শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

সুকুমার রায় ও বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি – প্রয়াণ শতবর্ষে ফিরে দেখা

সুকুমার রায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ একদা লিখেছিলেন, “…তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেজন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন।” যে ধরণের বৈপরীত্য সুকুমারের খেয়াল-রসসিক্ত রঙ্গসাহিত্যের মুখ্য উপজীব্য, তার পেছনে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিসঞ্জাত কোনো গাম্ভীর্যের ক্রিয়া নিহিত ছিল, এমন কথা বললে প্রথমে তা’ কিছুটা স্ববিরোধী শোনাতেই পারে। তার প্রধান কারণ, আমরা সুকুমারের এ ধরনের তাবৎ রচনাকে একরকম শিশুসেব্য হালকা ভোজ্য বলেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি, এবং বিজ্ঞান, আজও আমাদের কাছে প্রায়ই এক ধরনের দুরূহ ও বহিরারোপিত ব্যাপার হয়ে আছে। ফলত সুকুমার সাহিত্যের আপাত-আজগুবি জগৎকে বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর ভাবকল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা আমাদের কাছে যথেষ্ট আয়াসসাধ্য, বিভ্রান্তিকরও বটে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর তরুণ বন্ধু সুকুমারের স্বভাব পর্যবেক্ষণ করে এই যে “বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য” শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন, এতে একটু তলিয়ে ভাববার বিষয় আছে।

লন্ডনে তোলা গ্রুপ ফটো, ১৯১৩। সুকুমার, রোদেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ, সামনে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। এসময় ইংলন্ডে সুকুমার মুদ্রণবিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যার শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন।

‘গাম্ভীর্য’ বলতে এখানে হাস্যরসের বিরোধী কোনো গোমড়ামুখো খটোমটো ব্যাপার নয়, বোঝানো হয়েছে সেই বস্তুটিকে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সিরিয়াসনেস’। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হতে পারে, সুকুমার প্রধানত যেসব হালকা রসের ‘আবোল তাবোল’ পণ্য নিয়ে কারবার করেছেন, সেগুলো কি আদৌ কোনো সিরিয়স বস্তু! তার উত্তরে বলতে হয়— দৈনন্দিন সাংসারিক ঘটনাবলীই হোক, বা ব্যক্তিচরিত্রই হোক, তার বৈপরীত্য উদ্ঘাটন করতে হলে চাই সেগুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সম্যক বিশ্লেষণের দক্ষতা, যার অপর নাম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা। তাই আপাতদর্শনে যা আজগুবি বা অবাস্তব কল্পনা, তা কিন্তু জীবন সম্পর্কে খুব পোক্ত ধরনের সত্যদর্শন, বাস্তব সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান না থাকলে যথাযথভাবে গড়ে উঠতে পারেনা। সুকুমার নিজেই লিখেছিলেন, “…অবাস্তবকে কতকগুলি জ্ঞানত বাস্তবের রূপান্তর বা নূতন রকমের সমাবেশরূপেই আমরা কল্পনা করিয়া থাকি। সুতরাং ‘অলৌকিক রসের অবতারণা’ করিতে হইলে লৌকিকের জ্ঞানটা একটু বিশেষ মাত্রায়ই আবশ্যক। [‘ভারতীয় চিত্রশিল্প’] কাজে কাজেই সুকুমার-সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোর চেহারা যেভাবেই ফুটে উঠুক বা বিজ্ঞানের ছায়া যত অদ্ভুতভাবেই এসে থাকুক, এটা জানা জরুরী হয়ে পড়ে যে তাঁর ব্যক্তিজীবনে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি কোন্ প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল ।

বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি চর্চা ও পরিমণ্ডল

রবীন্দ্রনাথ সুকুমার রায়ের স্বভাবের মধ্যে যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য দেখেছিলেন, প্রকৃত পক্ষে তা তৈরী হয়েছিল তাঁর শৈশব থেকেই এক বৈজ্ঞানিক আবহমণ্ডলে শ্বাসবায়ু আহরণ করে আর বিজ্ঞানের নানা বিভাগে আত্মনিয়োজন ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির একটি তৈরী আবহমণ্ডল তিনি পরিবারের মধ্যেই পেয়ে গিয়েছিলেন। বাবা উপেন্দ্রকিশোর মুদ্রণ ও আলোকচিত্রের কারিগরীতে কুশলী ও কৃতবিদ্য ছিলেন এবং খ্যাতকীর্তি উদ্ভাবকও। বিরাট আকারের প্রসেস ক্যামেরা, ব্লক তৈরির কর্মশালা, ডার্করুম, রাসায়নিক সামগ্রী এসব সুকুমার ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছেন। অন্যদিকে এদেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি তাঁর দিদিমা—যাঁর ঘরে ঝোলানো দেখা যেত নরকঙ্কাল। আবার পিসেমশাই শ্রুতকীতি হেমেন্দ্রমোহন বসু ওরফে ‘এইচ বোস’, যিনি শুধু ‘কুন্তলীন’ তেল ও দেলখোস সেণ্ট- খ্যাতি নন, মোটরগাড়ি ও সাইকেল নিয়েও ছিল তাঁর কারবার। তাঁর দোকানে ফোনোগ্রাফের নানা মডেল সাজানো দেখেছেন সুকুমার। বড় হয়েও কারিগরিবিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যায় । আবার বাবার কাছেই দূরবীন দিয়ে আকাশের গ্রহতারা দেখতে শিখেছিলেন সুকুমার সেই ছেলেবেলাতেই। পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন এই দু’টি বিষয়ে একসঙ্গে অনার্স নিয়ে তিনি স্নাতক হন।

সুকুমার ছোটবেলা থেকেই ফোটোগ্রাফির চর্চা করতেন এবং বিলেতের কিছু পত্রিকায় তাঁর তোলা আলোকচিত্র ছাপাও হয়েছিল। উচ্চতর মুদ্রণবিদ্যার ব্যবহারিক পাঠগ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে তিনি বিলেতে যান । সেখানে কারিগরী শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গেসঙ্গে চলেছিল মুদ্রণবিজ্ঞান সম্পর্কে সুকুমারের অধ্যবসায় ও অধ্যয়ন। হিপোগ্রাফ প্রিন্টিং সম্পর্কে সুকুমার এসময় বিশেষ আগ্রহী হন। পেনরোজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়েলে হাফটোন মুদ্রণ সম্পর্কে সুকুমারের দু’টি পেপার ছাপা হয় (১৯১২-১৩)। এ ছাড়া ব্রিটিশ জার্নাল অব ফোটোগ্রাফির মতো পত্রিকায়ও সুকুমারের পিন-হোল থিওরি বিষয়ক বক্তব্য ছাপা হয়েছে। (জুলাই ১৯১৩ )

ভারতীয় মুদ্রণ প্রযুক্তির রূপকার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কিশোর-সেব্য বিজ্ঞানের ভোজ্য

‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুকুমার রায় ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে কিশোরদের জন্য স্বনামে, বেনামে এবং ‘উহ্যনাম পণ্ডিত’ ছদ্মনামে ছোট ছোট নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। বিজ্ঞানের নানা শাখায় শিশু ও কিশোর পাঠকের লৌকিক জ্ঞানটুকু যাতে যথাযথ ভাবে হয়, সেজন্য তিনি এই নিবন্ধগুলোতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি। এই বিজ্ঞানবিষয়ক সিরিয়াস রচনাগুলোর বিষবস্তুর বিস্তার সামান্য নয়। রেলগাড়ি, মাটির বাসন, জাহাজ বা কয়লার মতো সাদামাটা বিষয় থেকে শুরু করে এর মধ্যে আছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশচর্চা, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ, রসায়ন ও ধাতুবিদ্যা, সমুদ্র ও আবহমণ্ডল প্রভৃতি নানা বিচিত্র বিষয়। এর বৈশিষ্ট্য ছিল সহজবোধ্য ভাষা, প্রাঞ্জল বর্ণনা, সাহিত্যিক ও পৌরাণিক উপমার সাবলীল ব্যবহার আর মজলিশি বাচনভঙ্গী এবং সর্বোপরি এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য, বিশেষত তা যদি হয় শিশুভোগ্য, সর্বপ্রথম গুণ যে প্রাঞ্জল প্রকাশক্ষমতা, সুকুমার তার প্রয়োগকলার নিপুণ শিল্পী ছিলেন। তাঁর এই রচনাগুলোতে কঠিন বিষয়ের সহজ উপমার সাহায্যে উপস্থাপন আবার সহজ বিষয়ের মধ্যেও গভীরতর রহস্যের উদ্ঘাটনে স্বচ্ছন্দ দক্ষতা থেকেই তা মালুম হয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, মেরুজ্যোতি ও পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সম্পর্কের বিষয়টির বর্ণনার একটি অংশ :- “… এই পৃথিবীটা একটা প্রকাণ্ড চুম্বকের গোলা—সেই চুম্বকের এক মাথা উত্তরে আর এক মাথা দক্ষিণে, মেরুর কাছে। আর সূর্যটা যেন একটা প্ৰকাণ্ড বিদ্যুৎশক্তির কুণ্ড—তার মধ্য থেকে নানারকম আলো আর বিদ্যুতের তেজ আকাশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। … পণ্ডিতেরা বলেন এই সূর্যের বিদ্যুচ্ছটা আর পৃথিবীর চুম্বকশক্তি আর এই আলেয়ার আলো—এই তিনটির মধ্যে ভিতরে ভিতরে খুব একটা সম্পর্ক দেখা যায়।… সূর্যের গায়ে যখন ঘূর্ণির মতো দাগ দেখা যায় তখন পৃথিবীতেও চুম্বকের দৌরাত্ম্যে দিগদর্শন যন্ত্রগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে—আর মেরুর আকাশে যেখানে পৃথিবীর এই চুম্বকের মাথা, সেখানে এই আলেয়ার আলো আরো দ্বিগুণ উৎসাহে নূতন বাহার দেখিয়ে খেলা করতে থাকে।” [আকাশ আলেয়া’]

‘বেগের কথা’ প্রবন্ধটিতে বেগের আপেক্ষিকতা প্রসঙ্গে সুকুমারের উপমা কীরকম চিত্তাকর্ষক দেখা যাক :- “তালগাছের উপর হইতে ভাদ্রমাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে, তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়, কিন্তু ঐ তালটাই যদি- পেয়ারাগাছ হইতে একহাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না।” এরপরই অন্তর্নিহিত জাগতিক সত্যটির উদঘাটন সুকুমার করেন এইভাবে :- “চলন্ত জিনিষমাত্রেরই এইরূপ একটা ধাক্কা দিবার ও বাধা দিবার শক্তি আছে। পণ্ডিতেরা বলেন, জগতে যা কিছু তেজ দেখি, যে কোনো শক্তির পরিচয় পাই, সমস্তই এই চলার রকমারি মাত্র। বাতাসে ঢেউ উঠিল, অমনি শব্দ আসিয়া কানে আঘাত করিল—আকাশে তরঙ্গ ছুটিল, অমনি চোখের মধ্যে আলোর ঝিলিক জ্বলিল।…” বিজ্ঞানের মৌল তত্ত্ব যেন কত সহজ হয়ে উঠেছে সুকুমার রায়ের হাতে।

