
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে অন্যান্য সংগীতের প্রধান পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন মহাকবির কলম হাতে নিয়ে। পৃথিবীতে এমন কোনো মহাকবি নেই যিনি সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে, কী পরিমাণে, কী বৈচিত্র্যে, কী উৎকর্ষের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছেও আসতে পারেন। সংগীত, যা ভাষা ও সুরের মেলবন্ধনে সৃষ্ট একটা তৃতীয় শিল্পমাধ্যম, যার ব্যাকরণ এবং আঙ্গিক একেবারেই স্বতন্ত্র : এর সার্থক রূপায়ণ এবং কলাসিদ্ধি রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ আর কারো সৃষ্টিতে প্রকাশ পেয়েছে কিনা, গবেষণার বিষয়।


হোমার তাঁর মহাকাব্য ইলিয়াদ এবং ওদিসির গীতিধর্মী কাব্যকাহিনীকে তৎকালীন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সুরে সুরে গলায় তুলে প্রচার করতেন। যথারীতি সেই সুর কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে পরিবর্তিত হয়ে সুরে-সুরান্তরে বয়ে চলেছিল যা যুগে -যুগে, দেশে-দেশে ঐতিহ্যবাহী চারণ কবিরা বহন করে নিয়ে চলেন। “হোমারের মহাকাব্যের কাহিনী ফ্রিজিয়দেরই ঐতিহ্য।” – বলেছিলেন সুকুমার সেন। এখানে স্মর্তব্য যে রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি ছিলেন ভৃগু বংশীয়। রামায়ণও এইভাবে গান গেয়ে প্রচারিত হত। সুকুমার সেন লিখেছিলেন “বাল্মীকি চ্যবনের পুত্র বা বংশধর।”… চ্যবন শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘চরক’ অর্থাৎ যাযাবর যে ঘুরে বেড়ায় – চারণ কবি, গুণী পণ্ডিত বা শিক্ষার্থী।” …”আমার অনুমান হয়, ভৃগুরা ছিল প্রথমে গ্ৰীসের পরে আলবানিয়ার অধিবাসী, যাদের গ্ৰীকে বলা হয়, ফ্রুকস্ (Phruks), আর লাটিন থেকে আগত ইংরেজিতে বলা হয় ‘ফ্রিজিয়’ (Phrygian)। এঁরা গানবাজনায় খুব দক্ষ ছিলেন। ” বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের অনুমান মহাকাব্যগুলির আদিরূপ সংক্ষিপ্ততর ছিল।
সে দিক থেকে দুই মহাকবিই ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে চারণ কবি এবং দুজনেই বীণা (lyre) সহযোগে গান গাইতেন।
ভার্জিলের মহাকাব্য ঈনিড সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। দান্তের La Vita Nuova তে (The New Life) সনেটের সঙ্গে অনেক গান আছে, তবে কবিকৃত ভাষ্যেই তার অস্তিত্ব রয়ে গেছে, সুরে নয়।
ভিক্তর উগোও প্রচুর গান লিখেছিলেন, কিন্তু নিজে সুরজ্ঞ ছিলেন না।


শেক্সপীয়র শতাধিক (১৫৪) সনেট লিখেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গান লেখেন নি যদিও তাঁর নাটকে প্রায় ৫০টি মতন প্রচলিত গানের ব্যবহার আছে । এ ছাড়া তাঁর নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিম্নলিখিত কবিতাগুলি গানে ব্যবহৃত হয়েছিল:
1) It was a Lover and His Lass – ‘As You Like it’ (V.3)
2) Full Fathom Five’ – ‘The Tempest’ (I.2)
3) Sigh No More’ – ‘Much Ado About Nothing’ (II.3)
4) Songs – ‘As You Like it’ (II.5 , 7 & V.4)
5) Take, Oh ! Take Those Lips Away’ – ‘Measure for Measure’ (IV.1)
6) ‘How should I your true love know’ (Ophelia’s song) – ‘Hamlet'(IV.5)
বুদ্ধদেব বসু যাদের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন:” …আশ্চর্য সে-গান, কিন্তু সংখ্যায় আর ক’টি ! দুটি মৃত্যুর, দুটি প্রেমের, একটি বসন্তের ও একটি শীতের গানেই প্রায় পুঁজি শেষ।” অসাধারণ লিরিক যদিও, সুর তিনিই দিয়েছিলেন তেমন কোনো প্রমাণ নেই ।


