শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

সত্যজিতের দুই অসামান্যা

সত্যজিৎ রায়। নামটি উচ্চারিত হলেই বাঙালি তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী আপামর চলচ্চিত্রপ্রেমীর মননেই ছ’ ফুট চার ইঞ্চির এক শালপ্রাংশু পুরুষের প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে যাঁর কর্মকাণ্ডের দৈর্ঘ্য তাঁর শারীরিক উচ্চতাকেও ছাপিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল সেই বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই। যাঁর প্রথম চলচ্চিত্রই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী, মরমিয়া উপন্যাস অবলম্বনে ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫), প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সমগ্র বিশ্বের রুচিশীল ও শৈল্পিক সমাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলার ঘরে এসেছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কার প্রভৃতি। এরপর একে একে তাঁর হাত ধরে এসেছে অপরাজিত, জলসাঘর, অপুর সংসার, দেবী, তিন কন্যা, মহানগর, চারুলতা, নায়ক, গুপী গাইন বাঘা বাইন ইত্যাদি কালজয়ী চিন্তাশীল চলচ্চিত্র। যদিও বাঙালি তাঁর সৃষ্টির রসে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে থেকেছে চিরকাল, তবু সমাজের কিছু কিছু স্তর থেকে একটা মৃদু অনুযোগের গুঞ্জন ভেসে এসেছে প্রায়ই। আর তা হল এই যে তাঁর চলচ্চিত্রে পুরুষ চরিত্রের উপস্থিতি যত প্রবল ও বিপুল, নারী চরিত্রের সংখ্যা ঠিক ততটাও বেশি নয়। আর ঠিক এই কারণেই নাকি বাংলা সাহিত্যের অপর এক কালজয়ী চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনিতে তাঁর সহধর্মিণী সত্যবতী এবং অন্যান্য বহু নারী চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও সত্যজিৎবাবুর সৃষ্টি ফেলুদার কাহিনিতে নারী চরিত্রের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে! প্রদোষ মিত্তিরের জগতে নারী বলতে কেবল তোপসের মা, তাও তাঁর ভূমিকা রীতিমতো আণুবীক্ষণিক বললেও মোটেই ভুল বলা হয় না। আচ্ছা, চিত্রটা কি সত্যিই এরকমই ছিল? তাছাড়া, কোনো একজন চলচ্চিত্রকারের কোনো একটি বিশেষ চরিত্র বা ছবি দ্বারা কি তাঁর অন্যান্য চরিত্রদেরও এক কথায় মেপে ফেলা যায়, নাকি তা উচিত? বিশেষত, সে পরিচালক যখন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, যাঁর বাবা সুকুমার রায় ও মা প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী বিদূষী সুপ্রভা রায়, যাঁর জন্ম বাংলার বিখ্যাত রায় পরিবারে, যে পরিবারের নারীরা শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায়, মানবতাবাদে বরাবর তাঁদের পরিবারের পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছেন, সেই পরিবারের উত্তরপুরুষ এক চিত্রপরিচালক সম্পর্কে তাঁরই সৃষ্ট কোনো এক চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সমগ্র কেরিয়ারকেই কি আদৌ কাঠগড়ায় তোলা যায়? উত্তরটা হল, না। আর এই প্রবন্ধে আমার এই মতের সপক্ষে যুক্তিবিন্যাস করার উদ্দেশ্যে আমি বেছে নিয়েছি তাঁরই সৃষ্টিমালিকার অতুল্য দুই মণিকে। এবং তারা হল ‘চারুলতা’র চারু ও ‘মহানগর’-এর আরতি। বাংলা তথা সমগ্র বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এমন দুই চরিত্র যারা আধুনিকতা ও মানবতাবাদকে অঙ্গের ভূষণ করে পথ চলেছিল এবং অবধারিতভাবেই রায় পরিবারের পরশমানিক শ্রী সত্যজিৎ রায়ের অমোঘ মগজাস্ত্রেই হয়েছিল যাদের সাড়া জাগানো সৃষ্টি।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় আধুনিকা ও মানবতাবাদী নারী চরিত্রের সংখ্যা অনেক। তবে সকলের সম্বন্ধে তো আর এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে যাঁর কথা বাদ দিলে এই আলোচনা কিছুটা হলেও অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় বলেই মনে হয়, তিনি অবশ্যই ‘চারুলতা’র চারু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯০১ সালে রচিত ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” সত্যজিৎ সৃষ্টি করেন ‘চারুলতা’-কে। নামভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্রে চারুলতা ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এক বাঙালি জমিদারের অল্পবয়সী ও একাকিনী এক