শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

‘পুজোর গান’-এ সলিল চৌধুরীNew

সালটা ২০০৫। নিতান্তই প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী। মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাই, আবার বাড়ি ফিরে মায়েরই কোলে বসে ভাত খাই। তো সেই রকম কাঁচা বয়সে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে প্রথমবার বাজতে শুনলাম, “কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়”। এ গান যে একাধারে সুরকার ও গীতিকার সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে এবং শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সোনাঝরা কণ্ঠের জাদুতে ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘পুজোর গান’ হিসেবে, যার রেকর্ড নাম্বার GE 7553; এসবের কিছুই তখন জানি না। জানার কথাও নয় অবশ্য। কেবল কণ্ঠের পেলবতায়, ভাষার মাধুর্য্যে ও সুরের অদ্ভুত মায়াবী চলনে এটুকু অনুভব করতে পেরেছিলাম যে আমি আমার চারপাশে সমসাময়িক যে সব গান সাধারণত শুনতে পাই, এ গানের প্রকৃতি তার থেকে অনেকটাই অন্য রকম। এবং এই স্বর্গীয় সুর, মন ছুঁয়ে যাওয়া বাণী ও ঐশ্বরিক কণ্ঠের সম্পদেই নিহিত রয়েছে ‘আমার গান’।

হেমন্ত’র পুজোর গান

মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে। আমরা যার প্রতি আকৃষ্ট হই, যা আমাদের ভাল লাগে; তার উদ্দেশ্যে আমরা বারবার ছুটে যাই। আমি নিজের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রবণতা বারবার লক্ষ্য করেছি। সেই ছোটবেলা থেকেই তথাকথিত ‘পুরনো দিনের’ বাংলা গান শুনে কান-মন-প্রাণ যখন তাদের আত্মার আত্মীয় বলে আপন করে নিল, তখন সমসাময়িক বিভিন্ন ভাষার গান শুনতে আগ্রহ থাকলেও “অমলকমল-মাঝে, জ্যোৎস্নারজনী মাঝে” রম্যবীণার মতোই সদা সর্বদা বেজে উঠতে লাগল বহু পুরাতন, অথচ চিরনূতন পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের এই সব গানের গায়কী, সুর ও বাণী। কাজেই খুব স্বাভাবিক ভাবে একেবারে ছোটবেলা থেকেই যাঁর ঐন্দ্রজালিক সাংগীতিক প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, তিনি এক ও অদ্বিতীয় সলিল চৌধুরী। সত্যি, সেদিনও ভাবতে বসে কূল পাইনি আর আজও দিশা পাই না এই ভেবে যে একজন মানুষ তাঁর একটিমাত্র জীবনে বিবিধ বিষয় ও অনুভূতির গানে এমন ম্যাজিকের মতো বাণী ও সুরসংযোগ কীভাবে করতে পারেন যাতে অধিকাংশ শ্রোতার হৃদয়ের সঙ্গেই সংযোগ স্থাপন করা তাঁর পক্ষে হয়ে যায় জলের মতো সহজ?!

সলিল চৌধুরী

ক্লাস ফাইভে থাকতে কোনো এক উদাস, মন খারাপের বিকেলে আকাশ থেকে একটা কাটা ঘুড়ির হাওয়ায় গোঁত্তা খেতে খেতে নীচে নেমে আসা দেখার সময়েই রেডিওয় প্রথমবার শুনেছিলাম, “না, যেও না। রজনী এখনও বাকি”। কণ্ঠে লতা মঙ্গেশকর, কথা ও সুর শ্রী সলিল চৌধুরী। ১৯৫৯ সালে বাংলা আধুনিক গান বা ‘পুজোর গান’ হিসেবে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর ঠিক পরের বছর সলিলবাবু এই একই সুরে হিন্দি ভাষার ‘পরখ’ সিনেমায় একটি চিরআবেদনময়ী হিন্দি গান “ও সজনা, বরখা বাহার আয়ী”-ও সৃষ্টি করেন, যার কথার দায়িত্বে ছিলেন শৈলেন্দ্র ও কণ্ঠে সেই কস্তুরীগন্ধসমা লতা মঙ্গেশকর। এই গানটিতে “না, যেও না” বলে লতাজী যে প্রেমময় আর্তি বা আবদার আকাশে-বাতাসে ঘনিয়ে তুলেছিলেন, তা আমার বিষাদময় বিকেলের বিষণ্ণতা আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ দিন মন খারাপ হলেই ছুটে যেতাম এই গানের উদ্দেশ্যে, ঠিক যেভাবে ঘনীভূত কালো মেঘের দিকে আকুল হিয়ায় দু’ হাত বাড়িয়ে দেয় মানুষ কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ার আশায়…

