
বয়স ষোলো হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গেলো কুমুরানীর। বোন কমলার বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগেই। কুমুদিনীর মুখশ্রী সুন্দর, কিন্তু রঙখানি চাপা। অন্য বোনদের মতো চম্পকবর্ণা নয় সে। তাই লেখাপড়াতে মেধাবিনী হয়েও বিয়ের বাজারে তার দাম যেন একটু নিচের দিকেই। তা তেমনটাই হতো বটে সে’সব কালে। ওদিকে কমলা, মাস্টারমশাই এলেই যে মায়ের খাটের তলায় সেঁধোত, পঞ্চম শ্রেণী অবধি টেনে হিঁচড়ে উঠেছে কি না উঠেছে, সেই কিনা এক বছরের বড়ো দিদিকে টেক্কা দিলো বিয়ের প্রতিযোগিতায় । তা আগের দিনে এই সব ছিল বইকি। জানে শর্মিলী, এখনও দিম্মির বা কুমুদিদির রেশমি পক্ককেশে বিলি কাটতে কাটতে সেই সব গপ্পো শোনে ও।
‘বুঝলি শর্মী, তোর দিদুটা এমন হতচ্ছাড়ি ছিল না, কি বলবো।’
‘কেন কেন কী হয়েছিল কুমুদিদি,’ চোখ গোল গোল করে গল্পের আশায় শর্মিলী।
‘কী হবে আর, মা জেঠিমা পই পই করে ওই মেয়েকে বলে দিয়েছে, খবরদার, ছেলের বাড়ি দেখতে এলে সেই ঘরে ঢুকিস না যেন। ওমা হতচ্ছাড়ি মেয়ে শুনলে তো, ঠিক দরজা দিয়ে যেই উঁকি মেরেছে অমনি ছেলের কাকা আর দাদার চোখে পড়ে গিয়েছে।’

ব্যস, ওঁরা পরে খবর পাঠালেন যে ওই উঁকি মারা মেয়েটিকে তাঁরা দেখতে আসবেন আরো একবার।
তখন কুমুদিদি আর কি করেন। বুকে বালিশ চেপে সারারাত বালিশ ভেজালেন আর কি।
মনে মনে হয়তো বোন কমলাকে গাল মন্দ করেছেন কত। পাজি, আবাগী, রাক্ষসী, তোর মরণ হয় না? আমার থেকে এইভাবে ভালো পাত্রটিকে কেড়ে নিলি? কাল সাপ তুই, কাল সাপ!
তা এ তো আজীবনের গল্প। বোঝে শর্মিলী। ও যেদিন মধুরার সঙ্গে আকাশকে প্রথম দেখে, সেদিনই ভেবেছিলো – এ কিছুতেই মধুরার হতে পারে না, এ আমার, আমারই। ব্যাস আর কী হবে, তারপর থেকে আকাশ এইতো সেদিনও তারই ছিল। মধুরা বিয়ে থাওয়া করে স্টেটসএ সেটেল্ড। দুই বান্ধবীর এখনো মেসেজিং হয়। তবে গোলাপ কাঁটার মতো দুজনের মধ্যে একলা আকাশ মাঝে মাঝে খচ খচ করে ওঠে কখনো সখনো।
কুমু দিদির অবশ্য তার পরের বছরেই একজন প্রফেসর স্বামীর সাথে বিবাহ হয়ে যায়। দুই বোন, যখনি বাপের বাড়ি গিয়েটিয়ে স্বামীদের সম্পর্কে নোটস মেলান, কুমুর মনে হয় তিনিই যেন জিতেছেন। দাঁত উঁচু সরকারী চাকুরে, উমাশঙ্করকে স্বামী হিসেবে না পেয়ে ভালোই হয়েছে, বোঝেন কুমু। ভয়ঙ্কর মুখরা সে, হাড় কিপ্টে আর ছোটবেলাতে বাপ-হারানো উমা মায়ের এক্কেবারে নেওটা। আর সে জায়গায় সুধীর এক্কেবারে উল্টো। চুপচাপ, নির্বিরোধী মানুষটার মুখে কথা নেই। অথচ কর্তব্যে তিনি সবার সেরা। বৌ মেয়ে ছেলেকে আগলে রাখেন। কুমুর সুখই সুখ। তাঁর মুখের কথাই শেষ কথা। স্বামী ভালো হওয়াটা মেয়েদের ভাগ্য তো বটেই।
