শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

‘জগৎ-পারাবারের তীরে…’

উৎসব রাতের পর সকালের সূর্য বড় ম্লান হয়ে যায়। হেমন্তে ফসল প্রসবের পর প্রকৃতি যেন ক্লান্ত। তার সেই এলিয়ে পড়া মাঠ শুয়ে থাকে কুয়াশায়। সকালে ঘাসের ওপর শিশিরের ছোঁয়া পায়ে জড়িয়ে যায়। যদিও শহুরে মানুষ, প্রকৃতির উপস্থিতি তেমন ভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান না, তবু নাগরিক জীবন থিতু হতে চায়। ভাল বা মন্দ কাজের পরিণতিকে স্পর্শ করতে চায়।

কলকাতার এক নামী ‘পাবলিক’ স্কুলের অধ্যক্ষ বলছিলেন, আজকের ‘নবীন অঙ্কুর’, ছাত্র ছাত্রীদের অক্ষর বিমুখতার কথা। পড়া আর শোনার যে ঐতিহ্য সমাজ এতদিন বহন করে এসেছে, কোথাও যেন তার ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সেখানে ‘দেখা ও শোনা’ দখল নিচ্ছে ‘পড়া এবং লেখা’-র অভ্যাস। হয়তো নতুন প্রজন্ম নতুন ভাবেই আবিষ্কার করবে, মস্তিষ্ক সঞ্চালনার প্রক্রিয়া।

সংশয় থেকে যায়, প্রতিনিয়তঃ প্রযুক্তি নির্ভর যে তথ্য উদ্ঘাটন পদ্ধতি, আজ ছাত্র সমাজকে আকৃষ্ট করছে, তা তাদের মননশীলতা বৃদ্ধির কতটা সহায়ক? বইয়ের পাতায় সারিবদ্ধ অক্ষরকে মানুষ চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রহন করে। সেই অরূপ অক্ষরমালা থেকে মস্তিষ্ক নিজের মধ্যে রূপ সৃষ্টি করে। ইউটিউব বা অন্যান্য সমতুল ভিডিও স্ট্রিম-এ সেই অক্ষরমালার সুচারু ব্যাখ্যা, ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞানের আত্তীকরণকে অতিসরলীকৃত করতে গিয়ে, স্বীয় ক্ষমতা পঙ্গু করছে কি? যেখানে প্রতিটি ছাত্র নিজের মতো করে নিজের মনে তৈরী করতে পারতো নিজস্ব ভুবন; সে ভুবন এখন একীভূত হয়ে যায় সর্বব্যাপী মাল্টিমিডিয়ার দাপটে।

এ এক অভূতপূর্ব লড়াই! মানুষের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানুষেরই সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তবে এখনও পর্যন্ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কাছে ‘নিজস্ব ব্যক্তিগত প্রথম পুরুষ উপলব্ধি’ বলে কিছু নেই। বিস্ময়কর ভাবে কম্পিউটার ভিশনের সবকিছু থাকা সত্বেও এমন কোন যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয়নি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবটটি বলবে, তার প্রথম পুরুষ উপলব্ধি হয়েছে, ঠিক যেমন ভাবে মানুষের জৈবিক যন্ত্রের শরীরটি অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারে, ‘আমি’-কে।
এখানেই হয়তো আমরা হাত ধরতে পারি, বর্তমানের কিশলয়কে। মানব সন্তান হিসেবে যারা “পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে / জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে।”

প্রাণশক্তির এক নিজস্ব চালিকাশক্তি আছে। তাকে রোধ করতে পারে না কেউ। সে ঠিক বিস্তর বাধা বিপত্তি ভেদ করে গজিয়ে ওঠে। যেমন ঊষর মরুদেশে জেগে ওঠে সবুজ উদ্ভিদ, কংক্রিটের দেওয়াল ফাটিয়ে মাথা তোলে বটের চারা। সদ্যজাত নরম সবুজ পাতাটি অনায়াসে রূঢ় পৃথিবীর বুকে ছুঁড়ে দেয় এক রূপকথার হাসি।

সেই বিশ্বাসে ভর করে আজও রাশিরাশি অক্ষর রচিত হয়ে চলেছে। সে অক্ষর, মুহূর্তেই বিতরণের মহাপ্রযুক্তি ভর করে পৌঁছে যায় বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। ভুবনায়নের বেশকিছু দুরভিসন্ধির মধ্যে এটি নিশ্চিতভাবেই একটি আশীর্বাদ। হয়তো কেউ পড়বেন, বেশিরভাগই কেউ পড়বেন না। কিন্তু তাতে চর্চায় ছেদ পড়ে না। প্রতি প্রজন্মেই কিছু মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান লিপিবদ্ধ করে যাবেন। সে কাগজের পাতায় না হলেও, ইন্টারনেটের পাতায় তার দাগ কেটে যায়। আর সেই অক্ষর সঞ্জাত সেরোটোনিন বা ডোপামিন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া পার করে স্পর্শ করবে ডিএনএ-র গভীরে। উত্তর পুরুষের জন্য স্বাক্ষর রেখে যাবে যাবতীয় অর্জনের সুলুক সন্ধান।

জীবনের সব কিছু যেমন ঠিকঠিক নিয়ম মেনে হয় না, তেমনই অজস্র অপূর্ণতাকেই সকালের জড়িয়ে নেওয়া আলোয়ানের মতো ওম খোঁজার চেষ্টাতে থাকি আমরা সকলেই। ‌ফসল ঘরে ওঠার পর যেমন আবার মাঠ প্রস্তুত করতে হয় পরের ফসলের জন্য, মানব সভ্যতাও তেমন বীজতলার দিকে তাকিয়ে থাকে যেখানে ভবিষ্যত নাগরিকের নবীন চারা-র দল ভোরের আলোতে আলতো করে মাথা তোলে।

বাঙলার ঘরে ঘরে নবান্নর আয়োজন হয়। নতুন চালের সেই সুবাস আমাদের বেঁচে থাকার আশ্বাস নিয়ে আসে। সেই ঘ্রাণ গায়ে মেখে বাংলার ‘জগৎ-পারাবারের তীরে ছেলেরা করে মেলা।’

এই কার্তিকেই সারা রাত ধরে জ্বলে থাকে আকাশ প্রদীপ। পিতৃপুরুষরা সেই আলো চিনে চিনে নিচে নেমে আসে। ছুঁয়ে দেখে তাদের কুয়াশায় মোড়া উত্তরপর্বকে। ঘটা করে ক্যালেন্ডারে শিশুদিবস দাগিয়ে রাখলেও, সমগ্র জাতির মনে সংশয় জেগে থাকে। অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তাই বর্তমানের দুয়ারে রেখে যাই শাশ্বতর আলোকবর্তিকা। সে ‘জেনেরেটিভ এ-আই’ বা ‘কম্পিউটার ভিশন’ বা ‘নলেজ গ্রাফ’ নয়; বহু প্রাচীন এক প্রার্থনা, যা একদিন ঈশ্বর পাটনী জোড় হাতে বলেছিল, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”

[চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল]

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.