গ্যয়টে কোনো গান লেখেন নি যদিও তিনি সুরজ্ঞ ছিলেন এবং কিছু ধর্মীয় গাথায় সুর করেছিলেন। বীঠোফেন গ্যয়টের বেশ কিছু কবিতায় সুর করেছিলেন যার মধ্যে বিখ্যাত ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এগমন্ট নাটকটি নিয়ে ১৮১০ সালে কম্পোজ করেন Overture for Egmont । শুবার্ট তাঁর প্রায় ৬০টি কবিতায় সুর করেছিলেন যার মধ্যে রয়েছে ১৭৮২ সালে রচিত Gretchen am Spinnrade and Erkönig । কম্পোজ করেছিলেন ১৮১৫ সালে। ” রবীন্দ্রনাথের গানের মতো হুবহু গান জর্মনে আছে এবং সেগুলি জর্মনদের বড় প্রিয়। এগুলোকে ‘লীডার’ বলা হয়, এবং শুধু লীডার গাইবার জন্য বহু জর্মন গায়ক প্রতি বৎসর প্যারিস, লণ্ডন যায়। এসব লীডারের কোনো কোনো গানের কথা দিয়েছেন গ্যোটের মত কবি , আর সুর দিয়েছেন বেটোফেনের মত সংগীতকার। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের গানে গ্যোটে বেটোফেনের সমন্বয়। একাধারে এই দুই সৃজন পন্থার সম্মেলন হয়েছিল বলে রবীন্দ্র সংগীত জর্মন লীডারের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।” – লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ইংরেজি রোম্যান্টিক কবিরা যে গান লিখেছিলেন তার তেমন প্রমাণ নেই। রবার্ট বার্নস শ পাঁচেক গান লিখেছিলেন সেগুলি কবিতা হিসেবে খুব একটা উৎকৃষ্ট নয় এবং সুর প্রচলিত স্কচ লোকসংগীত ঘেঁষা।

আধুনিক কালে একমাত্র বব ডিলান প্রায় ৬০০ মতন গান তৈরী করেছেন। তাঁর গান বিশ্ববন্দিত। তার অন্যতম কারণ বহুল প্রচলিত ইংরেজি ভাষার advantage এবং আধুনিক সমাজ ও সময়ের যন্ত্রণাকে তীব্র এবং তীর্যক ভাবে সুরে বাঁধা। রাশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত কবিরা যেমন , আলেকজান্ডার পুশকিন, মিখাইল লারমনটভ, আলেকজান্ডার ব্লক, ইভান বুনিন বা আন্না আখমাতোভা কখনো গান লেখেন নি । একমাত্র বিশ্ববন্দিত গীতিকার ও সুরকার হলেন চাইকোভ্স্কি । চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশের সংগীত যে খুব উন্নত বলা যায় না, অনেকটা আমাদের ঔড়ব জাতীয় রাগ যেমন ভুপালী (Pentatonic) সুরের সরল ওঠা পড়া। জাপানি সংগীত শুনে রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিক্রিয়া “কিন্তু, এদের সংগীতটা আমার মনে হল বড়ো বেশি দূর এগোয় নি।” (জাপান -যাত্রী)
একথা ওদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। তা সত্ত্বেও শেষ বিচারে তাঁদের মহৎ কবির শিরোপা দিতে গেলে কবিতার সংজ্ঞাকে অন্যায় ভাবে বাড়িয়ে তুলতে হবে। যদিও ডিলান নোবেল পেয়েছেন গানের কবিতার জন্যই।
এবার ভারতবর্ষের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৩৫ এর ৭ই জানুয়ারী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “ভারতবর্ষের বহু যুগের-সৃষ্টি-করা যে সংগীতের মহাদেশ, তাকে অস্বীকার করলে দাঁড়াব কোথায়?” ঠিকই তো । আমাদের আদি মহাকাব্য রামায়ণ তো আগাগোড়া সুরে বাঁধা। ” অনন্তর ভ্রাতৃযুগল কুশ ও লব, পাঠ ও গীতকালে একান্ত শ্রুতিসুখকর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত এই ত্রিবিধ প্রমাণসম্মত ষড়জাদি সপ্তস্বরসংযুক্ত, তাললয়ানুকূল এবং শৃঙ্গার- হাস্য-করুণ-রৌদ্র-বীর প্রভৃতি রস-বহুল মহাকাব্য রামায়ণ শিক্ষা করিতে লাগিলেন …” বাল্মীকি রামায়ণ, চতুর্থ সর্গ , অনুবাদ: হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য । জয়দেবের গীতগোবিন্দ তো রাগে তালে বাঁধা। এ ছাড়াও মধ্যযুগে উত্তর ভারতের উল্লেখযোগ্য গীতিকার ও সুরকারদের অন্যতম ছিলেন মীরাবাঈ, কবীর, তুলসীদাস, সুরদাস, তানসেন , বৈজু বাওরা । দক্ষিণে ১৮-১৯ শতকের ত্যাগরাজ।
