একজন বিশিষ্ট কবি যখন কবিতার পাশাপাশি গদ্য রচনায় মন দেন, তখন তাঁর গদ্যভাষায় কি পদ্যের ছাপ পড়ে? এই ছায়া বা প্রভাব কি বাঞ্ছিত? – প্রশ্নদুটি নিঃসন্দেহে প্রাচীন এবং বিতর্কিত।
রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের আধুনিক সাহিত্যিক, যাঁরা কল্লোল যুগের সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ তদানীন্তন বাংলা সাহিত্যের মহীরুহসম প্রবীণ কবির গদ্যভাষায় কবিতার ছায়া বা কাব্যিক চলন নিয়ে কিঞ্চিৎ সমালোচনামুখর হয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথের কর্ণগোচর হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গটি জীবনের প্রান্তবেলায় পৌঁছনো রবীন্দ্রনাথ একটি আলাপচারিতায় বুদ্ধদেব বসুর কাছে উল্লেখ করেছিলেন: “তোমরা আমার ভাষার কথা বল, বল যে গদ্যেও আমি কবি।” (আলাপচারিতার অনুলিপি, ২৪.৫.১৯৪১, রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৫০, সুলভ বিশ্বভারতী)
এই আলাপচারিতায় আত্মপক্ষ সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন: “আমার ভাষা যদি আমার গল্পাংশকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মূল্য পায়, সেজন্য আমাকে দোষ দিতে পারনা। এর কারণ বাংলা গদ্য আমাকে নিজেকেই গড়তে হয়েছে, ভাষা ছিল না, পর্বে পর্বে স্তরে স্তরে তৈরি করতে হয়েছে আমাকে।… গদ্যের ভাষা গড়তে হয়েছে আমার গল্পপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে। মোঁপাসারা মতো যেসব বিদেশি লেখকের কথা তোমরা প্রায়শই বল, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে হলে তাঁদের কী দশা হত জানিনে।” – এ’ তো শুধু জবাবদিহি নয়, নিজের সাহিত্যকৃতী সম্পর্কে এ’ এক অসামান্য আত্মপ্রত্যয়ী উপলব্ধি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম যুগ পেরিয়ে বাংলা গদ্যভাষা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল, সে তো আজ এক অনস্বীকার্য ইতিহাস।
অন্যদিকে সত্যিই কি কবির গদ্যভাষা সেদিন বাঙালির মনের বাতায়ন দিয়ে ভিন্ন খাতে একটা নতুন বাতাস বইয়ে দেয়নি? তাঁর কাব্যসুষমামন্ডিত গদ্যভাষা সে’যুগের বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি মননকে কি সিঞ্চিত করেনি? আজও কি সেই বুদ্ধিদীপ্ত সযত্নলালিত ভাষার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ বোধ করেনা মননশীল বাঙালি হৃদয় ও মস্তিষ্ক? রবীন্দ্রনাথের একের পর এক উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ তো তাঁর তৈরি করা এক নতুন ভাষাশৈলীকে অবলম্বন করেই রচিত হয়েছে। নতুন যুগের আলোয় সাহিত্য রুচি ও আঙ্গিকের পরিবর্তন তাকে হয়তো নিত্যনূতন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে, কিন্তু কবির এই গদ্যভাষা থেকে গেছে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ সম্পদ হয়ে। তাকে অস্বীকার করার বা এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই।
তাঁর প্রায় সব রচনাতেই কবির নিজস্ব গদ্যভাষার নতুন থেকে নতুনতর রূপের সন্ধান করেছেন কবি। রক্তকরবী, শেষের কবিতা, লিপিকা, এবংবিধ অসংখ্য রচনায় তো আমরা এটা দেখেছি। কবির বয়স যত বেড়েছে, ততই নিত্যনূতন পরীক্ষার পথে লেখনী চালনা করেছেন তিনি । রবীন্দ্রনাথের গদ্যের যে বিশেষ ভঙ্গিটি আমাদের নজর টানে, তা হল, তাঁর গদ্যের অনেক জায়গায় মনে হয় যেন কবিতার চরণ পড়ছি। পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ রবীন্দ্রগদ্যে বাড়তে থাকে ক্রিয়াপদহীন বাক্যের সংখ্যা। গদ্যের এই বৈশিষ্ট্য তাঁর গদ্যভাষাকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় আসীন করেছে। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে এই বিশেষ ধারা শুরু। তারপর ‘শেষের কবিতা’ ও ‘দুই বোন’ হয়ে পর্যায়ক্রমে ‘যোগাযোগ-এ এসে যেন এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ‘গোরা’ বা ‘চার অধ্যায়’কেই বা আলোচনার বাইরে রাখি কি করে?
