শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

স্বর্ণযুগের বেতার নাটক

‘আকাশবাণী কলকাতা। আজকের নাটক…।’ এটুকু শোনার পরই বাংলার শহর ও গ্রামে লক্ষ লক্ষ রেডিওর সামনে অজস্র শ্রোতা নড়েচড়ে বসতেন। শুক্রবার রাত আটটায় সেই নাটক সম্প্রচারিত হতো। গ্রামের চায়ের দোকানে কিংবা চণ্ডীমণ্ডপে অথবা বাড়ির দালানে রেডিওর সামনে শ্রোতারা নাটক শোনার জন্য থাকতেন অধীর প্রতীক্ষায়। শহরেও একই চিত্র। বড়লোকের ড্রয়িংরুমে কিংবা বারো ঘর এক উঠোনের বাড়ির ছাদে একটু টুলের উপর বসানো থাকত ট্রানজিস্টর। তাকে ঘিরে শ্রোতার দল। ওই রেডিও নাটকের মধ্য দিয়েই হতো ভুবন দর্শন, আমাদের প্রতিদিনের বিনোদন। তখন সিনেমা ও মঞ্চ নাটকের বিরাট দাপট সত্ত্বেও এতটুকু কোণঠাসা হয়নি রেডিও নাটক। বেতার নাটককে বলা হয় কান দিয়ে দেখা। শুনতে শুনতে কল্পনা শক্তি একটি একটি করে অসংখ্য চিত্রকল্প তৈরি করত। শুধু শুক্রবার নয়, শনিবার আর রবিবারও ছিল নাটকের অমোঘ টান। সুখী গৃহকোণ, বেতার নাটক শ্রবণ।

সেই সময়টা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গত শতকের পাঁচ, ছয়, সাত কিংবা আটের দশককে বলা হয় বেতার নাটকের স্বর্ণযুগ। সেই সব বেতার নাটকের বিকল্প আজও টেলিভিশন মাধ্যম তৈরি করতে পারেনি। একের পর এক নাটক মানুষের মনকে ছুঁয়ে ফেলত, চোখে জল এনে দিত। শুধু কণ্ঠ দিয়ে, শব্দ দিয়ে তৈরি করা হতো পরিবেশ, অনুভূতি। হাসি, কান্না, দুঃখ, অনুরাগ, প্রেম, ঘৃণা। কী গভীর ছিল সেই সব অনুভূতির প্রহরগুলো! শব্দ দিয়ে কল্পনার মধ্যে আঁকা হয়ে যেত অজস্র ভার্চুয়াল ছবি। অসংখ্য শক্তিশালী নাট্যকার, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, আবহ সঙ্গীত পরিচালক এই মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বেশ কিছুদিন আগে বেতার নাটক নিয়ে অনেক কথা শুনেছিলাম জগন্নাথ বসুর কাছে। তিনি ছিলেন বেতার নাটকের স্বর্ণযুগের একজন অন্যতম কাণ্ডারী। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ইতিহাস রয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেছিলেন, রেডিও নাটক অনেকটাই মহাভারতে সঞ্জয়ের যুদ্ধ বর্ণনার মতো। তাঁর ভাষ্য শুনে যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র মনশ্চক্ষে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ দর্শন করেছিলেন, শ্রোতারাও শ্রবণেন্দ্রিয়র মধ্য দিয়ে যা শোনেন, তাই দিয়ে কল্পনায় একটা ছবি দেখতে পান। রেডিও নাটক শ্রোতাদের সেই দিব্যদৃষ্টি দান করে।
সব ক্ষেত্রেই যেমন একটা প্রস্তুতি পর্ব থাকে, রেডিও নাটকেরও প্রস্তুতি পর্ব ছিল। সেটা ১৯২৭ সাল থেকে। তখন থেকেই ধীরে ধীরে সে ছুঁয়ে ফেলে তার স্বর্ণযুগকে। একেবারে শুরুতে ছিল সলতে পাকানোর পর্ব। তখন ছোট ছোট নাটিকা সম্প্রচারিত হতো। এগুলিকে বলা হতো মাইক্রো ড্রামা। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে তা সম্প্রচারিত হয়েছিল। তখন বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, গুজরাতি প্রভৃতি ভাষায় কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নাটক সম্প্রচারিত হতো। সেই সঙ্গে সংস্কৃত নাটক ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ‘মৃচ্ছকটিক’ মূল ভাষাতেই অভিনীত হয়েছিল।
এগুলি করত ক্যালকাটা অ্যামেচার থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি বা ক্যাটস। তাদের আমন্ত্রণ করে আনা হতো অভিনয়ের জন্য। ১৯২৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বড় মাপের বেতার নাটক শুরু হয়। বাংলা বেতার নাটকের প্রথম প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ছিলেন সেখানকার ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। হীরেন বসু ছিলেন ওই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত। তখনও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র রেডিওয় যোগদান করেননি। বেতার কেন্দ্রের আমন্ত্রণে শ্যামবাজারের চিত্রা সংসদ অনেকগুলি নাটক বেতারে অভিনয় করেছিল। সেই দলে ছিলেন বেশ কিছু শক্তিধর মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ মল্লিক, বাণীকুমার, সত্য দত্ত প্রমুখ। এই দলটি প্রথম যে বাংলা নাটক পরিবেশন করে, সেটি হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দায়ে পড়ে দার-গ্রহ’।

