আরও একটি বছর ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নিল। নির্দ্বিধায় বলা চলে, সে চলে গেল বেশ কিছু হাহাকার আর যন্ত্রণার স্মৃতি বুকে নিয়ে। নতুন করে আর কোনো রোজনামচা বা জমা-খরচের হিসেব তার খাতায় লেখা হবে না। বিশেষ বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের ইতিহাস ও রাজনীতির অনুসন্ধিৎসুদের গবেষণার বিষয় হবে সে। আপাতদৃষ্টিতে এর বেশি কিছু গুরুত্ব নেই তার এই মুহূর্তে।
কিন্তু পুরোনোর নোট-বুকে নতুন কিছু আর লেখা না গেলেও সত্যিই কি সে চলে যাবে আমাদের বিস্মৃতির আড়ালে কিমবা আমরা আর ফিরে দেখব না তাকে? এমন তো নয়, যে পুরোনোর সমাপ্তি আর নতুনের আবির্ভাব – দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যতই আমরা পুরোনোকে সাড়ম্বরে বিদায় জানিয়ে একটি রেখা টেনে নতুনের আবাহনে মেতে উঠি অজানা এক নতুন আশায়, নতুন ভরসায়, যে চলে গেছে তার রেশ এড়ানো তো সহজ নয়।
সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া বছরটিকে সত্যিই কি আমরা ভুলতে পারব, না ভোলা সম্ভব? কিন্তু কোন্ দিক দিয়ে তাকে মনে রাখব আমরা? সে কী দিয়েছে আমাদের? আর কীই বা নিয়েছে?
দেনা-পাওনার খতিয়ানে চোখ রাখলে বছরটিকে মানব সভ্যতার ঘোর দুর্দিনের ৩৬৬ দিন বলে নির্দ্বিধায় চিহ্নিত করা ছাড়া কিন্তু উপায় নেই। তার পাশে প্রাপ্তির তালিকা বড় অনুজ্জ্বল।
একদিকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ, অন্যদিকে গোটা বিশ্বজুড়ে প্রায় মড়কের মত ছড়িয়ে পড়া অসন্তোষ, বিরোধ আর যুদ্ধের বিষবাষ্প। একদিকে শক্তিমানের মোড়লিয়ানা ও ছদ্ম ঔপনিবেশিকতাবাদ, অন্যদিকে ক্ষমতা দখলের লড়াই। একদিকে ধর্মীয় জেহাদীদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, অন্যদিকে ধর্মীয় প্রসারণবাদ – দেশে দেশে মানুষই আজ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। সংঘাতে সংঘাতে অব্যাহত ক্রমবর্ধমান মৃত্যুমিছিল। নিষ্পাপ শিশুরাও আজ যুদ্ধের বলি।
বিশ্বময় যুদ্ধ-বিগ্রহে আজ বিপর্যস্ত মানবতা। একদিকে চলছে দ্বি-বর্ষব্যাপী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সিরিয়ায় চলমান সরকার-বিরোধী যুদ্ধ, লেবানন-ইসরায়েলে চলেছে নিত্য-সংঘাত, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ, মায়ানমারে সরকার-রোহিঙ্গা-আরাকান সংঘাত, পাকিস্তান-আফগানিস্তান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান ঠান্ডা লড়াই – পৃথিবীর দিকে দিকে আজ শুধু অশান্তির কালো মেঘ। কবি-কথিত “নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”যেন আজকের পৃথিবীর, আজকের সময়ের কথা।
আমাদের পড়শী দেশে সরকারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে চুরমার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত ও শাসনযন্ত্র। শাসনক্ষমতায় আসীন সংবিধান-বহির্ভূত একটি স্বঘোষিত তথাকথিত সরকার। নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের ক্রন্দন ও হাহাকার আজ শস্যশ্যমলা সে দেশের আকাশ-বাতাসে। দেশের জাতীয় গর্বের ইতিহাস মৌলবাদীদের হাতে লাঞ্ছিত ও পদদলিত। জাতি তার নিজের গর্বের, বীরত্বের ইতিহাসকে শুধু অসম্মানিত ও অপমানিত করছে না, অবলুপ্ত করার পথে। তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একনিষ্ঠ সহযোগীটির প্রতি, অসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া পাশের রাষ্ট্রটির প্রতি চরম কৃতঘ্নতার নগ্ন প্রকাশ তাদের আচরণে ও নবনির্মিত রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নিরিখে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি দুটি রাষ্ট্রের বেসামাল পরিস্থিতির পাশে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, কিন্তু প্রশ্নের ঊর্দ্ধে নয়। মনিপুর থেকে পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্যে রাজ্যে প্রশাসনিক নৈরাজ্য প্রকট, দুর্নীতি সীমাহীন ও অবাধ, বহুক্ষেত্রেই আইনের শাসন শাসকের আইনে পরিণত। বিচারবিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা ও নিস্পৃহতায় আমাদের রাজ্যটি তো অভিযুক্ত, দোষী, দুর্নীতিপরায়ণ, লোভী, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিকদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত, যার চূড়ান্ত পরিণতি সরকারী হাসপাতাল আর-জি-কর-এ হতভাগ্য কন্যা ডাক্তারটির পাশবিক হত্যা, ঘটনার তিন মাস পরেও যার কিনারা আজও আমাদের মুখ চেয়ে রয়েছে। ২০২৪ এদের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে, যদিও সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় এদের নিশ্চিন্ত করে চলেছে।
এই আবহেই ঢাক-ঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, আলোর রোশনাই, বাজি-পটকা, গীর্জার ঘন্টাধ্বণি, হোটেল-রেস্তোরায় কেক-পেস্ট্রী, খানা-পিনা, নাচা-গানা, নদীবক্ষের তোপধ্বণির ধুম-ধাড়াক্কা সহযোগে গতকাল মধ্যরাত্রে যে অতিথি আমাদের দুয়ার-প্রান্তে এসে হাজির হল, যত রহস্য, যত আশা-প্রত্যাশা, কামনা-বাসনা, সব তাকে নিয়েই, যদিও তার আস্তিনে কি কি তাস লুকোনো আছে, তার হদিস পাওয়ার এই মুহূর্তে কোনো উপায় নেই। তার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তারও অন্তিম দিনটি পর্যন্ত।
পরিশেষে, শত হতাশা ও বিপর্যয়ের মধ্যেও কবির আশার বাণীই আমাদের শেষ অবলম্বন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ থেকে উদ্ধৃত করে বলি –
_“আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি– পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।”
রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
টুকরো টুকরো ঘটনার চমৎকার কোলাজে ভরে গেল ইতিহাসের পাতা।