বাংলাভাষার সূচনাকাল চর্যাপদ থেকে বৈষ্ণব পদাবলী হয়ে আধুনিক কাল পর্যন্ত সংস্কৃতির মূল সুরই তো সংগীত। এদের মধ্যে বিখ্যাত ১৮ শতকের কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন এবং ১৮ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯ শতকের প্রথম চার দশক রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু এবং প্রায় পুরো ১৯ শতক জুড়ে বাউল গানের অগ্ৰদূত অগণিত লালনগীতির স্রষ্টা লালন সাঁই বা লালন শাহ।

এরপর শুরু হয় আধুনিক যুগ। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বাগগেয়কার উঠে আসেন। ডি.এল.রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন,কাজী নজরুল ইসলাম ,জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, সলিল চৌধুরী ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের মধ্যে কী সংখ্যায়, কী উৎকর্ষে, কী সুর বৈচিত্র্যে, কী খ্যাতি -প্রতিপত্তিতে অনেকটাই এগিয়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সত্যি কথা বলতে কী, মাত্র ২০-২২ বছরের সৃষ্টি জীবনে তাঁর তিন হাজারেরও বেশি সংগীত রচনা শুধু বিস্ময়কর বললেও বোধহয় সব বলা হয় না। আর, কী তাদের সুর বৈচিত্র্য! আমাদের শুধু বিস্মিত করে না, বিমূঢ় করে তোলে। রাগপ্রধান, গীত, গজল, টপ্পা, ঠুমরী, লোকসংগীতের সমস্ত ঢং, ভক্তিমূলক, ইসলামী, স্বদেশ সংগীত, মার্চ সঙ , ইজিপশিয়ান সুর, হাসির গান আরো কত কী! তাঁর গানের কবিতায় আছে আবেগের বিস্ফোরণ, যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ যা প্রাথমিকভাবে কবিতার লক্ষণ , কিন্তু এর সঙ্গে যে তৃতীয় মাত্রার যোগে কবিতা শুদ্ধ শিল্পের সীমায় উত্তরিত হয়, সেই মননক্রিয়ার চিহ্ন তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল, ফলে তাঁর গানগুলির মহিমা যতটা না তাদের অন্তর্নিহিত কবিত্বে তার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় সুরের ব্যঞ্জনায়। সংগীতের যে কোনো আঙ্গিকেই তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দচারী। সাহিত্যিক বাংলা ছাড়াও আরবি, উর্দু, ফারসি এবং গ্ৰাম্য বাংলা শব্দের ব্যবহার করেছেন প্রায় জাদুকরের মতন – তার স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর গানে। জীবনের প্রয়োজনেই তাঁকে গানকে পেশা করে নিতে হয়েছিল, ফলে নির্মাণ করতে হয়েছিল অজস্রধারায় গান জনচিত্তজয়ী উপাদানের দিকে খেয়াল রেখে। সেইজন্য তাঁর কবিতাগুলির ভাষা প্রায়ই ব্যঞ্জনাময়তার বদলে আক্রান্ত হয়ে পড়ে বর্ণনাময়তায়। কোনো গানের আস্থাইটা ভারি সুন্দর, কিছুটা এগোবার পরই হঠাৎ কোনো অমার্জিত শব্দের প্রয়োগে, কোনো স্থুল স্পর্শে মোহ ভেঙে যায়। তিনি ছিলেন আগাপাশতলা স্বভাবকবি এবং আগাগোড়াই লিখে গেছেন কোনো পরিশীলনের তোয়াক্কা না করেই অনেকটা শীলার বর্ণিত naïve কবিদের মতো। বিভিন্ন প্রতিকূলতার পরিবেশে শেষ অবধি নজরুল প্রতিভা খুঁজে পায় না উত্তরণের পথ, সে জন্যই তাঁর সৃ্ষ্টি পৌঁছয় না কোনো পরিণতিতে। ‘আমি চির শিশু, চির কিশোর’ – তাঁর নিজের উক্তিই যেন তাঁর সাহিত্যিক জীবনে হয়ে উঠল এক ট্র্যাজিক ভবিতব্য। এতদ সত্ত্বেও নজরুলের গান অন্যের অবাঞ্ছিত সুর এবং গায়কীর অত্যাচার সহ্য করেও শুধুমাত্র তাঁর ঐশ্বরিক সাংগীতিক বোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের গুণ এবং প্রাণশক্তির জোরে আজ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অহংকার, অলংকার এবং উত্তরাধিকার , এ ব্যাপারে আশা করি দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই।