রানার

তবে শুধুই কি বিষাদ? সলিল চৌধুরী এমন এক বিস্ময়কর প্রতিভা, যিনি তাঁর কথা ও সুরের জাদুতে মানব-মনের প্রায় সকল অনুভূতিকেই স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ‘রানার’ কবিতা অবলম্বনে তিনি সৃষ্টি করলেন তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘রানার’। প্রায় অকল্পনীয় রকম নিখুঁত সুরে ও ছন্দে গান হিসেবে গাঁথলেন ‘রানার’-কে, যে গানে কণ্ঠ দেওয়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনো শিল্পীর পক্ষেই বোধ হয় সম্ভব ছিল না। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ ‘রানার’-এর নিত্যকার যাপনের সবটুকু struggle-কে, শান্ত গৃহের নিশ্চিন্ততায় বসে রেকর্ড কিনে গান শোনা মধ্যবিত্তের হৃদয়ে তুমুলভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন তিনি। আর এই দায়িত্ব পালনে তিনি যে সফল হয়েছিলেন, স্বয়ং কাল তার শব্দহীন সাক্ষী।
১৯৫৪-য় এল ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’-
“ধিনাক না তিন তিনা
এই বাজা রে প্রাণ-বীণা,
আজ সবার মিলন বিনা এমন জীবন বৃথা যায়।
এ দেশ তোমার আমার,
আর আমরা ভরি খামার,
আর আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনা…”
কী চিরকালীন বাণী, অথচ গানের ভাষায় এ সত্য উচ্চারণ আমরা কত কম শুনে থাকি, তাই না?

ধিতাং ধিতাং বোলে

১৯৫৫-য় এল ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’, ৬১-তে ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’। অবশ্যম্ভাবী গায়কী শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৭৮-এ আবার নিজের সুরে ও কথায় নিজেই কণ্ঠ দিলেন ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’। এই সম্পূর্ণ সময়টা জুড়ে সলিলবাবুর কাজে আমরা খুঁজে পেয়েছি এক চিরবিদ্রোহী সত্তাকে এবং এ কথা সত্য যে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ বা IPTA-র সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সংযোগ না থাকলে এই প্রতিবাদী সলিল চৌধুরীকে আমরা হয়তো পেতাম না। আসলে ১৯৪২ সাল থেকেই সলিল চৌধুরী Indian People’s Theatre-এর জন্য গান রচনা ও সুর সৃষ্টির কাজ শুরু করেন। তিনি তেভাগা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন, এমনকি বিংশ শতকের চারের দশকে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য সরকারি পরোয়ানাও জারি হয়ে গিয়েছিল দিক-বিদিকে। কাজেই বামপন্থী গণ আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই সলিল চৌধুরী যখন ‘পুজোর গান’ বা রেকর্ডের গান সৃষ্টি করতে উদ্যত হবেন, তাঁর কথা ও সুরের মধ্য দিয়েও যে সেই মাঠ-ঘাটের গন্ধ, কলকারখানার ভোঁ আর এক চিরবিদ্রোহী সত্তাই প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে, সে তো এক অবশ্যম্ভাবী বাস্তব!

