শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

পরার্থপরতার প্রতি জগবন্ধুর আর আস্থা রইল না। তাঁর অফিসের বস চক্রবর্তীবাবু অতীব সদাশয় পরোপকারী মানুষ । তাঁর কন্যা গত কয়েকদিন আগেই অকাল বিধবা হলেন। বাড়ির ফলবতী আমগাছটা বাজ পড়ে নষ্ট হল। জগবন্ধুর স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান হবার সময় রক্তাল্পতা জনিত কারণে প্রসবের সময় বিরল গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হল , তখন এই মানুষটিই শোনা মাত্র নিজের রক্ত দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেননি। জগবন্ধুর ক্ষমতা ছিল না বসকে অনুরোধ করার। তাঁর কারণ অবশ্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তির প্রতি শুধু ভয় নয়, ভয়ের চেয়েও কিঞ্চিৎ বেশি, ভবিষ্যতে ঋণ শোধ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভয়। এই তো , জগবন্ধুর অফিস সহকর্মীরা প্রায়শই টিফিনের সময় তাঁদের গিন্নীদের হাতে তৈরি ভালো মন্দ রান্নাবান্নার বাটি এগিয়ে দেন। জগবন্ধু অবশ্য সেসব নির্বিঘ্ন চিত্তে গ্রহণ করতে কুন্ঠিত হন না। কেউ কেউ আশায় থাকেন, জগাদা হয়তো কোনো একদিন তাঁদের পুষিয়ে দেবেন, কিন্তু সে গুড়ে বালি। সুনির্মল তো একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই দিল, “কী জগাদা , কাউকে কিছু খাওয়ালে কমে না গো, বাড়ে।” জগবন্ধু বললেন ” এ কী বিদ্যা নাকি যে দানে বাড়বে ? আমি কি কাউকে আমাকে খাওয়াতে বলেছি?” সুনির্মল আর কথা বাড়াননি তবে মনে মনে সংকল্প করেছিলেন, জগাদার সঙ্গে খুব প্রয়োজন না পড়লে দূরত্বই বজায় রাখবেন।

জগবন্ধুর পিতৃদেব কিন্তু হৃদয়বান পরোপকারী মানুষ। লোকজনকে খাওয়াতে বড়ই ভালবাসেন। দান-ধ্যানেই তাঁর মতি । তিনি মনে করেন, হিংসুটে লোকেদের হয়তো ধন মান অনেক কিছুই আছে, কিন্তু মনে আনন্দ নেই, অন্তর সদা পরশ্রীকাতরতায় ভরা। তাঁদের সারাক্ষণ নজর থাকে, কে তাঁর চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে,অথবা যেতে পারে এমন বর্তমান – ভবিষ্যতের দিকে।

জগবন্ধু

জগন্নাথ হিসেবী ছেলে। বেশ খানিকটা মায়ের স্বভাব পেয়েছে। একবার পাশের বাড়ির পিন্টু তাঁর চেয়ে বিজ্ঞানে মাত্র তিন নম্বর বেশি পেয়েছিল, তাতেই মা যে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন, প্রত্যেকবার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন সেই মূর্তিই চোখের সামনে ধরা দেয় বটে কিন্তু অনুপ্রেরণাও জোগায় সবাইকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলার। তাঁর মতে, মা তাঁকে এভাবে গাইড করেছে বলেই ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হতে পেরেছে, জয়েন্টে র্যাঙ্ক করতে পেরেছে। অযথা বাবার দেশপ্রেমের গচ্চা দিতে গিয়েই বিদেশ না গিয়ে এই সরকারি চাকরির ফাঁদে আটক হতে হয়েছে। মা না থাকলে বাবা এই বসত বাড়িটুকুও করতে পারতেন না। বাকি কাকা জ্যাঠারাতো গাঁয়ের বাড়ির খোঁজই নেয় না, একমাত্র তাঁর বাবাই সেখানে চাষাবাদে টাকা পয়সা ঢালে। বাবাকে মা শিখিয়ে বুঝিয়ে পারে না। এখন অবশ্য এ দায়িত্ব জগন্নাথের। তাঁর সংগ্রহে আছে কম করে একশ তেরো জনের পরোপকারের কাহিনি যেখানে রয়েছে এই প্রকার মানুষগুলির দুর্দশাক্রান্ত জীবনের ছবি। কিন্তু তাও জগন্নাথের পিতৃদেব হার মানতে রাজি নন। কেউ তাঁর উপকার চাক বা না চাক তিনি মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বেনই পড়বেন। কোনো খ্যাতির ধার ধারেন না, বরং বাহবা দিলে রাগই করেন। এ স্বভাব তাঁর মজ্জাগত।

