেই রবীন্দ্রনাথকে — যাকে পেতে গেলে কোন টীকাকারের ভাষ্যের প্রয়োজন হয় না, কোনও বিদগ্ধ সমালোচকের তত্ত্বের আলোকে আলোকিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না — এই রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় শুধুই প্রাণঢালা ভালোবাসায়, প্রাত্যহিক জীবনের শতসহস্র তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজের মধ্যে। জীবন যখন অর্থহীন মনে হয়, সীমাহীন অসারতাবোধ মনকে যখন গ্রাস করে নেয় তখন আন্ধকারের মাঝে “উল্লাসে প্রাণ ঢালার” “আঁধার বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠার” সঞ্জীবনী মন্ত্র আবার নূতন করে উদ্দীপ্ত করে তোলে।

অতিপরিচিত, বহুশ্রুত এই গানটি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত — যে প্রেম প্রসারিত সুদূর নীহারিকা থেকে এই পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত। তাঁর মরমী দৃষ্টিসম্পাতে সূর্য, চন্দ্র আর অতিক্ষুদ্র জোনাকির মধ্যে সব ব্যবধান ঘুচে যায়।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x