তবে বিদ্রোহের গান, ক্ষমতাশালীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গান শুনতে ভাল লাগলেও, হৃদিসিংহাসন জুড়ে যা বরাবরই বিরাজ করে থাকে, তা অতি অবশ্যই একমেবাদ্বিতীয়ম্ প্রেমের গান। যে গানের কথা হবে নরম, সুর হবে পেলব ও ঝরঝরে এবং গায়কী হবে গভীর রোম্যান্টিক। তাই সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরের আদ্যন্ত গুণমুগ্ধ হওয়ায় তাঁর প্রেমের গানেরও যে এই মেয়েটি একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্যের কী ছিল? হ্যাঁ, সলিল চৌধুরীর প্রেমের গানের সংখ্যা অন্যান্য জঁনারের গানের তুলনায় কিছুটা কম হলেও আমার কাছে quantity- র তুলনায় quality বরাবরই অধিক গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাই কাউকে যখন বলতে শুনি, সলিল চৌধুরীর গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব এতটাই বেশি যে ওয়েস্টার্ন বিট নির্ভর কম্পোজিশনই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, যে কারণে কোমল, আবেদন ও আকুতিময় প্রেমের গান তাঁর দ্বারা আর সৃষ্টি করা সম্ভব হল না, সত্যি বলি, মন এক লহমায় বিদ্রোহ করে ওঠে। আচ্ছা বলুন তো, তাঁর সুরে বিদেশী বাদ্যযন্ত্র পিয়ানোর টুং টাং বা তার ধ্বনিমাত্রিক কোনো স্বর বা যন্ত্রের অনুরণন প্রবলভাবে উপস্থিত থাকলেও; মন ভিজিয়ে দেওয়ার, ভিজিয়ে উদাস করে দেওয়ার আর উদাসবাউল মনকে পাগল করে দেওয়ার মতো মেলোডির উপস্থিতিও কি চিরহরিৎ বৃষ্টিঅরণ্যের সবুজ পাতার মতোই অফুরান ছিল না? আর সেই হৃদয়স্পর্শী সুরসাগরের উপস্থিতি যাঁর মানিকভাণ্ডারে থাকে, তিনি “হৃদয়ের ভাব কহিতে ব্যাকুল হয়ে” প্রেমের গান সৃষ্টি করবেন না বা করলেও তা শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করবে না, এমনটা কি কখনো হতে পারে?

সলিল চৌধুরী যে প্রেমের গানেও ঠিক কতটা দক্ষ ছিলেন, তার প্রমাণস্বরূপ তাঁর বহু বিশিষ্ট গানের ভাঁড়ার থেকে আপাতত আমি দুটি গানের নাম উল্লেখ করতে চাইব। প্রথমটি হল, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘পাগল হাওয়া’। যদিও এই গানের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও আমার মতে বেস্ট ভার্সানটি হল ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে সুবীর সেনের কণ্ঠে ‘পাগল হাওয়া’ (https://youtu.be/1dAk0WSsCFo?si=k11Qb8rctGvzalkW)। শ্রী সেনের কণ্ঠ এমনিতেই অসম্ভব গভীর ও রোম্যান্টিক। তার উপর এমন মোহময় সুর ও কথার যোগ্য সঙ্গত পেয়ে তিনি যে এই বিশেষ গানটিকে উৎকৃষ্টতার ঠিক কোন্ স্তরে উন্নীত করেছিলেন, ভাবতে গেলে আজও সমস্ত শরীর কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। দ্বিতীয় গান, ১৯৬০ সালে লতাজীর কণ্ঠে ‘ওগো আর কিছু তো নাই’ । সকলের কথা বলতে পারি না। তবে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সঙ্গীতের একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে পারি যে এমন melodious ও আকুতিময় প্রেমের গান আমি নিজে খুব কম শুনেছি (https://youtu.be/P0efUdE58tE?si=zG1_dfKb0Lzgyd-Q)। সলিল চৌধুরীর আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি একই সুর বিভিন্ন ভাষার গানে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োগ করতেন। ঠিক এমনভাবেই ১৯৬১ সালে ‘ওগো আর কিছু তো নাই’-এর সুরে মহম্মদ রফি ও লতাজীকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘তসবীর তেরে দিল মেঁ’। এবং ১৯৭৬ সালে অমোল পালেকর ও বিদ্যা সিনহা অভিনীত ‘ছোটী সী বাত’ ছবিতে গীতিকার যোগেশের কথায় ও লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘পাগল হাওয়া’-র সুরে প্রকাশ করলেন আর এক যুগান্তকারী গান- ‘না জানে কিঁউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দগী কে সাথ’। দুটি গানই রোম্যান্টিক গান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তবে এ বিষয়ে বিশেষ করে ‘না জানে কিঁউ’ এই বিরহগীতিটির নামোল্লেখ না করলেই চলে না। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এসে কোনো একটি বিরহবিধুর সাঁঝে এই বেদনাঘন গানটির সঙ্গে হৃদয়ের গভীর তারে একাত্মতা অনুভব করেননি, এমন প্রেমিক এ দেশে খুব বেশি আছেন কি?