কলকাতা বেতারের জন্মলগ্নে ভারতীয় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বর্তায় বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের ওপর

এরপরেই বেতার নাটকের দল গঠন হয়। সেখানে এঁরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চাকরি করতেন পূর্ব রেলে। মাঝে মাঝে তিনি এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে আকাশবাণীতে আড্ডা দিতে আসতেন। সেই সময় তিনি নৃপেনবাবুর নজরে পড়ে যান। তাঁর অনুরোধে তিনি রেলের চাকরি ছেড়ে আকাশবাণীতে যোগ দেন। নৃপেনবাবু তাঁকে নাটক বিভাগের দায়িত্ব দেন। ১৯৩৭ পর্যন্ত প্রায় সব নাটকেরই পরিচালনা করেছিলেন বীরেনবাবু। তখন অবশ্য ‘পরিচালনা’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো না। বলা হতো ‘তত্ত্বাবধায়ক’। ১৯৩৭ সালের পর গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও প্লেয়ার্স। তাঁরাই নাটকে অংশগ্রহণ করতেন। পরিচালনা করতেন বীরেনবাবুই।
আর একজন ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাস। তিনি ছিলেন অভিনেতা অনুপকুমারের বাবা। তিনিও কিন্তু এই সময়ে প্রায় সব নাটকে অভিনয় করতেন। এছাড়া এই সময় বাইরের যেসব দল রেডিওয় নাটক করত, সেগুলি হল নাট্যমন্দির, আড়িয়াদহ বান্ধব নাট্য সমাজ, বাণী সঙ্ঘ, মিলন মন্দির ইত্যাদি। ১৯৪০ সালের পর থেকে বেতারে এককভাবে নাটক প্রযোজনা শুরু হয়। তখন নাটকের সরাসরি সম্প্রচার হতো। সেই সময় শুক্রবার রাত আটটায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার এক একটি নাটক পরিবেশিত হতো। এছাড়া সোম, মঙ্গল, বুধ এবং রবিবারও নাটকের সম্প্রচার হতো।
একেবারে গোড়ার দিকে বহু নাটকে সেই সময়কার মঞ্চের সুপারস্টার শিশির ভাদুড়ি অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় বেতারে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। ওইদিন নাট্যমন্দির পরিবেশন করে ‘বসন্তলীলা’ গীতিনাট্য। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘নরনারায়ণ’ নাটকটিতে কর্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন শিশিরবাবু। তিনি শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’ নাটকে জীবানন্দ চরিত্রেও অভিনয় করেন। ষোড়শী হয়েছিলেন চারুশীলা। এছাড়াও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’এর রেডিও রূপ ‘ভ্রমর’-এ গোবিন্দলালের চরিত্রে শিশিরবাবু অভিনয় করেছিলেন। ভ্রমর করেছিলেন প্রভাদেবী।

