শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন

Goutam Nag

সুপ্রভাত অদেখা বন্ধুরা। আজ শীতের সকালে শীতের একটি পরিচিত গান নিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই : “শীতের হাওয়ার লাগল নাচন”।

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥
উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,
তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে॥
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে॥

গানের শুরুতেই শীতের হাওয়ায় পাতা ঝরার দৃশ্যের অবতারণায় অভিনবত্ব নেই — অভিনবত্ব এই অতিপরিচিত দৃশ্যের উপস্থাপনায়। শীতের বাতাস আর আমলকীবৃক্ষের সম্বন্ধ চিরাচরিতভাবে ভয়ভীতির। শৈশবে সহজপাঠ থেকেই আমরা তার পরিচয় পেয়ে আসছি : শীতের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই, শরতের সমাগমের মুহূর্ত থেকেই বাতাসে হিমেল স্পর্শ পাওয়া মাত্র আমলকী বনের বুক দুরুদুরু করে — পাতা খসানোর সময় আসন্ন ভেবে। আমলকী ডাল কাঙাল সাজে। কিন্তু এই গানে আমরা হিমেল হাওয়ায় “গগনভরা ব্যাকুল রোদন” বাজে না (এ কী মায়া লুকাও কায়া…), উত্তরবায় শাসন জানায় না (শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে)। এই গানে আমরা দেখি শীতের হাওয়ার এক ভিন্নতর রূপ, এক উচ্ছল, নৃত্যচপল রূপ।

এই নৃত্যলীলার অভিব্যক্তি গানের কাব্য অবয়বের গঠনের নানা স্তরে। ধ্বনিগত স্তরে লক্ষণীয় দ্বিরুক্ত শব্দের পুনরাবৃত্তি : “তালে তালে” “ডালে ডালে” । এছাড়াও “লাগল নাচন” শব্দবন্ধটি এবং “ শিরশিরিয়ে” ধ্বন্যাত্মক শব্দটি গাইবার সময় দুবার গাওয়া হয় : “লাগল নাচন” “লাগল নাচন”, “ শিরশিরিয়ে” “ শিরশিরিয়ে”। শব্দ বা শব্দবন্ধের এই পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে যেন এক নৃত্যচঞ্চল চরণসম্পাত বেজে ওঠে। সঞ্চারিত হয় এক ঘূর্ণায়মানতার অনুভুতি।
গানের প্রথম কলিতে ক্রিয়ার কর্তা (শীতের হাওয়ার) নাচন, কিন্তু দ্বিতীয় কলিতে কর্তা উহ্য। পাতাগুলি কে ঝরিয়ে দিল ? এর সম্ভাব্য দুটি উত্তর। একটি সম্ভাবনা : প্রথম কলির মত এখানেও ক্রিয়ার কর্তা হাওয়ার নাচন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা এই উহ্য কর্তা আমলকী গাছ বা আমলকী ডাল। অর্থাৎ আন্দোলিত আমলকীবৃক্ষই নৃত্যের তালে তালে একটি একটি করে পাতা ঝরিয়ে দেয়।
নৃত্য কেবল মনুষ্যসৃষ্ট শিল্পকলা নয়, বাদ্যযন্ত্রের ছন্দে অঙ্গসঞ্চালন নয়, রবীন্দ্রচেতনাবিশ্বে নৃত্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী প্রবহমান এক অনাদ্যন্ত ছন্দ — যার প্রকাশ পরিব্যাপ্ত নিসর্গসৌন্দর্যলীলার পরতে পরতে, প্রতিদিনের জীবনের সুখদুঃখে, হাসিকান্নায়, বিরহমিলনে। নৃত্যের ছন্দে সমস্ত বিপরীতের মধ্যবর্তী সব ব্যবধান ঘুচে যায়, একইসূত্রে তারা বাধা পড়ে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ “ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে” গানটি — এই গানে আমরা দেখি একই নৃত্যছন্দে ধরা পরে জন্ম-মৃত্যু, হাসিকান্না, ভালোমন্দ বন্ধন-মুক্তি। শীতের এই গানে আমরা দেখি দুই চিরবৈরী আমলকীবৃক্ষ আর হিমেল বাতাস নৃত্যরসে মেতে ওঠে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই ঝরে পড়া পাতাকে বিশেষিত করতে কোন নেতিবাচক অনুষঙ্গবাহী বিশেষণ ব্যবহৃত হয় নি : “শুকনো” “শুষ্ক” “জীর্ণ”। ঝরে পড়া পাতাদের প্রতি কোথাও অনাদর অবহেলা বা অনুকম্পা প্রকাশ পায় নি। তাদের চলে যাওয়ার মধ্যে কোন হাহাকারের ক্ষীণতম সুরটুকু কোথাও শোনা যায় না। এই ঝরে পড়ার মধ্য ফুটে ওঠে এক অনুপম ছন্দোময় সৌষম্য — তারা ঝরে পড়ে “তালে তালে”। এই নৃতলীলার তারাও সঙ্গী। চিরাচরিতভাবে বিষাদজাগানো একটি দৃশ্য রূপান্তরিত হয় সৌন্দর্যসঞ্চারী এক আলেখ্যে ।
অন্তরায় প্রথম দেখা যায় একটি নেতিবাচক অনুষঙ্গবাহী বিশেষণ “কাঙাল”। কিন্তু আমলকীবৃক্ষের এই দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় তার পূর্ণবৈভব। নয়নাভিরাম পত্ররাজির বিদায়ের পরই প্রকাশিত হয় তার ফলভারনত সৌন্দর্য। বহিরঙ্গ সৌন্দর্য ঘুচে গিয়ে উন্মোচিত হয় অন্তরের সৌন্দর্য, অন্তরের পূর্ণতা।