সলিল-লতা

সলিলবাবুর গানের একটি বৈশিষ্ট্য আমি উল্লেখ করলাম, তবে রয়েছে এমনই আরো অনেক বৈশিষ্ট্য। আর ঠিক তেমনই একটি বিশিষ্টতা হল, সলিল চৌধুরী তাঁর জহুরীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছিলেন যে তাঁর অশ্রুতপূর্ব, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল, মোহনীয় সুরের সঙ্গে লতাজীর কিন্নরীকণ্ঠের যখনই মেলবন্ধন ঘটে, তখনই তা জন্ম দেয় এক অভূতপূর্ব ইন্দ্রজালের। তাই তিনি তাঁর সমগ্র কেরিয়ার জুড়েই, বিশেষত ‘পুজোর গান’-এর ক্ষেত্রে, যেখানেই লালিত্যময় কণ্ঠমাধুর্য্যের প্রয়োজন হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেছে নিয়েছেন লতা মঙ্গেশকরকেই। এর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে ভূরি ভূরি। ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি'(১৯৫৯), ‘বাঁশি কেন গায়'(১৯৬০), ‘সাত ভাই চম্পা'(১৯৬১), ‘ও ঝরঝর ঝর্না'(১৯৬৮), ‘না, মন লাগে না'(১৯৬৯), ‘পা মা গা রে সা তার চোখের জটিল ভাষা'(১৯৭১), ‘অন্তবিহীন কাটে না আর যেন বিরহের এই দিন'(১৯৭২), ‘ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম'(১৯৭৫), ‘ও মোর ময়না গো'(১৯৭৫), ‘সবার আড়ালে সাঁঝ সকালে'(১৯৮৮), ‘ও আমার প্রাণসজনী চম্পাবতী কন্যা'(১৯৮৮), ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি'(১৯৮৮) এবং বিবিধ। আশা করা যায়, এই গানগুলোর নাম পড়তে পড়তেই আপনারা মনের মধ্যে গুনগুন সুর ভাঁজতে শুরু করে দিয়েছেন, ঠিক যেমনটা এখন আমি করছি লিখতে লিখতে! আর কালের বাধা ছিন্ন করে হৃদয়ের অন্তঃপুরে ওঁদের এই স্থায়ী, নিভৃত নিবাসই জানান দেয় যে সলিল-লতা জুটির গানগুলির জনপ্রিয়তা আজও ঠিক কতটা গগনচুম্বী।