শিশির কুমার ভাদুড়ী

এক সময় সপ্তাহের চার-পাঁচদিন নাটক হতো। তাই মাঝেমাঝেই নাটকের অভাব দেখা দিত। সেই সমস্যা মেটাতে তখন সরাসরি মঞ্চ থেকেও বহু নাটক সম্প্রচারিত করা হতো। যেমন ‘আলমগীর’, ‘সীতা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘সাজাহান’ প্রভৃতি।
সেই সময় রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকেরও রিলে সম্প্রচার রেডিওয় হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রেডিও নাটকের ক্ষেত্রে এক বিশেষ দিন। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ নাটকটি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দির থেকে সরাসরি রিলে পদ্ধতিতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এতে কবি স্বয়ং প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
কিন্তু সেখানেও অনেক অসুবিধা দেখা দিল। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের নানা মন্তব্য, হাততালিও বেতারে শব্দের সঙ্গে চলে আসত। তাতে শ্রোতাদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত হতো বা তাঁরা বিরক্ত হতেন। তাই বেশিদিন এই পদ্ধতিতে সম্প্রচার করা সম্ভব হল না।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

সেই সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অনুভব করলেন, রেডিও নাটক যখন একটি পৃথক বিনোদন মাধ্যম, তাই তার জন্য আলাদা করে নাটক লেখার প্রয়োজন আছে। তাই তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিক এবং নাট্যকারদের কাছে রেডিওর জন্য নাটক লেখার অনুরোধ করেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে রেডিওর জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী, যোগেশ চৌধুরী, শচীন সেনগুপ্ত প্রমুখ। পরের দিকে এলেন পরিমল গোস্বামী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবনারায়ণ গুপ্ত সহ অনেকেই। সেই সঙ্গে এই সব নাটকে আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হল। বীরেনবাবু সঙ্গীতের জন্য আনলেন পঙ্কজ মল্লিক, ধীরেন দাস, তারকনাথ দে, কাজি নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখ নমস্য ব্যক্তিত্বকে।
এছাড়া নাটকের পরিবেশ, সময় ইত্যাদি বোঝানোর জন্য নানা শব্দ সংযোজনা করা হতো। যেমন পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কুকুর-বিড়ালের ডাক, ব্যাঙের ডাক ইত্যাদি। হরবোলা শিল্পীদের দিয়ে তা করা হতো। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অজিত চট্টোপাধ্যায়, রবীন ভট্টাচার্য, সুনীল আদক প্রমুখ। বেতার নাটকের একেবারে উন্মেষ পর্বে বীরেন ভদ্র তার সুরটিকে বেঁধে দিয়েছিলেন। তাই তাঁকে বলা হয় ‘ফাদার অব রেডিও ড্রামা।’
১৯৫৮ সালে চালু হয় রেকর্ডিং করে নাটক সম্প্রচার। পরবর্তী সময়ে বহু স্মরণীয় নাটক বেতারে অভিনীত হয়েছে। যেমন শ্রীধর ভট্টাচার্যের প্রযোজনায় ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। ১৯৬২ সালে সম্প্রচারিত হয় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র অভিনীত ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’। সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে ‘অলীক’ নাটকে মূল চরিত্রে ছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য।
সাতের দশক থেকে বেতার নাটক অন্য আঙ্গিকে প্রবাহিত হতে থাকে। গল্প বলার পাশাপাশি জীবনের গভীর যন্ত্রণা, আকুতি, সঙ্ঘাতকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে আসে কাহিনী ও আঙ্গিকের নানা বদলও। এই সময়ের নাটক ‘পুষ্পকীট’। সুবোধ ঘোষের গল্পে নাট্যরূপ দেন মনোজ মিত্র। সেটা ছিল একজন হরবোলার ব্যর্থ প্রেমের গল্প। ‘লোহার ভীম’ ছিল মুম্বইয়ের এক স্টান্টম্যানের জীবন যন্ত্রণার কথা।

