
বাইরে বৃষ্টির শব্দ হলেই সুমন্ত্র চোখ বুজে তার আওয়াজ শোনে। মনে হয় উস্তাদ আলি আকবর খানের সেতারে দেশ রাগ বাজছে। সুরের ভিতর সে যেন বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার শব্দ আলাদা করে শুনতে পায়। জলপাইগুড়ির কলেজে চাকরি নিয়ে এসে সে ফারাকটা আরও ভালো করে বুঝেছে। কলকাতার বৃষ্টির মধ্যে যেমন একটা ছাপোষা গৃহস্থের বিরক্তি আছে, এখানে বৃষ্টি তা নয়। এখানে মেঘকে স্পষ্ট দেখা যায়। মনে মনে শক্তির কবিতাকে প্যারোডি করে সে মাঝেমাঝেই বলে, ‘এখানে মেঘ স্তনের মতো ঝোলে।’ কিন্তু এখন কোনও কাব্য নেই। সন্ধ্যা ক্রমেই অন্ধকারটাকে রাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঝড়বৃষ্টিতে কারেন্টও উধাও অনেকক্ষণ। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় একা যক্ষের মতো সে বসে আছে। বিরক্তির স্বাদের মতোই মুখটা কেমন তেতো লাগছে। একটু চা কিংবা কফি খেলে ভালো হতো। কিন্তু নিজে থেকে করতে আর ভালো লাগছে না। অন্যদিন তবু বিতনু আসে। কবিতা, সাহিত্য, সিনেমা নিয়ে আলোচনা হয়। কফি, সিগারেট সহযোগে সময়টা কেটে যায়। আজ যা দুর্যোগ, তাতে মনে হয় না বিতনু আর আসবে। কাজের মাসিও মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছে, এই বৃষ্টিতে রান্না করতে আসতে পারবে না। কী আর করা যায়! বিছানায় শুয়ে নিজের কম্পমান ছায়ার দেখে সে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, অনেক দিন আগে কেনা হুইস্কিটা আর খাওয়াই হয়নি। বের করলে হয়। এখন হয়তো ওটা এই বিষণ্ণ সময়টাকে মজিয়ে দেবে। ভাবতেই মনটা তার খুশ হয়ে গেল। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘শোনরে বিরহী যক্ষ, এমন বাদলে হুইস্কিই উপলক্ষ। ঢুকু ঢুকু খাও চানাচুর সহযোগে, ভুগবে না আর একাকীত্বের রোগে।’ তারপর হেসে উঠে বলল, ‘সাবাশ সুমন্ত্র পাল, বেড়ে কবিতা বানালে।’
বৃষ্টিতে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এসেছে। গ্লাসে হুইস্কিটা ঢেলে একটু একটু করে খেতে লাগল সে। ভাবল অনেকদিন নীল ছবি দেখা হয়নি। আজ এই ওয়েদারে দেখলে মন্দ হয় না। ওয়েদারটা খুব বিচলিত করছে। বিছানায় এলিয়ে শুয়ে মোবাইল দেখতে দেখতে গ্লাসে চুমুক লাগায় সুমন্ত্র। ফেসবুক দেখতে তার একদম ভালো লাগে না। যত লাইক-পিপাসুর দল। ভুলভাল কবিতার আবর্জনা আর নিজেদের ছবি ভিডিও লাইন দিয়ে পোস্ট করা। আর একদল আছে সবজান্তা, শুধু মানুষের ভুল ধরে বেড়ায়। তার মনে হয়, ফেসবুক জুড়ে অসুস্থ মানুষের ভিড়। তবুও দেখে সে। হঠাৎ করে মেঘনার একটা ছবি এসে যায় তার টাইম লাইনে। সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হাসছে। বাতাসে উড়ছে ওর খোলা চুল। হাসিটা যেন অন্যরকম। এ সৌন্দর্য যেন অন্যের কাছে ঈর্ষা করার মতো। থুতনির কাছে ওর সুন্দর তিলটা খোঁজার চেষ্টা করল সুমন্ত্র। জুম করে দেখার চেষ্টা করল। খুঁজে পেল না। কই, যখন ওর সঙ্গে মিশেছে, শয্যায় এক হয়ে মিশে গেছে, তখন তো ওকে এত সুন্দর লাগত না। ও কি তার কাছে কোনওদিনই সুখী ছিল না? সুবর্ণকে বিয়ে করার আগে তার সঙ্গে ওর প্রেমটুকু কি শুধুই মিথ্যা! তাই অমন করে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল?

বাইরে আবার একটা সশব্দে বাজ পড়ল। খুব কাছে। হয়তো তার বুকের ভিতরে। হাত থেকে পড়ে গেল ফোনটা, চলকে পড়ল গ্লাসের পানীয়। বদলে যাচ্ছে সুমন্ত্র। বাইরের বৃষ্টি আর বাতাসের মতোই সে যেন একরোখা হয়ে উঠছে। মনের ভিতরটা এখন অন্ধকার। আস্তে আস্তে উঠে গেল সে। আলমারি খুলে জামাকাপড়ের ভাঁজ থেকে ছুরিটা বের করে আনল। না, আর মেঘনাকে বাঁচতে দেওয়া উচিত নয়। এমনভাবে তাকে সে মারবে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। অনেকদিন ধরে সে সুযোগ খুঁজেছে। ফের আলমারিটা খুলে একটা মুখোশ পরে নেয়। ছদ্মবেশে পা টিপে টিপে আলমারির আড়ালটায় সে দাঁড়াল। মেঘনা না আসা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে আলমারি থেকে বড় পুতুলটা বের করে এনে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে। মুহূর্তে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শতচ্ছিন্ন পুতুলটার শরীরে সেই ছুরিটা বিঁধিয়ে দিয়ে বলল, ‘আই হেট ইউ। আই হেট ইউ। আমি তোমাকে সুখী হতে দেব না।’
বারবার ছুরিতে বিদ্ধ পুতুলটা পড়েই রইল। যেন মেঘনার নিথর দেহ। একসময় ক্লান্ত হয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়ল সুমন্ত্র। অন্যদিনের মতোই কাঁদল সে। বাইরে বৃষ্টির শনশন শব্দ। মোমবাতির শিখাটা শেষ লগ্নে এসে দপদপ করছে। কান্না, হা-হুতাশ আরও একবার তাকে ক্লান্ত করে তুলল। তখন ছিন্নভিন্ন পুতুলটার উপর রমনের ভঙ্গিমায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেটাকে বারবার চুমু খেতে খেতে সুমন্ত্র বলল, ‘আই লাভ ইউ মেঘনা। সারাজীবন এভাবেই তোমাকে ভালোবাসব আর ঘৃণা করব।’ বাইরে আরও একটা বাজ পড়ল। নিভে গেল মোমবাতিটা।