হেমন্ত-সলিল

তবে সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকর জুটির নাম করে নিয়ে, সলিলবাবুর সঙ্গে আর একজন ঐশ্বরিক প্রতিভাসম্পন্ন গায়কের যুগলবন্দীর উল্লেখ যদি না করি, তবে বাঙালি পাঠক হয়তো এখনই এই প্রবন্ধ পাঠ বন্ধ করে দিয়ে এই অধমের “তিন মাস জেল আর সাত দিনের ফাঁসি”-র নির্দেশ লাগু করে দেবেন! আবার অধম নিজেও সেই স্বর্ণকণ্ঠী গায়কের এমনই গুণমুগ্ধ ভক্ত যে সে নিজেও তার গুনাহ্-র ফলশ্রুতিতে নিজেরই চোদ্দ বছর বনবাস-টনবাসের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেলতে পারে! কাজেই এই বেলা প্রাণ থাকতে থাকতে যাঁর কথা প্রাণ উজাড় করে লিখে ফেলা যায়, তাঁর কথাই লিখি। সেই শিল্পী আর কেউ নন, তিনি হলেন বাংলা আধুনিক গানের অন্যতম পুরোধাপুরুষ শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সলিল চৌধুরী তাঁর প্রায় সব রকম গানেই চক্ষুদানের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। আর হেমন্তবাবু গানের প্রাণপ্রতিষ্ঠায় যে ঠিক কতটা সফল হয়েছিলেন, তার প্রমাণ ‘গাঁয়ের বধূ'(১৯৪৮), ‘নৌকা বাওয়ার গান’ ও ধান কাটার গান'(১৯৫১), ‘ধিতাং ধিতাং বোলে'(১৯৫৪), ‘পথে এবার নামো সাথী'(১৯৫৫), ‘পথ হারাবো বলেই এবার'(১৯৫৮), ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক'(১৯৫৮), ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা'(১৯৬১), ‘মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে'(১৯৬১), ‘শোনো কোনো এক দিন'(১৯৬৯), ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা'(১৯৬৯), ‘ঠিকানা'(১৯৭০) এবং আরো অনেক, অনেক গান।

সলিলের গানে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

তবে শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকর তো নন। সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে বাংলা ‘পুজোর গান’ রেকর্ড করেছেন আরো বহু বিশিষ্ট শিল্পী। তাঁদের মধ্যে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় অন্যতম। কারণ ১৯৫২-য় তাঁর গাওয়া ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’, ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী’ এবং ‘ক্লান্তি নামে গো, রাত্রি নামে গো’-র মাধ্যমেই আমরা পূর্বেকার প্রধানত গণসঙ্গীতের উপর প্রাধান্য দেওয়া সলিল চৌধুরী ও পরবর্তীকালের সুর-তাল-লয়-বাণী-ছন্দ-জঁনার সব কিছু নিয়েই experiment করতে আগ্রহী সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এছাড়াও সুচিত্রা মিত্র, প্রীতি সরকার, দেবব্রত বিশ্বাস, নায়ক বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত তাঁর কথায় ও সুরে গান গেয়েছেন। সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে অন্যান্য বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারাও বহু জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। এখন লিখতে লিখতে হঠাৎ সেই সব গানের কয়েকটির সুর মনে পড়ে যাওয়ায়, ভাবলাম এখানে সেগুলির নামও উল্লেখ করে রাখি। বিষয় যখন সলিল চৌধুরীর ‘পুজোর গান’-এর স্মৃতিচারণের মতো সৎকার্য, সেক্ষেত্রে “অধিকন্তু ন দোষায়”!

আপনারা সকলেই হয়তো শুনেছেন। হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘ভালবাসি বলেই ভালবাসি বলি না’। আমার অসম্ভব প্রিয়। কথা নিয়ে এমন দাওপ্যাঁচ সলিল চৌধুরী ছাড়া আর কে মারতে পারেন বলুন তো? অথবা সবিতা চৌধুরীর (তখন সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) ‘সুরের এই ঝরঝর ঝর্না’। গানের কথায় ও সুরে এমন মিল?! বাস্তবিক যতক্ষণ শুনি, সুরের ঝর্নাই নিরন্তর বয়ে চলে বলে বোধ হয়! আরও একবার সলিল চৌধুরী না থাকলে এই অনুভূতি অজানাই থেকে যেত। অথবা ধরুন, পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি’ ( এই গানটা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠেও রয়েছে ), বা অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর ‘মন মাতাল সাঁঝ সকাল’ এবং অতি অবশ্যই সলিলবাবুর কন্যা অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া ‘আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে’, ‘একানড়ে কানে কড়ে’ ও ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে; আয় না, যা না গান শুনিয়ে’। বাঙালি বাবা-মায়ের তাঁদের শিশু ভোলানাথকে জগৎ চেনানোর প্রথম প্রচেষ্টা সুরের মূর্ছনায়। সন্তানকে এর চেয়ে ভাল উপহার ঐ বয়সে আর কিছু দেওয়া যায় কি? আবার একই সঙ্গে যাঁরা বড় হতে হতে কখনো ছোট হয়ে দেখতেই গিয়েছেন বেমালুম ভুলে, তাঁদের জন্যও তাঁর এই সৃষ্টিগুলি ছিল eye opener-এর ভূমিকায়। তাই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে আর যাই হোক, সলিল চৌধুরীর অবদানকে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বা প্রচেষ্টা ফুটবলে আত্মঘাতী গোলেরই নামান্তর।

