
“Soft as slow-dropping waters in a pool
Kissed by the moon at midnight, deep and cool,
Whose liquid sound upon the ear doth fall
Fraught with enchantment brooding over all –
Such was the spell which held my soul in fee
Entranced on hearing first GITANJALI.” (বড় হরফ লেখকের সংযোজন)
[৭ জুলাই ১৯১২। ইংল্যান্ডে রোটেনস্টাইনের বাড়ি। আমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ। কবি ইয়েট্স তাঁর আবেগমথিত গলায় পড়ে চলেছেন ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে কবিতা।
গণ্যমান্য শ্রোতৃমন্ডলীর মধ্যে বসে চার্লস্ ফ্রিয়ার অ্যানড্রুজ, একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ও শিল্প-সাহিত্যের অধ্যাপক। অনুষ্ঠান শেষে সেই সন্ধ্যায় একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে রাস্তায় চলেছেন অ্যানড্রুজ। তাঁর কথায় –“নির্মেঘ আকাশ, আকাশের গায়ে ঈষৎ রক্তরাগ – ভারতের অস্তরবির ছোঁওয়া যেন লেগেছে লন্ডনের আকাশে। একা চলতে চলতে আমি ভাবতে লাগলাম, কী আশ্চর্য এই কবিতা : জগৎ-পারাবারের তীরে ছেলেরা করে মেলা… ।
On the seashore of endless worlds, children meet…
On the seashore of endless worlds is the great meeting of children.”
শান্ত হল না মন। ‘ON FIRST HEARING OF GITANJALI’ কবিতাটা লিখে কবির প্রতি পুজোর নৈবেদ্য রচনা করলেন, যার প্রথম স্তবক এই ভূমিকার শুরুতে।]

‘চার্লি’ অ্যানড্রুজের নিজের কথায় তিনি দ্বিজ। তাঁর জন্ম দু’বার – প্রথমবার ইংল্যান্ডে উত্তরের বন্দর শহর নিউকাস্লে ১৮৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীবার
১৯০৪ সালে – ভারতে প্রথম পদার্পণ। তাঁর যাপিত জীবনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্বাধীনতাকামী ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত মানুষের প্রতি দরদ তাঁর প্রতি মনোযোগী যে- কোনো মানুষকে প্রাণিত করবে। কিন্তু অ্যানড্রুজের সম্পর্কে বিশেষ করে ভারতীয়রা তেমন অনুধ্যায়ী হতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীর লজ্জা।
বংশ পরম্পরায় খ্রিস্টধর্মে অনুরক্ত পরিবারের প্রভাব অ্যানড্রুজের মধ্যেও সঞ্জীবিত ছিল। তাঁর পিতামহ ছিলেন মেথডিস্ট চার্চের যাজক। বার্মিংহামের Catholic Apostolic Church-এর ধর্মযাজক জন এডুইন ও তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মেরি শার্লটের সন্তান অ্যানড্রুজ। যীশু খ্রিস্টের আজীবন ভক্ত অ্যানড্রুজ ধর্ম-ভাবনার সেই orthodox dogma-এর ঊর্ধ্বে উঠে খ্রিস্টধর্মের নিরিখে শ্রম ও পুঁজির সম্পর্ক বিচার করেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন শিল্প-সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্বের (classics and theology)প্রথম শ্রেণীর স্নাতক তিনি। ১৮৯৬ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রকাশিত অ্যানড্রুজের লেখা ‘Christanity and the Relationship between Capital and Labour’ রচনাটিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে বিশেষ সম্মান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাধীন অবস্থায় তাঁর বিশেষ অনুধ্যান ছিল কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত করে প্রমাণ সংগ্রহ করা, যার যুক্তিগ্রাহ্যতা যথাযথভাবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে উপস্থাপিত করা যায়। পুঁথিগত বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগই ছিল তাঁর প্রধান বিষয়। ফলত, পরবর্তীকালে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক অথবা নিঃসহায় রেল-কর্মচারি অথবা উৎপীড়িত এবং শোষিত মানুষের সমস্যা-সমাধানের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলোকে চতুর ব্যবসায়ী এবং সন্দেহপ্রবণ আমলাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে অ্যানড্রুজকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