তবে এঁদের মধ্যে বাল্মীকি ছাড়া মহাকবির অভিধা কাউকেই দেওয়া যায় না, আর তাঁর লেখা কালের পারাবার পেরিয়ে আমাদের কালে এসে পৌঁছলেও, তাঁর সুর ব্যঞ্জনা এখন অমরাবতীর সামগ্ৰী, মর্তবাসী দীর্ঘকাল সে রসে বঞ্চিত। বাল্মীকি বাদ দিলে একমাত্র মহাকবির কলম নিয়ে গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ । বুদ্ধদেব বসু যেমন বলেছেন:
“কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গানের ছলে কাব্যের যে চোখ-ধাঁধানো, প্রাণ-কাড়ানো হিসেব-হারানো ঐশ্বর্য আমাদের ঘরের আঙিনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার কথা আমরা কী বলবো ? … এ-গানগুলি শ্রেষ্ঠ কবিতা … “
রবীন্দ্রনাথ যেমন নতুন নতুন ছন্দ সৃষ্টি করতে করতে কবিতার ভাষা তৈরী করে নিয়েছেন, গানের ক্ষেত্রেও তাই। কবিতায় মাত্রাবৃত্ত আবিষ্কার করলেন এবং উদাহরণস্বরূপ পাঁচমাত্রার ছন্দের কবিতার জন্য গানেতেও তার উপযুক্ত সংগতের ব্যবস্থা করে নিলেন নতুন তালের সৃষ্টি করে। ৩/২ মাত্রার ঝম্পক, যেমন:
আমারে তুমি/ অশেষ করে/ছ (৫+৫+১)
এমনি লীলা/ তব (৫+২)
ফুরায়ে ফেলে/আবার ভরে/ছ (৫+৫+১)
জীবন নব/নব (৫+২)
এইভাবে কবিতায় যে scan করা যেতে পারে, যেখানে শেষপর্বে কোথাও ১ মাত্রা আবার কোথাও ২ মাত্রার অপূর্ণ পদ রাখা, এটা বাংলা কবিতায় এর আগে কক্ষণো হয় নি। এজরা পাউন্ড এই ছন্দ সম্বন্ধে লিখেছিলেন ” The third song (“আমারে তুমি অশেষ করেছ “) is even more interesting in its construction, and is comparable to first “pes” of the strophe in some very elaborate Tascan canzoni. it is rhymed and measured as follows. We have no equivalent in Greek or English for these feet of five syllables and the reader had better considered them purely as musical bars.
1.2.3.4.5 – 1.2.3.4.5. – 1. rhyme in cho
1.2.3.4.5. – 1.2 rhyme in tabo
1.2.3.4.5. – 1.2.3.4.5. -1. rhyme in cho
1.2.3.4.5. – 1.2. rhyme in naba
এই যে কবিতায় নতুন সৃষ্টি ৩+২ মাত্রার ছন্দ গানের তালেতেও নতুন সৃষ্টি করে নিতে হল। এরকম প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। ষষ্ঠী তাল , রূপকড়া, নবতাল, একাদশী, ইত্যাদি সবই কবিতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। কবিতায় যেমন গানেতেও রবীন্দ্রনাথের মূল কৃতিত্ব Scansion এর বৈচিত্র্যে।
প্রায় দুহাজার গানের মধ্যে সুর ব্যতিরেকে অন্তত কয়েকশ গান আছে যারা কবিতা হিসেবেও কলাসিদ্ধিতে সম্পূর্ণ এবং যাদের প্রণোদনা আজও সমানভাবে উজ্জ্বল এবং ক্রিয়াশীল। এমন সুস্পষ্ট কাব্যিক রূপ, শিল্পগরিমা, ধ্রুপদী বিন্যাস যা প্রায় সনেটের মতোই মিতবাক এবং যা প্রায়ই চারুপদ্যের মধ্যমিল- অন্তমিলের তরল ধ্বনিমাধুর্যের সীমানা ছাড়িয়ে কবিতার শুদ্ধ সীমায় বীণার মতো ধ্রুবপদে ঝঙ্কৃত। রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী গানের ইতিহাসে এমনকি রবীন্দ্রোত্তর কালেও, যে কোনো ভাষাতেই এমন উদাহরণ বিরল। গানগুলির কিছু কিছু বিশ্লিষ্ট পঙক্তি এখানে উদাহরণ স্বরূপ আমরা দেখে নিতে পারি :
১) ঘিরেছিল বনগন্ধ ঘুমের চারিধারে …
২) বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে …
৩) কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে
গন্ধ ছড়াল ঘুমের প্রান্ত পারে …