জগবন্ধুকে নিয়ে অফিসে আড়ালে আবডালে প্রবল ক্ষোভ আছে। শুধু তাঁর কলিগদের মধ্যেই নয়, বসেরাও বিরক্ত। তাঁরা তাঁকে এখন আর কোনো কাজই দেন না। মাঝেমাঝে কোনো সহকর্মীর ওপর বেশি কাজের চাপ পড়লে, কেউ কেউ বসের কাছে নালিশ করে, ” জগবন্ধু ,কেন বসে বসে মাইনে নেবে , তাঁকে কাজ দেওয়া হোক।” বস জগবন্ধুকে ডেকে পাঠায়, কাজও দেয় কিন্তু কাজ দিলেই জগবন্ধু পর পর কয়েকদিন ডুব দিয়ে দেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। জগবন্ধু যে কাজকর্ম পারে না এমনটা নয়, রীতিমত দক্ষ কিন্তু করেন না এবং মনে করেন, অফিসটাইমটা অনাবশ্যক অফিস কর্মে নষ্ট না করে অনলাইন শেয়ার বাজারে কাটানোই লাভজনক। জগবন্ধু বহু দিনের অভিজ্ঞতা দ্বারা খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছেন যে, বস ,সহকর্মী এরা দু- একদিন ঝাড় দেবেন, বিরক্ত হবেন কিন্তু তাঁর তাতে মাইনেতে কিছু কম পড়বে না এবং কাজকর্ম অচিরেই কোনো না কোনো পরহিতার্থীর ঘাড়ে চাপবে। তিনি বরাবর এটাই দেখেছেন, সমাজ সংসার সর্বত্র এই রীতি, ভালো মানুষের ঘাড় মটকানো। জগবন্ধুর এ হেন আচরণ শোধরাতে না পেরেও অনেকে তাঁর থেকে মুখ ফেরাতে পারেন না। তাঁর একটা বড়ো কারণ, জগবন্ধু যোগ্যতায় একদা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ইঞ্জিনিয়ারিংএ প্রথম একশোর মধ্যে র্যাংক হোল্ডার, কিন্তু পিতার পরামর্শেই তাঁকে এই অপেক্ষাকৃত কম মাইনের সরকারি চাকরি করতে আসতে হয়। তা না হলে এতদিন সে এ দেশেই থাকত না। ফলে অফিসের লোকজন আড়ালে গালমন্দ করলেও সামনে যথেষ্ট সমীহ করেই চলে।

জগবন্ধুর স্ত্রী সুধা। জগবন্ধু অফিস চলে যাবার পর তাঁর নেশা হল স্কুল কলেজের বন্ধু বান্ধবদের সাফল্যের উচ্চতা মাপা। তিনি এইসময় হিসেব করেন ,জগবন্ধুর বদলে মৈনাককে বিয়ে করলে সে এতদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকতে পারত ; নিদেনপক্ষে রামেশ্বরকে বিয়ে করলে ব্যাঙ্গালোর তো গন্তব্য হতই। সুনন্দা, তাঁর স্কুলের বন্ধু, সে দিব্যি বুদ্ধি করে থার্ড বয়কে প্রপোজ করেছিল। ছেলেটা যে এত উন্নতি করবে ডাক্তারিতে, সুধার কল্পনাতেও ছিল না। জগবন্ধু স্মার্ট হ্যান্ডসাম ফার্স্ট বয় ছিল, সেইভাবেই সুধা এগিয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে যে এমন তরল যুবক গরল প্রতিপন্ন হবে, কে তা জানত! ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে মোহনাকে দেখে সুধা চমকে উঠল। এতদিনে সে ব্যাটা তাঁর রিকু অর্থাৎ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। ‘পিপল ইউ মে নো’ তে ওর বর খালি ঘুরঘুর করে। সে অবশ্য সুধার মাস্টার্সের ক্লাসমেট। ততদিনে তো জগবন্ধুর সঙ্গে পাকা কথা সারা। একবার ভেবেও ছিল সে মত পাল্টে ফেলবে কিন্তু পদবীতে আটকে গেছিল। সুধার বাবার ছিল এক গোঁ, ” ওসব অজাত কুজাত ঘরে আনা চলবে না। ” কী এমন অসুবিধা হত, দিনের শেষে ভালো থাকাটাই তো আসল কথা। মোটের ওপর যুগ তো এখন ওদেরই, প্রত্যেক সরকার চায় এঁদের নানাবিধ ভাতা, পড়াশোনা থেকে চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ সংরক্ষণ দিতে। মোহনার এখন রূপ খুলে গেছে, আজ গ্রিস , তো পরশু গ্লাসগো। এই সব দেখতে দেখতে সুধা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে!