১৮৯৫ সালে কেমব্রিজ ত্যাগ করে দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে অ্যানড্রুজ আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়ে তাঁর কাজ এবং অনুধ্যানের বিষয় ছিল –
বস্তিবাসীদের জন্য নিবাস প্রস্তুত, বেকারত্ব দূরীকরণ আর বিদ্যুৎ-পরিকাঠামোর উন্নয়ন। এই সমস্ত কাজের প্রেক্ষিতে তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘My
experience’-এ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অ্যানড্রুজের উচ্চারণ – “…MADE ME AN OUT-AN-OUT OPPONENT OF THE CAPITALIST SYSTEM.” (বড় হরফ লেখকের)। একই সঙ্গে অ্যানড্রুজের বাসনা জাগে একজন নিয়মিত ‘priest of the Church of England’ হিসাবে আত্মনিয়োগ করা। যদিও চার্চে খ্রিস্টান ধর্মের পরিপন্থী কিছু কাজকর্মে বিরক্ত তাঁর চিত্ত এই বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিল, তথাপি, অ্যানড্রুজ একজন ধর্মযাজক হিসাবে নিজের পরিচয়কে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শারীরিক অসু্স্থতার কারণে ১৯০০ সালে অ্যন্ড্রুজ শিক্ষক হিসাবে তাঁর কেমব্রিজের পুরনো কলেজে ফিরে এলেন, যেখানে পরবর্তী তিনটে বছর তাঁর ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের চিন্তা প্রায়শই তাঁকে নাড়া দিচ্ছে। অবশ্য খ্রিস্টধর্মানুসারে নিজের দেশে আমূল সামাজিক পরিবর্তন সাধনের একজন
উৎসর্গীকৃত কর্মী হিসাবে থাকাটাই ছিল তাঁর প্রথম পছন্দ। কিন্তু বাধা এল।
দিল্লিতে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে সেন্ট স্টিফেন কলেজের শিক্ষক ও তাঁর প্রিয় বন্ধু বেসিল ওয়েস্টকটের মৃত্যু হল। কেমব্রিজ ভাতৃসংঘ নামাঙ্কিত(Cambridge Mission Brotherhood) পরিচালকমণ্ডলীর নির্দেশে নিতান্ত বাধ্য হয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে ওই কলেজের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে হল অ্যান্ড্রুজকে। প্রায় সবার অলক্ষ্যে ভারতবর্ষে দ্বিতীয়বার জন্ম নিতে এলেন চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ। সেটা ওই ২০০৪ সালের মার্চ মাস। আমরা ধন্য হলাম।

বোম্বাইতে পদার্পণ করার পরে দিল্লিতে এসে অ্যানড্রুজ ইংরাজি সাহিত্য ও ইতিহাসের
অধ্যাপক হিসেবে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে যোগ দিলেন। ওই কলেজে তাঁর পরিচয় এবং প্রায় পারিবারিক সদস্যের মতো ঘনিষ্ঠতা হল ওখানকারই সহ-উপাধ্যক্ষ
সুশীলকুমার রুদ্রের সঙ্গে। একজন খ্রিস্টান ও জাতীয়তাবাদী মানুষ হিসাবে
সুশীলবাবু সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন। প্রাথমিকভাবে এই দেশকে জানতে-বুঝতে ও
অ্যানড্রুজকে কর্মে উদ্দীপ্ত করতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। অচিরে অ্যানড্রুজের
চিন্তা-চেতনা-শিক্ষা, সর্বোপরি মানবদরদী মন নিয়ে যাবতীয় কর্মের উদ্দীপনা,
তাঁকে শিক্ষক ও ছাত্রমহলে প্রবল জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল
শিশুসুলভ সারল্যে মাখা তাঁর স্মিত হাসি, যা দিয়ে তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীকে
নয়, পরে যেখানে ‘তরুমূলের মেলা, মোদের খোলা মাঠের খেলা’ আর ‘নীল
গগনের সোহাগ-মাখা সকাল-সন্ধ্যাবেলা’, সেই শান্তিনিকেতনকেও ‘সব হতে আপন’
করে নিয়েছিলেন।

১৯০৭ সালের শেষে রুদ্র এবং অ্যানড্রুজের প্রচেষ্টায় সেন্ট স্টিফেন কলেজ সুস্পষ্ট