উদাহরণ ও উপমার সাবলীল প্রয়োগ সুকুমারের বৈজ্ঞানিক রচনার একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। দৈনন্দিন ঘটনাবলী থেকে উদাহরণ যেমন তিনি চয়ন করেন, তেমনই স্বচ্ছন্দে উপমা তুলে আনেন আমাদের পুরাকাহিনী ও জ্ঞানবিশ্বাসের পরিচিত জগত থেকে। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি পর্যায়ে নীহারিকা থেকে উদ্ভূত জমাট বাষ্পপিণ্ডের তিনি অবলীলায় তুলনা দেন ঘুরন্ত চাকার গা থেকে যেমন কাদা ছিটকে যায় ব’লে, ক্যামেরার সঙ্গে চোখকে তুলনা করে লেখেন—“এক মিনিট খুব ঝাপসা জিনিসের দিকে

তাকাইলে মানুষের চোখ ক্লান্ত হইয়া পড়ে, কিন্তু ফোটোগ্রাফের প্লেট যত বেশি করিয়া তাকায় ততই বেশি দেখিতে পায়।…” [নীহারিকা] সূর্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে সৌরকলঙ্কের তুলনা তিনি করেন ‘ফোসকা’র সঙ্গে আবার দরকার হলে অনায়াসপটুত্বে আমদানি করেন রূপকথার উপমা বা সাহিত্যিক রূপকল্প।

পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেখানে কল্পনা করেছিলেন এক দুঃসাহসী দৈত্যের, যে হাত বাড়িয়ে পৃথিবী থেকে সূর্যকে ছুঁতে পারে [ বিশ্বপরিচয়], সেখানে সুকুমার এই দূরত্ব বোঝাতে ব্যবহার করেছেন ইঞ্জিনের উপমা, ঘন্টায় সাত মাইল বেগে সূর্যের দিকে ছুটতে শুরু করলে যা, সূর্যে গিয়ে পৌঁছবে ১৭৭ বছর পর। [সূর্যের কথা] কয়লা খনিতে দীর্ঘস্থায়ী যে আগুন জ্বলে, সে সম্পর্কে তাঁর রচনাটির নাম সুকুমার দিয়েছেন ‘রাবণের চিতা’, রেডিও প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন পৌরাণিক আকাশবাণীর কথা আবার ক্লোরোফর্ম প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মহাভারতের সম্মোহন ৰাণের। [‘ক্লোরোফর্ম ]

বৈজ্ঞানিক কল্পন্যাসলেখকের যে দূরকল্পনা ভবিষ্যৎকে স্পর্শ করে যায় তার সার্থক নমুনা সুকুমারের লেখাতেও দেখতে পাওয়া যায়। ‘চাঁদমারি’ শীর্ষক রচনায় চাঁদে যাত্রীবাহী রকেট চালিত মহাকাশযান পাঠানো ও তার ধীর অবতরণের পরিকল্পনা বেশ গুরুত্ব সহকারেই করা হয়েছে এবং সবশেষে সুকুমারের অভ্রান্ত ভবিষ্যদর্শন এ রকম :-“হয়ত তোমরা সব বুড়ো হবার আগেই শুনতে পাবে যে চাঁদের দেশের প্রথম যাত্রীরা চাঁদে যাবার জন্য রওনা হয়েছে। একইভাবে ‘আকাশবাণীর কল’ নামে নিবন্ধটিতে সুকুমার সংবাদ আদান প্রদানের উদ্দেশ্যে বেতারপ্রেরক যন্ত্রের ব্যবহারের কথা লিখেছেন এমন এক সময়ে, যখন তাঁর পাঠকদের মধ্যে বেতার যন্ত্রের ওরকম ব্যবহারের কোনো ধারণাই ছিলনা। সুকুমার রায়ের এ জাতীয় কল্পরচনার শেষ উদাহরণটি আমরা দেখব তাঁর ‘ভুইফোড়’ শীর্ষক রচনাটি থেকে, তাঁর জন্মশহরে তাঁর জন্মশতবর্ষের কয়েকবছর আগেই যে কল্পনা ফলে গেছে :- ”কথা হচ্ছে, কলকাতায় এইরকম ভুইফোঁড় সুড়ঙ্গের রেল বসান হবে। তা যদি হয়, তখন আর বর্ণনা দেবার দরকার হবে না, টিকেট কিনে চড়ে দেখলেই পারবে,— আর মনে করবে, এ আর একটা আশ্চর্য কি ?”