সাধারণত বিকেল চারটের দিকে সোপান আসে। সে হল বাবাই এর থেরাপিস্ট। বেশ ভাব বাবাই এর সঙ্গে। বাবাই আবার নতুন করে আঁকা শুরু করেছে। সোপান গ্রামের ছেলে। সেই গ্রামের নদী পুকুর মাঠ ঘাট সম্বলিত তাঁর ছোটবেলার গল্পই মূলত বলে। বাবাইয়ের আঁকায় দেখি এখন সে সবই ফুটে ওঠে । বাবাইতো তাঁর দেশের বাড়ি যায়নি কখনও। এখানে ফ্ল্যাট কেনবার পর তাঁর বাবাই ভুলে গেছে মাটির গন্ধ। জগন্নাথের মা অবশ্য শহরেই থাকতে পছন্দ করেন, গ্রামের বাড়িতে রান্নাঘর, বাথরুম সব ছাড়া ছাড়া। ফ্ল্যাটে চলাফেরা এই বয়সে অনেক সুবিধের। তাছাড়া ছেলের নিত্যকার দেখভাল করাও তাঁর কাজ। বৌমা তো পঙ্গু ছেলে নিয়েই ব্যস্ত। সোপান নাকি ফেসবুকে কবিতা টবিতাও লেখে। সুধা প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেছে। মন্দ লেখে না ছেলেটা, কিন্তু কী লাভ এসবে ! কয়েকটা লাইক কমেন্টস ছাড়া কিছুই তো পাওয়ার নেই। কলেজ লাইফে জগবন্ধুরও এমন বাতিক হয়েছিল সুধার প্রেমে পড়ে। তবে অচিরেই ঘোর কেটেছিল। সুধাই তাঁকে বলেছিল, ‘ভালো চাকরি না পেলে , সে ফিরেও তাকাবে না, তা সে তুমি যতই আমাকে কবিতা লিখে নাচাও।’ মিথ্যে স্বপ্নের জগতের বন্ধুত্ব ঘুম ভাঙলেই কেটে যায়।

হুইলচেয়ারে বাবাই

ওদের একমাত্র ছেলে বাবাই আজ মা’কে ডাকেনি, সে নিজেই হুইল চেয়ার ঠেলে ডাইনিং এ এসে ভাত বেড়ে নিয়েছে। মুশকিল হল এঁটো বাসনগুলো রান্নাঘরে রাখতে গিয়েই বেচারার হাত ফসকে বাটিটা ঝনঝন শব্দে মেঝেতে পড়ে গেছে। সুধা সেই আওয়াজে হতচকিত হয়ে ঘুম থেকে জেগে সটান ছুটেছে রান্নাঘরের দিকে। ছেলে তখন হুইল চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুধা অবাক হয়ে চিৎকার করে, ” বাবু, তুই ভালো হয়ে গেছিস !” গত তিনবছর ধরে ছেলেটা কোমর নড়াতে পারে না। এইভাবে যে ছেলেটা পঙ্গু হয়ে যাবে কেউ ভাবতেই পারেনি। ভুল চিকিৎসার খেসারত দিতে দিতে তাঁদের জীবন পর্যুদস্ত। সুধা বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে জগবন্ধুকে ফোন করে। খবর শুনে শুধু জগবন্ধুই নয়, তাঁর অফিসের সকলেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়। জগবন্ধু জানালা দিয়ে চেয়ে দ্যাখে অফিসের নিচে ফুলের বাগানে পড়ন্ত বেলার শীতের রোদ। সেই সামান্য উষ্ণতা মেখে গোলাপ টগরের সে কী মাথা দোলানো। জগবন্ধু তাঁর পাশের টেবিলের সহকর্মীকে জড়িয়ে ধরে, আনন্দধারায় ভিজে যায় চিবুক। জগবন্ধুর বাবা খবরটা পেয়েই ফোন করে বললেন, ” জগৎ, , জীবনের সব হিসেব একদিনে মেলে না, কোন পূর্ব পুরুষের পূণ্য কর্মের ফল কীভাবে ধরা দেবে, কেউ জানে না।”