গৃহিণী। যে বয়সে মেয়েরা প্রথম নারী হয়ে ওঠা শুরু করে, মনের সবটুকু কথা তার স্বামীর কাছে খুলে বলে প্রাণের সাধ মেটাতে চায়, সেই মধুর যৌবনে চারুলতা সঙ্গীহীনা কারণ তার স্বামী পত্র-পত্রিকার কাজে অসম্ভব ব্যস্ত। তাও হয়তো সে তার হৃদয়পানে চেয়ে দেখতে শিখত না, যদি না সে শিক্ষিতা হত। আসলে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বেথুন স্কুল যা সেই সময়ে ‘ভদ্র’ পরিবারের মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিদ্যালয় এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে আসে উডের ডেসপ্যাচ, যেখানে নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এর সাথে সাথেই ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি পুরুষ তাঁদের পরিবারের মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে প্রয়াসী হয়। সেই সময়ের এই উদার চিন্তাধারারই প্রতীক চারুলতার স্বামী ভূপতি। সে চায় তার স্ত্রী যে কাজে দক্ষ অর্থাৎ সাহিত্যচর্চায়, তা সে মন দিয়ে করুক। নবযৌবনা চারুরও ইচ্ছে করে সমমনস্ক সাহিত্যপ্রেমী কারো সাথে মনের কথা ভাগ করে নিতে, তার সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি লাভ করতে, ভালবাসা পেতে। কিন্তু তার স্বামীর সময়াভাবে চারুর পক্ষে তার কিছুই সম্ভব হয় না। আবার তার আত্মীয়া মন্দা-ও মূঢ় এবং কল্পনা ও সাহিত্যের রসে নিতান্তই বঞ্চিত এক নারী, তাই তার সাথেও চারুর মনের দুস্তর অমিল। এমনতরো “একেলা বিরহের বেলা” কাটানোর মুহূর্তে চারুর জীবনে আসে তার অল্পবয়সী এক দেবর অমল। এই নব্যযুবক এক সাহিত্যিক। চারু তার সাথে সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে প্রাণের আরাম লাভ করে, তার ইচ্ছা হয় কেবল তারা দু’জনে মিলে যে সাহিত্যের ভুবন রচনা করবে, সেখানে ভূপতি, মন্দা কারোরই যেন কোনো প্রবেশাধিকার না থাকে। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী ও প্রশংসাকামী অমলের পক্ষে এই আবদার রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই সে মন্দার সঙ্গেও তার সাহিত্যকর্ম ভাগ করে নিতে শুরু করে আর এতে চারুর হয় ঈর্ষা। অমলের বিবাহের সম্ভাবনায়ও তার চোখে জল আসে। আর এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক শিক্ষিতা গৃহবধূ তার স্বামী ছাড়াও অপর পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে কোনো দোষ না দেখার মতো আধুনিক চিন্তাধারা অর্জন করে উঠতে সমর্থ হয়েছে। সে যে এক নারী, তারও যে জীবনে ভূপতি, অমল প্রমুখ পুরুষদের মতোই ভালবাসা, মনোযোগ ও সম্মানের প্রয়োজন আছে এবং তা না পেলে তারও যে অপর কোনো পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্বাধীনতা আছে ( ঠিক যে স্বাধীনতা একজন পুরুষ ভোগ করে ), সেই পরম সত্যকেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায় চারুলতা। আর মানবিকতা তো কেবল তখনই দেখানো হয় না যখন কোনো ব্যক্তি কেবল অপর এক ব্যক্তির মানবিক অধিকারগুলিকে লঙ্ঘন করতে অসম্মত হয়! বরং যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে এক ঊনমানবরূপে গণ্য না করে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্খাকেও পূর্ণ মর্যাদাদানের মাধ্যমে আপনাকেও পূর্ণরূপে ভালবাসতে শেখে, তখনও তা মানবতাবাদের দ্যোতক হয়ে ওঠে বৈকি! আর কোনো নারী যখনই নিজের ইচ্ছেকে এভাবে মর্যাদা দিয়ে নিজেকে পুরুষেরই সমতুল্য বলে গণ্য করতে শুরু করে, তখনই সে সমাজের বিষদৃষ্টিতে পড়ে যায়। আর তাই অমলের প্রতি চারুর আকাঙ্ক্ষা সকলের নজরে এসে যাওয়ায়, চারুর ঘরও পরিণত হয় এক ‘নষ্টনীড়’-এ। তবে চলচ্চিত্রে চারুলতার পরিণতি যাই হোক না কেন, সে যে প্রগতিশীল মনোভাব ও মানবতাবাদের ডানায় ভর করে প্রাচীনতা থেকে নবীনতার দিকে এক মোহন উড়াল দেয়, এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো সন্দেহ থাকে না। সত্যজিতের সমকালীন অন্যান্য চিত্রপরিচালকেরা এই সময় নব্য বাস্তবতাবাদের উপর ভিত্তি করে সিনেমা তৈরি করছিলেন। তাঁদের ছবির চরিত্ররাও ( যাঁদের মধ্যে অবশ্যই নারীরাও ছিলেন ) নিজেদের কথা নিজেরাই সুস্পষ্ট স্বরে বলে উঠছিলেন। তাই এই ধারারই ছবি ‘দি বাইসাইকেল থিফ’-এর অন্যতম গুণগ্রাহী সত্যজিৎ-ও যে তাঁর সিনেমাতে চারুলতার হাতেই তার নিজের ইচ্ছের রাশ তুলে দেবেন, এতে আর আশ্চর্য কী?