দিদুরা সব দিম্মির বাড়িতে এলে ভারী খুশী হয় শর্মিলী। একটাই কারণ, অনেক গপ্পো হয় আর তার থেকেই জীবনের পাঠ নেয় শর্মিলী। যাই হোক, সে জানে জীবন নদী একখাতে বই না। ঢেউ এসে, প্লাবন এসে সব তছনছ করে দেয় এক এক সময়। যেমন কুমু দিদির জীবনে হয়েছে। ওই অত ছেলে মেয়ে স্বামী নিয়ে সুখের সংসারে কার চোখ পড়লো কে জানে! কুমু দিদুর মেয়ে স্বপ্ন মাসিকে শর্মিলী খুব ভালোবাসে। ভালোবাসা উভয়তই কিন্তু শর্মী যেন ছোট্ট বয়সটি থেকেই স্বপ্ন মাসিকে হিরোইনের মতো দেখে। এক ঢাল চুলের স্বপ্ন মাসি একটি কলেজে হিস্ট্রি পড়ান। তাঁর সাগরের মতো উদার চোখদুটিতে অপার মায়া মাখানো। শর্মীর খুব ইচ্ছে করে, বড়ো হয়ে স্বপ্ন মাসির মতো হতে, ওই ভাবে শাড়ী পড়তে প্যাস্টেল শেডসের, ওই ভাবে বান খোঁপাতে যে কোনো কিছু ফুল লাগাতে আর অমন ঝর্ণার মতো ঝরঝর হাসতে। শর্মী যখন প্রায়ই ওদের বিডন স্ট্রিটের সেই পুরোনো বাড়িটিতে গিয়ে থাকে, তখন কুমু দিদি, স্বপ্না মাসি আর ও ছাদে চলে আসে সন্ধ্যেবেলাতে।

‘একটা গান ধর তো স্বপন,’ বলে ওঠেন কুমু দিদি।
তখন মনে হয় মেয়ের জন্যে যত স্নেহ, ভালোবাসা ঝরে পড়ে কুমু দিদির গলাতে।
‘কোন গান মা, “আজ জ্যোৎস্না রাতে” গাই?’ বাধ্য মেয়ের মতো বলেন স্বপ্না মাসি।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটাই গাও স্বপ্না মাসি,’ বলে শর্মিলী ; আর তখন সমস্ত জোছনা এসে পড়ে, ওদের সেই পুরোনো বাড়ির ছাদে। ছাদে চুল মেলে বসে বসে স্বপ্না মাসি গায়, আর কুমুদিদি গলা মেলায় ওর সাথেই। শর্মিলীর মনে হয়, যত রাজ্যের সুখ যেন এসে জড়ো হয়েছে এদের এই একরত্তি ছাদটুকুতে। শরিকের বাড়ি, যে যতটুকু পেয়েছে তাই নিয়েই খুশী ওরা। শান্ত স্বভাবের সুধীন দাদু কক্ষনো শর্মিলীর দাদুর মতো হাঁক ডাক করেন না, ন’টা বেজে গেলে, খাবার সময় বয়ে গেলে। শর্মিলীর দাদু সবসময় দিদুকে দাঁতে পেষে কেন, জানে না সে। আর সেইজন্যেই শর্মিলী দিদুকে বলে, ‘ইশ তুমি যে কেন সে’দিন উঁকি দিতে গেলে, না হলে হয়তো তোমার সুধীন দাদুর মতো কোনো শান্ত মানুষের সাথেই বিয়ে হতো।’
‘চুপ,’ হেসে বলেন দিম্মু, ‘এমন পাকা মেয়ে না তুই … ওসব বলতে নেই, নিন্দে হয়l’
কিসে যে কী কী হয়, তখনও বুঝতে পারত না শর্মী। এখন বোঝে, যা হবার তাই হয়l নাহলে আকাশ এমন অদ্ভুত ব্যবহার করে কেন ওর সাথেl এতো নেশা করে সবসময়, যা মনে আসে তাই বলে?