৪) স্বপ্নভারে জমল বোঝা চিরজীবন শূন্য খোঁজা …
৫) অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা
আমারে তার অর্থ শেখা …
৬) তার আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্যপর্বত…
৭) সেথায় তৃণ তরু যত
মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মতো…
৮) রক্তে রেখে গেছে ভাষা , স্বপ্নে ছিল যাওয়া আসা …
৯) তুমি কিছু নিয়ে যাও বেদনা হতে বেদনে …
১০) কত দিনের কত ব্যথা হাওয়ায় ছড়ায় ব্যাকুলতা …
১১) সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,
পথ হারানোর বাজিছে বেদনা সমীরণে।…
১২) অম্বরপ্রান্তে যে দূরে ডম্বরু গম্ভীর সুরে
জাগায় বিদ্যুৎছন্দে আসন্ন বৈশাখী –
১৩) আবেশ লাগে বনে শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে …
১৪) তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে –
ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি-‘পরে।…
১৫) “এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে,
তরী এল তীরে –
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় না কো …”
তুলনীয় : “সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন…” – জীবনানন্দ দাশ
একজন গান শোনাবার জন্য বিনিদ্র প্রহর জেগে থাকেন, অন্যজন অন্ধকারে একা একা আয়োজন করেন পাণ্ডুলিপির। এক আধুনিক কবির সুর এসে যেন মিলে গেল এক চির-আধুনিক কবির সুরধুনীতে।
এ কি শুধুই মাত্র একটি ব্যতিক্রমী সমাপতন? আরো কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক :
“বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা …” গীতবিতানের প্রারম্ভিকা – রবীন্দ্রনাথ
“- তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী! – জীবনানন্দ দাশ
“হৃদয়ে যে কথা লুকানো রয়েছে সে আর জাগাস নে।।” – রবীন্দ্রনাথ
“কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে !” – জীবনানন্দ দাশ
“কূজনহীন কানন ভূমি দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে…” – রবীন্দ্রনাথ
“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া…” – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অনুসন্ধিৎসু পাঠক আরো হয়তো উদাহরণ পাবেন।
১৬) আকাশের বিদ্যুৎ বহ্নি অভিশাপ গেল দেখি …
এরকম অজস্র কবিতার মণিমাণিক্য যা রবীন্দ্রনাথের আগে এবং পরে কোনো গীতিকারের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই সুচারু গীতিকার ছিলেন কিংবা এখনো লিখে চলেছেন, কিন্তু কেউ মহাকবির কলম নিয়ে জন্মগ্ৰহণ করেন নি।
প্রত্যেকটি গানেই তাঁর নিজস্ব সুর সংযোজন এবং কবিতার কথার ভাবকে সংগীতের স্বরের রসায়নে জারিয়ে তুলে যে এক অপূর্ব কথা ও সুরের যৌগপদ সৃষ্টি করে নেন যা আর শুধু কথা বা সুর বলে আলাদা করা যায় না, হয়ে ওঠে কালজয়ী সংগীত যেখানে বাউল এসে কেদারায় হাত ধরে, ঝিঁঝিটে মেশে ইটালিয়ান সুর। “তুমি একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে ” – গানটির কাঠামো মোটামুটি কেদারা রাগের । কিন্তু এর দ্বিতীয় পদে “বাউলের সুর লেগেছে, এনে দিয়েছে উদাস ভাবের করুণ বিহ্বলতা ” – এ কথাটা লিখেছিলেন স্বয়ং কণিকা এবং বীরেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়” কেদারায় বাঁধা এই গানটিতে যে অসীমের মধ্যে মুক্তির আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে তা কি বাউলের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করে না ? এক সময় ‘আমি চিনি গো তোমারে’ গানটিকে ইটালিয়ান