শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রবীন্দ্রনাথের গানের “অধরা মাধুরী”

রবীন্দ্রনাথের গানের “অধরা মাধুরী”/আবু সাঈদ ফিরোজ
সহজে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না এমন একটা অধরা মাধুরী আছে রবীন্দ্রনাথের গানে। রবীন্দ্র-তাত্ত্বিকেরা প্রায়শই রবীন্দ্রনাথের গানের এই বিশিষ্টতাকে পাণ্ডিত্যের বেড়াজালেই আটকে রাখতে পছন্দ করেন। তাঁদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি তথা ভারতীয় হয়েও ছিলেন বিশ্বনাগরিক। ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করেও বিশ্বের যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর তা আজীবন গ্রহণ করেছিলেন অত্যন্ত অকৃপণভাবে। ভারতীয় ঐতিহ্যের উপনিষদ ছিল তাঁর জীবন এবং জগত সম্পর্কিত চিন্তার ভিত্তি। ‘আনন্দ’ (ব্যাপক অর্থে) ছিল তাঁর চিন্তা এবং দর্শনের মূল কথা। অতএব তাঁর সঙ্গীত যে তাঁর এইসব মননশীল চিন্তা চেতনাকেই ধারণ করবে সেটাই স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক বলেই তা এমন এক মার্গে অবস্থান করে যেখানে চিন্তা জগতের উত্তরণ না ঘটিয়ে ভক্ত-শ্রোতাদের পক্ষে সহসা পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আর এই কারনেই রবীন্দ্রনাথের গানের সব মাধুরীই সহসা সকলের কাছে ধরা পড়ে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কিত এই জ্ঞানমার্গীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করেও বলা যেতে পারে জ্ঞানের চাইতেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রেম এবং ভক্তিতে ভরা। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে নিজেই বলেন —                                    
 
যারা  কথা দিয়ে তোমার কথা বলে
তারা  কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে।।
একের কথা আরে
বুঝতে নাহি পারে,
বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে ॥
যারা  কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর
তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর  ।।                       
বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে                                  
বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে ॥


 
এখানে এই গানে ‘কথা’ হল জ্ঞানমার্গের বিষয়। যুক্তি আছে এখানে, তর্ক আছে, আছে দর্শন, আছে মনন, আর তাই আছে জানা না-জানা, বোঝা না-বোঝার বিড়ম্বনা। আর ‘সুর’ হল ভক্তি তথা প্রেমমার্গের বিষয় তাই এখানে বোঝা না-বোঝা, জানা না-জানার বিড়ম্বনা নেই, আছে শুধু প্রেমের মধ্য দিয়ে চরণ তলে মিলিত হবার পরম আকুতি।
কিন্তু কথা যে কেবলই দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি করে সে কথাও ঠিক নয় মোটেই, অন্তত রবীন্দ্রনাথের গানে তো নয়ই। কারণ রবীন্দ্রনাথের গানে সুর এবং কথা রথ এবং সারথীর মতো। আর তাই এ গানের ভাবসম্পদ কথা এবং সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপেই প্রকাশিত। এখানে কথার অপূর্ব কাব্যময়তা সুরারোপিত হয়ে যে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে তা
কোথাও আর কারও গানে সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না।                  
 
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের গানে সঙ্গীতের ভাবসম্পদ যে কেবল বাণীর মাধুর্য কিংবা সুরের বৈচিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তাও কিন্তু নয়। সুরে-বাণীতে-ছন্দে-লয়ে সঙ্গীতের যে পরিপূর্ণ প্রকাশ তার মধ্যেই এ গানের ভাবসম্পদ নিহিত। প্রকৃতির মত সুষম এবং স্বাভাবিক ছিল তাঁর গান। তাঁর গান শুনলে মনে হয় এ গান যেন প্রকৃতিরই ঝর্ণাধারার মধ্যে সৃষ্ট এবং বিকশিত। এ গান যতটুকু প্রকাশিত হয় তার চেয়ে অনেকগুন অপ্রকাশিত থাকে। এ গানের সুর ও বাণী যতটুকু বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি “না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর” আড়ালে থেকে কুহক বিস্তার করে। যতটুকু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় এ গানের সংগীত-সুষমা তার চেয়ে অনেক বেশি অতীন্দ্রিয়ের অনুভূতিতে ভরা থাকে তা।