এবং তাঁর পত্রাবলী! কি অনবদ্য গদ্যভাষা দিয়ে আনুমানিক প্রায় ৮০০০ চিঠির ভান্ডার তিনি গড়ে রেখে গেছেন! দৈনন্দিন চিঠিপত্রকে বিষয় ও ভাষার সৌকর্যে যে এত মহিমান্বিত করে তোলা যায়, এমন শাশ্বত রূপ দেওয়া সম্ভব, রবীন্দ্রনাথের মতো আদ্যন্ত জীবনশিল্পী না এলে আমরা হয়তো তা জানতেই পারতাম না। ছিন্নপত্রাবলী তো বটেই, তাঁর বহুধা বিস্তৃত চিঠিপত্রের সুবিশাল ভান্ডারে কবি অমিয় চক্রবর্তী ও হেমন্তবালা দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ তাঁর অননুকরণীয় গদ্য ভাষার সাক্ষ্য বহন করছে।
তাই রবীন্দ্রনথের কবিতার পাশাপাশি কবির গদ্যভাষাও আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে সময়ের এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, যেখান থেকে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব রূপের সন্ধান পেয়েছিল।
“খুব খুব ভাল হয়েছে পত্রিকাটির কন্টেন্ট এবং অন্যান্য যা কিছু সব। লেখকদের লেখার মান কেবল সাধারণ ভাবে ভাল বললে, কম বলা হয়, লেখার মান এবং বিষয়বস্তু অত্যন্ত উঁচুমানের। আমরা যারা দূরে থাকি, কেবল দূর থেকে দেখি আর স্বাদ নিতে চেষ্টা করি আপনাদের অনবদ্য অপূর্ব প্রয়াসের, তাদের কাছে বিস্ময় কেবলই আপনাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আপনাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, মোটকথা আমাদের সকলের বিস্ময়ের রবীন্দ্রনাথকে চিরকালীন অভিনবত্বে আবিষ্কার করার আপনাদের অনিঃশেষ প্রচেষ্টাটিও। আমার শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা জানবেন। ভাল থাকবেন, অনেক ভাল।” — আবু সাঈদ ফিরোজ, ঢাকা, বাংলাদেশ
রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
এ কথা খুব ই সত্যি, রবীন্দ্র -পূর্ব বাংলা ভাষায় ছিল সমাসবদ্ধ পদের সমাহার। বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, মধুসূদনের হাত ধরে যে ভাষা আধুনিক হতে শুরু করেছিল, রবীন্দ্রনাথের হাতে তা সুষমামন্ডিত হয়ে প্রকৃত সাবালক হয়ে ওঠে। ভাষা একটি গতিশীল বিষয়।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাঙাগড়া চলবেই।আজও চলছে।বাঙলা সাহিত্যের ভাষার সেই প্রদোষকালে তাঁর হাতেই রূপ পায় মান্য,প্রমিত বাংলা গদ্য ভাষা।স্বল্প পরিসরে লেখক খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন সমকালীন নতুন লেখকদের সংশয়, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় এবং সামগ্রিক ভাবে বাংলা ভাষার শিল্পীত উত্তরণকে।