বৈজ্ঞানিক গাম্ভীর্যের উল্টোপিঠ

শিশু সাহিত্যের যে-বিভাগটির পসারী হিসেবে সুকুমার রায়ের প্রধান পরিচয়, তাকে সাধারণভাবে হাস্যরস, আজগুবি বা উদ্ভট রস, কখনো বা খেয়াল রস নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, যার জনপ্রিয়তম উদাহরণ অবশ্যই ‘আবোল তাবোল’। ‘শিল্প বিচার’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন তাঁর শিশুভোগ্য রচনার আপাত অবাস্তব ব্যাপারগুলোকে বাস্তবের রূপান্তর হিসেবে দেখা যেতে পারে। যেমন, ‘কাঠবুড়ো’ কবিতাটিতে হাঁড়ি নিয়ে ‘দাড়িমুখো’ যে বৃদ্ধটির বর্ণনা আছে, সে কিন্তু মূলত একজন কাঠ বিশেষজ্ঞ। কাঠের স্বাদ গন্ধ শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও “আশেপাশে হিজিবিজি আঁকে কত অঙ্ক” — এ তো আদতে বৈজ্ঞানিক গবেষণারই ছবি, উপস্থাপনাটুকুই শুধু মজার। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণার ছবি সুকুমারের আরো কিছু মজার রচনায় পাওয়া যায় যেমন ‘কি মুশকিল’, ‘নোট বই’, ‘বুঝিয়ে বলা’, ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’, ‘গন্ধ বিচার’ [খাই খাই]। তাই হালকা সুরে বললেও এসবের পেছনে রয়েছে সুকুমারের চিন্তার গাম্ভীর্য । আবোল তাবোল-এর আপাত-অবাস্তব জগৎকে যদি তার স্রষ্টার বাস্তব সম্পর্কে বেশীমাত্রায় অভিজ্ঞতার রূপান্তর হিসেবে দেখা যায়, তবে সেই সব হাল্কা ব্যঙ্গের পেছনে বিজ্ঞানচেতনা সম্পর্কে সিরিয়াস চিন্তার অবদান স্বীকার করতেই হয়। আসলে বিজ্ঞানচেতনাটা সুকুমারের স্বভাবের অঙ্গীভূত ছিল বলেই তিনি এই সংস্কৃতির অভাব যেখানেই দেখেছেন, আঘাত করেছেন, যেমন ‘ঝালাপালা’ নাটিকায় আমাদের কুসংস্কার তাঁর লক্ষ্যবস্তু। এতে দুলিরাম বলছে—‘আমাদের বেড়ালটা সর্দিগর্মি হয়ে মারা গেছে—’ জমিদার বলছে—’এসব বোধহয় সেই ধূমকেতুর জন্যে—’ ইত্যাদি।

কাঠবুড়ো

আবার এরই উল্টোপিঠ হচ্ছে সুকুমারের সিরিয়াস কিছু রচনা, যা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের জন্য লেখা। এগুলোও অবৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ও সংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে নিবেদিত। এখানে এগুলির বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই। তাই আমরা “দৈবেন দেয়ম্” প্রবন্ধের কিছু অংশ সবশেষে উদ্ধার করছি, যেখানে অদৃষ্টবাদ ও দৈবাশ্রয়ী অবৈজ্ঞানিক ভাবনার