করে জনসমক্ষে জাতিগত সাম্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে। কলেজে
কোনোরকম রাজনীতির প্রসঙ্গ আলোচিত হবে না – এমন সরকারী নিষেধাজ্ঞাও
উপেক্ষিত হয়। অ্যানড্রুজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন যে, কলেজে সি.আই.ডি-র
উৎপাত, যা থেকে তিনি নিজেও নিস্তার পাননি, ও সরকার কর্তৃক এমন নৈতিক
অবমানা শিক্ষা সংক্রান্ত মূলনীতির একেবারেই পরিপন্থী। কলেজের ভারতীয় ছাত্ররাও
সমতা এবং ন্যায়পরতার দাবিতে সোচ্চার হয়। এই বছর কলেজের অধ্যক্ষ
অবসরগ্রহণ করাতে সরকার কর্তৃক অ্যনড্রুজের নাম বিবেচিত হয়। অ্যানড্রুজ এই
অনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন এবং তিনি সহ-উপাধ্যক্ষ সুশীলকুমার রুদ্রের
নাম প্রস্তাব করেন। এ-বিষয়ে তরুণ ইংরাজ শিক্ষকেরাও অ্যানড্রুজকে সমর্থন
করেন। অবশেষে ইংল্যান্ডের কলেজ পরিচালক সমিতি সেন্ট স্টিফেন কলেজের প্রথম
ভারতীয় অধ্যক্ষ হিসাবে সুশীলকুমার রুদ্রকে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়।
১৯১২ সালে রোটেনস্টাইনের বাড়িতে সেই সান্ধ্য সাক্ষাতের পর কয়েক মাসের
মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অ্যানড্রুজের এক গভীর বন্ধুত্ব রচিত হয় যার সুদৃঢ় বন্ধন
আমৃত্যু অটুট ছিল। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কটা ‘বন্ধুত্ব’ শব্দবন্ধ দিয়ে বিচার্য নয়,
সম্পর্কটা যথার্থ নিহিত আছে সেইখানে যেখানে অ্যানড্রুজ নিজেকে মনে করেছেন
একজন ‘disciple’ ও তাঁর ‘master’ বড় শ্রদ্ধা-ভালবাসার রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের কথা, “my India is an idea, not a geographical expression.
Therefore I am not a patriot – I shall ever seek my compatriots all
over the world.”। সেই রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতন অ্যানড্রুজের মননে এক
অভিন্ন সত্তা। শান্তিনিকেতনকে ঘিরেই তাঁর বিশ্ব-বীক্ষণ। বলছেন অ্যানড্রুজ –“The
circumference of Santiniketan is the larger world, and I have to travel round that circumference in order to be true to the centre.”।
রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি – ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ভারতের এই অবিস্মরণীয় মানুষ
দুটির সম্পর্কের রসায়নটা বড় জটিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে, “A Mahatma, the
emancipated soul that realizes itself in all souls.”; এবং গান্ধীজির বিচারে
রবীন্দ্রনাথ শুধু ‘Bard of Santiniketan’ নন, মানবতার সেই ‘The Great
Sentinel’। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদিত হলেও দর্শনগত
প্রজ্ঞায় এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের অবস্থান ছিল বিপ্রতীপ। এঁদের বিতর্কের মহত্বে
উদ্বেলিত রোমাঁ রোঁলার তো মনে পড়েছে তুলনীয় একমাত্র সেন্ট পল্স আর
প্লেটোকে! আর এমন দুই মহাত্মার মাঝে ঠাঁই পাওয়া এন্ড্রুজ মানবতার নতুন
আলোকে খ্রিস্টকে উপলব্ধি করেছেন। সম্ভবত কথাটা বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের –
“Andrews was a hyphen between Rabindranath and Gandhi.”। বড় সত্যি কথা। আর রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধীজিই বোধ হয় নিজেরা তাঁদের পারস্পরিক
সম্পর্কের নিরিখে অ্যনড্রুজ সম্পর্কে এই মহৎ সত্যটাকে খুব বেশি করে উপলব্ধি
করেছিলেন।

শুধু শান্তিনিকেতনের শিক্ষকতা নয়, শুধু ছাত্রদের নিয়ে অঙ্গে লালামাটি মেখে
খেলাধূলা নয়, নয় শুধু আবাল্য চর্চিত ছবি আঁকা, কবিতা লেখা আর শিল্প-
সাহিত্যের রসাস্বাদনে ডুবে থাকা – বাইরের জগতেও রবীন্দ্রনাথের সহচর হিসাবে