আপনার মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। জীবনের প্রথম পর্বে কবি রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষা পাঠ আমার বাংলা ভাষার প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ তৈরি করেছিল। আজও দীর্ঘ সময়কাল পেরিয়ে কবির সেই ভাষার প্রতি আমার আকর্ষণ অক্ষুন্ন রয়েছে। ভাষা অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো বাঁক বদল, দিক বদল করবেই। কিন্তু ঐতিহাসিক মাইলফলকের মত শাশ্বত কালের যাত্রাপথে কিছু নির্মাণ চিরউজ্বল হয়ে থাকবে। সেটা মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের মতো চিরায়ত স্রষ্টাদের সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
একদম ঠিক।
“কবির গদ্য” এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে এক কবি কাব্য গান প্রবন্ধ পত্রসাহিত্য ইত্যাদি নানা সৃষ্টির আড়ালে নিয়ত আর এক নির্মাণ কার্য করে চলেছেন যা বাংলা ভাষাকে অভিনবত্বের চূড়ান্তে পৌঁছৈ দিতে পেরেছিল। আপনার লেখার ভাষা ও শৈলী এবং তার সঙ্গে নানা উদ্ধৃতির সপ্রয়োগে নিবন্ধটি
ভারি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।এই আন্তর্জালিক পত্রিকাটির গৌরবের ইঙ্গিত যেন এই নিবন্ধে।
অশেষ ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই।
গদ্যের সভায় গেলে কবির পা টলবে কি না এই সংশয় হয়েছিল কবি নীরেন্দ্রনাথ। পদ লালিত্য ঝংকার মুছে ফেলা তত সহজ তো নয়। কিন্তু তাতে কি ? আমাদের জীবন পাত্র পুর্ন হল তো, আর কি তোমার চাই। পত্র সাহিত্যের কথা অমৃত সমান। ভাবাই কঠিন কি ভাবে তিনি এই সমান্তরাল ধারা বহমান রেখেছিলেন। তার দিনা ওই আট প্রহরের বেশি তো নয়। সম্পাদক মশাইকে মূল সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্যে সেলাম।
যে পথেই ওঁর পা পড়েছে,সে পথেই তিনি অগ্রপথিক।সে পথেই ওঁর মৌলিক চিন্তা ভাবনা ওঁকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে।এবারের সম্পাদকীয় তার একটি দিক নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছে সুন্দরভাবে।অন্য দিক গুলিও আলোচনার পরিসরে আসবে,এই আশায় রইলাম।
যে পথেই ওঁর পা পড়েছে, সে পথেই তিনি অগ্রপথিক।সে পথেই ওঁর মৌলিক চিন্তা ভাবনা ওঁকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে।তার একটি দিক নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত এবারের সম্পাদকীয়তে সুন্দর ভাবে করা হয়েছে। অন্য বিষয়গুলি আলোচনার পরিসরে আসুক,এই প্রত্যাশায় রইলাম।
কবিতায় বিন্দুতে সিন্ধুকে ধরা যায়, গদ্যের কিছুটা আকাশ লাগে। রবি কবি লিখছেন সকাল বেলা কাটিয়া গেল, বিকাল নাহি যায়। এত সংক্ষেপে একাকিত্ব, বিষন্নতা এবং আরো অনেক কিছু গদ্যে প্রকাশ অসম্ভব। কিন্তু আমাদের গদ্যের ও নিজস্ব ঘর বাড়ি আছে যার ভিত্তি এই ঠাকুর। তরজায় তাকে পাওয়া যাবে না , নিবিড় পথ জরুরি। সম্পাদক মশাইয়ের কৃতিত্ব তিনি তার নাবালক পত্রিকাটির মাথায় অনেক বড় মানুষের হাত পেয়েছেন। তার ও পত্রিকার শ্রী বৃদ্ধি হোক।