চারুলতা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এর ঠিক আগেই ১৯৬৩ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ ঘটে আর এক অসামান্যা নারী চরিত্রের, যার কথা উল্লেখ না করলে আমাদের এই আলোচনা আজ আরও একবার ভিত্তিহীনতার সম্মুখীন হয়। আর সে হল ‘মহানগর’-এর আরতি। যদিও মহানগর চারুলতার আগেই মুক্তি পেয়েছিল, তবু আরতির নাম চারুলতার পরে উল্লেখ করার কারণ হল এই যে চারুলতার সময়কাল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আর মহানগরের পটভূমিকা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কলকাতা। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ নামক একটি অনবদ্য ছোটগল্পকে অবলম্বন করে গড়ে তোলা এই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে- “It marks the transformation of the middle class ‘home wife’ to a working woman.” বাস্তবিক, মহানগরের আরতি ( নামভূমিকায় আবারও সেই কাজল চোখের ব্যক্তিত্বময়ী অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় ) চেয়ে দেখার মতোই এক চরিত্র বটে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে উচ্চ বর্ণ, মধ্যবিত্ত, বাঙালি এক যৌথ পরিবারের গৃহবধূ হয়েও সে পরিবারের সকলের নিষেধ ( এমন কি তার নিজের বাবারও! ) অমান্য করে পরিবারের প্রয়োজনে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে চাকরি নেয়। ‘রঘুবংশম্’-এ আদর্শ জীবনসঙ্গিনীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মহাকবি কালিদাস সেই কবেই বলেছিলেন আদর্শ স্ত্রী হবেন “গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ”। কিন্তু তাঁর বহু শতক পরে বাঙালি পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে গৃহিণীর অধিক আর সম্মান দিতে সম্মত নয়, তখন নারীকে সর্বদা পশ্চাতে রাখার সেই অবমাননাকর নীতির বিরুদ্ধে শাণিত যুক্তি-বুদ্ধির অধিকারিণী আরতি এক সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তবে আরতি যদি নিজেকে এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখত, তাহলে তাকে আজ আমরা প্রগতিশীলা এক নারীরূপে মনে রাখলেও হয়তো বা আমাদের কাছে সে এতটাও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ না-ই হয়ে উঠতে পারত। নিজেদের বা সংসারের প্রয়োজনে তো আমরা মেয়েরা কত কিছুই করে থাকি। তবে সেই পরিবারের অভ্যন্তরেই অসম্ভব দারিদ্র্য তার নিদারুণ থাবা জাঁকিয়ে বসার পরেও যখন কোনো নারী কেবল তাঁর সহকর্মী অপর এক নারীর সম্পর্কে কটূক্তি করায় ও পরে সেই মেয়ের কাছে কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করায় হেলায় সে চাকরি ছেড়ে আসতে দ্বিধা করে না, তখনই আমরা বুঝতে পারি যে আরতি একমেবাদ্বিতীয়ম্। আসলে আরতির সহকর্মী এডিথ এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে। সে স্কার্ট পরে, লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙায়, ঝরঝর করে ইংরিজি বলে; এতে করে আরতিদের বস মিঃ মুখার্জি এডিথকে সহজেই কটূক্তি করা যায় বলে মনে করলেও, আরতি কিন্তু তা মনে করে না। সে নিজেকে ও এডিথকে এক আসনে বসাতে সক্ষম হয়, সম্মানকে সকলের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। আর যে নারী জাত-পাতের ভেদাভেদ সহজেই মুছে ফেলতে পারে, মালিক ও কর্মচারীর সম্মানকে এক আসনে বসিয়ে দেখতে সক্ষম হয় এবং সে সম্মান যেখানে রক্ষিত হয় না, হাজার প্রয়োজন সত্ত্বেও সেই স্থান ছেড়ে আসতে একবারও দ্বিধা করে না, তাকে একই সাথে প্রগতিশীলা, মানবিক ও অসামান্যা বলে অভিহিত করলে নিশ্চিতভাবেই খুব বেশি প্রশংসা করা হয়ে যায় না।