বিরুদ্ধে সুকুমারের ঋজু মতামত সরাসরি নিক্ষিপ্ত হয়েছে:- “… কতগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে তখন তাহার প্রভাব কতদূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সবচাইতে বড় দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ।…ইহার চাইতে মানুষ যদি চার্বাকের মতো বেপরোয়া নাস্তিক হইয়া বলিত ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’…জীবনের পক্ষে তাহাও আশার কারণ হইত, অন্তত বোঝা যাইত যে প্রাণের আশা এখনো সে ছাড়ে নাই । বিজ্ঞানপ্রাণ জাতিমাত্রেরই জাগ্রত পুরুষকার — আবেষ্টনকে অতিক্রম করিবার জন্য মানুষের দুরন্ত সংগ্রাম, শিক্ষা ও সাধনা দ্বারা বাহিরের বিরুদ্ধশক্তিকে জয় করিবার অদম্য উৎসাহ। সুতরাং দৈবকে চূড়ান্তরূপে স্বীকার করিয়াও বিজ্ঞান আপনার সাধনবলে তাহার বিষদাঁত ভাঙিয়া রাখে।

বিজ্ঞানের জুজু যখন টিকিতত্ত্ব ও গঙ্গাজল মাহাত্ম্যের সমর্থনেও অবতীর্ণ হইয়া থাকে, তখন দৈববাদ যে বিজ্ঞানের দোহাই দিবে, সেটা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যথার্থ দরদ যেখানে আছে সাক্ষাৎ জ্ঞানস্পৃহা সেখানে জাগ্রত। জীবন ও সংসার সেখানে কেবল মায়ার পরিহাস নয় জীবন্ত প্রাণের উত্তাপ সেখানে দৈববাদের বীজকে ভর্জিত করিয়া ফেলে।”
আশা করি, এটুকু থেকে বিজ্ঞানপ্রাণ মানুষটির বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিবিষয়ক ধারণার কাঠামোটি কিছুটা বোঝা যাবে।

আকরপঞ্জী:-

১। সমগ্র শিশু সাহিত্য / সুকুমার রায়
২। বিজ্ঞানকর্মী সুকুমার/ সিদ্ধার্থ ঘোষ – দেশ ৬-৯-১৯৭০।
৩। দৈবেন দেয়ম্/ সুকুমার রায় –উৎস মানুষ, জুন ১৯৮৭।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Dipon Mitra
Dipon Mitra
4 months ago

ভারি সুন্দর লেখা। সুকুমার রায়ের এই বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে আমার ধারণা ছিল না। লেখক সুকুমার রায়ের নানান লেখার যে অংশগুলি উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলি থেকে প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সুকুমার রায়ের যে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাগুলি তুলে ধরেছেন সেগুলি সত্যিই প্রমাণ করে যে তাঁর বিজ্ঞানের জ্ঞান গভীর ছিল, এবং সেগুলিকে নেহাৎ তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তবিকভাবে তিনি বুঝতেন এবং বোঝাতে পারতেন। তবে তাঁর আবোল-তাবোল ও অন্যান্য যে উদ্ভট রসের রচনা অথবা বলা ভালো মৌলিক সৃষ্টি কিন্তু বৈজ্ঞানিক চেতনা সঞ্জাত ছিল বললে আমার বিবেচনায় এই উদ্ভট সৃষ্টিকে আমরা সঠিকভাবে ধরতে পারব না। বিজ্ঞানের উদ্ভাবনার পিছনে মানুষের কল্পনা শক্তির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তেমনভাবেই এই উদ্ভট রসসৃষ্টির পিছনেও কল্পনা শক্তির একটা মস্ত ভূমিকা থাকে। কিন্তু দুয়ের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। উদ্ভট রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যেরকম একজন সৎ কবি মৌলিক কাব্যভাষায় পৌঁছান তাঁর সাধনার ফলে, সুকুমার রায়ও তাঁর উদ্ভট রচনায় সেভাবেই পৌঁছিয়ে ছিলেন। তাঁর এই সমস্ত লেখাগুলি পড়লে এক অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তাঁর উদ্ভট রস একই সঙ্গে আনন্দ ও বিস্ময়বোধ তৈরি করে। এই রচনাগুলির থেকে তাঁকে বৈজ্ঞানিকের থেকে বেশি আমরা কবি হিসেবে পাই।