এ গানে “দুঃখ”  এবং “আনন্দ”  বিপরীতধর্মী  কোন বিষয় নয়  মোটেই,  বরং বৃহৎ দুঃখ এবং বৃহৎ আনন্দের অতলস্পর্শী  রূপ এক  এবং অখণ্ড এই গানে। “ছিন্নপত্রাবলী”-র আত্মকথাতে এ ইঙ্গিতই দিয়েছেন কবি নিজেই পতিসরে থাকা অবস্থায়, বলেছেন, “রামকেলি প্রভৃতি সকাল বেলেকার যে-সমস্ত সুর কলকাতায় নিতান্ত অভ্যস্ত এবং প্রাণহীন বোধ হয়, এখানে তার একটু আভাস মাত্র দিলেই অমনি তার সমস্তটা সজীব হয়ে ওঠে। তার মধ্যে এমন একটা অপূর্ব সত্য এবং নবীন সৌন্দর্য দেখা দেয়, এমন একটা বিশ্বব্যাপী গভীর করুণা বিগলিত হয়ে চারিদিককে বাস্পাকুল করে তোলে যে, এই রাগিনীকে সমস্ত আকাশ এবং সমস্ত পৃথিবীর গান বলে মনে হতে থাকে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়াযন্ত্রের মতো।”                                    
এছাড়া শিলাইদহে থাকতে লিখেছেন — “প্রকৃতির সঙ্গে গানের যত নিকট সম্পর্ক এমন আর কিছু না– আমি নিশ্চয়ই জানি এখন যদি আমি জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে রামকেলি ভাঁজতে আরম্ভ করি তা হলে এই রৌদ্ররঞ্জিত সুদূরবিস্তৃত শ্যমলনীল প্রকৃতি মন্ত্রমুগ্ধ হরিণীর মতো আমার মর্মের কাছে এসে আমাকে অবলেহন করতে থাকবে।
যতবার পদ্মার উপর বর্ষা হয় ততবারই মনে করি মেঘমল্লারে একটা নতুন বর্ষার গান রচনা করি — কথা তো ওই একই– বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ করেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু তার ভিতরকার নিত্যনূতন আবেগ, অনাদি অনন্ত বিরহ বেদনা, সেটা কেবল গানের সুরে খানিকটা প্রকাশ পায়।”

এ সব কিছু থেকে আমাদের মনে হয়েছে,  রবীন্দ্রনাথের গানের অধরা মাধুরী একটি নিত্য অথচ বিমূর্ত বিষয় এবং এর সন্ধান পেতে হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কিত কতকগুলি প্রতীতিকে অনিবার্য ভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হয়। এই প্রতীতির ধারণা যদিও আপেক্ষিক, রুচিভেদে যদিও এর ভিন্নতা থাকবে তবু নিচের কতকগুলি প্রতীতিকে আমরা
গ্রহণ করব আমাদের এই আলোচনাকে অর্থবহ করতে।

                                                    
(১) বিশ্বপ্রকৃতি তথা নিসর্গের সৌন্দর্যের কাছে পরিপূর্ণভাবে নিবেদিত হয়ে প্রচুরের সন্ধান লাভ– অনেকে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে অভিযোগ করে থাকেন যে, রবীন্দ্রনাথ নাগরিক কবিদের মতো নগরজীবনকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তেমনভাবে ধারণ করতে পারেননি। নগরজীবনের যুগ-যন্ত্রণা তাঁর লেখাতে তেমন ভাবে ফুটে ওঠেনি। এই অভিযোগের ব্যাপারে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও বস্তুতপক্ষে এই অভিযোগ অস্বীকার করা যায় না। আসলে রবীন্দ্রনাথ নগরজীবনের কবি ছিলেন না। নগরজীবনের যুগ-যন্ত্রনা তাঁর কবিতায় বা গানে দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারেনি কখনও। এর পেছনের বড় কারণটি হল রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য চেতনার ভিত্তি বা ক্যানভাসের বহুমাত্রিকতা বা অসীমতা। রবীন্দ্রনাথ যে সুন্দরকে তাঁর হৃদয় রাজ্যে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই সুন্দরের সুদূর-পিয়াসী বাঁধনহারা রূপ তাঁকে নগরজীবনের যুগযন্ত্রণার খণ্ডিত বাস্তবতাকে ধারণ করতে প্রয়াসী করেনি কখনও, বরং তা তাঁকে সব সময়ই নিয়ে গেছে কাছে থেকে দূরে, সীমা থেকে অসীমে। “আমার আপন গান আমার অগোচরে আমার মন হরণ করে,/নিয়ে সে যায় ভাসায়ে সকল সীমারই পারে।/ওই যে দূরে কূলে কূলে ফাল্গুন উচ্ছ্বসিত ফুলে ফুলে/সেথা
হতে আসে দুরন্ত হাওয়া, লাগে আমার পালে।” গানের মধ্যে এই যার আকুতি অর্থাৎ নিজের সৃষ্ট গান যার ইচ্ছাধীন নয়, বরং যিনি নিজেই তাঁর গানের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে অসীমের  পথে পাড়ি জমান, সেই “তিনি” কেমন করে কারও ইচ্ছা পূরণের জন্য নগরজীবনের ইট কাঠের বেদনার কথা ব্যক্ত করবেন তাঁর গানে! তাঁর ভাষাতেই বলি- “সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।/কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!/ ইটের পর ইট,  মানুষ মাঝে কীট– /নাইকো ভালবাসা, নাইকো খেলা।” — অতএব নগরজীবনের যন্ত্রণাকাতর  প্রাত্যহিকতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের সব মাধুরী ধরা না পড়াটাই স্বাভাবিক। যতটুকু ধরা দেয় তা শুধু মাত্র নগরজীবনের বৃত্ত বা বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে না পারা শিল্পী শ্রোতাদের কাছে ধরা দেবারই মত। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের গানের অধরা মাধুরীর ছোঁয়া পেতে হলে মহাবিশ্বের নৈর্ব্যক্তিকতা
একই সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে নিবেদিত হতে হয়। বেরিয়ে পরতে হয় অবগুণ্ঠনমুক্ত প্রকৃতির সন্ধানে।

