প্রথম পর্ব
এই লেখা যাঁরা পড়ছেন, জানি না ছোটোবেলা বা বড়োবেলাতেও, তাঁদের কতজনের জন্য সারা বছর নতুন জামা-জুতো কেনা হতো? আমার তো হতো না। যা কিছু ‘নতুন’ প্রাপ্তি’ সবই বছরের কোনও একটা বিশেষ সময়ের জন্য রাখা থাকতো। বাটা কোম্পানির এই শাশ্বত বিজ্ঞাপনটি শুধু জুতোর জন্য নয়, বাঙালি যাপনের একটি সংক্ষিপ্ততম স্লোগান।
পয়লা বৈশাখ থেকে পঞ্জিকা শুরু হলেও বাঙালির বছর শুরু হয় পুজোর দিন থেকে। আমাদের স্মৃতির দুটো পর্ব আছে – পুজোর আগে আর পুজোর পরে। এভাবেই আমরা অতীত-ভবিষ্যতের জন্য জায়গা করে দিতুম। যাকে পণ্ডিতরা বলেন ‘ইতিহাস’, তা আসলে কী? ফেলে আসা অতীতের নানা ঘটনা, মানুষ, স্মৃতি, মুহূর্তের নিরবচ্ছিন্ন মালা। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তারা আবার ফিরে আসবে একদিন। মানুষের কাছে। তাদের মধ্যে কতোটা অংশ শুদ্ধসত্ত্ব উপলব্ধি, কতোটা মেদুর আবেগ, তার বিচার করে মহাকাল। গুরু বলেছেন, ‘রবার যেটা সেটাই রবে’।
‘বাঙালিয়ানা’ নামে যে জাতিভিত্তিক অস্মিতার অনুভব এক বিশেষ ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সক্রিয় থাকে, সঙ্গীতবোধ তার একটি জরুরি অংশ। বাংলার বাইরে নানা জায়গায় অন্যান্য ভাষাসংস্কৃতির সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের থেকে শুনেছি, তাঁরা মনে করেন গানবাজনার ঐতিহ্য বাঙালিদের এক সহজাত উত্তরাধিকার। গানের সমঝদারি নাকি বাঙালিদের এক জন্মগত অর্জন। এই ধারণাকে অনৃত মনে করার কোনও কারণ নেই। বাংলা গানের মূলস্রোত, উপনদী, শাখানদীর অন্ত নেই। বাংলা ভাষার শিকড়ই রয়েছে চর্যা গানে। এই বিপুল সুর প্লাবনের রাজত্বে ‘পুজোর গান’ একটি অন্যতম উজ্জ্বল সংযোজন।
‘পুজো’ শব্দের সঙ্গে সচরাচর দেবতা জড়িয়ে থাকেন। দেশের অন্য সব প্রান্তে সে রকমই ভাবা হয়। কিন্তু বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের চাপে দেবতার থেকে ‘প্রিয়’র পুজো অনেক বেশি জনপ্রিয়। অন্তত রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে। ‘পুজোর গান’ অভিধাটি দেবতামুখী নয়, উদযাপনমুখী। এসেছিলো রেকর্ড কোম্পানির দৌলতে। একশো দশ বছর আগে। পুজোয় বাঙালির সব কিছুই ‘নতুন’ চাই। গানও। সাহেব বণিকরা বুঝেছিলো ব্যাপারটি। বাঙালিরা তাঁদের অনুগমন করেছিলেন।
এপার বাংলায় দুর্গোৎসব নামক উদযাপনটির ব্যাপ্তি বিশাল। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যান্য দিকগুলির সঙ্গে সুরচর্চার ক্ষেত্রেও এই উৎসব নিজস্ব ছাপ রেখে আসছে বহুকাল ধরে। ব্রিটিশ রাজশক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে, বাংলার প্রধান সামাজিক ও আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে দুর্গাপুজা, বৃহত্তর অর্থে দুর্গোৎসব’কে, রাজশক্তির পোষকতা এনে দিয়েছিলো। মুঘল আমলের দুর্গাপূজা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ের দুর্গাপূজা, তার থেকে কোম্পানির আমলের দুর্গাপূজা অন্য মাত্রা নিয়েছিলো। রাজা নবকৃষ্ণ ও তাঁকে অনুসরণ করে কলকাতার বাবু-কালচারের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা, শেষে বহু মানুষের যোগদানে আয়োজিত বারো-ইয়ারি পুজোর বাড়বাড়ন্ত, পরবর্তী কালে বাঙালির দুর্গাপুজোর প্রতিরূপটি বদলে দিয়েছিলো। নিধুবাবু নাগরিক বাঙালির সঙ্গীতরুচিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই ধারায় শ্রীধর কথক, গোপাল উড়ে প্রমুখ বহু গুণী শিল্পীর সমবায়ে বাংলায় একক নাগরিক গানের ধারাটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে ছিলো দাঁড়া-কবিগান, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, বাই-গান প্রভৃতি নতুন শৈলীর গান। সেকালের সাধারণ মানুষ দুর্গাপুজোর সময় আয়োজিত বিভিন্ন আসরে এই সব গানের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। পুজোর উৎসবের অঙ্গ হিসেবে বাঙালি পুরোনো দিনের কীর্তনভিত্তিক সঙ্গীতধারার বাইরে গিয়ে নতুন ধারার গানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
২.