যেদিন ওই ভয়ংকর খবরটা এলো শর্মিলীর দিদুর কাছে, আর দিদু মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদতে বসলো, সেদিন শর্মিলী প্রথমে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। দাদু বললেন, ‘আজ স্কুলে যাবিনা, আজ আমরা বিডন স্ট্রিট যাবো এক্ষুনি। তোর দিদুকে একটু গুছিয়ে নিতে দে।’ এর পর দিদুই ফাঁস করলো ব্যাপারটা। ‘ওরে স্বপ্না রে, এমন করে আমাদের ছেড়ে যেতে হয় মা?’ স্বপ্ন মাসি চলে গেছেন? বাড়ি ছেড়ে? কিন্তু কোথায়? কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলো না শর্মিলী। দাদুর মতো কিপ্টে ভদ্রলোক সেদিন ট্যাক্সি করে ওদের নিয়ে গেলেন। তারপর তো যা বোঝার বোঝাই গেলো। স্বপ্ন মাসি নাকি অন্তঃস্বত্তা হয়েছিল কাউকে ভালোবেসে। কুমু দিদিকে স্বপ্ন মাসি সে কথা উচ্চারণ করতেই, অমনি তিনি প্রচন্ড ক্ষেপে উঠলেন। এ যেন সেই মা নয়, অন্য কেউ। এ মাকে স্বপ্না চেনেন না। শুধু বলতে লাগলেন – ‘মা দয়া করো, ক্ষমা করো আমাকে মা। আমি ওকে পেটে নিয়ে কোথাও চলে যাবো। অন্য কোথাও দূরে। মফস্বলে। সেখানে ওকে মানুষ করে তুলবো মা।’
‘তা যাবে না? কালসাপ। ডাইনী, হারামজাদী … এই নাও এক টিন কেরোসিন রইলো, এই দিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেল এখনই।’
তা তারপর আর কিচ্ছু বলেনি, স্বপ্ন মাসি। রাতের অন্ধকারে, বাড়ির উঠানে, সেই একটিন গায়ে ঢেলে আগুন দিয়ে সব জ্বালা জুড়িয়েছে। পোড়া গন্ধ পেয়ে বাড়ির সবাই এসে দেখে প্রায় ছাই হয়ে গেছে কুমারী মায়ের দেহ।

তারপর থেকেই কুমু দিদুর স্বামী এক্কেবারে অন্যরকম। কথায় কথায় গালাগাল স্ত্রীকে। তিনি জানেন ওই স্ত্রীর বলাতেই মেয়ে ওই কর্ম করেছে। আর কোনোদিন ক্ষমা করেননি স্ত্রীকে। স্বপ্ন তাঁর কাছে প্রথম কচি সূর্য্যকিরণের মতোই ছিল। আর চিরকালের মতো নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কুমু দিদি। আকাশ ছাওয়া জোছনাতে তিনি ছাদে দিয়ে কেবল ডাকতেন, ‘এই নে আয় মা, এই দেখ বাটি ভরে দুধ এনেছি যে, খেয়ে নে মা, কিছু খাসনি যে।’ আর আঁচল ভরা খৈ মুড়ি ছড়াতে থাকতেন ছাদে। শর্মী পা টিপে টিপে ছাদে গিয়ে দেখেছে। ছাদের এক ধারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন কুমু দিদু আর কাক, চড়ুই, পায়রা, শালিখ ভিড় করেছে তার চারপাশে সেই ছড়ানো খৈ মুড়ি খেতে। কুমু দিদু আত্মমগ্ন, যেন অন্য কোন লোকে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কাল সাপ ও, কাল সাপ, আমার এমন সাজানো সংসারটা শেষ করে দিলো! নিচে বক বক করে চলেছেন সুধীর দাদু, বাড়ির উনকুটি চৌষুট্টি কাজকর্ম নিয়ে।