ঝিঁঝিট বলে চিহ্নিত করা হত , ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ‘ গানটিকে বলা হত স্কচ কেদারা, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ‘কে স্কচ ভুপালি। রাগ-রাগিণী খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসে অথচ বাসটিকে অস্বীকার করে না। কোথাও স্বেচ্ছাচারী নয় এবং এই সৃষ্টির প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্য এমনই যে শুনলেই যে কেউ বলে দেবে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। দেশীয় ঐতিহ্যের বিপুল উত্তরাধিকার তাঁর জন্মসূত্রেই পাওয়া, এর সঙ্গে সারা জীবন ধরে তিনি অর্জন করে নিয়েছেন দেশাতিরিক্ত সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে। উদাহরণস্বরূপ আমরা ওপরের প্রথম বাক্যটি যদি দেখি –
” ঘিরেছিল বনগন্ধ ঘুমের চারিধারে”-তে যে তানটি রয়েছে মধ্যসপ্তকের কড়ি মধ্যম-পঞ্চম থেকে ক্রমান্বয়ে উত্তরণ প্রতিটি শুদ্ধ পর্দা বেয়ে একেবারে তারসপ্তকের শুদ্ধ গান্ধার ছুঁয়ে একই পথে মধ্যসপ্তকের পঞ্চমে ফিরে আসা যেন চারিধারে পাক খেয়ে ঘুরে এসে বৃত্ত সম্পন্ন হল।
তেমনি যদি শেষ উদাহরণ নেওয়া যায় – ‘আকাশের বিদ্যুৎ বহ্নি অভিশাপ গেল লেখি’ – তে তারসপ্তকের শুদ্ধ গান্ধারে বিদ্যুৎ তার সমস্ত অগ্নি উদ্গীরণ সম্পন্ন করে মধ্য সপ্তকের শুদ্ধ গান্ধারে ( একই পর্দা শুধু ওপর সপ্তক থেকে নীচের সপ্তকে, যেন শীর্ষ থেকে সানুদেশে) এসে অভিশাপ লিখে তবেই সে সংবৃত হল । এই কথাগুলিকে অন্য কোনো স্বর প্রয়োগে যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন একই ভাবে আন্দোলিত করতে পারে কিনা। তাই রবীন্দ্রনাথের যে সব সুর হারিয়ে গেছে তাতে অন্যের সুর সংযোজন অপরাধ বলেই গণ্য করা উচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য স্পর্শস্বর, শ্রুতি ও মীড়ের সঠিক ব্যবহার। এছাড়াও ছোট ছোট রাবীন্দ্রিক টপ্পার দানা যা দীর্ঘ সাধনা এবং প্রকৃত গুরুর তত্ত্বাবধান ছাড়া আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এর সুরের আপাতসারল্য বহু যত্নে লভ্য, তাই এই সংগীতকে কোনোমতেই প্রচলিত উচ্চাঙ্গসংগীত বা লোকসংগীতে প্রত্যাবর্তন বলা যাবে না। এ একেবারে নতুন সৃষ্টি যেখানে কাব্যিক বৈশিষ্ট্য সাংগীতিক স্বাতন্ত্রে একাত্মতা পায় অথচ সুর কখনই ভূমিকাভ্রষ্ট হয় না। তাঁর সুরের উপরিতলে যতই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বৈচিত্র্য ফুটে উঠুক না কেন, শিকড় থাকে ভারতবর্ষীয় সংগীতের গভীরে। এ যাবৎ ৬৬ খণ্ডে প্রকাশিত ” স্বর বিতানের প্রথম দিককার রচিত ৫৪৬টি গানের রাগ-রাগিণী ও তালের নির্দেশ দেওয়া আছে (‘স্বরবিতান খণ্ড’)৪, ৮, ৯, ১০, ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৫,২৬,২৭,২৮,২৯,৩২,৩৫,৩৬,৩৭,৩৮,৪৫ দ্রষ্টব্য) রাগ-রাগিণী ও তালের বৈচিত্র্যও কম বিস্ময়কর নয় । বর্তমান প্রবন্ধে এই ৫৪৬টি গানে ব্যবহৃত রাগ-রাগিণী ও তালের সংখ্যা দেখানো হল। ” সমীক্ষা করেছিলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর ‘সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান’ বইটিতে। দেখা যাচ্ছে গীতবিতানে সঙ্কলিত রবীন্দ্রনাথের ২২৩২ গানের মধ্যে (১৮৭৫টি গানের সুর পাওয়া যায় – সূত্র : ডঃ পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকারের ‘গীতবিতান ভাণ্ডার ‘) মাত্র ৫৪৬টি গানে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত রাগের সংখ্যা ১৩৪ এবং উক্ত গানেতে ব্যবহৃত তালের সংখ্যা ২৮। অবিশ্বাস্য!