সলিল-অন্তরা

এতক্ষণ যে কটি গান নিয়ে সাধ্যমতো আলোচনা করার বা বলা ভাল, মনের ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করলাম, সেগুলি বাদেও সলিল চৌধুরী ‘আকাশবাণী’-তে রম্যগীতির সুর ও বাণীসংযোগ করেছেন, ফিল্মের গানে সুর ও কথা বসিয়েছেন বড় যত্নে ও মেধায়। তাঁর ক্ষুরধার মেধা ও মননশীল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় তুখোড় বহু কবিতার মধ্যে আজও। তবে এখন তো আমরা সলিল চৌধুরীর দ্বারা সৃষ্ট বাংলা ‘পুজোর গান’ বা রেকর্ডের গান অর্থাৎ non-film songs-গুলিকে নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি, তাই আজকের আলোচনা এখানেই সাঙ্গ করলাম। জানি লিখতে গিয়ে কিছু দোষ-ত্রুটি হয়তো হয়েই গিয়েছে। আসলে আমি তো সেই সময়ে বড় হইনি, যখন সলিল চৌধুরী বা তাঁর সমসাময়িক সুবিখ্যাত শিল্পীরা হৃদয়স্পর্শী গানের ডালি উপহার দিয়ে চলেছিলেন বাঙালিকে দশকের পর দশক ধরে অথবা আমি কোনো স্বনামধন্য গানের গবেষকও নই, যিনি এ বিষয়ে লিখতে গেলে কক্ষণো কোনো ভুল করতেই পারেন না। তাই আমি জানি, কিছু ভুল, কিছু খামতি থেকে যেতেই পারে। তবে যাঁর সাংগীতিক প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আজ থেকে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগের বাংলায় বেড়ে ওঠার ইচ্ছে আজও হৃদয়ে প্রবলভাবে অনুভূত হয় কেবল সেই ফেলে আসা সময়ের বাংলায় বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশে প্রকৃতরূপে বাঁচতে-বেড়ে উঠতে পারব বলে; যাঁর গান শুনে বারবার মনে হয়, অরিজিৎ সিং-এর গানের পরিবর্তে যদি কেউ এঁর গান আমার সামনে এসে আমারই জন্য গাইতে পারেন, তবে তাঁর প্রেমে হয়তো তক্ষুণি পড়ে যেতে পারি এবং আজও বাংলার অশান্ত, বিচারহীন পরিস্থিতিতে যাঁর সৃষ্টি “পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা” বলে ডাক ছেড়ে দলে দলে পথে নেমে আসেন সাধারণ মানুষ, বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে, সেই আলোতেই পথে নেমে ন্যায়বিচারের পথ চিনে নেবেন বলে; সেই বিস্ময়কর সঙ্গীতপ্রতিভা সলিল চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার জন্যই আমার আজকের এই প্রচেষ্টা। সকলে যখন তাঁদের মতো করে ‘পুজোর গান’ নিয়ে লিখেছেন, আমিও না হয় ‘সলিল-পুজো’র মধ্যে দিয়ে আমার ‘গানের পুজো’ এই বেলাতেই সেরে ফেলি।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.

0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x