সত্যজিৎ রায়

রেডিও নাটকের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের যে অবদান, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু রেডিও নাটকের ক্ষেত্রেও তাঁর চিন্তাভাবনার ছাপ পাওয়া যায়। রেডিওয় সত্যজিৎ রায়ের ১৩টি গল্পের নাট্যরূপ প্রচারিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ফেলুদার কয়েকটি গল্প নিয়ে নাটক সম্প্রচারিত হয়। ফেলুদা করেছিলেন গৌতম চক্রবর্তী। ‘বাক্স রহস্য’ সহ বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে তাঁর লেখা নাটক হয়। আর একটি গল্প নিয়ে হয় ‘অতিথি’ নাটক। সেই গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রটি। নাটকে উৎপল দত্তের চরিত্রটি করেছিলেন পিএলটির সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ১৯৮৮ সালে নাটকটি প্রযোজনা করেন জগন্নাথ বসু।
তবে সত্যজিতের যে নাটকটি রেডিওয় সব থেকে বেশি আলোড়ন তুলেছিল, সেটি হল ‘সেপ্টোপাসের খিদে’। রেডিওর তৈরি নাট্যরূপ পছন্দ না হওয়ায় তিনি নিজেই নাট্যরূপ দেন। সেটি ১৯৭৪ সালে। একটি মাংসাশী গাছকে নিয়ে গল্প। নাটকটি বেতার নাটকের ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার জয় করে। এটির প্রযোজনা করেন জগন্নাথ বসু ও সম্পাদনা করেন সমরেশ ঘোষ। অসাধারণ আবহ সঙ্গীত করেছিলেন প্রবীর মজুমদার। উদ্ভিদপ্রেমী কান্তিবাবুর চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেন জয়ন্ত চৌধুরী। ছিলেন প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর পজ অ্যাকটিং এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। এভাবে পজ অ্যাকটিংয়ের কথা সত্যজিৎ রায়ই বলেছিলেন। অবশ্য এর আগে ছবি বিশ্বাস রেডিওয় পজ অ্যাকটিং চালু করেছিলেন।
পরবর্তীকালে বেতার নাটকে আবহ সঙ্গীতের গুরুত্ব আরও বাড়ে। প্রবীর মজুমদারের সঙ্গীত পরিচালনায় দাগ কাটে ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ কিংবা বিমল করের ‘খড়কুটো’ নাটকগুলি। এছাড়া বলতে হয় অনল চট্টোপাধ্যায় বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। ‘কোনি’ নাটকে অভিজিৎবাবুর আবহের কাজ ছিল অনবদ্য।

নির্মল কুমার

এক সময় নির্মলকুমারকে বলা হতো রেডিওর উত্তমকুমার। রোমান্টিক অভিনয়ে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অসাধারণ বাচিক অভিনয় ও চরিত্র চিত্রণ তিনি করেছেন। রেডিওয় চার পর্বে ‘শ্রীকান্ত’ নাটকে তিনি শ্রীকান্তের ভূমিকায় ছিলেন। এছাড়া তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ নাটকে রোমান্টিক অভিনয় ইতিহাস হয়ে আছে। শ্রীকান্তে নতুনদা করেছিলেন চিন্ময় রায়। চিন্ময় রায়ের ‘চোখে আঙুল দাদা’র অভিনয় রেডিও নাটকের ক্ষেত্রে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। মনোজ মিত্রের এই নাটকটি আজও সুপারহিট বলে ধরা হয়।
অসংখ্য অভিনেতা রেডিও নাটককে সমৃদ্ধ করেছেন। শম্ভু মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, জগন্নাথ বসু, তৃপ্তি মিত্র, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়,কেয়া চক্রবর্তী, শাঁওলি মিত্র, কণিকা মজুমদার, জয়শ্রী সেন, মঞ্জু দে, বিনতা রায়, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
তৃপ্তি মিত্রের ‘সরীসৃপ’, শম্ভু মিত্রের ‘ফকির’, ‘ঘাতক’, ‘স্বীকারোক্তি’ ভোলার নয়। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘শকুনির পাশা’য় অভিনয় ইতিহাস হয়ে আছে। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক অভিনয় ‘তামাকু সেবনের অপকারিতা’ কিংবা তাঁর ‘ভুবনেশ্বরী’ অথবা ‘কোনি’ নাটকের খিদ্দা অভিনয় আজও মানুষ মনে রেখেছেন। অজিতেশের একক অভিনয় সমৃদ্ধ নাটক ছিল ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নিঃসঙ্গতা’ বা ‘স্ট্রাইকার’ অনবদ্য।
রেডিওয় আর একটি আলোড়ন ফেলে দেওয়া নাটক হল ‘সাহেব’। নাট্যকার রঞ্জন রায়ের সঙ্গে প্রযোজক অজিত মুখোপাধ্যায়ের আলাপ হয় ট্রামে। সেখানে ‘সাহেব’ নাটকটির কথা শুনে তিনি ঠিক করেন, এটিকে নাটক অভিনয় করবেন। ‘সাহেব’ করেন জগন্নাথ বসু, বাবা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বউদি শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে সেটির চলচ্চিত্রায়ণ হয়। বহু রেডিও নাটক শুনে চলচ্চিত্রকাররা অনুপ্রাণিত হয়েছেন ছবি করায়। যেমন শাঁওলি মিত্র ও সমীর লাহিড়ি অভিনীত ‘প্রবাহ’। পরে এটি নিয়ে ‘বিচার’ নামে সিনেমা হয়। সন্দীপ রায়ের ছবি ‘নিশিযাপন’ তৈরির আগে সেটি রেডিও নাটক হিসাবে সম্প্রচারিত হয়।
অন্যান্য কয়েকটি স্মরণীয় নাটক ছিল ‘আঁধার পেরিয়ে’, ‘বরফের নদী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য, ‘ন হন্যতে’ প্রভৃতি। ‘ন হন্যতে’ নাটকে মির্চার চরিত্রে ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং অমৃতা করেন শাঁওলি মিত্র। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেই নাটকের টেপটি মুছে ফেলা হয়। এছাড়াও অজ্ঞাত কারণে বহু অসাধারণ নাটকের টেপ একসময় মুছে ফেলা হয়েছিল। তার মধ্যে কেয়া চক্রবর্তীর বহু নাটক রয়েছে।
নাট্য প্রযোজনায় যাঁরা নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তাঁরা হলেন অজিত মুখোপাধ্যায়, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষৌণীশ বাগচি, জগন্নাথ বসু, সমরেশ ঘোষ, সিদ্ধার্থ মাইতি প্রমুখ।
সমরেশ ঘোষ তাঁর প্রযোজিত নাটকগুলির মধ্য দিয়ে সমাজে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কুষ্ঠরোগীদের সমস্যা নিয়ে ‘আসনবনি, র্যাগিং বিরোধী নাটক ‘জেনেশুনে বিষ’, ক্যান্সারের সচেতনতা নিয়ে ‘তৃতীয় পক্ষ’ তাঁর বিশেষ কাজ। অসাধারণ সম্পাদনার কাজ করতেন সমরেশবাবু। পুরস্কৃত বেতার নাটকগুলির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দু’টি ক্ষেত্রেই তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন। একটি নাটক ‘তিমি তিমিঙ্গিল’। অন্যটি ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’। বেঞ্জামিন মোলায়েজের জীবনী অবলম্বনে নাটকটিতে মোলায়েজ করেন জগন্নাথ বসু। সারা বিশ্বের রেডিও ও টিভি মাধ্যমে সম্প্রচারিত নাটকগুলির জন্য ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে এটি।
রয়ে গিয়েছে একটিই অভাব। উত্তমকুমার কখনও বেতার নাটকে অভিনয় করেননি। উত্তমকুমারকে একবার অনুরোধ করা হয়েছিল বেতার নাটকে অভিনয়ের জন্য। তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে দেখা যাবে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।