সেখানে তারায় ভরা রাত্রির আকাশ কিংবা জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ধরণীর মধ্যে অবগাহন করে পরিপূর্ণ হতে হয়। প্রকৃতির খোলা আকাশ আর মুক্ত বাতাসে স্নাত হয়ে শুদ্ধ হতে হয়; আর এই শুদ্ধতার মধ্য দিয়ে শ্রোতার সঙ্গীতরুচির আরও এক স্তর উন্মোচিত হয় রবীন্দ্রনাথের গানের অধরা মাধুরীর স্পর্শ পাবার জন্য। 
                                             
 
(২) সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এবং তুচ্ছের মধ্যে অনন্যকে খুঁজে পাবার মতো বিস্ময়কে হৃদয়ে ধারণ —  প্রতিদিনের চেনা জগত কে চিরনূতন করে দেখবার মতো একটি অপার বিস্ময় ছিল রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে। আর এই বিস্ময় ছিল বলেই এ জগতের তাবৎ ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছের প্রতি ছিল তাঁর অসীম মমতা। তাঁর গানে প্রতিদিনের তুচ্ছতার বিষয় বা বস্তু যতটা মহৎ বা বৃহৎ হয়ে উঠেছে তা আর কারও গানে কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না। “এ সুর আমি খুঁজেছিলেম রাজার ঘরে,/শেষে ধরা দিল ধরার ধূলির পরে।/এ যে ঘাসের কোলে আলোর ভাষা আকাশ হতে ভেসে আসা/এ যে মাটির লে মাণিক-খসা হাসি-রাশি।” রবীন্দ্রনাথের “এ সুর” কে খুঁজে পেতে কোন রাজার ঘরে যেতে হয় না, এ সুর ধরার
ধূলির পরেই নিজেকে ধরা দেবার অপেক্ষাতে   লুকিয়ে থাকে। যার হৃদয়ে বিস্ময় আছে এ সুর শুধু তারই। বিস্ময়াভিভূত কবি “মাটির কোলে মাণিক-খসা” এ সুরকেই অভিষিক্ত করেছেন তাঁর অজস্র গানে।  একইভাবে হাট, মাঠ, পথের ধুলা,
ঊষার সোনার বিন্দু (শিশিরকণা), মাঘের আমের মুকুল, পাতায় পাতায় আলোর নাচন  এই সব ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ বিষয় যে মহৎ এবং বৃহৎ হিসাবে অভিষিক্ত হতে পরে, এক অদৃশ্য সুতো দিয়ে এদের সঙ্গে যে হৃদয়ের বন্ধন সৃষ্টি হতে পারে রবীন্দ্রনাথের গান না শুনলে এ ধারণা আমাদের মনে স্পষ্ট  রূপ লাভ করে না। অতএব তুচ্ছ এবং ক্ষুদ্রের
মধ্য হতে অনন্যকে খুঁজে পাবার মত বিস্ময়ও আর একটি প্রতীতি যার উপস্থিতি হৃদয় মনে একান্ত প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের গানের অধরা মাধুরীর সন্ধান পেতে।
 