এখানে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূল্যবান মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক : “…অতএব বিচিত্র সুরের ও মিশ্রণের প্রয়োজন রয়েছে। সে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ মিটিয়েছেন – হিন্দুস্থানী সুরপদ্ধতির abstract nature-কে concrete করে, এক কথায় সুরকে humanise করে, অথচ তাকে আর্ট থেকে artifice-এর নিচু পঙক্তিতে নামতে না দিয়ে। শুনেছি ও পড়েছি বিলেতে বীটহোফেন্ এই কার্য করে ছিলেন। যদি সত্য হয়, তা হলে রবীন্দ্রনাথকে তাঁরই সঙ্গে তুলনা করা চলে, আমাদের দেশে তাঁর সমতুল্য composer জন্মায় নি ।”

৭ই জানুয়ারী,১৯৩৫ ধূর্জটিপ্রসাদকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ” বাংলাদেশে আমার নামে অনেক প্রবাদ প্রচলিত; তারি অন্তর্গত একটি জনশ্রুতি আছে যে , আমি হিন্দুস্থানী গান জানি নে, বুঝি নে। আমার আদি যুগের রচিত গানে হিন্দুস্থানী ধ্রুবপদ্ধতির রাগরাগিনীর সাক্ষীদল অতি বিশুদ্ধ প্রমাণসহ দূর ভাবী শতাব্দীর প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিদারুণ বাকবিতণ্ডার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ইচ্ছে করলেও সেই সংগীতকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি নে; সেই সংগীত থেকেই আমি প্রেরণা লাভ করি এ কথা যারা জানে না তারাই হিন্দুস্থানী সংগীত জানে না।”
যে কোনো কালোত্তীর্ণ শিল্পই ভাবী কালের শিল্পকলার আগ্নেয় সত্তায় আপন সৃষ্টিবীজের স্বাক্ষর রেখে যায়।
কবির কল্পিত সেই দূর ভাবী শতকে দাঁড়িয়ে আমরা স্রষ্টার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলতে দেখছি। বাকবিতণ্ডা তো সেই কবেই শুরু হয়েছিল, আজও তার বিরাম নেই। কিন্তু তাঁর গান ভেঙে যখন দেখি প্রখ্যাত মার্গ সংগীত শিল্পীরা এক একটি বন্দিশ তৈরী করছেন তখন বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টি সৃষ্টিকলায় আজো ক্রিয়াবান এবং ভবিষ্যতেও যে তার ব্যত্যয় হবে না এ বিষয়ে এখন জোর দিয়েই বলতে পারি :
যেমন প্রখ্যাত সরোদীয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘আজি যত তারা তব আকাশে’-র অনুপ্রেরণায় মাজখাম্বাজে কিংবা ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ থেকে তৈরী করে নেন অসাধারণ পীলু বন্দিশ, কিংবা স্বয়ং আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের হেমন্ত রাগ সৃষ্টির পেছনে “আধেক ঘুমে নয়ন চুমে” গানটির প্রেরণা। বিস্ময়ের কথা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯৩৫ এর আগষ্টে বর্ষামঙ্গল উৎসবে অতিথি শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন, সঙ্গে পুত্র আলি আকবর খাঁ এবং দিন ১৫ সেখানে থাকা কালীন এই রাগটি সৃষ্টি করেন। সারা আশ্রমে তখন গুঞ্জরিত কবির নতুন সৃষ্টি “আজি বরিষণমুখরিত শ্রাবণরাতি” (প্রকাশিত ০৬/০৮/১৯৩৫) গানের সুরে। জানি না এই সুরের রেশ খাঁ সাহেবের অবচেতনে কোনো ছাপ ফেলেছিল কি না। কয়েকদিন বাদে যখন হেমন্ত রাগটি সৃষ্টি করে কবিকে শোনালেন, দেখা গেল বিলাবল ঠাটের রাগটির (ঔড়ব-সম্পূর্ণ) চলন রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের খুব কাছাকাছি, কেবল রবীন্দ্রনাথ সঞ্চারীতে শুদ্ধ ঋষভের জায়গায় কোমল ঋষভ ব্যবহার করেছেন মাত্র। কিন্তু একেবারেই মিলে যায় ৯ বছর আগে তৈরী ‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’ গানটির সুরের সঙ্গে। বর্তমানে এই দুটি গানকেই বিশেষজ্ঞরা হেমন্ত রাগে উল্লেখ করেন। এ যেন রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ লেখার ঘটনা।
এ ছাড়াও অন্যান্য গুণী শিল্পীদের হাতে তৈরী হয়েছে :