এখানে “নটীর পূজা”র শেষ দৃশ্যটি মনে পড়ে যায়। শ্রীমতী সুন্দর হয়েছিল, পূর্ণ হয়েছিল যখন সে নৃত্যের তালে তালে একটি একটি করে আভরণ, তারপর রাজবেশ আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করে ভিক্ষুণীর চীরবাসে আত্মপ্রকাশ করেছিল। শ্রীমতীর এই পূর্ণতা কিন্তু প্রতীকী। অন্যদিকে নিষ্পত্র ফলভারাবনত আমলকীবৃক্ষের শোভা একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহী বাস্তব।

এই গানে আমরা দেখি শীতের রিক্ততা ও পূর্ণতার যুগলরূপ। শীতের অন্যসব গানে দেখা যায় শুধুই শীতের পূর্ণতা বা শুধুই তার শূন্যতার বাণীরূপায়ণ। এই পর্যায়ের বারটি গানের মধ্যে দুটিতে দেখি শীতের পূর্ণতার রূপ — “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে” এবং “এল যে শীতের বেলা”। উল্লেখ্য শীতের পূর্ণতার রূপটি দেখা যায় শুধু ভরাক্ষেত্রের প্রাচুর্যে। শীতের গানে শীতের ফুলের সমারোহ দেখা যায় না। কুঞ্জকাননে তার আবির্ভাব নির্দয় সর্বস্বাপহারীর মত। তার রিক্ত অকিঞ্চন রূপটি দেখা যায় সাতটি গানে : “ শিউলি-ফোটা ফুরোল”, “ছাড়্ গো তোরা ছাড়্ গো”, “ “আমরা নূতন প্রাণের চর”, “এ কি মায়া”, “মরা ভাঙব তাপস””শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে বলে”, “হে সন্ন্যাসী”। কিন্তু শূন্যতা ও পূর্ণতার এমন সহাবস্থান, শীতের এই দ্বৈতসত্তার চিত্রায়ণ শুধু এই গানটিতেই দেখা যায়।