তাঁর নানা ভূমিকা। সুভাষচন্দ্রের প্রতি কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের চরম বিদ্বেষমূল
আচরণের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ যখন সোচ্চার, এবং সেই প্রেক্ষিতে গান্ধীজির
মনোভাবটা যখন স্পষ্ট – “The matter is too complicated for Gurudev to
handle”; যখন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একাকী
রবীন্দ্রনাথের যুদ্ধে পাশে নেই গান্ধীজি – এমনকি চিত্তরঞ্জনও, পাশে থেকে গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের ‘হাইফেন’ হয়ে অ্যানড্রুজের সেই গুরুদায়িত্ব পালনটুকু তো ইতিহাসের
উজ্জ্বল অধ্যায়।

আর একটা কথা, মৃত্যু তো রবীন্দ্রনাথের আজীবন সঙ্গী, যে সম্পর্কে তাঁর নিয়ত উপলব্ধি – ‘তবে তাই হোক’। পাশে থেকে তাঁর এই পরম- পাওয়া মানুষটির গভীর-নিবিড় উপলব্ধিকে ছুঁতে চেয়েছেন অ্যানড্রুজ। ১৯৩২ সালে জার্মানিতে প্রিন্টিং টেকনলজি পড়তে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মীরাদেবীর পুত্র নীতিন্দ্রনাথ। কন্যাকে নীতুর চিকিৎসার জন্য জেনেভা পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। পাশে আর কেউ নেই। অ্যান্ড্রুজ তখন ইংল্যান্ডে; রবীন্দ্রনাথের চিঠি পেয়ে ছুটে গেলেন তিনি; কিন্তু দেরি হয়ে গেল। তাঁর পৌঁছবার আগেই ৭ অগাস্টে মৃত্যু হল নীতিন্দ্রনাথের।
৮ অগাস্টে অ্যান্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন – “আমার হৃদয় এবং অন্তর আপনার
সঙ্গে আছে এবং এই দুঃখের সময়ে আপনি আমার যত কাছে আছেন তেমন আগে
কখনও ঘটেনি।” ভারতবর্ষের সঙ্গে অ্যানড্রুজের সম্পর্কের প্রসঙ্গ এলেই কবির মতো
তাঁকে আমাদেরও নমস্কার জানাতে হয় –
প্রতীচীর তীর্থ হতে প্রাণরসধার
হে বন্ধু এনেছ তুমি, করি নমস্কার।
প্রাচী দিল কণ্ঠে তব বরমাল্য তার
হে বন্ধু গ্রহণ করো, করি নমস্কার।
খুলেছে তোমার প্রেমে আমাদের দ্বার
হে বন্ধু প্রবেশ করো, করি নমস্কার।
তোমারে পেয়েছি মোরা দানরূপে যাঁর
হে বন্ধু চরণে তাঁর করি নমস্কার।

১৯১৪ সালে অ্যানড্রুজের জীবনে আরও এক নতুন দিকের সূচনা। প্রত্যক্ষ
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হল। সূত্রটা অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী
ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষায় গান্ধীজি এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলের আন্দোলন। ফিজি,
জামাইকা, ত্রিনিদাদ, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি স্থানে আখ ক্ষেতে ও কলে কাজের
জন্য চু্ক্তির ভিত্তিতে দরিদ্র ভারতীয়দের নিয়ে গিয়ে প্রকৃত পক্ষে দাসে পরিণত করা হত। আমাদের দেশের অন্যান্য রাজনীতিকরা এই শ্রমিকদের সম্পর্কে কখনও কোনো
আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ১৯১৫ সালে গোখেলের মৃত্যুতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের
দাসত্বমোচনে অ্যান্ড্রুজ সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর অনলস পরিশ্রমে অবশেষে
এই দাসত্বের বিলোপ ঘটে । ১৯১৭ সালে ফিজিতে বন্ধুরা তাঁর মানবদরদী
অবদানের জন্য তাঁকে ‘দীনবন্ধু’ আখ্যায় ভূষিত করে। অ্যান্ড্রুজের এই মহান
ভূমিকার জন্য তাঁর প্রতি ভারতবাসীর অপরিসীম ঋণ থেকে গেছে। মডার্ন রিভিউ
মাসিকের সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, কত পরিশ্রম আর ভারত
সরকারের সঙ্গে কী কষ্টকর দরবার-আলাপে মেটিয়াব্রুজ অঞ্চলে ফিরে আসা
শ্রমিকদের সহায়তা করেছিলেন অ্যানড্রুজ। আমাদের মধ্যে কতজন আছেন যারা
অ্যানড্রুজের এই ভূমিকা সম্পর্কে জানা দূরে থাক শুনেছেন মাত্র! অ্যানড্রুজ শেষবার
দক্ষিণ আফিকায় গিয়েছিলেন ১৯৩৫ সালে।