তিলক কামোদ , সুরফাঁকতালে রচিত ‘ শান্তি করো বরিষণ’ এর স্থায়ী থেকে মধ্যলয়ের অনুপম গৎ , ‘এমন দিনে তারে বলা যায় ‘ ভেঙে দেশমল্লারে ত্রিতালের গৎ , ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম ‘ ভেঙে ইমনকল্যাণে মধ্যলয়ে ত্রিতালে গৎ, ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল’ ভেঙে খাম্বাজ/দাদরায় গৎ , ‘যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার’ ভেঙে কাফি/ঝাঁপ তালে, ‘তব দয়া দিয়ে হবে যে মোর জীবন ধুতে ‘ ভেঙে ভৈরবী , ‘স্বপ্নে আমার মনে হল ‘ ভেঙে হাম্বীর, কিংবা ‘সে কোন বনের হরিণ ছিল ‘ ভেঙে হেমন্তের গৎ ।
রবীন্দ্রনাথের নিজের গলায় তাঁর গান শুনতে শুনতে এজরা পাউন্ডের মনে হয়েছিল ” We have found our new Greece, suddenly.” তাঁর শুধু মনে পড়ছিল তুলনীয় দান্তের প্যারাডিসো।
“Ecco chi crescera linostri amori (ঐ দ্যাখো! আমাদের প্রেমগুলি যিনি বিকশিত করেন)। “Mr. Tagore” teaches his songs and music to his jongleurs, who sing them throughout Bengal. He can boast with the best of the troubadours… ” লেখেন তিনি। এজরা পাউন্ড যিনি বাংলা ভাষা এবং ভারতীয় সংগীতের শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষকে সহজাতভাবে পান নি তা সত্ত্বেও তাঁর এই পর্যবেক্ষণ আমাদের বিস্মিত করে।
আর অননুকরণীয় বুদ্ধদেব বসু লেখেন “তাঁর গান মনে না ক’রে আমরা দেখতে, শুনতে, ভালোবাসতে, ব্যথা পেতে পারি না, আমাদের নিগূঢ় মনের বিরাট মহাদেশের কোথায় কী আছে হয়তো স্পষ্ট জানিনে, তবে এটা জানি যে সে-মহাদেশের মানচিত্র আগাগোড়াই তাঁর গানের রঙে রঙিন।”
শেষ করব কবির নিজের গান সম্বন্ধে আত্মোপলব্ধির নির্মোহ অথচ প্রত্যয়ী উচ্চারণের রেশটুকু নিয়ে:
” জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি নে। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবুও বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না; যুগ বদলায়, কাল বদলায়, তার সঙ্গে সব কিছুই তো বদলায়। তবে সব চেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালিরা, শোকে, দুঃখে, সুখে, আনন্দে, আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এই গান তাদের গাইতে হবেই।”
অস্তাচলের ধারে বসে পূর্বাচলের পানে তাকিয়ে স্মৃতিকাতর কবি মৃত্যুর ঠিক সাত মাস আগে ০৯/০১/১৯৪১ তারিখে রানী চন্দকে আলাপচারিতায় এই কথাগুলি বলেছিলেন। কী গভীর সত্য ছিল তাঁর এই উচ্চারণ। আজ শোকে, দুঃখে, সুখে, আনন্দে তাঁর গান মন্ত্রের মতো মন্দ্রিত হয়ে চলেছে বাঙালির ভবনে ভবনে। জানি না পৃথিবীর ইতিহাসে এর দ্বিতীয় উদাহরণ আছে কি না।
*
তথ্যসূত্র :
১) গীতবিতান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) সংগীত চিন্তা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩) জাপান-যাত্রী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪) আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ: রানী চন্দ
৫) গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন: সৈয়দ মুজতবা আলী
৬) শান্তিনিকেতনে আলাউদ্দিন খাঁ : বীতিহোত্র রায় (প্রৈতি, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা , ১৩৯৬)
৭) ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী (৩য়)
৮) রবীন্দ্রনাথের গান : বুদ্ধদেব বসু
৯) সংগীতে রবীন্দ্রপ্রতিভার দান : স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ
১০) The Complete Works of William Shakespeare
১১) রামকথার প্রাক্- ইতিহাস – সুকুমার সেন
১২) সেকাল থেকে একাল (রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস্ , পাউন্ড) – বিষ্ণু দে
১৩) Rabindranath Tagore – Ezra Pound
১৪) অন্তর্জাল তথ্যভান্ডার
খুব ভালো লাগলো। দেশি ও বিদেশি সঙ্গীত শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞান আর অসাধারন দখল না থাকলে এইরকম উপস্থাপনা প্রস্তুত একেবারই অসম্ভব, বিশেষ করে এখনকার অপসংস্কৃতির যুগে। আপনারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন সঙ্গীত জগৎকে।
খুব ভাল লেখা।