আজ অফিস থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমে বাজারে গেল জগবন্ধু। যদিও সে ছেলের পঙ্গুত্বকে কাটাতে পারবে ভেবে জীবনকে নিজের মত করেই সইয়ে নিয়েছিল, কিন্তু আজ একটা আস্ত দেড় কেজির ইলিশ কিনেই ফেলল। কেটেকুটে ব্যাগে ঢোকাতেই হঠাৎ পিছন থেকে কার ডাক শুনতে পেল জগবন্ধু।

“আরে , মৈনাক, কবে ফিরলি ?”

এই তো শীতেই ক’টা দিন ছুটি।

জগবন্ধু সচরাচর এমনটা করে না। ভেবেচিন্তেই পা ফেলে। কিন্তু মৈনাককে বলেই ফেলল, ” চল, বাড়িতে, এক কাপ চা খেয়ে আসবি।”

মৈনাক যে এত সহজে রাজি হবে জগৎ ভাবতেই পারেনি। সে ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ এখন, ধনে মানে তাঁর সঙ্গে আকাশ পাতাল তফাৎ।

মৈনাক সানন্দে বলল, ” ফার্স্ট বয়ের আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা তাঁর নেই , বন্ধু।”

জগত কিঞ্চিৎ হতাশ সুরেই কথা বাড়ালো, ” ফার্স্ট বয়দের চেয়ে থার্ড বয়রাই এখন এগিয়ে রে।”

এই থার্ড বয়কেই জগন্নাথ সকাল বিকাল গালমন্দ করে। তাঁর মতে ওই ভুলভাল চিকিৎসা করে ছেলেটাকে পঙ্গু করে দিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। মৈনাক বারবার আশ্বস্ত করেছে ভিডিও কলে যে ছেলের রিকভারিতে সময় লাগবে, তবে ফিজিওথেরাপিতেই তাঁর দাঁড়াবার ক্ষমতা ফিরে আসবে।

“সে তুই যাই বল, তোর মেধার ধারে কাছে ঘেঁষবার ক্ষমতা আমার নেই।”

জগন্নাথের ইচ্ছে করছিল গালমন্দ করতে, কিন্ত সেটা হয়ে উঠল না।

ইতিমধ্যেই সুধা থেরাপিস্ট সোপানকে খবর দিয়েছে। সে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছে বাবাইয়ের কাছে। কীভাবে আরো ভালো করে হাঁটা চলা রপ্ত করা যায়, সেই সব কৌশল দেখাতে ব্যস্ত।

মৈনাককে দেখে সুধা ব্যস্ত হয়ে কীভাবে তাঁর খাতির যত্ন করবে খুঁজে পায় না। অর্ডার দেয় তাঁর প্রিয় খাবার চিকেন চিজ মোমোর। এমন একটা দিনেই যে ডাক্তারবাবু এভাবে হাজির হবে, সেও অকল্পনীয়।

সোপান কাজ শেষে বেরিয়ে যায়। বাবাই তার বাবাকে কাছে ডেকে বলে, ” সোপান কাকুকে যেতে দিও না, ফিজ বাবদ তোমার দেওয়া কাকুর সব টাকাপয়সা আমার কাছে জমা আছে। “

জগন্নাথ চমকে ওঠে।

বাবাই বলে, ” তুমিই না একদিন বলেছিলে তোমার সব টাকা আমার জন্য জলাঞ্জলি যাচ্ছে। তারপর থেকে সোপান কাকু টাকা নিত না। এই নাও। এখন তো তাঁকে দাও।”