হৃদয়ের এই বিস্ময়ের ধারণাটি স্পষ্ট করা যাক একটি উদাহরণ দিয়ে– অত্যন্ত তুচ্ছ একটি বিষয়, গ্রামের পথের ধারে এক অবহেলিত বেণুবন (বাঁশঝাড়)। পথে যেতে কেউ দেখে, কেউ দেখে না। যারা দেখে তাদেরও দৃষ্টিনন্দন হবার মতো বিশিষ্টতা নেই কিছুই তার। এরপর বসন্ত এল। বসন্ত বাতাসে বেণুবন নব কিশলয়ে আচ্ছাদিত হয়ে নবরূপে
বিকশিত হল। কিন্তু তাতেই বা এমন কী? নতুন পাতায় সবুজের সমারোহটা একটু বেশি, এই তো? এর চেয়ে বিমুগ্ধ হবার মত আর কীই বা থাকতে পারে পথের ধারের এক অবহেলিত বেণুবনের? কিন্তু না, পারে। অখ্যাত অবহেলিত তাতে কী? তার কি প্রেমাস্পদের দেখা পাবার জন্য কোন ব্যাকুলতা থাকতে নেই? নেই কী প্রেমিকের স্পর্শসুখে “একটুকুতেই কাঁপন ধরার”  কিংবা শিহরিত হবার আকাঙ্ক্ষা? আছে, অবশ্যই আছে। আর আছে যে তা যখন মূর্ত হয় রবীন্দ্রনাথের এই গানে–                                                    
 
“ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে।
নূতন-পাতার-পুলক-ছাওয়া পরশখানি দাও বুলিয়ে॥
আমি পথের ধারের ব্যাকুল বেণু  হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু গো–
আহা, এস আমার শাখায় শাখায় প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে॥
ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, পথের ধারে আমার বাসা।
জানি তোমার আসা-যাওয়া, শুনি তোমার পায়ের ভাষা।
আমায় তোমার ছোঁওয়া লাগলে পরে একটুকুতেই কাঁপন ধরে গো —
আহা, কানে-কানে একটি কথায় সকল কথা নেয় ভুলিয়ে॥”
 
তখন আমাদেরও পথের ধারের তুচ্ছ অবহেলিত বেণু বনের শাখায় শাখায় প্রাণের গানের ঢেউ ওঠার আনন্দে রবীন্দ্রনাথের হাট, মাঠ আর পথের ধূলার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা আনন্দলোকের সন্ধান পেয়ে বিমুগ্ধ হতে হয়।                                             

