শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর (প্রথম পর্ব)

অনাদি কাল হতে মানুষের মনে ঈশ্বর ভাবনা বা ঈশ্বর চেতনা এক জটিল প্রপঞ্চের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। মানুষ ঈশ্বরের স্বরূপ সন্ধান করেছে তার মানবজন্মের প্রায় শুরু থেকেই। বুঝতে চেয়েছে “ঈশ্বর” কী? জানতে চেয়েছে, তার সর্বব্যাপী অনুসন্ধিৎসা দিয়ে সে জানতে চেয়েছে, ঈশ্বর আসলে ঠিক কী? নিত্যের মধ্যে এক অনিত্য, নাকি অনিত্যের মধ্যে এক সর্ব-চেতন নিত্য! ঈশ্বর কি ভূমা যা এক বহুত্বের সমার্থক প্রজ্ঞা, নাকি ঈশ্বর এক জগতময় প্রেম পদবাচ্য।

দেখা যায়, প্রচলিত ধর্মদর্শনের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে মানুষের আরো গভীরতর অনুসন্ধিৎসার মধ্যে ঈশ্বরের “এক নিত্য রূপ” বিরাজ করে, তবু সেটিই কি তার শেষ চিন্তা বা শেষ প্রজ্ঞা, ঈশ্বর বিষয়ক? নাকি ঈশ্বর আরো দূরের কোনো এক নিত্য-চেতন? যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবু সে থাকে, জীবনের মাঙ্গলিক আভাষ হয়েই থাকে? এসব প্রশ্ন এসেছে, গেছে অনাদিকাল হতে। মানুষ খুঁজেছে, প্রাণের অনিঃশেষ আকুতি নিয়ে খুঁজেছে তার ঈশ্বরের স্বরূপ। তারপরও জানেনা সে, পেয়েছে নাকি পেয়েও পায়নি তার শেষ প্রজ্ঞার ঈশ্বরকে। তাই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে মানুষের ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞান অন্বেষণের প্রপঞ্চ।


এরই মধ্যে আবার কিছু মানুষ প্রচলিত প্রথাবদ্ধ ধর্ম এবং ধর্ম নির্দেশিত ঈশ্বরকে সন্দেহ করতে চেয়েছে , শুরু থেকেই এর প্রবল রূপের প্রকাশ দেখে, এর কথিত দয়া এবং করুণার আড়ালে লুকোনো দয়াহীনতার কাঠিন্য দেখে। আসলে মানুষ, রূপের মধ্যে অরূপকে পেতে চায়, রূপের মধ্যে “আনন্দস্বরূপ”-কে দেখতে চায়, রূপের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রবলতাকে নয়। তাই মানুষের ঈশ্বর কল্পনায়, তার কল্পিত ঈশ্বরের গুণপনার মাঝে সত্যিকারের প্রেম এবং করুণা যেন বিরাজ করে, এটাই কিন্তু মানুষ চায়।

প্রচলিত প্রথাবদ্ধ নয়, এ জগতে ব্যতিক্রমী ঈশ্বরের রূপ যাঁরা কল্পনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তবে ধারণা করি মানুষের ভুল হয় তখন, যখন দেখা যায় যে রবীন্দ্রনাথকে প্রচলিত ধর্মদর্শনের হিন্দু থেকে ব্রাহ্ম, বহু-ঈশ্বরবাদী থেকে একেশ্বরবাদী এমনকি কেবল মানবতা তথা মানবধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলে তাঁর ধর্মদর্শনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে প্রয়াস পান। অথচ সমগ্র রবীন্দ্র সৃষ্টির নির্যাসকে খুব সংবেদন দিয়ে লক্ষ্য করলে আমরা অবশ্যই দেখব রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের প্রতিদিনের আওড়ানো ধর্মদর্শনের বিষয় থেকে অনেক দূরে নিজেরই সৃষ্ট ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় খুঁজেছেন প্রতিনিয়ত। চেষ্টা করেছেন তাঁর হৃদয়ভ্যন্তরের প্রেম এবং অপরিমেয় বিস্ময় দিয়ে অন্তরতর এক ঈশ্বরের স্বরূপ জানতে এবং প্রকাশ করতে।

কে গো অন্তরতর সে
আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে॥
আঁখিতে আমার বুলায় মন্ত্র, বাজায় হৃদয়বীণার তন্ত্র,
কত আনন্দে জাগায় ছন্দ কত সুখে দুখে হরষে॥
সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে–
তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
কত দিন আসে কত যুগ যায়, গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
নানা পরিচয়ে নানা নাম ল’য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥

তবে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের প্রকাশ সেখানে নয়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ধর্মদর্শন নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে সরাসরি লিখেছেন (যেমন তাঁর প্রবন্ধে বা গল্পে), রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের প্রকাশ, বা বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিলীন হয়েছে তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীতে। পরিপূর্ণ ভাবে বিলীন হয়েছে অবিমিশ্র চেতনার অজস্র সঙ্গীতে। মানতেই হবে একথা যে, সমগ্র রবীন্দ্রসৃষ্টির মধ্যে তাঁর সঙ্গীত কেবল শ্রেষ্ঠই নয়, তাঁর সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাবে সেসব কথা বলেছে, তাঁর সৃষ্ট ঈশ্বর নিয়ে সেসব গান গেয়েছে, যা তাঁর আর কোন সৃষ্টিই বলেনি বা বলতে পারেনি। আর তাঁর এসব কাজের সঙ্গে প্রকৃতি,অর্থাৎ অকৃপণ অবগুন্ঠন্মুক্ত বিশ্বপ্রকৃতি থেকেছে সব সময়ই তাঁর সঙ্গে অজস্র সব ঘটনার অপূর্ব নিয়ামক হতে।

রবীন্দ্রনাথের একটা নেশা ছিল! নিজের মতো করে নিজের চারপাশের প্রকৃতির ছোট, বড়, ক্ষুদ্র, বৃহৎ সব ধরনের আয়োজনকে সঙ্গে নিয়ে এক মহৎ সৃষ্টির খেলাতে নিমগ্ন হবার নেশা। আর এই নেশার মধ্য দিয়ে কত ভাবে, কত ভঙ্গিতে যে তিনি তাঁর একান্ত ঈশ্বর, নিজস্ব ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছেন, তার কাছ থেকে মহৎ আনন্দের স্বরূপ জেনেছেন, পথ জেনেছেন, তার পরশ পেয়ে পথের দুঃখতাপ ভুলে অমৃতলোকে পৌঁছনোর দীক্ষা নিয়েছেন, তার কোন শেষ নেই।


পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্খানে
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে ॥
কী অচেনা কুসুমের গন্ধে, কী গোপন আপন আনন্দে,
কোন্ পথিকের কোন্ গানে ॥
সহসা দারুণ দুখতাপে সকল ভুবন যবে কাঁপে,
সকল পথের ঘোচে চিহ্ন সকল বাঁধন যবে ছিন্ন
মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে–
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে ॥

কেমন করে বলেন তিনি এ কথা? সকল পথের চিহ্ন যখন অবলুপ্ত, সকল বন্ধন যখন ছিন্ন, মৃত্যু যখন আমার দ্বারপ্রান্তে এসে আঘাত করে আমার এই ক্ষুদ্র প্রাণে, তখনও “তুমি”! কোথা হতে যেন অতি সঙ্গোপনে তুমি আমার কাছে আসো, তোমার স্পর্শের সঙ্গে একান্তে তোমার এক অমৃতপরশও আসে আমার হৃদয়ে, আর এসে সবার অলক্ষ্যে আমাকে, আমার এই প্রাণে, আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার সে পরশ তুমি বুলিয়ে দাও। এ তুমি এক মহৎ তুমি, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের পটভূমিতে যেন মহৎ জীবনের অনুপ্রেরণা হয়েই আসা, মহৎ প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে আসা আমার হৃদয়েশ, আমার জীবনদেবতা, একান্তে প্রকাশ পাওয়া আমার একান্ত ঈশ্বর।

জীবনদেবতা, অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথ কথিত জীবনদেবতাই রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক মঙ্গলময় অনুপ্রেরণার ঈশ্বর, তাঁর সব কর্মের সদর্থক চালিকাশক্তি। তবে আমি মনে করি, কেবলমাত্র জীবনদেবতার ধারণাই রবীন্দ্রনাথের জীবনে পরিপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণা নয়, অন্তত আমার তেমন মনে হয় না। তাহলে কী আছে বা আর কী কী আছে তাঁর পরিপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে? আছে, অনেক কিছুই আছে। ফুল আছে, পাখি আছে, দখিনা বাতাস আছে, নাচ আছে, গান আছে, নিত্য বাজা বীণা আছে, পথের ধূলাবালি আছে, ঘাসের উপরে জমে থাকা ঊষার শিশিরবিন্দু আছে, মাঘের আমের মুকুল আছে, নদী আছে, সাগর আছে, নীল আকাশ আছে, বরিষণমুখর শ্রাবণ-সন্ধ্যা আছে, আনন্দ আছে, দুঃখ আছে, শোক আছে, জীবন আছে, মৃত্যুও আছে আর এ সবকিছুই আছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। কিন্তু এত “আছে”র সমারোহে, এ ধারণা আমাদের পক্ষে করা খুবই স্বাভাবিক যে, মানুষের জীবনের প্রতিদিনের অনুষঙ্গ, ক্ষুদ্র তুচ্ছ অনুষঙ্গ কী করে, কোন মহান কারণে মানুষের ঈশ্বর রূপে বিবেচিত হয়, বা মানব জীবনে ঈশ্বর হয়ে ওঠে?

