
গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে আলোচনার জন্য বেছে নিলাম দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের ২৮৩ গানের মধ্যে গ্রীষ্ম উপপর্যায়ের গানের সংখ্যা মাত্র ১৬। যেখানে বর্ষাসঙ্গীত ও বসন্তসঙ্গীতের সংখ্যা যথাক্রমে ১১৪ ও ৯৬। রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মের গান লিখতে শুরু করেন ৫৮ বছর বয়স থেকে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে গ্রীষ্মঋতুকে প্রত্যক্ষ করেছেন মূলত দুটি দৃষ্টিকোন থেকে। কখনও কখনও গ্রীষ্মকে তিনি অনুভব করেছেন শুধুই শরীরী চেতনায়। কোন কোন গানে খররৌদ্র, দুঃসহ দহনজ্বালা, সর্বত্রব্যাপী শুষ্ক কাঠিন্যের বাণীরূপায়ণ। অনেকক্ষেত্রে গানের সমাপ্তি ঘটেছে কালবৈশাখী বা ঝঞ্ঝার প্রতীক্ষায়। এই পর্যায়ের গানের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে : “নাই রস নাই”, “ প্রখর তপন তাপে” “দারুণ অগ্নিবাণে রে”……। আর এক শ্রেণির গানে কবি গ্রীষ্মের ইন্দ্রিয়চেতনার অন্তরালবর্তী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি রূপ প্রত্যক্ষ করেন। যিনি মানবসংসারে সমস্ত দুঃখ আঘাতকে চরম আত্মিক উত্তরণের সোপানরূপে, ঈশ্বরের পরম দানরূপে সাদরে বরণ করে নেন, সেই কবি নিসর্গসংসারে গ্রীষ্মের অগ্নিময়, দহনজ্বালাজর্জর রূপটির মধ্য দিয়ে তার কল্যাণময় রূপটির উন্মোচন করেন। একাধিক গানে গ্রীষ্মের ধ্যানমগ্ন তপশ্চর্যাকঠোর রূপটি বিধৃত। এমন গানের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে : “বৈশাখ হে মৌনী তাপস” “এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ” “নমো নমো, হে বৈরাগী” “হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে”….।
এবার যে দুটি গানের কথা বলব তাদের পূর্বোক্ত শ্রেণির কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এই দুটি গানে গ্রীষ্মের বহিরঙ্গ শুষ্ক কঠোর রূপটি অথবা তার অন্তর্লীন কল্যাণময় তপস্বীরূপটির কোনটিই চিত্রায়িত হয় নি। গ্রীষ্ম এই দুটি গানে শুধু প্রেমের স্মৃতিচারণের পটভূমি।গানদুটি হল “বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া” এবং “মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে ”। বস্তুত গানদুটিকে প্রেমপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা ছিল না । প্রকৃতপক্ষে গীতবিতানে তাদের শ্রেণিবিন্যাস না জানা থাকলে, স্বতঃস্ফূর্ত পাঠে তাদের গ্রীষ্মসঙ্গীত বলে চিহ্নিত করা কঠিন হোত। গানদুটির কোনটিতেই গ্রীষ্মের রূপকল্পের বিস্তার নেই যার ভিত্তিতে গানগুলির এমন শ্রেণিবিন্যাসের সমর্থন মিলতে পারে। এই শ্রেণিবিন্যাসের একমাত্র ভিত্তি প্রথম গানে দুবার “বৈশাখ” নামটির ব্যবহার, দ্বিতীয় গানে শুধুমাত্র একবার “তপ্ত হাওয়া”র উপস্থিতি।

গানদুটি পরপর তুলে দেওয়া হল। এরপর আমরা রূপকল্পের প্রয়োগে এবং অভিব্যক্ত অনুভূতির স্তরে গানদুটির সমান্তরালতা এবং স্বাতন্ত্র্যের পর্যালোচনা করব।