আকাশবাণী ভবন

স্বর্ণযুগের বহু নাটক আকাশবাণীর আর্কাইভে জীর্ণ অবস্থায় আজও পড়ে রয়েছে। সেগুলি অবশ্য পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। সম্প্রতি সাড়ে সাতশোর বেশি পুরনো নাটককে ডিজিটাইজড করা হয়েছে। সেই সব টেপের অনেক ফিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, বাদল সরকারের ‘সারারাত্তির’, শম্ভু মিত্র অভিনীত ‘প্রফুল্ল’ সহ অসংখ্য নাটক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও কিছু নাটক আছে, কিছু নাটক হারিয়ে গিয়েছে। অবহেলা, উপেক্ষা আর নিরাপত্তা জনিত কারণে সেসব টেপ আর্কাইভ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সময়ের গভীরে ডুব দিয়েও আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tanmay Banerjee
Tanmay Banerjee
1 month ago

বাঙালির জীবনযাপনের একটি ফেলে আসা উজ্জ্বল অধ্যায়ের ওপর আপনি আলোকপাত করেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।

Ashesh Dasgupta
Ashesh Dasgupta
1 month ago

অসাধারণ একখানি প্রতিবেদন। আমাদের শৈশবের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম রেডিও এবং তার মাধ্যমে সংগীত ও নাটকের অতুলনীয় আনন্দের স্বাদ যেন আবার পেলাম। অভিনেতাদের চাক্ষুষ না দেখেও শুধুমাত্র তাদের কন্ঠস্বর দ্বারাই আমরা নাটকের কাহিনীর সঙ্গে নিজেদের involved অনুভব করতাম।
এরকম আরও প্রতিবেদনের অপেক্ষা থাকব।অসংখ্য ধন্যবাদ।

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x