শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রাজপ্রাসাদের হর্ষ উল্লাস থমকে গেল, যে মুহূর্তে দুর্যোধন, সদ্য দাসীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া রাজকুলবধূ দ্রৌপদীকে, সর্বসমক্ষে হাজির করার হুকুম জারি করলেন। একটু আগেও পাশাখেলা নিয়ে সভাঘরে তুমুল উত্তেজনা ঘিরে ছিল। একটা করে দান পড়ছে আর যুধিষ্ঠির একে একে হারাচ্ছেন, তার ঐশ্বর্য। কৌরবপক্ষের সমস্ত সমর্থক এই আদেশ-এ যেন স্তম্ভিত হয়ে যায়। অবশেষে দুঃশাসন দ্বারা সেই তুলনারহিত অপকর্ম সাধন। সরাসরি সে এই কাজ করলেও, যার আদেশে সে এই গর্হিত কাজ করেছে তিনি দুর্যোধন, আর যাঁরা বাধা দিতে পারতেন, অথচ নির্বাক সাক্ষী হয়ে রইলেন, তাঁরা হলেন স্বয়ং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য, মহামতি বিদুর সহ পান্ডব ভাইয়েরা, মহাবীর কর্ণ এবং আরও অন্যান্য সভাসদরা। কৌরব ভাইদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন।

সেই কবেকার গল্প, যুগ যুগ ধরে আজও প্রাসঙ্গিক। এই কারণেই জয়কাব্য, (যা পরবর্তীকালে মহাভারত নামে পরিচিত) হল একটি মহাকাব্য।  

সভ্যতার আদিকাল থেকে সমাজে অপরাধ রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তার প্রধান কারণ মানুষ নিজে। আমাদের মধ্যেই ভালো আর খারপ দুটো অস্তিত্বই বিরাজ করে। আদতে মানুষ একটি পশু, তারও সমস্ত পাশবিক প্রবৃত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। আবাল্য শিক্ষা, পরিবেশ, পরিবার, সমাজ সমস্ত কিছুর প্রভাবে আমাদের পাশবিক প্রবৃত্তি প্রশমিত হয়, আমরা ‘মানুষ’ হয়ে উঠি। 

কিন্তু পাপের স্রোত বোধহয় বন্ধ হয়না। সে ফল্গুর মতো রক্তের আড়ালে বইতে থাকে। ডিএনএ-র ভিতরে তার স্বাক্ষর গাঁথা হয়ে থাকে, প্রতি প্রজন্মে তা এমনিভাবে বেরিয়ে আসে। 

আজকের আর-জি কর মেডিকেল কলেজের ঘটনার প্রেক্ষিতে হয়তো সেই প্রবৃত্তি কাজ করেছে, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজ। সেই সমাজ মানুষকে ভালো খারাপের বুনিয়াদী ধারণাকে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে। বর্তমান ভোগবাদী দুনিয়াতে, ভোগ, লালসা, প্রতিপত্তি, অর্থ-ই যেন একমাত্র সার্থকতা। যে কোন উপায়ে সেই অভীষ্ট লাভ করতে মানুষ আজ প্রস্তুত। যা সমাজের, পরিবারের, পরিবেশের সর্বোপরি নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ঘৃণ্য ছিল, আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেইসব কাজ অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেতে অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এমনকী এসমস্ত দুরাচার, দুরারোগ্য ব্যধির মতো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, যা সমস্ত অসদুপায়কে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতেও দ্বিধা করছে না।

তবে কি ভালো খারাপের শাশ্বত সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে হবে? খারাপের ঔজ্জ্বল্যের মাঝেও যেটুকু ভালো, ডিএনএ-র কোন গোপন তন্তুর ভেতর বেঁচে ছিল, এক অমোঘ নিয়মে তা যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে। কোন সামাজিক অথবা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকের আশীর্বাদ ছাড়া কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। যে সামাজিক বিবেক নিতান্ত অবহেলায় কোন এক বিস্মৃতির কুলুঙ্গীর ভেতর ধূলিধুসরিত হয়ে পড়েছিল, তাই যেন এক ধাক্কায় মানুষকে মাটির কাছাকাছি টেনে নামিয়েছে। ৯ই আগস্টের নারকীয় ঘটনার, এইটি যেন একমাত্র সদর্থক দিক! 

চিত্রগ্রাহক- কুণাল চক্রবর্তী, সৌজন্যে- সোশাল নিউজ এক্স ওয়াই জেড

‘আশা’ হল একমাত্র সেই শেষ মোমবাতিটি, যার আলো দিয়ে একে একে নির্বাপিত প্রতিটি বাতিদানে নতুন করে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া যায়। সেই আলো হল; শুভবোধের, চেতনার আর সম্মিলিত সদিচ্ছার। ঘটনার অভিঘাতে কেঁপে উঠেছে সমগ্র বিশ্ব। শুধুমাত্র কলকাতা শহর বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই অসহনীয় অপরাধের ক্রোধ ছুঁয়ে গেছে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্য থেকে বিশ্বের বহু শহরে। তাই আজ সমগ্র নাগরিক সমাজের একমাত্র দাবী “বিচার চাই”। 

রবিঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘ন্যায়দন্ড’-এর সেই চিরায়ত বাণীর আজ সত্য দর্শনের সময় এসেছে। কায়মনবাক্যে, নারী পুরুষ ধর্ম বয়স নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেকের কামনা,

“অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, 

তব ঘৃণা যেন তারে, তৃণ সম দহে”      

অপরাধের প্রতি, অপরাধীর প্রতি এবং সেই সব কুশীলবের প্রতি, যারা অন্তরালে থেকে অপরাধীদের ক্রমান্বয়ে মদত দিয়ে চলেছে, তাদের সকলের প্রতি এই ঘৃণা যেন প্রশমিত না হয়। যে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, বিচার না পাওয়া পর্যন্ত, তা যেন নিভে না যায়।  

[চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল]

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.