ঈশ্বর তো হলেন সৃষ্টিকর্তা, আব্রাহামিক ধর্মমত অনুসারে ঈশ্বরের প্রাথমিক এবং প্রধান গুণ বা গুণের বৈশিষ্ট্য হল ঈশ্বর সৃষ্টি করেন, ঈশ্বর স্থিতি এবং লয়ের সূত্রধরও, অর্থাৎ সৃষ্টি এবং লয়ের আদি-অন্ত সব তারই আওতাধীন, সেই একই কারণে মানুষের শাস্তির বিধানও তিনিই করতে পারেন। এসব গুণ থাকাতে গতানুগতিক ভাবনার এ ঈশ্বর অত্যন্ত ফর্মাল, অত্যন্ত স্মার্ট। মধ্যযুগে এই ঈশ্বরের দাপট ছিল প্রচণ্ড, অথবা বলা ভালো, এ ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে যাজক সম্প্রদায়ের দাপট এতটাই বেড়েছিল যে একজন মঙ্গলময় ঈশ্বরের ধারণা পেতে মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছিল। আর এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের জন্য মানবিক ঈশ্বরের এক ব্যতিক্রমী রূপ প্রস্তাব করেছিলেন লেট রেনেসাঁসের দার্শনিক ডাচ বংশোদ্ভূত বারুখ স্পিনোজা। স্পিনোজা ছিলেন সর্বপ্রাণবাদী অদ্বৈতবাদী। স্পিনোজার মতে- ঈশ্বর এবং জগৎ অভিন্ন। কাজেই অতিজাগতিক ঈশ্বরের সন্ধানে দৃশ্যমান জগতের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিতে বাঁচেন ও আন্দোলিত হন। (গড মুভস অ্যান্ড লিভস্ ইন নেচার।) সমগ্র বিশ্ববহ্মান্ডই ঈশ্বর। সেই পরাক্রমশীল ঈশ্বরের বন্দনা হয় না। কেবল অনুভব করা যায়। ধর্ম ছাড়াও যে ঈশ্বর থাকতে পারেন, মানুষের ধর্মবোধ ছাড়াও যে একজন ঈশ্বর, ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন সেই ব্যতিক্রমী ধারণা দিলেন স্পিনোজা সপ্তদশ শতাব্দীতে। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন সেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই ঈশ্বর কাউকে উদ্বিগ্ন করে না, ভয় দেখায় না, শাস্তিও দেয় না।

আর রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় সকল সঙ্গীতে এক অপার বিস্ময়ের সঙ্গে নানান রূপের নানান উপাদানে বা অনুষঙ্গে (যে সকল উপাদানের অনেকগুলির কথাই বিবৃত করেছি আগে) আবিষ্কার করেন, সমগ্রে তা এক মাঙ্গলিক কিন্তু এক আনমনা ঈশ্বর। সৃষ্টির আনন্দে বিভোর হন না রবীন্দ্রনাথের সেই ঈশ্বর, বরং বিভোর হন আনন্দের সৃষ্টিকে দেখতে এবং দেখাতে। তাই তার পূজা যখন হয় মন্দিরে, তখন আনমনা থাকেন তিনি, আনমনা হয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে সেইসব শিশুদের ধুলোমাটি নিয়ে খেলা দেখতে থাকেন, যে শিশুদের প্রবেশাধিকার নেই মন্দিরপ্রাঙ্গণে (যে প্রাঙ্গণ ঈশ্বরের নামে পূজারী বা পুরোহিতের একচ্ছত্র আধিপত্যে নিয়ন্ত্রিত।) রবীন্দ্রনাথের আনমনা ঈশ্বর শিশুদের সেই খেলা দেখেন আর মন্দির অভ্যন্তরের পূজারত পুরোহিতকে বেমালুম ভুলে যান। সময় হয় না তাঁর পুরোহিতের ভক্তির অর্ঘ্য সাজানোর মহা-আয়োজন দেখার (“Children run out of the temple and play with dust, God watches their game and forget the priest.” ‘Stray Birds’, Rabindranath.)। এমনই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর।

তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।
বুঝতে নারি কখন্ তুমি
দাও-যে ফাঁকি ॥
ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁওয়ার
পিছন হতে পাই নে সুযোগ চরণ-ছোঁওয়ার,
স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি ॥
দেখব ব’লে এই আয়োজন মিথ্যা রাখি,
আছে তো মোর তৃষা-কাতর আপন আঁখি।
কাজ কী আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়–
পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়,
সরল প্রাণে নীরব হয়ে তোমায় ডাকি ॥

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে জানতে বা বুঝতে উপাসনালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, হৃদয় বা মনের মন্দিরেই তাঁর অধিষ্ঠান। হৃদয়ে এবং হৃদয়ভ্যন্তর থেকে বাইরে তাঁর যাওয়া-আসা। আবার তাঁর ঈশ্বর স্পিনোজার ঈশ্বরের মতো পাপপুণ্যের হিসাব নেন না, দেন না কাউকে শাস্তি কিংবা তিরস্কার। বরং বলেন, (সমাজের বিধিনিষেধের) বেড়াটা ভাঙো, দেখবে ওপারে হাসছে নতুন দেশ, নতুন পৃথিবী, নতুন জীবন।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
2 months ago

“সে আছে বলে চোখের তারায় আলো ,
এমন রূপের খেলা রঙের মেলা অসীম সাদায় কালো।”

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনা সহজ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে পরিবেশিত। লেখককে ধন্যবাদ।