শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

গত ১৫ ই  জুন ছিল আমাদের কলকাতা থেকে কালিম্পং রওনা হবার দিন। তার কিছু আগে থেকেই শুনছি উত্তর বঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। কলকাতা আর দক্ষিণ বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন বহুকাল বৃষ্টির দেখা নেই, উত্তর বাংলা তখন ভেসে যাচ্ছে অবিরল ধারাবর্ষণে। অতএব যাত্রাপথে বাধাবিঘ্নের আশঙ্কা যথেষ্ট ছিল, কিন্তু সেরকম কোন সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। তিস্তাবাজারে পৌঁছেই মনে হল, অন্য জগতে এসে পড়েছি। বর্ষায় স্ফীত তিস্তা প্রবল গৈরিক স্রোতে ছুটে চলেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আকাশে বিকেলের শান্ত মেঘ, বাতাসে ঠাণ্ডার পরশ। কালিম্পঙে যখন এসে পৌঁছলাম, ম্লান সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হোটেলের বারান্দা থেকে অনেক নিচে তিস্তা তখন একটি স্থির শাদা রেখার মতো , তার ওপরে থমকে আছে ধোঁয়ার মতো মেঘ। মনে আশা হল, আগামী দিন তিনেক আকাশে মেঘ ও রোদের খেলা দেখে সুন্দর সময় কাটানো যাবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই, যে এর মধ্যে একবারও মেঘ তার ঘোমটা সরালো না, তার আড়ালে রঙে রূপে উজ্জ্বল দৃশ্য অদেখা রয়ে গেল।

কালিম্পং  থেকে তিস্তা


কালিম্পঙে আগে কখনও রাত্রিবাস করিনি । দার্জিলিংয়ের মতো জনবহুল নয় কালিম্পং, এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটির দার্জিলিংয়ের তুল্য প্রশাসনিক ও ঐতিহাসিক গৌরব না থাকলেও  এর নিভৃত নির্জনতার এক আলাদা আকর্ষণ আছে। কালিম্পং নামের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে বৃষ্টিঝরা ঠাণ্ডা দিন, মস্ত সাহেবি বাংলো আর ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলার ছবি। আর এখানে গৌরীপুর লজে এসে শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু অনবদ্য কবিতা লেখার স্মৃতি ।

গৌরীপুর লজ

কিন্তু আষাঢ়ের মেঘলা আঁধারে এবার আমাদের কাছে কালিম্পং ধরা দিল অশ্রুনয়না বিরহিণীর মূর্তিতে । হোটেলের ভিতরে এক নিঃসঙ্গ স্তব্ধতার অনুভূতি । বৃষ্টি থামলে এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসা পাখির কূজন । নির্জন সমুদ্রতীরে জলের কল্লোল অনন্ত সময়কে নিয়ে খেলা করে, আর নির্জন পাহাড় সময়কে গতিহীন, মন্থর করে রাখে। তাই কালিম্পঙে দুদিনই আমরা sight seeing এ বেরিয়েছিলাম। প্রথম দিন শহরের ভিতরে প্রাচীন দুরপিন দারা monastery , Morgan house ও তার আশেপাশে বৃষ্টিতে পিছল ঢালু পথ  আর শ্যামসজল প্রকৃতি।  মনে হল, যদি ক্ষণিকের জন্য দুপুরের নরম হলদে আলোয় দৃশ্যমান হত কাঞ্চনজঙ্ঘা, যদি মেঘ বলে উঠত , “… after the rain , with never a stain the pavilion of heaven is bare”, কিন্তু সেই মেঘমুক্ত সাম্রাজ্যের কোনো আভাস পাওয়া গেল না। 

 দুরপিন দারা বৌদ্ধ মঠ


পরের দিন আবহাওয়া ছিল মনোরম। আমরা শহর ছাড়িয়ে রামধুরা হয়ে গেলাম Munsong পর্যন্ত। পথের ধারে অজস্র দীর্ঘদেহ পাইন গাছ আকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে , পাহাড়ের গায়ে সজল বাতাসে দুলছে কত নাম না জানা ফুল । এ জায়গা যে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় সেটা অনুমান করা যায়। পথের শেষে ব্রিটিশ আমলের জলসা বাংলো। তার চারপাশে গাছপালায় ঘেরা কাননভূমি – বিশ্রাম নেওয়ার আদর্শ জায়গা। কিন্তু নাগরিক সভ্যতায় অভ্যস্ত আমরা বিশ্রাম শব্দের অর্থ ভুলে গিয়েছি। তাই কিছুক্ষণ পরেই মন বলে ওঠে,  এ’বার ফিরতে হবে।