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে কিছু আধুনিকা ও মানবতাবাদী নারী চরিত্রদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে স্থান ও সময়াভাবে কেবল চারুলতা ও আরতির কথা উল্লেখ করেই আজ কলমকে বিরতি দিতে হল। তবে বাস্তবেই কি সত্যজিৎ কেবল এই দুই অসামান্যাকেই প্রাণ, রূপ ও চক্ষু দান করেছিলেন? মোটেই না! সত্যজিতের অবিস্মরণীয়া নারী চরিত্রদের নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘অপু ত্রয়ী’-র সর্বজয়া, দুর্গা ও অপর্ণার নাম যদি উল্লেখ না করা হয়, তবে তো তা স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি, দুয়ের প্রতিই এক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়! তবে শুধু ওরাই নয়। এরপরেও থেকে যায় ১৯৬০ সালে ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের দয়াময়ী; ৬১-র ‘তিন কন্যা’-র রতন, মণিমালিকা ও মৃন্ময়ী; ‘ঘরে-বাইরে’-র বিমলা; ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র সুতপা প্রমুখ নারীপ্রধান বিবিধ ছবি। সত্যজিৎ এছাড়াও বহু ছবি পরিচালনা করেছিলেন যেখানে নারী চরিত্রেরা তেমন মুখ্য না হলেও তারাও তাদের বিশেষত্বে দর্শকের মনে দাগ কেটে যেতে সক্ষম হয় ( আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মানবতাবাদকেই সত্যজিৎ অন্যতম প্রাধান্য দিয়ে এসেছিলেন। )। এমন কোমল ও আধুনিকা চরিত্রদের মধ্যে ‘আগন্তুক’-এর অনিলা বা ‘গণশত্রু’-র বিদূষী শিক্ষিকা ইন্দ্রাণী গুপ্ত অবশ্যই অনবদ্য। তবে এদের নিয়ে আলোচনা করতে করতেই ১৯৯৪ সালের ‘উত্তরণ’ ছবিটির কথাও মনে পড়ে। এ ছবির আউটডোরের পরিচালক সন্দীপ রায় হলেও ইনডোর শুটিং আর চিত্রনাট্য রচনার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। সে ছবিরও অন্যতম মুখ্য চরিত্র কিশোরী মানসী তার আতঙ্কে পরিপূর্ণ দুই কাজলকালো চোখে স্বপ্ন বুনে তুলেছিল শহরে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আপন যোগ্যতায় রোজগার করার, মানবিকতার মঙ্গল করস্পর্শে শহুরে ও চরম বৈষয়িক ডাক্তারের মনও সে সাময়িকভাবে হলেও কোমলসুন্দর করে দিতে সক্ষম হয়েছিল ( আর এক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয় মানসীর চরিত্রে শুভলক্ষ্মীকে বেছে নিয়েছিলেন কিন্তু সেই খাঁটি জহুরি সত্যজিৎ-ই। )। তাই সবশেষে, শ্যাম দুয়া-র সুরে সুর মিলিয়ে আমাদেরও বলতে ইচ্ছা হয়- “Satyajit had portrayed Indian women in the milieu of sensitive time and space in his films.” যে নারী বজ্রের চেয়েও কঠোর, আবার কুসুমের থেকেও কোমল; ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের দাঁড় করিয়ে সত্যজিৎ সেই সকল নারীকেই তাঁর চলচ্চিত্রে স্থান দিয়েছিলেন সসম্মানে। আর তাই তো এখন মে মাস ( বা ‘Ray’ মাস )-এর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে বাঙালি আজও করজোড়ে বলে ওঠে, “মহারাজা, তোমারে সেলাম…”

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
5 months ago

সত্যজিতের চলচ্চিত্রের দুটি অতি উজ্বল নারী চরিত্রের মনোগ্রাহী আলোচনা। সুলিখিত প্রবন্ধ।

Sanchita Basu
Sanchita Basu

অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন। ভুল-ত্রুটি সহ চেষ্টা করেছি, এই মাত্র। ‘রবিচক্র’-কে আন্তরিক ধন্যবাদ শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চার এমন চমৎকার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য।

দ্বৈপায়ন গোস্বামী
দ্বৈপায়ন গোস্বামী
5 months ago

বেশ লাগলো লেখাটি পড়ে, সত্যজিতের ছবিতে শিশু শিল্পীদের নিয়ে এরকম বিশ্লষনাত্মক লেখা পেলে ভালো লাগবে।

SANCHITA BASU
SANCHITA BASU

বেশ, চেষ্টা করব। অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।