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ।
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ॥
স্বপ্নশেষের বাতায়নে হঠাৎ-আসা ক্ষণে ক্ষণে
আধো-ঘুমের-প্রান্ত-ছোঁওয়া বকুলমালার গন্ধ।।
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ,
যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলো কেশের স্পর্শ।
চাঁপাবনের কাঁপন-ছলে লাগে আমার বুকের তলে
আরেক দিনের প্রভাত হতে হৃদয়দোলার স্পন্দ॥ (প্রকৃতি /১৯)
মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে
ক্লান্তি-ভরা কোন্ বেদনার মায়া স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে-মনে।।
কৈশোরে যে সলাজ কানাকানি খুঁজেছিল প্রথম প্রেমের বাণী
আজ কেন তাই তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায় মর্মরিছে গহন বনে বনে॥
যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে ডুবেছিল বিস্মরণের তলে
আজ কেন সেই বনযূথীর বাসে উচ্ছ্বসিল মধুর নিশ্বাসে,
চাঁপাবনের কাঁপন-ছলে লাগে আমার বুকের তলে **সারাবেলা চাঁপার ছায়ায় ছায়ায় গুঞ্জরিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥ (প্রকৃতি /২৩)

সমান্তরলতা
হাওয়া — প্রথম গানের শুরুতে এবং প্রায় কেন্দ্রস্থলে (আট কলিবিশিষ্ট গানের পঞ্চম কলিতে)। দ্বিতীয় গানের কেন্দ্রস্থলে দেখি শব্দদ্বিরুক্তি : হাওয়ায় হাওয়ায়।
বাতায়ন— দ্বিতীয় গানের শুরুতে এবং প্রথম গানে অন্তরার শুরুতে। বলা যেতে পারে দুইয়ের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথম গানের বাতায়নের ইন্দ্রিয়গ্রাহী অস্তিত্ব নেই । এই বাতায়ন বাস্তব ও স্বপ্নের, ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়াতীতের মধ্যবর্তী সীমান্তরেখাটি চিহ্নিত করছে। দ্বিতীয় গানে এই বাতায়ন ইন্দ্রিয়গ্রাহী বাস্তবের অঙ্গ। তবে ভিন্নতর পাঠও সম্ভব। এই বাতায়নকে বর্তমান বাস্তব ও অতীতের মধ্যবর্তী সীমারেখা বলে ব্যাখ্যা করা যায়। তেমন ব্যাখ্যা অযৌক্তিক নয়। এ সেই বাতায়নপথ যে পথ দিয়ে অতিক্রান্ত কৈশোরের বিস্মৃত ভাবনা আবার এসে ধরা দেয় আজ জীবনের মধ্যভাগে — “মধ্যদিন”কে মধ্যবয়স বলে ভাবা যেতে পারে।
ফুল — দুটি গানের আভোগে আছে চাঁপা। পূর্ববর্তী অংশে অন্য একটি ফুলের সুরভিবিস্তার — প্রথম গানে বকুলের, দ্বিতীয় গানে বনযূথীর। আলোচ্য গানদুটি বাদ দিলে গ্রীষ্ম উপপর্যায়ের আর কোন গানে নির্দিষ্ট কোন ফুলের নাম দেখা যায় না। তাছাড়া যে সব গানে ফুলের রূপকল্প রয়েছে সেখানে দেখা যায় শুধু শুকনো ফুল অথবা ঝরা ফুল। তেমন দৃষ্টান্ত তিনটি : শুষ্ক ধূলায় খসে পড়া ফুলদলে (নাই রস নাই) ; এখনি মলিন হবে প্রভাতের ফুলহার (প্রখর তপনতাপে) ; যে ফুল কানন করত আলো / কালো হয়ে সে শুকালো (চক্ষে আমার তৃষ্ণা। আমাদের আলোচ্য গানদুটিতে গ্রীষ্মের নিষ্করুণ, রিক্ত রূপটি