বিশ শতকের একেবারে প্রথম দশক থেকে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার স্রোত সাধারণ মানুষের ঘরের মধ্যে নতুন নতুন সম্ভাবনা আমদানি করতে শুরু করে । গ্রামোফোন রেকর্ড সাধারণ মানুষের গীত তৃষ্ণাকে প্রশমিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করে। ১৯০১ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি কলকাতায় অফিস খোলে। ১৯০৭ সাল থেকে রেকর্ড ছাপানো শুরু হয়। ১৯১৪ সালে শারদীয় দুর্গাপুজোর সময় ‘এইচএমভি’-র ছাপ্পায় ‘পুজোর গান প্রকাশ শুরু হয়ে যায়। প্রথম বছরের পুজোর গানের অংশ ছিলো আগমনী-বিজয়া, ভক্তিমূলক, বাই ও কীর্তনাঙ্গের বাংলা গান। গেয়েছিলেন মানদাসুন্দরী দাসী, বেদানাবালা দাসী, কৃষ্ণভামিনী দাসী, কে মল্লিক প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য, সেই বারের পুজোর গানের মধ্যে ছিলো অমলা দাশের কণ্ঠে (মিস দাশ) রবীন্দ্রসঙ্গীত। তালিকাটিতে স্পষ্ট, বাঙালির সেকালের সঙ্গীতরুচির আবহমান ও অভিনব নমুনাগুলি সাহেব কোম্পানির দাক্ষিণ্যে সাধারণ্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলো। বণিকের বাণিজ্য-প্রয়াস বাংলা গানের জগৎকে আমূল বদলে দিয়েছিলো দশ বছরের মধ্যে। পুরোনো বল্কলের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালির গান নতুন প্রসাধন ও অলংকরণের সাজে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
বিশের দশক থেকে পাঁচের দশক-এর সূচনাকাল পর্যন্ত বাংলা গানের জগতে ব্যাপক মন্থন চলেছিলো। প্রচলিত প্রথার গান, বিচিত্র নতুন পথে যাত্রা করে নানা রকম চমক সৃষ্টি করতে থাকে। এ ছিলো বাংলা গানের নিজস্ব অবয়ব গড়ে ওঠার প্রস্তুতি। সেই যুগের ‘পুজোর গান’ শুনলে নতুনতর স্বাদের পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পর্বে তিন দশকের পুজোর গান নিয়ে পৃথক ভাবে আলোচনা করার অবকাশ আছে। পাঁচ থেকে আট দশক সময়কালে বাংলা ‘পুজোর গান’ মান ও সৃজনশীলতায় ঔৎকর্ষে অনন্য হয়ে ওঠে। এই নিবন্ধে যৎকিঞ্চিৎ তার চর্চাই উঠে আসবে।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গ্রহমণ্ডলীর প্রভাব থেকে লক্ষণীয় ভাবে পৃথক হয়ে যাওয়া বাংলা গানের ঐতিহ্যটির পত্তন হয়েছিলো পাঁচের দশক থেকে। বাঙালির ‘পুজোর গান’ সেই গৌরবজনক ধারার প্রত্যক্ষ ও প্রধান উত্তরাধিকারী। আগের তিন দশক-এর ক্ষমতাবান শিল্পীরা যে ক্ষেত্রটি কর্ষণ করে গিয়েছিলেন, পরের তিন দশক জুড়ে সেখানে অপর্যাপ্ত সোনার শস্য ফলেছিলো। সেই সব স্রষ্টাদের মধ্যে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত, পঙ্কজকুমার মলিক, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রাইচাঁদ বড়াল, শচীনদেব বর্মণ এবং আরও অনেকে। এই যুগে বাংলা গানের দিকচক্রটি বিশেষ ভাবে প্রসারিত হয়ে গিয়েছিলো। দেশচেতনার গান বা প্রেমসঙ্গীত, উভয় ধারার বাংলা গানেই পশ্চিমি সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে উঠছিলো। সুরসাগর হিমাংশু দত্ত বা অনুপম ঘটক রাজকীয় মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিলেন তখন। তিনের দশকে ‘পুজোর গান’ গাইতেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল, শচীন দেববর্মণ এবং নবোদিত তারকা যূথিকা রায়।
৩.
উদ্ভাবন ও পরিশীলন, উভয় লক্ষণেই ধনী এতোজন স্রষ্টা ও শিল্পীর যৌথ প্রয়াসে বাঙালির সঙ্গীতরুচি ক্রমশ আরও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। তাকে বারুদ প্রস্তুত হবার সময়কাল বলা যায়। রসিকজনের আকাঙ্খার বারুদে প্রথম ফুলকিটি জ্বালিয়েছিলেন একজন প্রায় নামহীন তরুণ। যাঁর খ্যাতি তখন Agit Prop ধারার রাজনৈতিক গণসঙ্গীতে গড়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অন্তর্জগতে বাংলা কাব্যসঙ্গীতকে নতুন দিশা দেবার ইচ্ছাও প্রায় আকাশছোঁয়া। বিস্ফোরণের আধার ছিলেন আরেকজন যুবক, যিনি ততোদিনে বিখ্যাত হতে শুরু করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ইন্দ্র রায় রোডের বাড়ি থেকে সলিল চৌধুরীর নিরাশ মুখে বিদায় নিয়ে আবার ফিরে আসার ঘটনাটি বাংলা গানের পৃথিবীকে একটা অন্য মোড় এনে দেয়।
পাঁচ থেকে আট দশকের সময়কালটিতে বাংলা গানের সম্রাট ছিলেন এক ও অদ্বিতীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে সুরকার হিসেবে থাকতেন প্রধানত সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ এবং তিনি নিজে। এঁদের সমন্বয়ে অসংখ্য গান সৃষ্টি হয়েছে এই পর্বে। সলিল চৌধুরী ছিলেন টোটাল কম্পোজার। সুরের সঙ্গে গানের কথাও নিজেই রচনা করতেন।
‘গাঁয়ের বধূ’ গানটি বাংলা গানে একটি জলবিভাজক সৃষ্টি। তার তাৎপর্য গত পঁচাত্তর বছর ধরে রসিক শ্রোতাদের চিত্তে সমান জেগে আছে। ১৯৪৯ সালে ‘গাঁয়ের বধূ’ প্রকাশিত হয়। তবে তা ‘পুজোর গান’ ছিলো না। সেবার পুজোয় হেমন্তের গান ছিলো পবিত্র মিত্রের কথায়, সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে ‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’ এবং ‘আলেয়ার মত কেন’ জাতীয় পুরোনো ধারার গান । ১৯৫০ সালের পুজোর গানে হেমন্তের কাছে আবার ফিরে আসেন সলিল চৌধুরী। রেকর্ড হলো সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’। ১৯৫১-র পুজোয় এই ত্রয়ী সৃষ্টি করলেন আরেকটি কালজয়ী গান। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা, ‘রানার’। কবিতাটিতে সুর যোজনা গিয়ে সলিল নিজেই বলেছিলেন,
‘…রচনাটি আমি হাজার বার উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি’। একটি ‘সা’ থেকে যাত্রা শুরু করে সুরটিতে ছ’বার ষড়জ পরিবর্তন আছে।‘ সলিলের উদ্ভাবনী দক্ষতা বাংলা গানে এক নতুন নিরিখ তৈরি করে দেয়। এই গানে কাব্যসঙ্গীতের পরিচিত ‘চক্রীয়’ আবর্তন পরিহার করে লিনিয়ার প্রগ্রেসনে এক ‘রানারে’র যাত্রার গতিটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গানের কোনও স্থায়ী নেই। সেখানে ফিরে আসাও নেই। গানের সুরের গতিপথে ধরতে চাওয়া হয়েছে এক অন্তহীন যাত্রা। ব্যক্তিগত ভাবে এই নিবন্ধকার বিশ্বাস করে ‘রানার’, নতুন ধারার বাংলা কাব্যগীতি তথা ‘পুজোর গান’ পরবর্তী কালে যে শিখর স্পর্শ করেছিলো, এই গান সেই শোভাযাত্রার মিছিলের মুখ।
৪.