 
(৩) বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং শব্দলালিত্যের অলঙ্কারে আবদ্ধ সঙ্গীতসুষমার বিচিত্র রূপ অনুসন্ধান- ভাব প্রকাশের জন্যই হয়তবা রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র সব শব্দের সমুদ্র মন্থন করে তুলে এনেছিলেন বৈচিত্র্যময় এমন কিছু শব্দ যা বাংলা গানে তাঁর আগে বা পরে কেউ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। একইভাবে ভাবের উৎকর্ষ সাধনের জন্যই বাক্য তথা বাকভঙ্গির নব নব রূপের প্রয়োগও ঘটিয়েছেন একমাত্র তিনিই তাঁর গানে। অতএব রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দলালিত্য এবং বাকভঙ্গির অপূর্ব বিস্তারের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গীতসুষমার বিচিত্র রূপ অনুসন্ধান করে তাঁর গানের অধরা মাধুরীর সন্ধান পাওয়া সম্ভব। শব্দ অতি সাধারণ অথচ প্রয়োগের অসাধারণত্বের কারণে তার ব্যঞ্জনাও হয়ে ওঠে অসাধারণ। একইভাবে বাকভঙ্গির বহুবিচিত্রতা তাঁর গানকে করে তোলে বিচিত্রমার্গী।
রবীন্দ্রক্যাবে তথা সাহিত্যে শব্দ প্রয়োগের যে সব কারণ সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় সাধারণভাবে গানের ক্ষেত্রেও সেগুলি লক্ষণীয়। পৌনঃপুনিকতা, বৈচিত্র্যপ্রিয়তা, প্রত্যয়প্রবণতা, উপসর্গপ্রীতি, অন্তঃমিল, অনুপ্রাসপ্রবণতা, স্ত্রীবাচকতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ঐ সূত্রগুলির অন্যতম। “সাহিত্যের পথে”-তে কবির কৈফিয়ত প্রবন্ধের একস্থলে
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন– তোমাদের নালিশ এই যে, খেলা, ছুটি, আনন্দ এই-সব কথা আমার কাব্যে বার বার আসিয়া পড়িতেছে। কথাটি যদি ঠিক হয় তবে বুঝিতে হইবে, একটা কোন সত্য আমাকে পাইয়াছে। তার হাত আর এড়াইবার জো
নাই। অতএব এখন হইতে আমি বিধাতার মতোই বেহায়া হইয়া এক কথা হাজার বার বলিব।– বস্তুত এ সত্য অন্য কিছুই নয়; এ সত্য তাঁর এক ধরণের মানসতন্ত্র। বিশেষ বিশেষ শব্দের প্রতি তাঁর আসক্তি। যে সব শব্দের ঝঙ্কারে কিংবা ব্যঞ্জনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মোহাবিষ্ট তেমন কিছু শব্দ হল- অমল, ছায়া,করুণা, সিক্ত, ধারা, শ্যামল, গন্ধ, পথ, কানন, ভোলা, বেণু, বীণা, গান, নিত্য, হারা, অসীম, নতুন, ধূলা, অকারণ, আনন্দ, মধুর, ধরা, অধরা, বাঁশি, সুর, খেলা, জীবন, যৌবন, চঞ্চল, ঝিল্লি, নীপ, ভুবন, বাতায়ন, ধন, ধ্যান, আধার, সুন্দর, তারা, ব্যাথা, প্রেম, মালা, নদী, ঘন, কমল, রাত, রাত্রি, বিভাবরী, রজনী, যামিনী, নিশি, নয়ন, আঁখি, স্বপন, স্বপ্ন, আকাশ, গগন, হৃদয়, হৃদি ইত্যাদি। এছাড়া আজস্র শব্দ লালিত্য সৃষ্টি হয়েছে একটি শব্দের সঙ্গে এক বা একাধিক শব্দের চিত্রবন্ধনে  যেমন-
সুধাধারা, সুধারস, সুধারসধারা, সুধাপুরনিমা, সুধাঢালা, সুধাসাগর, সুধারসবরসে, সুধায়-সুধায়-ভরা, সুধাবিষে, গীতসুধা, সঙ্গসুধা, হৃদয়বীণা, হৃদয়হরণ, হৃদয়মাঝে, হৃদয়পুরমাঝে, হৃদয়শশী, হৃদয়নন্দনবনে, হৃদয়বাসনা,
হৃদয়তলে, হৃদয়রক্তরাগে, হৃদয়মাঝে, হৃদয়কোণে, বিরহবিধুর, বিরহবেদনা, বিরহাকাশভালে, বিরহপ্রদীপে, বিরহদিগন্ত, বিরহকাতর, বিরহব্যথার, আনন্দধারা, শ্রাবণধারা, বৃষ্টিধারা, বারিধারা, বাদলধারা, সুধাধারা, অশ্রুধারা, অন্ধকারঘন, আনন্দঘন, করুণাঘন, মর্মবেদনাঘন, তিমিরঘন, নিদ্রাঘন, পল্লবঘন, যৌবনঘন, ছায়াঘন, নিমেষহারা, বিরামহারা, আপনহারা, ক্লান্তিহারা, নিদ্রাহারা, ভাষাহারা, এছাড়া আছে সিক্তযুথী, সিক্তমালতী, ভোলাদিন, গন্ধবেদনা, মহামধুরিমা, নীপবন, ইত্যাদি তিনি নানান গানে ও লেখায় ব্যবহার করেছেন অজস্রবার। এইসব শব্দের এবং শব্দলালিত্যের অলঙ্কারে তাঁর গানের বাণীতে এসেছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। বাকভঙ্গির
বৈচিত্র্যময়তার উদাহরণ আলাদাভাবে দেয়া নিরর্থক কারণ রবীন্দ্রনাথের গানের বাকভঙ্গি কিংবা বাণীর বিন্যাস মাত্রই বৈচিত্র্যময়তায় ভরা।                                   

(৪) চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের প্রকৃত আবহে অবগাহন — চিত্রকল্প আরও একটি বিষয় যেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের অধরা মাধুরী লুকিয়ে থাকে। গানের বাণীই যদিও চিত্রকল্পের বিষয় তবু কবিতার ন্যায় গানের চিত্রকল্প গানের কবিতা বা গানের বাণীকে অবলম্বন করেই প্রজ্বলিত হয় না, সুরের আলোর আভায় সে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। সে আলোয় তার ক্ষীণ দেহের লাবণ্য ও সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। বচনের মধ্যে
অনির্বচনীয়ের ছোঁয়া লাগে অনুভবের প্রতিটি স্তরে। আর তাই বিমূর্ত কোন বাণীর ক্ষেত্রে যে কোন হৃদয়হরণ করা সুন্দর বিষয়ের “রূপ কল্পনা”ই রবীন্দ্রনাথের গানের চিত্রকল্প হতে পারে। অর্থাৎ বিমূর্তবাণীর চিত্রকল্পের বিষয়টি হল এক সুন্দরকে আর এক সুন্দরের আবহে বা স্পর্শে সুন্দরতর করে পাবার মতো। যেমন গভীর বাণী সমৃদ্ধ একটি গান —                                              
 