ভারতে আসার পর অ্যানড্রুজের যাবতীয় উদ্যোগ ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক,
শিক্ষা, শ্রমিক সংগঠন এবং ড্রাগ-বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে। অ্যানড্রুজের কাজের
পরিধির বিস্তার এতই ব্যাপক যে তাকে চিত্রিত করা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের অসাধ্য।
ভাতের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও অ্যানড্রজের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ১৯২৫ সালে
বোম্বাইতে ও ১৯২৭ সালে নাগপুরে দুবার তিনি All India Trade Union
Congress সভাপতি নির্বাচিত হন।১৯২৮ সালে লন্ডনে আয়োজিত কমনওয়েলথ
শ্রমিক নেতাদের সম্মেলনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তা ছাড়া All India
Railwaymen’s Federation প্রতিষ্ঠায় অ্যানড্রুজের ছিল বড় ভূমিকা।
প্রত্যক্ষ রাজনীতি অ্যানড্রুজ করেননি বটে, কিন্তু ভারতের সমস্ত
জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রে লিখে ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ পরাধীনতা থেকে
স্বাধীনতার দাবি ছাড়া ভারতের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। ১৯২০
সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, “ভারতের বেশির ভাগ নেতাই এখনও
তাঁদের শৃঙ্খলকে বুকে আঁকড়ে আছেন। তাঁরা সত্য বলতে ভয় পান – যেমন তাঁরা
গত বছর কথা বলতে ভয় পেয়েছিলেন যখন পাঞ্জাব নিয়ে তোমার আকস্মিক
বজ্রাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছিল।” অ্যানড্রুজের কাছে কাম্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা
‘complete and perfect independence’। ১৯৩৮ সালে গিরিজা মুখোপাধ্যায়ের
সঙ্গে যুগ্মভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা কংগেস দলের একটা ইতিহাস – ‘The
rise and growth of the Congress.
ভাবতে অবাক লাগে, অ্যানড্রুজ তাঁর নিজের দেশবাসীর অনেকের কাছে তাঁর
ভারতপ্রেমের ফলস্বরূপ চিহ্নিত হয়েছিছেন একজন ‘traitor’ হিসাবে। আর সেই সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের সময় থেকে C.I.D. তো বটেই ভারতবাসীর একাংশের মনে
অ্যানড্রুজ একজন ‘spy’ হিসাবে অসম্মানিত রয়ে গেলেন। এখানে আচার্য
জগদীশচন্দ্রের নামটাও উঠে আসে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাস লিখেছেন
–“স্যার জগদীশ ‘মহামতি এন্ড্রুজ’কেও (যিনি দীনবন্ধু এন্ড্রুজ নামে খ্যাত) ব্রিটিশ
গভর্নমেন্টের গুপ্তচর বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন। কিন্তু কবি (রবীন্দ্রনাথ) তাহা
বিশ্বাস করিতেন না। স্যার জগদীশের তৎকালীন সহকারী সুরেশ নাগের নিকট
শুনিয়াছি যে, এন্ড্রুজের বিষয়ে কবির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়া হেতু স্যার জগদীশ
বোলপুর শান্তিনিকেতনে যাওয়া একেবারে পরিত্যাগ করেন…”(আমার জীবন কাহিনী
/ পৃঃ১৩৯)।
পুলিন বিহারী দাসের উদ্ধৃতি অনুসারে অ্যানড্রুজ সম্পর্কে জগদীশচন্দ্রের ধারণার
সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ আমরা এখানে করছি না। কিন্তু এই প্রেক্ষিতে পুলিনবাবুর
উদ্ধৃত সুরেশ নাগের সাক্ষ্যটি নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, অ্যান্ড্রুজের মৃত্যু
১৯৪০ সালে। কিন্তু তারও আগে জগদীশচন্দ্রের মৃত্যু ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭-এ।
১৯৩১ সালেই জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ৭০তম জন্মদিনে (২৫বৈশাখ
১৩৪৩) লিখছেন –
বন্ধু,
জগতের কল্যাণের জন্য তোমার অবিশ্রান্ত চেষ্টা বহু বৎসর ধরিয়া যেন
ফলবতী হয় আজ এই প্রার্থনা করিতেছি। তোমার বিশ্বভারতীর কোন অনুষ্ঠানের
সাহায্যার্থে ৫০০ টাকা পাঠাইতেছি, গ্রহণ করিয়া সুখী করিবে।
তোমার জগদীশ
তা হলে কি সম্পর্কের এমন অবনতির ইতিহাসটা ১৯৩১-এর পরে ওই ক’টা
বছরের, আর শুধু ওই কারণেই? এখানেই প্রশ্নটা।
অ্যানড্রুজ অনুপ্রাণিত হলেন গান্ধীজির অহিংসা ও সত্যাগ্রহর আদর্শে। এই আদর্শই
তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় শক্তি যুগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ‘Master’ বা
‘Gurudev, প্রায় সমবয়সী ভাতৃসম চার্লির কাছে পরম বন্ধু গান্ধীজি শুধুই
‘Mohan’। ‘What I owe to Christ’ গ্রন্থে অ্যানড্রুজ বড় ভাল বলেছেন ১৯১৪
সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের কথা – “Our hearts met from
the first moment we saw one another, and they have remained united by the strongest ties of love ever since. To be with him was an inspiration which awakened all that was best in me, and gave me a high courage, enkindled and enlightened by his own. His tenderness towards every slightest thing that suffered pain was only a part of his tireless search for truth, whose other name was God.”

তবে মনে রাখতে হবে, গান্ধীজির আন্দোলনের শরিক হয়েও বেশ কিছু গুরত্বপূর্ণ
প্রশ্নে অ্যানড্রুরেজের অবস্থান ছিল একেবারেই তাঁর বিপ্রতীপ। যেমন
জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের রাজ-সম্মান ত্যাগের সিদ্ধান্ত
যে গান্ধীজির বিচারে ‘premature’ – মানতে পারেননি অ্যানড্রুজ; যেমন অসহযোগ
আন্দোলনের কর্মসূচী হিসাবে বিদেশী দ্রব্য বয়কট ও বিদেশী বস্ত্র পোড়ানোকে তাঁর
‘গুরু’ রবীন্দ্রনাথে মতো তাঁরও মনে হয়েছে এমন আন্দোলন উগ্র জাতীয়তাবাদেরই
নামান্তর; যেমন অহিংসার বাণী প্রচারের পাশাপাশি ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে
মানুষকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রতিশ্রুতিকে মেনে নেওয়া অ্যানড্রুজের পক্ষে অসম্ভব
ছিল।
বিশ্বভারতীর তদানীন্তন শিক্ষক এবং জালিয়ানাওয়ালাবাগের গণহত্যার পর তথ্য
সংগ্রহ করতে গিয়ে পাঞ্জাবে অ্যানডড্রুজের সফর সঙ্গী গুরদায়াল মল্লিক ‘Christ’s
Faithful Apostle’ – সংক্ষেপে C.F.A. – ধর্ম পরিচয়কে সম্পৃক্ত করে এই নতুন
সংক্ষিপ্ত নামে তাঁর নবজন্ম ঘটিয়েছিলেন। অ্যানড্রুজের প্রতি জওহরলাল নেহরুর
যথাযথ শ্রদ্ধার্ঘ্য – “imaginative insight into the mind and heart of a hurt and and helpless people”। শান্তিনিকেতনের সহশিক্ষক পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী অ্যানড্রুজের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেন। শাস্ত্রীজির বিচার –“ব্রাহ্মণ দুই রকমের – বর্ণ ব্রাহ্মণ বা জাতি ব্রাহ্মণ, আর গুণ ব্রাহ্মণ।… অ্যানড্রুজ সাহেব ছিলেন গুণব্রাহ্মণ,
আমার চোখে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ।”
গান্ধী-কথিত এই ঈশ্বর প্রেরিত (‘Godsend’) ও গভীরভাবে ঈশ্বরতুল্য
মানুষটি (He is an intensely godly man) রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে জানিয়ে
গেলেন তাঁর জীবনের উপলব্ধ চরম সত্যটি – “আমি আগের মতো মিশনারি হতে
পারব না। সে দিন চিরতরে চলে গেছে এবং তুমি আমাকে সেই দাসত্ব বন্ধন
থেকে মুক্তি দিয়েছ।”

১৯২১ সালের জানুয়ারিতে অ্যানড্রুজ বেশ অসুস্থ হওয়াতে তাঁর ‘My dearest
Charlie’কে গান্ধীজির ধমক শুনতে হল – “You had no business to get
ill”। তেমন আশানুরূপ সুস্থ না হওয়াতে আবার লিখলেন, “ঈশ্বরের সৈনিকের পক্ষে
শয্যাশায়ী থাকা কি অপরাধ হবে না?” (Must not be a crime for God’s
soldier to be bed ridden?)। কিন্তু শেষে অবাধ্য তাকে তো হতেই হল!