পাহাড়ী গ্রাম মাঙসাং


পরের দিন ১৮ ই জুন সকালে আমরা কালিম্পং ছেড়ে কার্সিয়ং যাত্রা করলাম। সারা পথ চলল প্রায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি – আমাদের মতো সমতলের বাসিন্দার পক্ষে ওই ঝড়জলের মধ্যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা এক অভিজ্ঞতা বটে। মেঘে বৃষ্টিতে অন্ধকার পার্বত্য অরণ্য, ঝোড়ো বাতাস বইছে । তার মধ্যে একটু বৃষ্টি থামলে,  রোদের ক্ষীণ আভা বনের মধ্যে দেখা গেলে যে এমন আনন্দের অনুভূতি হতে পারে , আগে জানা ছিল না । আবার সেই তিস্তা বাজারের পাশ দিয়েই আমরা কার্সিয়ং পৌঁছলাম। বন্যাপ্লাবিত নদীর ধারে একটি একলা সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে, অজানা কারণে এই দৃশ্যটি এখনও মনে পড়ছে।

Netaji-Musuem-Kurseong
নেতাজী প্রদর্শশালা – কারসিয়াং


কার্সিয়ং নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেঘ,  কুয়াশা,  অর্কিড আর টয় ট্রেন। এখানকার বাসিন্দা যাঁরা,  তাঁদের কাছে জীবন নিশ্চয়ই এত কাব্যময় নয়। তবু অনেক গল্প,  স্মৃতি ও ইতিহাস মিলে মিশে মনের মধ্যে এই ছবি তৈরি হয়েছে। সমতল থেকে ওপরে ওঠার পথে এই শহর থেকেই বোধহয় landscape এর রূপান্তর ঘটে,  শুরু হয় শীতের রাজ্য। এখানে আমাদের Homestay পাহাড়ের অনেক উঁচুতে , সেখানে আবার  মেঘে ঢেকে যাওয়া সব  দৃশ্য, নির্বাসনের অনুভূতি , নিরন্তর বৃষ্টি । পরের দিন সকালে বৃষ্টি থামার সামান্য লক্ষণ দেখেই আমরা শহর দর্শনে বেরোলাম। প্রথম গন্তব্য , গিদ্ধা পাহাড়ে নেতাজি museum । ১৯২২ সালে নেতাজির মেজদা শরৎচন্দ্র বসুর তৈরি এই বাড়ির অবস্থানটি চমৎকার – নির্জন, কিন্তু কাছেই লোকালয়।  কাঠের তৈরি সুদৃশ্য বাংলো বাড়ির ভিতরে অনাড়ম্বর প্রদর্শনী ছবি ও আসবাবে সাজানো, ভিতরে লম্বা বারান্দায় কাঁচের জানালা। কার্সিয়ং ও দার্জিলিং অঞ্চলে সেকালের ইংরেজিশিক্ষিত, অভিজাত বাঙালির শৈলনিবাস অনেক ছিল যেখানে তাঁরা ছুটি কাটাতে ভালোবাসতেন। সকলেরই মনে পড়বে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাড়ি Step Aside, নীলরতন সরকারের Glen Eden, জগদীশচন্দ্রের মায়াবতী। সব মিলিয়ে গত শতাব্দীতে, এমনকি স্বাধীনতার পরেও এই রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জোরালো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে সেটা হয়তো সুখের হয়নি, তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

মাকাইবাড়ি চা-বাগান

কার্সিয়ং শহরের উচ্চতম শিখরে অবস্থিত ঐতিহ্যসম্পন্ন Dow Hill School, তার প্রাসাদোপম বাড়ি দেখে মুগ্ধ হলাম । বৃষ্টির আচ্ছন্নতার মধ্যে দেখলাম Makaibari চা বাগান, যার চায়ের স্বাদ বিশ্ববিখ্যাত। বহুদিন আগে তাকে দেখেছিলাম , আজ সে দেখার কোনো স্মৃতি নেই। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যতই উঁচুতে উঠি, জনাকীর্ণ, ঘিঞ্জি কার্সিয়ং ক্রমশঃ নির্জন , অতি মনোহর রূপ ধারণ করে। বৃষ্টিসিক্ত , ঘন সবুজ পাইন গাছের সারি কত বছরের অনুচ্চারিত ইতিহাস নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মনে মনে ভাবি, আমাদের ভ্রমণ শেষ হয়ে যাবে দুদিন পরেই , কিন্তু শ্যামল এই অরণ্য থেকে যাবে এমনই দুর্গম , নীরব ও ইঙ্গিতময়, কত পথিকের মুগ্ধতার সাক্ষী হয়ে। আশ্বিনের নির্মল আলো তার গাম্ভীর্যকে প্রসন্নতায় সাজিয়ে দেবে , আনন্দময় ফাল্গুন তাকে নিবেদন করবে কত বনফুলের অঞ্জলি। আর বনভূমির মাঝখানে ছায়াচ্ছন্ন শ্যাওলা ধরা পথটি থাকবে আপনমনে তার কালজয়ী উদাসীনতায় ।

দিন সাতেক পরে কলকাতায় ফিরে আকাশে গোধূলির আলো কেমন অচেনা মনে হল। মনে পড়ে গেল ফেলে  আসা তিস্তাকে, বৃষ্টিমুখর পাহাড়ের নীলাভ অন্ধকার। যে প্রখর সূর্যকিরণ থেকে মুক্তির আশায় উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম , যেন কতদিন পরে তার দেখা পেয়ে ক্ষণিকের জন্য ভালো লাগল। এই ভালো লাগাও আমার এবারের ভ্রমণের একটি অর্জন।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.