ছুটি হইয়াছে। সারাদিনের বৈচিত্র্য বিহীন কাজের উপান্তে পুরুষটি নিজ স্থান হইতে বাটির উদ্দেশে বাহির হইল। শরীরে এখনও নিরাপত্তা রক্ষীর বেশ। এক নিমেষ দেখিলে নিতান্তই বেমানান প্রতীয়মান হয়। তথাপি তাহার আনন্দে কৃপণতা নাই। সঙ্গে থাকা পানীয় জলের বোতলটি বাজাইতে বাজাইতে চলিয়াছে। প্রকান্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণি ক্ষেত্রটির শেষ প্রান্তে পোশাক পরিবর্তনের স্থান। বর্তমানে কর্তব্যরত প্রহরী সদ্য মুক্ত পুরুষটির তল্লাশি করিবে, অতঃপর বাহিরে যাইবার অনুমতি মিলিবে। সকলই অত্যন্ত যন্ত্রবৎ সমাধা হয়। পুরুষটি এক্ষণে উন্মুক্ত আকাশের নিচে দন্ডায়মান। প্রহরীর পরিচ্ছদ আর নাই, এক্ষণে তাহাকে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ রূপে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, উহার চেহারায় এক অন্য পেশাদারের ছাপ রহিয়াছে।
রাত্রি বাড়িয়াছে। রাজপথে যন্ত্রশকটের পরিমাণ হ্রাস পাইয়াছে। তেমনই একটিতে চড়িয়া নিকটবর্তী রেলস্টেশনে পৌঁছাইতে হইবে। রাত্রিকালীন অন্তিম দুই তিনটি রেলগাড়ি অবশিষ্ট, তাহারই একটিতে কোন প্রকার নিজের শরীরটিকে গুঁজিয়া দিতে পারিলে, একটি দিবস কাটিয়া যায়।
চলন্ত রেলগাড়ির অন্তিম লগ্নের যাত্রীদিগের অধিকাংশই শ্রমজীবী। গ্রাম হইতে উঠিয়া আসা মানুষের দল, শহরের বিবিধ বিপণিতে, ক্ষুদ্র অথবা মাঝারি শিল্পসংস্থায় কর্মীরূপে শ্রমদান করেন। সমস্তদিনের ঘর্ম নিঃস্বরণের পর নিজ নিজ আলয়মুখী হইয়াছে। ইঁহারা, কলকারখানায় কর্মরত সংগঠিত শ্রমিক নহেন। কলকারখানার শ্রমিকগণ মূলতঃ তৎসংলগ্ন অঞ্চলেই বসবাস করিয়া থাকেন। গ্রাম হইতে দূর শহরে আসিয়া প্রাত্যহিক শ্রমদানের জীবিকায় নিয়োজিত মানুষের সংখ্যাটিও অপ্রতুল নহে, তথাপি তাহারা মূল সমাজের মনযোগের আকর্ষণে ব্যর্থ।
সেই সকল সহযাত্রীদের ভিতর এই পুরুষটি তাহার বুদ্ধিদীপ্ত মুখমন্ডলের জন্য অথবা অন্য কোন বৈশিষ্ট্যর কারণে কিঞ্চিত বিসদৃশ। সারাদিনে প্রায় আট নয় ঘন্টা দাঁড়াইয়া প্রহরা কর্তব্য করিবার পর, রেলগাড়িতে সামান্য বসিবার সুযোগ পায়, সেক্ষণে চক্ষু মুদিয়া যায়।
গন্তব্য স্টেশন পৌঁছিতে আরও একটি ঘন্টা কাটিয়া গিয়াছে। গ্রাম্য স্টেশনটির চারিপাশে সকল বিপণির বাতি নিভিয়া রহিয়াছে। পুরুষটি আঁধার দেখিয়া নিশ্চিন্ত হয়। তাহার এই পরিশ্রমক্লিষ্ট শরীরটিকে নিজ লোকালয়ের পরিচিত মহল হইতে যতদূর সম্ভব গোপন রাখিতে সচেষ্ট হয়। সপ্তাহ দুই তিন পূর্বে ঘটিয়া যাওয়া একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে অসম্ভব অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়িয়াছিল, তাহার সীমা পরিসীমা নাই। বিপর্যস্ত হইয়া আত্মহননের মতো চিন্তাও আসিয়া পড়িতেছিল, ঠিক সেই সময়, পূর্ব কর্মক্ষেত্রের পরিচিত এক ব্যক্তি তাহাকে এই প্রহরীর কাজের সন্ধান দেন। অতঃপর অন্তত কোনক্রমে দিনভর কর্মরত হইয়া ব্যস্ত থাকিবার উপায় ঘটে, যাহা অলস মস্তিষ্ককে বিরূপ আচরণ হইতে সামান্য হইলেও বিরত রাখিতে সক্ষম হইয়াছে। যদিও ইহাতে আর্থিক ও সামাজিক স্থান পূর্বাবস্থার সহিত তুলনীয় নহে।
নিকষ অন্ধকারের ভিতর নিজেকে কতকটা আড়াল করিয়া মূল রাস্তা হইতে নামিয়া আলের পথ ধরিয়া নিজ গৃহের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হইতে থাকে। অকস্মাৎ একটি সাইকেল আসিয়া দাঁড়ায়। সাইকেল আরোহী একটি কিশোর। সে বলিয়া ওঠে, “স্যার, চলে আসুন। আমি পৌঁছে দিচ্ছি।” নির্জন রাত্রিতে ক্লান্ত পথিকের নিকট এ হেন সাহায্য বার্তা আসিলে
সকলেই খুশি হইত, কিন্তু পুরুষটি যেন তড়িতাহত হইল! সে কোনক্রমে “না রে! আমি হেঁটেই যাচ্ছি।” বলিয়া ক্ষেতের আল বরাবর ছুটিতে লাগিল। চন্দ্রহীন ধূসর যামিনীতে সে পলাতক বাতাসের ন্যায় নিজেকে গোপন রাখিবার সকরুণ চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। উচ্চতম আদালতের রায়দানের পর হইতে সে ভুলিতে চায় তার পূর্বতন শিক্ষক পরিচিতি।
নতুন বৎসর আসিয়া পড়িল, আলের উভয় পার্শ্বে নবীন ধান্যশীর্ষে ফসল আসিয়াছে, তাহাদের সবুজ রঙ, এই রাত্রির অন্ধকারে বর্তমান সমাজের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণরূপে প্রতীত হইতেছে। তাহার মধ্য দিয়া উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটিয়া যাওয়া একটি শিক্ষিত বঙ্গসন্তান, সম্পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে তাহার চূড়ান্ত ব্যর্থতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া ব্যঙ্গ করিতে লাগিল। অসহায় সহনাগরিকের দল, মুখ লুকাইতে কোন অবগুন্ঠন খুঁজিয়া লইবে বুঝিতে পারে না।

সুধী,
১৪৩২-এ নববর্ষে রবিচক্র আন্তর্জালিক পত্রিকা দ্বিতীয় বৎসরে পদার্পন করিল। প্রতি মাসে দুটি করিয়া সংখ্যা নিয়ম করিয়া প্রকাশ করিতে পারিব কিনা, ইহা লইয়া যথেষ্ট সন্দেহর অবকাশ ছিল। কিন্তু আপনাদের মতো পাঠককুল পাইয়া আমরা অভিভূত। সেই সঙ্গে, বেশ কয়েকজন বিদগ্ধ লেখক আসিয়া হাল ধরিলেন। তাহাদের নিয়মিত লেখণী সিঞ্চনে চারাগাছটি প্রাণ পাইল, একটি একটি করিয়ে নতুন পাতার পরিস্ফুটন ঘটাইতে সক্ষম হইল।
চূড়ান্ত অসুন্দর সময়ে নিরন্তর সুন্দরের চর্চা করাই আমাদের প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা। সে ভাষাকে দৃঢ় করিয়াছেন লেখক এবং পাঠক- আপনারা, আপনাদিগের সহৃদয় মনসংযোগ দ্বারা। সেই আগ্রহ দেখিয়া আমরা উৎসাহিত হইয়াছি এবং উক্ত চালিকাশক্তি দ্বারা এক বৎসর পারও হইয়া গেল।
আজ নববর্ষে আশার কথা লিখিতে ইচ্ছা করিলেও, বাঙলার প্রতিটি সচতেন নাগরিকের ন্যায় রবিচক্রও শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটিয়া যাওয়া অবর্ণনীয় ক্ষতির যন্ত্রণায় বিদ্ধ।
কামনা করি, সমস্ত “ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে” আমরা যেন সত্যের আগুন জ্বালাইতে পারি, নববর্ষে এই হউক আমাদিগের অঙ্গীকার।
ভবদীয়
সম্পাদকীয় দপ্তর


রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
একরাশ বিষন্নতা লইয়াই পড়া শুরু করিলেম। বিষয়বস্তু, উপস্থাপন, ঘটনার বাস্তবিকতা অতীব প্রাসঙ্গিক। তমসাচ্ছন্ন পথ আরও তীব্র অমানিশায় আবৃত হইলো। ভাষায় অবগাহন করিয়া, ক্রমশঃ বিমুগ্ধ হইলেম। লেখকের অতি বলশালী লেখনীর প্রমাণ আরও একবার পাইলেম।
যারপরনাই প্রীত হইলেম। লেখনী সুরঞ্জিত হউক।
ইতি
২রা বৈশাখ, ১৪৩২
নবদ্বীপ
ভবদীয়
গণদীপ বিশ্বাস
চোখে জল এসে গেলো।
সাধু ভাষার প্রয়োগ শরৎচন্দ্র কে মনে পড়ালো।
কিন্তু শেষ পংক্তির কাছটা এতো হৃদয় বিদারক।
আমাদের টেবিল এ আমাদের ভগিনী প্রতীম একজনের আদালতের রায় সব স্বপ্নই শেষ হয়েছে। আমাদের সমস্ত জুনিয়র দের মধ্যে সেরা ছিল। দু রাত ঘুমাইনি। চোখের সামনে কী দেখে যেতে হচ্ছে বলে বোঝাতে পারছি না। স্কুলে সর্ব সাকুল্যে তিনজনের গেছে। দুজন গ্রুপ সি আর ডি ছিল। এদের মধ্যে একজনের আগেই omr প্রকাশিত হয়েছিল নেট এ। বিশ্বজিৎ বসুর রায় অনুযায়ী। তাকে নিয়ে আমরা অতো ভাবিনি। কিন্তু আরেকজন সেই সুদূর গ্রাম থেকে স্কুটি তে আসত শহরে। ছোট শিশুর মা। আজ থেকে তার আসা বন্ধ।
স্কুলে যে কী থমথমে পরিবেশ। কিছু আর ভালো লাগছে না।
Anonymous