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–-
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।।
কত-যে গিরি কত-যে নদী -তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব।।
তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি
হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী।
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী–
হল না সারা, কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব।।
 
এর সঙ্গে গভীর অরণ্য, নদী কিংবা শ্যমল গিরি প্রান্তরের চিত্রকল্প মোটেই বেমানান মনে হয় না বরং প্রকৃতির এই রূপ কল্পনার সঙ্গে এক বৃহৎ “তুমি”র বিরাটত্ব-এর প্রচ্ছন্ন পটভূমি শ্রোতাকে এই গানের বাণী এবং সুরের মাহাত্মে অশেষ হওয়ার অনুধ্যান বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।                                      
 
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার”, “আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণ রাতি”, “বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি” কিংবা “শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়” ইত্যাদি গানে বর্ষণ মুখর ঝিল্লি ঝংকৃত নিশীথে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ বহ্নির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ায় আন্দোলিত অরণ্যের বৃক্ষরাজি যে রহস্যময়তার সৃষ্টি করে ছায়াঘন সেই রহস্যময়তার রূপকল্পনার সঙ্গে স্মৃতি-বিস্মৃতি ভারাক্রান্ত একাকিত্বের নিঃশব্দ অভিনিবেশ চিত্রকল্পের বিষয় হয়ে গানগুলির আবেদন আমাদের কাছে বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। এইভাবে- “আজি গোধূলি লগনে এই বাদলগগনে/তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গণি/সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা/অকারণ পুলকে আঁখি ভাসে জলে।” এবং “ওহে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি-/ রেখেছি কনকমন্দিরে কমলাসন পাতি।/ তুমি এসো হৃদে এসো, হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ/ মম অশ্রুনেত্রে কর বরিষণ করুণ হাস্যভাতি।” এই চমৎকার গান দু’টির  চিত্রকল্প আমাদের নিয়ে যায় দূর অতীতে বৈদিক যুগের অরণ্যবাসী ঋষি আশ্রমে। সেখানে শুচি শুভ্র হৃদয়ে কোনও আশ্রমকন্যা তার দয়িতের প্রতীক্ষায় অধীর
হয়ে প্রহর যাপন করছে, আথবা প্রতীক্ষার প্রহর শেষে সেই বিরহী-হিয়া তার কাঙ্ক্ষিত দয়িতের আগমনে ফুলমালা নিয়ে দয়িতকে বরণ করার পরমোৎসবের আয়োজন করছে।                                   
 
অন্য কিছু গান যেমন- “মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।”, “যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে/মিলাব তাই জীবনগানে”, “তোমার আসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই/ কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই”। ইত্যাদি গানের মধ্যে বৃহৎ “তুমি” র কাছে বিস্ময়াভিভূত ক্ষুদ্র “আমি”র অপার বিস্ময়ের প্রকাশ তথা আত্মনিবেদিত হয়ে নিঃশঙ্ক, নিশ্চিন্ত হবার চিত্রকল্প গানগুলির আবেদন আমাদের কাছে বাড়িয়ে দেয় বহুগুন।        
 
রবীন্দ্রনাথের গানের সঞ্চারীতে এসে সুরের বিস্তার যেভাবে ঘটে তাতে মনে হয় গোটা গানের সমগ্র আনন্দ বেদনার চিত্রকল্প যেন সঞ্চারীতেই এসে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, ছায়ানট-কেদারা রাগে একটি গান-
 

গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা ॥
হয়তো সে তুমি শোন নাই, সহজে বিদায় দিলে তাই–
আকাশ মুখর ছিল যে তখন, ঝরোঝরো বারিধারা ॥
চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি,
আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।
আর কি কখনো কবে  এমন সন্ধ্যা হবে–
জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা ॥
 