হেমন্ত ও সলিল বাঙালির গান শোনার অভ্যেসটি বদলে দিয়েছিলেন। সলিল আগে পথেঘাটে মানুষের বিদ্রোহ, সংগ্রামের গান বেঁধে বেড়াতেন। হেমন্ত গাইতেন চিরাচরিত পঙ্কজকুমার বা কমল দাশগুপ্তের ঘরানায় পুরোনো শৈলীর ‘আধুনিক গান’। ‘পুজোর গান’ নামক বাহনটি তাঁদের দুজনকেই একটা নতুন সৃষ্টির পথে নিয়ে এসেছিলো। বাংলা গানের যে ধারা ‘রানার’ থেকে শুরু হয়েছিলো, সেই পরম্পরায় কী কী গান সৃষ্টি হয়েছিলো খুঁজতে গেলে তালিকাটি বিস্মিত করে। যেমন, ‘পাল্কীর গান’ (১৯৫২), ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ / পথে এবার নামো সাথি’ (১৯৫৫), ‘পথ হারাবো বলেই এবার/ দূরন্ত ঘূর্ণির’ (১৯৫৮), ‘আমি ঝড়ের কাছে/ মনের জানালা ধরে (১৯৬১), ‘শোনো কোনো এক দিন/ আমায় প্রশ্ন করে’ (১৯৬৯)।
এছাড়া সলিলের মন্ত্রশিষ্য এবং তাঁর ঘরানার একজন প্রধান সুরস্রষ্টা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে পুজোর গান এসেছিলো ‘তোমার ও মন মহুয়া/ সোনালী চম্পা আর রূপালী চন্দ্রকলা ‘ (১৯৫৯), ‘এমন একটা ঝড় উঠুক/ সবাই চলে গেছে’ (১৯৬৯), ‘আমিও পথের মতো/ অনেক অরণ্য পার হয়ে’ (১৯৭১)। সলিলের সহযোদ্ধা আরেকজন ক্ষমতাশালী সঙ্গীতস্রষ্টা পরেশ ধর ১৯৫৩ সালে হেমন্তের জন্য পুজোর গান নির্মাণ করেছিলেন। দুটিই গানই প্রবাদপ্রতিম। ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’ এবং ‘ফুলের মতো ফুটলো ভোর’ (জোয়ারের গান)।
রসিক শ্রোতারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন উল্লেখিত সুরস্রষ্টাদের দৌলতে পাঁচের দশকের পর থেকে বাংলা গানের দুনিয়ায় নতুন চরিত্রের সঙ্গীত নির্মাণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো । তাঁদের আত্মপ্রকাশের বাহন ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন মহাশিল্পী এবং উপলক্ষ ছিলো ‘পুজোর গান’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরীর সমবেত প্রয়াসে গড়ে ওঠা সুরসৃষ্টির ক্রমান্বয়ী শ্রেষ্ঠত্ব বাংলা গানকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে যায় যে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে অন্যান্য স্রষ্টারাও উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠতেন।
‘পুজোর গান’-কে উপলক্ষ করে নতুন সুরের জোয়ার শুধু সলিল বা তাঁর ঘরানার শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। স্বনামধন্য নানা স্রষ্টা ‘হেমন্ত-আশ্রয়ী’ সঙ্গীতের ডালি নিয়ে আমাদের স্মৃতির রত্নশালা ভরে দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, রতু মুখোপাধ্যায়ের মতো বড়ো মাপের নাম পাওয়া যায়। তবে সলিল ব্যতিরেকে যে দুজন সুরস্রষ্টা ‘পুজোর গান’-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ন ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের নাম নচিকেতা ঘোষ এবং স্বয়ং হেমন্ত। সলিল, নচিকেতা এবং হেমন্ত তিনজনেরই সুরসৃষ্টির দুনিয়া আলাদা। রসিকের বিশ্লেষণী আতশকাঁচে পার্থক্যগুলি ধরা পড়ে যায়। কিন্তু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এই তিন ধারার সুরস্রষ্টাই হেমন্ত ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারেননি। কারণ হেমন্ত ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। সলিল বলতেন, তাঁর গানের জন্য যখন হেমন্ত-কে পাওয়া যায়, তখন ‘Sky is the limit’. অর্থাৎ সুরকার হিসেবে সলিল শ্রেষ্ঠতম নির্মাণের জন্য হেমন্ত-কেই বেছে নেন।
৫.