সুধা সোপানকে ফোন করে। সোপান বলে, “বৌদি, আমার কাজ শেষ, বাবাইকে সব এক্সারসাইজ বুঝিয়ে দিয়েছি।”

বাবাই

পাশের বাড়ি থেকে কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ভেসে আসছে। সুধা ফোনটা রেখে জানালার পাশে দাঁড়ালো। প্রাণভরে শ্বাস নিল। অন্ধকার আকাশে চাঁদটাকেও খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। সোপান বাবাইকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পূর্ণিমা দেখাতো, আবার বৃষ্টিভেজা জোৎস্নাও চিনতে শিখিয়েছিল। সুধা অবশ্য তখন এসব কবিমার্কা দৃষ্টি পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ সোপান এবং চাঁপা একাকার। সে চলে গেছে তো কী হয়েছে, মনের দরজাটা যেন আজ থেকে তাঁর জন্যই দরাজ।

সোপান জীবনে কোনোদিন ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ফোর্থ কোনোটাই হতে পারেনি মিডিওকার ছিল, ডাক্তার হয়ে ওঠার মেধা তাঁর ছিল না। আজ তাঁর নিজেকে কেমন জানি ফার্স্ট বয় মনে হল। সত্যিই তো, সঠিক যত্নই পারে সংশোধন করতে, সেটাও তো চিকিৎসারই অঙ্গ।

জগন্নাথ জানত, সোপান আর এদিকে আসবে না। পিতৃদেব বললেন, ” জলাঞ্জলি দেওয়া টাকাপয়সাগুলো এভাবেই ফিরে আসে রে জগত। তোকে ঠকাবে এমন সাধ্য কার ! তবে সভ্যতার সোপান বরাবরই পিচ্ছিল, তাকে বেয়ে ওঠা তোর পক্ষে সম্ভব নয়। “

বাবার কথায় জগন্নাথ খানিকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে যায়। সম্বিত ফিরে পেলে ভাবে, “সোপান ছেলেটা বড্ডো বোকা। এখন তো টাকাটা নিতেই পারত। খুশি হয়ে নাহয় আরো কিছুটা বেশীই দাবি করতে পারত। এত বড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে !”

পিতৃদেব তাঁর মনের কথা কীভাবে বুঝতে পারেন কে জানে!
হয়তো যতটা বোকা ভাবা হয়, ততটা নন। তিনি নাতির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “আসলে পরার্থপরতার প্রকৃতিই এমন, যে এর স্বাদ পেয়েছে তাঁর কাছে এমন জগন্নাথরা চিরকাল ঠুঁটো। “

শ্বশুরমশাই নাতিকে ডাক দিলেন, ‘ বাবাই, তোমার আঁকা দেখাও।’

নতুন করে হাঁটতে শিখে টলোমলো পায়ে সে খাতাটি বাড়িয়ে দিল দাদুর হাতে….

গ্রামের শেষ
মজা নদী
চরের ধারে অশ্বত্থতলা
যেন সহস্র বাহু ছড়িয়ে আছে বিনম্র ডালপালা

ঝড় বৃষ্টি মেঘ বজ্র
পাখির কোলাহল
সাইকেলটি থামিয়ে ক্ষণিক
থমকে গেছে দগ্ধ পথিক
আয়না ছায়ায় নাচছে তখন হাজার দোলাচল

একটি কোণায় শিকড় গেড়ে সাদা কালো শিলা
পায়ের নিচে ছড়িয়ে আছে একটি দুটি ফুল

অনেক অবহেলা……

তবুও তিনি আগলে রাখেন
ছেঁড়াখোড়া গ্রামখানি
দ্যাবতা হওয়ার বহু জ্বালা
পাথর দুখে আলোর ঝলকানি

গ্রামের শেষ
মজা নদী
চরের ধারে অশ্বত্থতলা
মগ্ন হয়ে দেখছি তাঁকে

একলব্য……

গাছ – পাথরের সবাক চারুকলা।

কবিতা – সোপান
ছবি – স্বপ্নতরু

বাবাইয়ের স্বপ্নতরু নামটা অবশ্য সুধাই রেখেছিল জগবন্ধুরই একটা কবিতা থেকে…..।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x