অন্তরার কথাবস্তুর সঙ্গে এর গঠনকৌশলটিও লক্ষণীয়। এই অংশে আমলকীবৃক্ষের শূন্যতার রূপ চিত্রিত করতে একটি সদর্থক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে : “উড়িয়ে দেওয়ার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে”। অপরদিকে একটি নঞর্থক বাক্যের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে তারই পূর্ণতার রূপটি “তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে”। যে নৃত্যের ছন্দে দুই চিরশত্রু শীত আর আমলকীবৃক্ষের মধ্যে সব দূরত্ব ঘুচে যায়, সেই ছন্দেই যেন ‘নেতি’ আর ‘ইতি’র মধ্যে সব ব্যবধান অবলুপ্ত হয়ে যায়।
যে সব গানে প্রতিবিম্বিত শীতের সর্বরিক্ততার রূপ তার মধ্যে অনেক গানে আমরা দেখি এই শূন্যতার মধ্যে পরিপূর্ণতার অনুসন্ধানের প্রয়াস। এই সমস্ত গানে শীতের শূন্যতা কবির দৃষ্টিতে বহিরাবরণ মাত্র। শীত ছদ্মবেশী বসন্ত; শীতের নিষ্প্রাণ রুক্ষতার মধ্যে আছে অনাগত বসন্তের অনুপম রূপবিস্তারের স্বপ্ন, পাতা ঝরার মধ্যে নিহিত আছে নূতন পাতার আবির্ভাবের আশ্বাসবাণী। শীতের সেই গোপন বৈভব উদ্ভাসিত কবির অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিচেতনায়। কিন্তু আমাদের আলোচ্য গানে আমলকীবৃক্ষের রূপবৈচিত্র্য সম্পূর্ণভাবেই ইন্দ্রিয়চেতনায় বিধৃত একটি দৃশ্য — যা কবিকল্পনার নির্মাণ নয় — প্রকৃতির নিয়মে যা ঘটে । আস্থায়ী ও অন্তরা অংশে অনাগতের কোন বাণী নেই, শীত এই গানে নববসন্তের অগ্রদূতরূপে বন্দিত হয় নি। শীত রয়েছে তার আপন অধিকারে। কবির দৃষ্টি এখানে ইন্দ্রিয়চেতনার সীমানা অতিক্রম করে নি।
সেই অতিক্রমণের প্রয়াস শুরু হয় সঞ্চারী থেকে। শীতের শূন্যতা এবং পূর্ণতা যার অন্তবিহীন লীলার বিচিত্র অভিব্যক্তি সঞ্চারীতে দেখি সেই লীলাময়ের সন্ধানে নিরত কবি। অন্তরা পর্যন্ত আছে শুধুই শীতের দৃশ্য, দ্রষ্টা থাকেন অন্তরালে। গানের পরবর্তী অংশে দ্রষ্টার উপস্থিতি অনুভব করা যায় ক্রিয়াপদে (“রইনু বসে”) এবং সর্বনামের (“আমার”) মধ্য দিয়ে। গানে কবির সক্রিয় ভূমিকা নেই তিনি শুধু “বসে” থাকেন। “নাচন” “উড়িয়ে দেওয়ার” “ঝরিয়ে দিল” “মাতন” — এই সমস্ত গতিদ্যোতক বিশেষ্য এবং ক্রিয়ার পর আসে স্থিতিদ্যোতক ক্রিয়া “রইনু বসে”। উদ্দাম নৃত্যচঞ্চলতার পর আসে ধ্যানতন্ময়তা — শীতের শূন্যতা ও পূর্ণতার রূপের অন্তরালস্থিত অরূপসত্তার অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা। শুরু হয় প্রতীক্ষার পর্ব।

গানের শেষ অংশে সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটে না, সেই প্রতীক্ষা শুধু দীর্ঘায়িত হয়। সঞ্চারী ও আভোগ — দুই অংশেরই শেষে আছে কালবাচক শব্দ : “বেলা” “সকালে”। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে কালবাচক শব্দের পূর্বে আসে তিনটি কালবাচক শব্দ : “কবে” “কখন” “কোন”। নৃত্যচঞ্চল উচ্ছলতায় যে গানের শুরু তার সমাপ্তি ঘটে অধীর প্রশ্নব্যাকুলতায়। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষাতেই বলা যায় “আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে হয় নি আমার পাওয়া”।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
7 days ago

প্রতিদিনের শত তুচ্ছতার আঁধাবাঁধনে মানযুষ আবদ্ধ । তার থেকে মৃত্যুতরণতীর্থ পথে উত্তবণের পফ এই গান। আপনার বিশ্লেষণ অপূর্ব। মনে হচ্ছে এ জীবন মিথ্যা নয় । কোন এক আশ্চর্য আলোর
পথের অভি সারী এ জীবন। ধন্যবাদ আপনাকে।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x