প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতাল থেকে কলকাতার Reordam Nursing Home-এ
স্থানান্তরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন অ্যান্ড্রুজ ১৯৪০ সালের ৫ এপ্রিল। কবি
তখন শান্তিনিকেতনে। একই সময়ে তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
জীবনও প্রায় নির্বাপিত। ক’দিন পরে তিনিও চলে যাবেন (৩ মে ১৯৪০)। এই
দুই প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-বেদনায় শরীর ও মন ক্লান্ত-অবসন্ন কবির। গান্ধীজি
টেলিগাম করে উদ্বিগ্ন কবিকে অ্যানড্রুজের শরীর সম্পর্কে আশ্বস্ত করার চেষ্টা
করলেন। অ্যানড্রুজের দুশ্চিন্তা পাছে কবি তাঁকে দেখতে আসার ঝুঁকি নেন। এই
কথাও জানিয়ে গান্ধীজি কবিকে বিরত করলেন। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী
হাসপাতালে আসাতে কবি কিছুটা শান্তি পেলেন অবশ্য। আর গান্ধীজি, প্রিয় বন্ধুর
শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে তাঁর সহজাত অভয়বাণী কি শোনালেন –

“Be brave Charlie”? জানি না। প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্য পেয়ে অ্যানড্রুজেরও চোখের
কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল কি পরম তৃপ্তির দু-ফোঁটা অশ্রুবিন্দু? তাও জানি না।
শুধু জানি, নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখা অ্যান্ড্রুজের কাঁপা গলায় ইতিহাসের এক অমোঘ
উচ্চারণ – “Mohan, Swaraj is coming”
ঋণী –
* রবীন্দ্রজীবনী / প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় (২-৪)
* রবিজীবনী / প্রশান্তকুমার পাল (৬-১০)
* রবিজীবন / বিজন ঘোষাল (১-৩)
* রবীন্দ্ররচনাবলী /পঃ বঃ সরকার
* পিতৃস্মৃতি / রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
* রবীন্দ্রনাথের বিদেশী বন্ধুরা / সমীর সেনগুপ্ত
* রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র / নেপাল মজুমদার
* চার্লস ফ্রিয়ার এন্ডরুজ / সুশান্ত নাগ
* আমার জীবন কাহিনী / পুলিন বিহারী দাস
* পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ / অমল হোম
* জগদীশচন্দ্র বসু ।।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – দুই বন্ধুর চিঠি
* C.F. Andrews: Representative Writings / National Book Trust
* The Visvabharati Quarterly / Andrews Number
* The Visvabharati Quarterly / Gandhi Number
* Letters to a Friend / Tagore’s letters to Andrews
- Andrews Papers – 1 & 4 / Dinabandhu Andrews Centenary
Committee - Tagore Studies 1969-1972 / Tagore Research Institute
- The Selected Works of Mahatma Gandhi (Vo.-5)
এখনকার সময়ে এই সব মানুষদের জীবনের কথা আলোচনায় আসা খুব জরুরী।একজন ধর্মযাজক থেকে একজন উঁচুদরের মানবপ্রেমিক হয়ে ওঠার ধারাবাহিক বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়েছি।আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।