– এই গানের চিত্রকল্পে জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেন অসীম ব্যক্তিত্বের  অধিকারিণী এক রহস্যময়ী নারী প্রতিমূর্তিকে স্থান করে দেয়া হয়েছে। প্রদোষের আলো-আঁধারির বর্ণনা আছে এখানে, আছে ঝরোঝরো বারি ধারায় আকাশ মুখরিত হওয়ার বর্ণনা, সেই সঙ্গে আরও আছে একটি দুর্লভ সন্ধ্যার বর্ণনা যে সন্ধ্যা কারো জীবনে একবারই আসে এবং আর কখনো আসবে না বলেই অনুমিত হয়। তবে এ সবকিছুকে ছাড়িয়েও চিত্রকল্পের প্রধান
বিষয় হয়ে ওঠে এক রহস্যময়ী নারী যে নারী তাঁর প্রেমিকের বিদায় ক্ষণে একটি কথাও না বলে, আঁখি না তুলে মেঘে ঢাকা গোধূলির রহস্যময়তার মধ্যে নিজেকে করে তোলে আরও রহস্যময়ী। তবে সমগ্র গানের সুরে এবং কথায় প্রথম থেকে যা বলবার আয়োজন চলছিলো তা যেন সঞ্চারীর মাত্র দুটি চরণেই-(চেয়েছিনু যবে মুখে তোল নাই আঁখি,/আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।)বলা সম্ভব হোল।  অর্থাৎ মেঘ, বরিষণ, প্রদোষের আলো-আঁধারির খেলা এ সবকিছু মিলে যে রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছিল তার সঙ্গে প্রেমিকের প্রেম-উচ্ছ্বাসের জবাবে আনত নেত্রে স্থির হয়ে থাকা ব্যক্তিত্বময়ী প্রেমিকার রহস্যময় নীরবতা যুক্ত হয়ে গানের চিত্রকল্প যেন সঞ্চারীতে এসেই পরিপূর্ণতা লাভ করল।                                       
 
অমূর্ত কোন বিষয় যখন রবীন্দ্রনাথের গানে মূর্ত হয়ে, হয়ে ওঠে প্রাণীন অথবা শরীরিণী তখন নিমিষেই সেই গানের বাণীর গুরুত্ব কিংবা মাহাত্ম্য আমাদের কাছে ভিন্নমাত্রিক হয়। যেমন-
 
লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি।
তোমার নন্দননিকুঞ্জ হতে সুর দেহো তায় আনি
ওহে  সুন্দর হে সুন্দর ॥
আমি আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে
তোমারি আশ্বাসে।
তারায় তারায় জাগাও তোমার আলোক-ভরা বাণী
ওহে  সুন্দর হে সুন্দর ॥
পাষাণ আমার কঠিন দুখে তোমায় কেঁদে বলে,
পরশ দিয়ে সরস করো, ভাসাও অশ্রুজলে,
ওহে  সুন্দর হে সুন্দর।
শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে
আমার চিত্তমাঝে,
শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহো টানি
ওহে  সুন্দর হে সুন্দর ॥

এই গানের- আমি আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে/ তোমারি আশ্বাসে। বাণীর এই অংশের চিত্রকল্পটিকে বলা যায় প্রতীক্ষার চিত্রকল্প। এখানে রাতের আকাশে আঁধার দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রতীক্ষার আসন। সেই আসন বিছিয়ে প্রতীক্ষমাণ কেউ যখন পরম এক সুন্দরের জন্য প্রতীক্ষা করে তখন সেই প্রতীক্ষার ব্যাপকতা একই সঙ্গে প্রতীক্ষিতের বিরাটত্ব আমাদের কাছে আপনা আপনিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এমনিভাবে- “হিয়া আমার পেতে রেখে সারাটি পথ দিলেম ঢেকে,/ আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি।”  অথবা – “আমার ব্যথায় ব্যথায় পা ফেলিয়া এলে
তোমার সুর মেলিয়া,/ এলে আমার জীবনে।” কিংবা- “নিবিড় হবে তিমির-রাতি, জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,/ পরাণখানি দেব পাতি-চরণ রেখো তাহার ‘পরে।”  এইসব গানে “ব্যথা” “পরান” কিংবা “হিয়া” র মত অমূর্ত উপাদানে সৃষ্টি হয়ছে চরণ ফেলার বা স্পর্শ করার পথ। তবে চরণ ফেলার স্থানকে পথ বলি আর যা-ই বলি এখানে তার প্রকাশ হৃদয়গত আবেগকে অনুরণিত করেছে প্রচুর ভাবে। আর এভাবেই গানগুলির চিত্রকল্পকে করে তুলেছে অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। একইভাবে অন্ধকার তথা নিশীথ রাত্রিকে যখন স্ত্রী বাচক প্রাণীন অথবা শরীরিন করে তোলা হয় তখন তা চিত্রকল্পের চেনা গণ্ডিকে ফেলে যায় বহুদূরে যেমন- “আর বিলম্ব কোরো না গো, ওই যে নেবে বাতি/ দুয়ারে মোর নিশীথিনী রয়েছে কান পাতি।” অথবা- “নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে/ আঁধার কেশভার দিয়েছে বিছায়ে।” এইসব গানে অন্ধকার রাত্রি নিজেই এক অব্যাক্ষায় নারীমূর্তির রহস্যময় আভাস হয়ে উঠেছে। মূর্ত অমূর্তের আলোছায়ায় এমন রহস্যময়তায় ভরা রোম্যান্টিক চিত্রকল্প কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই সম্ভব বলে মনে হয়।    
 
