ইছামতির পাশে বসতে ভাল লাগে। জল পেরোলেই সাতক্ষীরা। সে অন্য দেশের গল্প। ভাবতে কেমন মনে হয়? ‘অন্য দেশ’ অর্থ অন্য কিছু? যা আমার মতো নয়? অথচ সীমান্ত পেরলে একই মানুষ, সার দিয়ে গ্রাম বাংলা, একই কান্না হাসি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একই রোদের নিচে একই ভাষায় জড়াজড়ি করে থাকে।
পুরোন যাঁরা এখনও আছেন, তাঁদের গলায় ‘হারানোর হাহাকার’ আজও কানে বাজে। কেউ কেউ নিজেই হতে চায় ‘নাথুরাম’। কেউ বলেন, নেতাজি থাকলে এ বিভাজন হতোই না। কী হলে, কী হতে পারতো, জানা নেই। ইতিহাস বড় কঠিন। সে পাতায় লেখার সুযোগ একবারই মাত্র আসে। তারপর সময়ের খাপে, প্রস্তরীভূত হয়ে যায় সেই গল্প। পাতা উল্টে ছুঁয়ে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি, ঠিক বা ভুলের মাসুল গুনি।
তারপরেও পট বদলায়। তৈরি হয়ে ওঠে নতুন ইতিহাস। মানুষই পারে, নিজেদের প্রবৃত্তির উর্দ্ধে উঠে, স্বকীয়তা অর্জন করতে। বাংলা ভাষা, মর্যাদা পায় বিশ্বের দরবারে। নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা শোনা যায়, বিবিসি, ডয়েসে-ভেল, রেডিও ওয়াশিংটন সহ বহু দেশে বাংলা সম্প্রচারণ শুরু হয়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হয়।
ভাঙা আজাদী নিয়ে এপারে দাঁড়িয়ে, আমাদের অর্থাৎ টুকরো হয়ে থাকা বাঙালির উপরেও খানিক গর্বের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আন্তর্জাতিক মর্যাদায় সৃষ্টি হয় সাহিত্য, শিল্প, গান। এপার থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখি, কেমনভাবে বাংলা চর্চা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়! এ তো আমারও ভাষা! তাই গৌরবের ভাগীদার হতে তো কোন বাধা নেই। বেড়ার অন্যদিক থেকেও সেই প্রতিফলিত গুণপনায় বুক ভরে ওঠে।
ভাষায় আদান প্রদান চললেও কাঁটাতার থেকেই যায়। সময়ের সঙ্গে, অনাত্মীয় বিভেদ যদি বা মেটে, রক্তের বিরোধিতা যেন মেটার নয়। সে ঠিক লুকিয়ে থাকে রক্তের গভীরে। নতুন অর্জনের আলোতে, যতই ভুলে যাই, তবু সেই কলহ-র বীজ গোপনে বাড়তে থাকে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং থেকে নোয়াখালি, কোন কিছুই যেন কেউ ভোলে না। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত, নতুন করে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। যেসব প্রসঙ্গের মীমাংসা হয়ে গিয়েছে, সেসব আবার করে তোরঙ্গ খুলে বার করে, রোদে দেওয়া হয়।
যে সময়, ভাবনার বিষয় হতে পারে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার’, ‘সবুজ শক্তি’, ‘কার্বন পদচিহ্ন’ অথবা ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং’, তখন মাংস খাওয়ার লড়াই-এ আমরা রাস্তায় নামছি।
তবু এর মধ্যে আশার কথা, ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা যথার্থ পরিণত মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন, এই দেশে আর কোন ধর্মস্থানের চরিত্র বদল করার মামলা গৃহীত হবে না। হয়তো সময়ের কোন বাঁকে সত্যিই কোন ধ্বংস স্তূপের উপর তৈরি হয়েছে, অন্য ধর্মের ইমারত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আর ‘মাটি’ খুঁড়ে বেদনা জাগাতে রাজি নয়। বহু বছরের বহু ঘাম, রক্তের বিনিময়ে এসেছে এই স্থিতাবস্থা। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সেই অবস্থাকে ভাঙার অধিকার কারও নেই। যেমন ফিলিস্তিনি ও ইহুদীদের লড়াই, দেড়হাজার বছর পার করেও হিংসার অবসান হয়না। ক্রমাগত আঘাত আর প্রত্যাঘাত চলতেই থাকে। দুই পক্ষেই অবিশ্রাম রক্তক্ষরণে জনজীবন বিপর্যস্ত। এর কোন শেষ দেখতে পায় না কেউ।
একটা সময়, ‘দেশ’ কেন ভাগ হয়েছে ভেবে দুঃখ করেছে অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে যাদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হতে হয়েছে। তারপরেও কয়েক বছর পর বাংলা ভাষার জয়যাত্রায় গর্বিত হয়েছে সব বাঙালিই। দীর্ঘদিন পার করেও ফেলা আসা মাটির কথা বলে, অনকেই আবেগে বুক ভরায়।
সেই আবেগে কোথাও এখন ঘুণ ধরেছে। একের পর এক ঘটে চলা নীচতার নিদর্শনের কথা শুনতে শুনতে, এখন যেন মনে হয়, ভাগ্যিস বিভাজন হয়েছিল। একটি দেশ যখন চাঁদে বা মঙ্গলে পাড়ি জমাচ্ছে, অন্য দেশটি তখন খুঁজে খুঁজে শতাব্দ প্রাচীন বিধি নিষেধ সমাজের ওপর আরোপ করে চলেছে। অথচ মুক্তমনা শিক্ষিত সমাজ ভয়ে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। পুরো দেশটাই যেন অন্ধকার যুগে পৌঁছে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। সর্বশক্তিমান এঁদের শক্তি দিন, জাত ধর্মের আগে যেন মানুষ হয়ে উঠতে পারে, আজ এই প্রার্থনা। কাজী সাহেবের দর্শনকে নতুন করে অন্তরে নেওয়ার প্রয়োজন,
“মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।”
রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
খুব প্রাসঙ্গিক আলোচনা, ভালো লাগল