চিত্রায়ণের উদ্দেশ্যে ফুলের রূপকল্পের ব্যবহার হয় নি ; ফুলেরা আপন মহিমায় প্রোজ্জ্বল। তারা পটভূমি রচনা করছে না ;গানে অভিব্যক্ত আনন্দ বেদনা সঞ্চারে তাদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। যূথী ও বকুলের ভূমিকা সম্বন্ধে বলতে হয়, যে সব গানে নির্দিষ্ট কোন ফুলের গন্ধের উপস্থিতি রয়েছে, তাদের মধ্যে এই দুটি ফুলের প্রয়োগই সর্বাধিক :যূথীর গন্ধ আটটি গানে এবং বকুলের গন্ধ সাতটি গানে। কিন্তু পুষ্পসৌরভমাধুর্যের লেশমাত্র গ্রীষ্মের অন্য কোন গানে মেলে না।

স্বাতন্ত্র্য
কালগত পটভূমি : প্রথম গানে বর্তমান বাস্তবের পটভূমি বৎসরের একটি নির্দিষ্ট সময় : বৈশাখ। অন্যদিকে যে অতীতে প্রত্যাবর্তন ঘটছে তা সুনির্দিষ্ট কোন পর্ব নয় : “আরেক দিনের প্রভাত”। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় গানে দেখা যাচ্ছে বর্তমান বাস্তবের পটভূমি নির্দিষ্ট কোন সময় নয় : কোন মাসের নাম ব্যবহৃত হয় নি, কেবলমাত্র “তপ্ত হাওয়া”র মধ্য দিয়েই গ্রীষ্মের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। কিন্তু এই গানে অতীতচারিতার অভিমুখ জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট পর্ব : কৈশোর। দুটি গানেরই পটভূমি গ্রীষ্মঋতু হলেও বর্তমান ও অতীত পরিমণ্ডল নির্মাণকৌশলে বৈপরীত্য দেখা যায়।
প্রেমমূর্তি : প্রথম গানে দেখা যাচ্ছে আস্থায়ীর শেষে “চরণ”, তারপর অন্তরা ও সঞ্চারীর শেষে প্রায় প্রতিসম অবস্থানে যথাক্রমে বকুলমালা (তার আড়ালে কন্ঠের আভাস পাওয়া যাচ্ছে) এবং “কেশ”। চরণ থেকে কেশ — যেন সম্পূর্ণ শরীরী একটি অবয়ব চকিত আভাসে ধরা দিয়ে যায় গানের প্রথম তিন অংশ জুড়ে। দ্বিতীয় গানে মানসপ্রতিমা কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহী রূপ পরিগ্রহ করে না। কৈশোরের সেই দিনগুলিতে প্রকাশবিহ্বল অর্ধোচ্চারিত সেই বাণীর রেশটুকুই সমস্ত গান জুড়ে থেকে যায়; কোথাও সামান্যতম কোন শরীরী আভাস মেলে না।
অভিব্যক্ত অনুভূতি : দুটি গানের প্রধান পার্থক্য অভিব্যক্ত অনুভূতির স্তরে। প্রথম গানে আছে “হর্ষ”। দ্বিতীয় গানে প্রেমের “বেদনা” — “নৈরাশা” “অশ্রুজল”।

অভিনবত্ব
একটি গানে শরীরী আভাস, অন্য গানে সম্পূর্ণ অশরীরী প্রেমমূর্তি নির্মাণ, একটিতে প্রেমের হর্ষ, অপরটিতে প্রেমের বেদনা —- দুটি গানের একত্র পাঠে প্রেম তার পরিপূর্ণতায় ধরা দেয়। অভিনবত্ব এখানেই যে রবীন্দ্রনাথ প্রেমের পরিমণ্ডল রচনার জন্য নির্বাচন করেছেন গ্রীষ্মঋতুকে। প্রেমের পটভূমিরূপে আমরা প্রথাগতভাবে বর্ষা বা বসন্তকে দেখতে অভ্যস্ত। আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে প্রেমের কাব্যে গ্রীষ্ম প্রায় ব্রাত্য। আমাদের আলোচ্য প্রথম গানটিতে অবশ্য বৈশাখ নামটি ছাড়া কোনভাবে গ্রীষ্মের উপস্থিতি নেই। নিদাঘদহনজ্বালার সামান্যতম লেশও নেই, সমগ্র গান জুড়ে আছে এক স্নিগ্ধ মনোরম আবহ — যা প্রেমের চিত্রায়ণের সম্পূর্ণ অনুকূল। কিন্তু দ্বিতীয় গানে পটভূমি গ্রীষ্মের প্রভাত নয়, মধ্যাহ্ন , এই গানে আছে তপ্ত হাওয়া। এই তপ্ত হাওয়া হারানো দিনের বাণীবহন করে আনছে। তপ্ত হাওয়ার এই স্মৃতি- উদ্দীপক ভূমিকাও অভিনব। আমরা সাধারণভাবে দেখি হারানো অতীতে কল্পপ্রত্যাবর্তনে পথের দিশারী “বাদলা হাওয়া”, সজল বাতাস। বস্তুত প্রকৃতিপর্যায়ের গানে অতীতচারিতার অধিকাংশ দৃষ্টান্ত বর্ষার গানে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য সজল হাওয়ার পথ ধরে অতীতের উদ্দেশে যে স্বপ্নযাত্রা তার অভিমুখ কখনও ব্যক্তিজীবনের অনির্দিষ্ট কোন অতীতের পর্ব (আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে : আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে /কাঁপন ভেসে চলে ) কখনও এই যাত্রা কালান্তরের উদ্দেশে (আজ আকাশের মনের কথা : বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে ; বহুযুগের ওপার হতে : যে মিলনের মালাগুলি ধূলায় মিশে হল ধূলি / গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে)। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সুনির্দিষ্ট কোন অতীত পর্বে উত্তরণ ঘটায় শুধু তপ্ত হাওয়া — কৈশোরে প্রত্যাবর্তনের, কিশোরপ্রেমের স্মৃতিচারণের দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র গ্রীষ্মের গানেই।
লক্ষণীয় অগ্নিবর্ষী বাতাস এই বিরহবেদনাকে জ্বালাময় করে তোলে না, উত্তপ্ত বাতাস স্বপ্নাবেশ সঞ্চার করে ; প্রাণের গভীরে অবরুদ্ধ নৈরাশ্য “উচ্ছ্বসিত” হয়ে ওঠে “মধুর নিশ্বাসে”। বেদনা মধুর হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের একাধিক গানে রয়েছে : এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে ( তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে / যেন আমায় স্মরণ করে) ; নয়ন ছেড়ে গেলে চলে ( তোমার সুধারসের ধারা গহনপথে এসে / ব্যাথারে মোর মধুর করে নয়নে যায় ভেসে) ; ব্যাকুল বকুলের ফুলে (বেদনা সুমধুর হয়ে ভুবনে আজি গেল বয়ে) ; গায়ে আমার পুলক লাগে (বিরহ আজ মধুর হয়ে ভরেছে প্রাণমন) ; বিরহ মধুর হল আজি ; আমার যেদিন ভেসে গেছে : নিবিড় সুখে মধুর দুখে জরিত ছিল সেই দিন)। কিন্তু বেদনার এমন রূপান্তরে “তপ্ত হাওয়ার” ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশিত।
প্রেমের নৈসর্গিক পটভূমি সম্বন্ধে আমাদের চিরাচরিত ধারণাটাই রবীন্দ্রনাথ ভেঙে দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আপনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বারবার করে আমাদের মুগ্ধতা এনে দেয়।বহুবার শোনা গানকে আবার নতুন করে ফিরে পাওয়ার আনন্দ এনে দেয়।কখনো কখনো এমন আবেশ রচনা করে, যার প্রভাব সারা জীবনের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে।আপনার এই অনুসন্ধান জারী থাকুক, এই অনুরোধ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানাই।