শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বঙ্গজীবনের পাঁচালী – চোদ্দ শতক (পর্ব – ৪)

বিশের দশকের এক নতুন বিস্ময় –
পর্দায় মানুষ নাচে, করে অভিনয় ।।
বিনোদনে ছায়াছবি নবীন মাধ্যম,
কত গুণী নট ও স্রষ্টা ঢালি নিজ শ্রম
গড়িল এ তিলোত্তমা শিল্প-সুষমায়,
সকলের উল্লেখের নাহিকো উপায়।।
শতকের প্রথমেই সিনেমার আগমন,
ছায়াছবি বাণীহীন ছিল যে তখন।।
সে যুগেও নির্দেশনা, পরিবেশনায়
বাঙালি কৃতীর দান লক্ষ করা যায়।।

ওপরের সারিতে বাম থেকে ডানে হিমাংশু রায়, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু,
নিচের সারিতে বীরেন সরকার, বিমল রায়, হীরালাল সেন ও নীতীন বসু

ধীরেন্দ্রনাথ, হীরালাল আর বীরেন সরকার,
হিমাংশু রায় আদি নাম কত বলি আর ।।
তিরিশের দশকে কথা ফোটে সিনেমায়,
দেবকী, প্রমথেশ, নীতীন আর বিমল রায় —
বাংলাদেশের এইসব চলচ্চিত্রকার
নানা স্বাদের ছায়াছবি দেন উপহার ।।
সাহিত্যভিত্তিক ছবির পরিবেশনায়
নিউ থিয়েটার্সের দান ভোলা নাহি যায়।।

ওপরের সারিতে বাম থেকে ডানে অহীন্দ্র চৌধুরী, ছায়া দেবী, কানন দেবী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,
নিচের সারিতে মধু বসু, যমুনা বড়ুয়া, চন্দ্রাবতী দেবী ও সাধনা বসু

দুর্গাদাস, কাননবালা, অহীন্দ্র, প্রমথেশ
অভিনয়ে রেখে যান দীর্ঘস্থায়ী রেশ।।
চন্দ্রাবতী, ছায়া দেবী, যমুনা বড়ুয়া
নারী চরিত্রায়নে দেন প্রতিভার ছোঁয়া।।
নির্দেশনা, নৃত্যেগীতে পরিচিত অতি
মধু ও সাধনা বসু কৃতী এ দম্পতি ।।

[ ধূয়া – আহা, বেশ বেশ বেশ! আহা, বেশ বেশ বেশ বেশ!]

ছবি বিশ্বাস, অশোক কুমার ও পাহাড়ী সান্যাল

ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, অশোক কুমার —
ইত্যাকার সমাবেশ কত তারকার ।।
নির্দেশনা, সংগীতে আর অভিনয়-কৌশলে
বাঙালি গুণীরা দীপ্ত প্রতিভার বলে ।।
বাংলা ছাড়াও হিন্দি ছবির পর্দায়
বাঙালি কুশলীরা খ্যাত নিজ গরিমায়।।
সঙ্গীতে কে সি দে আর পঙ্কজ, হেমন্ত,
মান্না, জগন্ময় প্রমুখের দান অফুরন্ত।।

পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, জগন্ময় মিত্র ও মান্না দে

সিনেমা-দুনিয়ার বাইরে সংগীতের বাণী
প্রচারে অবদান যোগায় গ্রামোফোন কোম্পানি।।
ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া,
কে মল্লিক সংগীতে ভাসান বাঙালির হিয়া।।
এছাড়া নজরুল, ভীষ্মদেব, দিলীপ রায়,
আব্বাসউদ্দিনের গান সবারে মাতায়।।

ওপরের সারিতে বাম থেকে ডানে আব্বাসউদ্দিন, দিলীপকুমার রায়, আঙুরবালা, নজরুল ইসলাম,
নিচের সারিতে ইন্দুবালা, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও কমলা ঝরিয়া

এই শতকে কলকাতায় বেতারের পত্তন
বাংলা সংস্কৃতির করে নব উন্মোচন ।।
কেন্দ্রের পরিচালক হন নৃপেন মজুমদার
সঙ্গে রাইচাঁদ, হীরেন বসু, নলিনী সরকার —
নানা দিকপাল গড়েন এই বেতার কেন্দ্রের ভিত
নজরুল, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, শরৎ পন্ডিত।।
পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন ভদ্র ও বাণীকুমার —
তিনে মিলি বাঙালিকে দেন উপহার
স্তোত্রগীতিনাট্য মহিষাসুরমর্দিনী; –
শরতে এ বাঙালির হৃদয়-রাগিনী।।

★★★ ★★★ ★★★

ওপরের সারিতে বাম থেকে ডানে (দাদাঠাকুর) শরৎচন্দ্র পন্ডিত, রাইচাঁদ বড়াল, বাণী কুমার,
নিচের সারিতে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও নলিনীকান্ত সরকার

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক ঘটনাবহুল
যুদ্ধ-দাঙ্গা-মহামারী-মৃত্যুসমাকুল ।।
অর্থনৈতিক মন্দায় পঙ্গু বাংলার মধ্যবিত্ত,
সংস্কৃতির ডাকে তবু জাগ্রত তার চিত্ত।।
ভারতের নানা স্থানে সাম্যবাদী জন
গড়ে তোলে সাংস্কৃতিক গণসংগঠন।।
দেশ ও বিশ্ব দুই ক্ষেত্রেই সচেতন বঙ্গ-
গড়ে ওঠে সেথাও প্রগতি লেখক সংঘ
সাম্যবাদ ও বিশ্বশান্তি, যুদ্ধবিরোধিতা
প্রচারে রচিত গল্প, গান আর কবিতা
দিকে দিকে ছড়াইতে কর্মীরা প্রস্তুত —
সোমেন চন্দ, মুনীর আর আব্দুল ওদুদ।।
আরো এক সংগঠন এই সংগ্রামের অঙ্গ–
ফ্যাসিবিরোধী লেখক আর শিল্পী সংঘ
মড়কেও শিল্পীদের থামেনি সৃজন,
ক্যালকাটা গ্রুপ চিত্রীদলের হইল পত্তন।।
পঞ্চাশের মন্বন্ত্বর কিংবা তেভাগা আন্দোলন
সবেতেই সাড়া দেয় বাংলার শিল্পীগণ।।
এই পর্বে দুই শিল্পীর তূলিতে কী জোর –
জয়নুল আবেদীন আর সোমনাথ হোড়।।
গানে-নাট্যে-সাম্যাদর্শে উদ্বেলিত বঙ্গ।
নব ইতিহাস রচে গণনাট্য সংঘ।।
শ্রমজীবী অবজ্ঞাত মানুষের আকাঙ্ক্ষা
গানে-নাট্যে রূপ দিতে চলিল পরীক্ষা।
গণনাট্য সংঘ এল এই ধারা বেয়ে,
কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা এ।।
রাজনীতির বাইরেরও লেখক শিল্পীগণ

সফল করেন এই নাট্য আন্দোলন :-
উৎপল, বিজন, শম্ভু, হেমাঙ্গ, হেমন্ত,
জ্যোতিরিন্দ্র, সুচিত্রা, সলিল, দেবব্রত।।
সাম্যবাদ ও বামপন্থার স্বপ্ন চোখে নিয়ে
কত কবি, শিল্পী, নট আসেন যে এগিয়ে।।
[ ধুয়া:- বেশ , বেশ বেশ! আহা বেশ বেশ বেশ!]

ওপরের সারিতে বাম থেকে ডানে শম্ভূ মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য্য, সলিল চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র,
নিচের সারিতে দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও উৎপল দত্ত

দিনেশ দাস, বিমল ঘোষ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়-
বামপন্থী এ কবিরা ভাবনায় ও চিন্তায়।।
রবিশঙ্কর, শেখর চ্যাটার্জি, জোছন দস্তিদার —
গণনাট্যকর্মীদের নাম বলি কত আর !
মজুতদারি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসের বিরুদ্ধে
সামিল এই শিল্পীদল সাংস্কৃতিক যুদ্ধে।
আরেক কবির কথা না বলা পর্যন্ত
সম্পূর্ণ হবে না সাম্য-স্বপ্নের এ বৃত্তান্ত।।
শোষণহীন সমাজের স্বপ্নে ছিল যে বিভোর-
সুকান্ত ভট্টাচার্য নামে সে কবিকিশোর ।।
নবজাতকের জন্য সরাবে জঞ্জাল,
জীবনের বৃন্ত থেকে ফুটন্ত সকাল–
আনবে ছিঁড়ে– এই স্বপ্ন পূরণের আগে
জীবনান্ত হল তাঁর হায়, ক্ষয় রোগে।।

● সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ছাড়পত্র :-
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হ’ল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।…
চ’লে যাব — তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাবো আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥
“●

★★★ ★★★ ★★★

চল্লিশের দশকে সুভাষ নেতা দৃঢ়মতি
হরিপুরায় হইলেন কংগ্রেস সভাপতি।।
চোখে তাঁর দূরদৃষ্টি, হৃদয়ে সাহস,
সাম্রাজ্যবাদের সাথে না করে আপোষ।।
অক্লান্ত সংগ্রামের বাণী তাঁর অবদান-
সমাজবাদ ও শিল্পায়নের জানান আহ্বান।।
এ আহবানে রূপ দিতে সুভাষ তৎপর
ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গড়েন অতঃপর।।
প্রাচীনপন্থী গান্ধী ও তাঁর অনুগামীগণ
পছন্দ করেন না এই নবীন দর্শন।।
পরের বছর তাঁরা চান অন্য সভাপতি —
সুভাষের মতে তাতে আদর্শের ক্ষতি।।
এর ফলে গান্ধীবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী সাথে
ভোটাভুটি হলে সুভাষ জয়ী হন তাতে।।
রুষ্ট গান্ধী সহ যত রথী মহারথী
রচিলেন যে ষড়যন্ত্র — লজ্জাকর অতি!
সুভাষ গঠিত কার্যকারী সভা থেকে
বারোজন পদত্যাগ করেন একে একে।।
সহযোগ না পাওয়াতে সুভাষ তখন

সভাপতি পদ তাঁর করেন বর্জন।।
কিন্তু কংগ্রেস যেন অবিলম্বে নামে
ব্রিটিশ শাসক সনে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে —

এই মর্মে সুভাষচন্দ্র চালাইয়া প্রচার
কার্যত কংগ্রেস হতে হন বহিষ্কার।।
[ধূয়া – ধিক ধিক ধিক! ওরে ধিক, শত ধিক!]

এ সংকটে সুভাষের লাঞ্ছনা দেখিয়া
রবীন্দ্রনাথ দাঁড়ান পক্ষপুট বিস্তারিয়া।।
পক্ষীমাতা করে রক্ষা যে ভাবে শাবককে,
বঙ্গকবি শক্তি দেন বাংলার নায়ককে ।।
সুভাষের স্বপ্নসৌধ মহাজাতি সদন —
কবিগুরু করেন তার ভিত্তি সংস্থাপন।।
সুভাষকে ব্রাত্য করে কংগ্রেস যখন,
দেশনায়করূপে তাঁকে করিয়া বরণ
স্বপ্ন দেখেন কবি সুভাষ এইবার
স্বদেশের চিত্তে নব প্রাণের সঞ্চার
করিবেন ঘুচাইয়া দাসত্ব-বিভীষিকা,
দেশলক্ষ্মী তাঁরই ভালে দিবেন জয়টীকা।।
এ আশায় তাঁর হস্তে করেন অর্পণ
তাসের দেশ নাটিকার নব সংস্করণ ।।
জুড়ে দেন সুভাষের উদ্দেশে লেখা গান–
স্বদেশ-তরীর যিনি কান্ডারী মহান!


★ রবীন্দ্রনাথের গান –
খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে
ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো!
তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল —
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো।।…
“★

কবি চান এ বিরোধে গান্ধীর হস্তক্ষেপ —
বাঙালির ক্ষতে পড়ুক শান্তির প্রলেপ!
না গণিয়া গান্ধী বাঙলার ব্যথা ও সম্মান

রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব করেন প্রত্যাখ্যান।।
[ধুয়া- আগে কহ আর, আহা, আগে কহ আর!]

না দমিয়া বীর মুক্তিতৃষ্ণায় চঞ্চল
গড়িলেন ফরওয়ার্ড ব্লক নামে দল।।
শংকিত ইংরেজ তাঁকে অন্তরীণ করে,
কৌশলে পালান তিনি ছদ্মবেশ ধরে।।
দুর্গম যাত্রার শেষে জার্মানিতে এসে
আবির্ভাব হল তাঁর নেতাজীর বেশে।।
ভারতীয় সেনাদল এক করিয়া গঠন
স্বাধীন ভারত কেন্দ্র করিলেন স্থাপন।।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x