নচিবাবু হেমন্তকে দিয়ে কী কী ‘পুজোর গান’ গাইয়েছেন ভেবে দেখা যায়। ‘মেঘ কালো আঁধার কালো/ ধিন কেটে ধিন’ (১৯৫৭), ‘তারপর? তার আর পর নেই/ তুমি এলে অনেক দিনের পরে'(১৯৬২), ‘কোন পাখি ধরা দিতে চায়/ কোনো নতুন কিছু কথা’ (১৯৬৩), ‘একগোছা রজনীগন্ধা / যদি জানতে চাও’ (১৯৭২)। এছাড়া হেমন্তের বিখ্যাততম গানগুলির মধ্যে নচিবাবুর সুরে ‘আমার গানের স্বরলিপি / ঝাউয়ের পাতা ঝিরঝিরিয়ে’ (১৯৫৮) এবং রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা/ কী দেখি পাই না ভেবে’ (১৯৬২) একই সময়ের গান হলেও পুজোর কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো। অবশ্য বৃহত্তর অর্থে এই সব গান ‘পুজোমণ্ডপ’ বা গৃহকোণের গ্রামোফোনে পুজোর গানের সঙ্গেই বাজতো।
হেমন্ত যখন নিজের সুরে ‘পুজোর গান’ বাঁধতেন তার মাত্রা ছিলো এককথায় অনন্য। ১৯৫৮ সাল থেকে হেমন্ত পুজোর সময় বা তার দু মাস আগে প্রকাশিত গানগুলি, যাদের মেজাজ বাঙালির বার্ষিক উৎসবের সঙ্গে মেলানো থাকতো, নিজের সুরে গাইতে শুরু করেন। যেসব গানের জন্য বাঙালির অবচেতন স্মৃতিতে হেমন্ত, ‘হেমন্ত’ হয়ে উঠেছিলেন তার সিংহভাগ গান এর মধ্যে পড়ে। নিজের সুরে গাওয়া সেই সব সৃষ্টি মুখ্যত ছিলো ‘পুজোর গান’। ১৯৫৮ সালে ‘পুজোর গান’ গাইতে গিয়ে হেমন্ত বহুদিন পরে নিজের সুরে দুটি গান রেকর্ড করেছিলেন। তখন তিনি ‘নাগিন’ ও অন্যান্য হিন্দি ছবির দৌলতে সারা দেশের এক বিখ্যাত সুরকার। আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গানগুলি, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা’ এবং কত রাগিনীর ভুল ভাঙাতে’, হেমন্তকে বাংলা গানে সুরের জগতেও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। পর পর আসে , ‘কোনদিন বলাকারা’/ জানি না কখন তুমি’ (১৯৫৯), ‘অলির কথা শুনে/ আমি দূর হতে তোমারেই’ (১৯৬০), ‘আরো ভালো হত/ হাজার বছর ধরে’ (১৯৬৪), ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে/ ও দুটি আঁখি যেন’ (১৯৬৫), ‘চলে চলে মাঝখানে/ আমার জীবন যেন’ (১৯৬৬), ‘জীবনের হাট থেকে / চোখে যদি জল করে টলমল’ (১৯৬৭), ‘ফেরানো যাবে না আর/ ঘুম নেই কেন চোখে’ (১৯৬৮), ‘তুমি চলে গেলে/ না যেও না’ (১৯৭৩),সেদিন তোমায় দেখেছিলাম/ কতদিন পরে এলে’ (১৯৭৪), ‘চলিতে চলিতে পথে তোমায় দেখে/ অমন ডাগর ডাগর চোখে’ (১৯৭৫), ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না/ তুমি কী যে বলো’ (১৯৭৫), ‘গভীর রাতে হঠাৎ জেগে/ সেই সে ফুলের গন্ধ’ (১৯৭৬) ইত্যাদি।
৬.