এমনিভাবে জীবন এবং জগতের বিচিত্রতার সঙ্গে, ধ্যানমৌন প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান মিলিয়ে নিতে পারলে সে গানের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অধরা মাধুরী আপনা থেকেই ধরা দেয় আমাদের কাছে, আর সে গান তখন এক নতুন মাত্রা পেয়ে, আরও বেশি করে হয়ে ওঠে আমাদের প্রাণের সম্পদ, হৃদয়ের সম্পদ।

এই গানের- আমি আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে/ তোমারি আশ্বাসে। বাণীর এই অংশের চিত্রকল্পটিকে বলা যায় প্রতীক্ষার চিত্রকল্প। এখানে রাতের আকাশে আঁধার দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রতীক্ষার আসন। সেই আসন বিছিয়ে প্রতীক্ষমাণ কেউ যখন পরম এক সুন্দরের জন্য প্রতীক্ষা করে তখন সেই প্রতীক্ষার ব্যাপকতা একই সঙ্গে প্রতীক্ষিতের বিরাটত্ব আমাদের কাছে আপনা আপনিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এমনিভাবে- “হিয়া আমার পেতে রেখে সারাটি পথ দিলেম ঢেকে,/ আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি।” অথবা – “আমার ব্যথায় ব্যথায় পা ফেলিয়া এলে
তোমার সুর মেলিয়া,/ এলে আমার জীবনে।” কিংবা- “নিবিড় হবে তিমির-রাতি, জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,/ পরাণখানি দেব পাতি-চরণ রেখো তাহার ‘পরে।” এইসব গানে “ব্যথা” “পরান” কিংবা “হিয়া” র মত অমূর্ত উপাদানে সৃষ্টি হয়ছে চরণ ফেলার বা স্পর্শ করার পথ। তবে চরণ ফেলার স্থানকে পথ বলি আর যা-ই বলি এখানে তার প্রকাশ হৃদয়গত আবেগকে অনুরণিত করেছে প্রচুর ভাবে। আর এভাবেই গানগুলির চিত্রকল্পকে করে তুলেছে অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। একইভাবে অন্ধকার তথা নিশীথ রাত্রিকে যখন স্ত্রী বাচক প্রাণীন অথবা শরীরিন করে তোলা হয় তখন তা চিত্রকল্পের
চেনা গন্ডিকে ফেলে যায় বহুদূরে  যেমন- “আর বিলম্ব কোরো না গো, ওই যে নেবে বাতি/ দুয়ারে মোর নিশীথিনী রয়েছে কান পাতি।” অথবা- “নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে/ আঁধার কেশভার দিয়েছে বিছায়ে।” এইসব গানে অন্ধকার রাত্রি নিজেই এক অব্যাক্ষায় নারীমূর্তির রহস্যময় আভাস হয়ে উঠেছে। মূর্ত অমূর্তের আলোছায়ায় এমন রহস্যময়তায় ভরা রোম্যান্টিক চিত্রকল্প কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই সম্ভব বলে মনে হয়।

[ছবি-কৃতজ্ঞতাঃ আন্তর্জাল]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Somen Dey
Somen Dey
4 months ago

সুবিন্যস্ত এবং মনোগ্রাহী লেখা । যোগাযোগ উপন্যাসে বিপ্রদাস কুমুকে একটি কথা বলেছিল – “ সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয় , চিরকালটা থাকে আড়ালে । আর গানে চিরকালটাই আসে সামনে , ক্ষুদ্রকালটা হয়ে যায় তুচ্ছ । “ অন্য গানে তা হোক বা না হোক রবীন্দ্রনাথের গানে ঠিক তাই হয়ে থাকে ।

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
Reply to  Somen Dey
4 months ago

যথার্থ বলেছেন। এটাই সারাৎসার।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
4 months ago

এক অপূর্ব সুন্দর আলোচনার সাথে পরিচয় হল। রবীন্দ্রগানের অনন্যতা নিয়ে আমার মনে ওঠা অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল।মুগ্ধ যে হয়েছি, তা আলাদা করে বলার বোধহয় দরকার নেই। এমনই আরও আলোচনার প্রতীক্ষায় রইলাম।