সলিলের সুরের গড়ন ছিলো পশ্চিমি স্ট্যাকাটো শৈলীর। ভিত্তি ছিলো সিম্ফনি। গানের এই দুই পশ্চিমি চরিত্রকে তিনি সীবনহীন ভাবে মিলিয়ে দিতেন বাংলা লোকসঙ্গীত ও দেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আমেজের সঙ্গে। শ্রোতার জন্য তা ছিলো এক পর্যায়ের সুরের স্বর্গারোহণের মতো। গানের তাল, লয়, স্কেল, কর্ড বদল করে হারমনির বৃহত্তর জগতে শ্রোতাকে লীন করে দেওয়া। অন্যদিকে নচিকেতা ঘোষ ছিলেন মেজাজি শিল্পী। গোছানো স্বভাব। সুরের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতেন মেধাজাত কৌশলের জাদুতে। আপাতভাবে মনে হতো সুরের চলনটি কতো সহজ। মসৃণ স্বাচ্ছন্দ্যে বয়ে যাচ্ছে জলের মতন। অথচ গণিতটি এরকম ‘সরল’ নয়। যেমন ধরা যাক, হেমন্তের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’। স্থায়ীর প্রথম লাইনটি পুনরাবৃত্ত। কিন্তু চমকটি শুরু হয় পরের লাইন থেকেই। ‘যে কালিতে বিনোদিনী হারাল তার কুল’। তার সপ্তক ছোঁয়া আবেদন সেই সুরে। তার পরেই কীর্তনাঙ্গ সুরে সংলাপের মতো নেমে এসে মিলে যায় স্থায়ীতে। আমাদের কানে ব্যাপারটা ‘সহজ’ লাগে। হেমন্তের সুর লাগানোর ব্যাপ্তি নচিবাবুর সুরের জাদুকে আত্মস্থ করে আমাদের অন্তর্মহলের গভীরে পৌঁছে দেয়। সলিলের তৈরি করা সুরে হেমন্ত যেভাবে সুর লাগান, নচিবাবুর করা সুর লাগানোর সময় নিজেকে পাল্টে ফেলেন। আবার নিজের করা সুরে যখন তিনি গান করেন তখন তাঁর কণ্ঠে সেই সব সুরের ফ্রেজ উঠে আসে, যাদের সঙ্গে তিনি সব চেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ। অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের মসৃণ সুরসংস্থান তাঁকে স্বস্তি দেয়। সাফল্য নিয়ে আসে।
বাঙালির ‘পুজোর গান’-এর রত্নভাণ্ডার থেকে গান শুনতে শুনতে শ্রোতার কাছে আমাদের গানের আত্মা স্বপ্রকাশ হয়ে ওঠে। গত পাঁচ দশক ধরে বাংলা গানের যে ক্রম উত্তরণ ঘটেছে তার সূচক হিসেবে এই ধারার গানগুলি প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরতে পারে। এই পর্বে আমরা পাঁচ থেকে আট দশকের মধ্যে পুজোর গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে সামান্য চর্চা করলাম। পরবর্তী পর্বে আশা করি অন্যান্য মহীরুহদের স্মরণ করারও সুযোগ আসবে।
৭ .
পুজোর গানের মাঠ ছিলো যেন ডার্বির অন্তিম খেলা। প্রত্যেকে তাঁদের সেরা সামর্থ্য নিয়ে মাঠে নামতেন। লক্ষ করার বিষয়, সেকালে সারা বছর জুড়ে নানা অবসরে বাংলা গানের রেকর্ড প্রকাশিত হলেও প্রত্যেক সুরস্রষ্টা ও শিল্পী তাঁদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিটি ‘পুজোর গান’-এর অবসরে শ্রোতাদের কাছে নিয়ে আসতে চাইতেন। এই নিবন্ধের আধেয় বাঙালির ‘পুজোর গান’-এর ‘গান’ হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। তার নিহিত শিল্প সম্ভাবনার বস্তুগত বিচার। গানের সঙ্গে বিজড়িত স্মৃতিমেদুরতা মানুষকে হয়তো কখনও ঋদ্ধ করে। কিন্তু শিল্প হিসেবে গান এক ভিন্ন প্রপঞ্চ। গভীর মেধা, নিবিড় শ্রম এবং এক জটিল বিজ্ঞান। গানের আধারে স্মৃতির উজ্জ্বল উদ্ধার আমাদের মনোভূমিকে নিয়ত রসসিক্ত করে যায়। অন্যদিকে গানের সঙ্গে নিজস্ব, নির্জন যাপন স্পষ্ট করে শিল্প-উপলব্ধির অন্য মাত্রাও আছে। হয়তো তার প্রভাব নিতান্ত তাৎক্ষণিক নয়। দূরগামী। কিন্তু সঙ্গীত ও রসশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য গানের গুণমানকে নিছক স্মৃতিমেদুরতার ঊর্ধ্বে যেতে হবে। ‘পুজোর গান’-এর সূতিকাঘরে জন্ম নিলেও সেই সব গানের এলেম সময়ের কষ্টিপাথরে ফেলে বিচার করা হয়।
[ক্রমশঃ]