জীবনে ঘটনার ঘনঘটা কোন বিপরীত মেরুতে দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষকে, বলা অসম্ভব।
ওই ঘটনার পরে, কী জানি কেন, শর্মিলীর দাদু তার দিদুর উপর ভয়ানক রকমের যত্নবান হয়ে পড়েছেন। কিপ্টে স্বভাব অনেক কেটে গিয়েছে। দিম্মুর ৯৯ জ্বরেও বাপরে, মা রে, করেন, ওটাই তাঁর স্বভাব।
বলতে থাকেন, ‘ওরে, এবার আর রেহাই নেই রে, আমাকে যেতে হবে …
ওরে মাথা কনকন, পা কন কন রে, আর পারি না।
কড়িয়াল শাড়িটা পরিয়ে দিস শর্মী, মনে হচ্ছে তোর দাদুকে রেখেই যাবো এবার’ – এইরকম আর কি।
তা আগে হলে দাদু ভেংচি কেটে বলতেন –‘নেও নেও আর রঙ্গ করো না দিকি, যত্তরাজ্যির আদিখ্যেতা তোমার।’
শর্মীর মায়া হতো, আহা বেচারি দিম্মু, মায়ের ছোট মেয়ে তো, বড়ো আদরের তাই।
এখন দাদু কেমন পাল্টে গেছেন গো। মনে মনে হাসে শর্মী। দিম্মুর জ্বর হলেই নিয়ম করে এসে ওষুধ দিয়ে যান বুড়ো, রাস টক্স, ব্রায়োনিয়া – রসগোল্লা এনে দেন ভাঁড়ে। গরম গরম চা করে দিতে বলেন কুঞ্জ মাসিকে। আর দিম্মু শুয়ে শুয়ে চোখ পিট্ পিট্ করে দেখেন। ওর ফর্সা গাল আহ্লাদে লাল হয়ে ওঠে। তখন শর্মীর ইচ্ছে করে দিম্মিকে জোরে চেপে ধরে হাম খায় ও।
এমনি করে বিস্তর টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে জীবন বয়ে যায় শর্মিলীদের। কখনওসখনও কুমু দিদুর পুরোনো বাড়িটাতে যায় শর্মিলী। কুমু দিদু হয়তো ওকে অবাক করে দিয়ে বলেন, ‘কেন এসেছিস? স্বপ্ন এখনো কলেজ থেকে পড়িয়ে ফেরেনি যে। তা ছাড়া ও এখন আর গান গাইতে পারে না রে। ওর গলা বন্ধ হয়ে গেছে। আমিই ওর সব বলা বন্ধ করে দিয়েছি, জানিস।’ তখন চোখে জল এলেও সামলে নেয় শর্মিলী। কুমু দিদির গায়ে হাত বোলায়। মামা চলে গেছেন দূরে চাকরিতে। এখন দুই বুড়ো বুড়ি থাকেন কোনো মতে। সুধীন দাদু সব করেন কাজকর্ম। আর গজর গজর করতে থাকেন অনুক্ষণ। যে মানুষ একটি কথাও বলতে না, তিনি অনর্গল বাজে কথা চাষ করে চলেছেন, ভাবতেও খারাপ লাগে। কিচ্ছুক্ষণ বসে, বাড়ির পথে পা বাড়ায় শর্মিলী। আজকাল আকাশ বড়ো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওদিকে টিনারা নতুন এপার্টমেন্টএ উঠে গেছে, ওদের তিন নম্বর বাচ্চা হতে চলেছে। ভরা সংসার। তাই হোক, ভালো হোক ওদের, ভাবতে থাকে ভালো মনের মানুষ শর্মিলী। ট্যাক্সি করে ফিরছে আজ ও, শরীরটা কেমন যেন লাগছে, পার্ক স্ট্রিটের উপর ট্যাক্সি থামতে চোখে পরে আকাশকে। সঙ্গে ওই নোজরিংওয়ালি মেয়েটি, চোখে সুখ-কাজল, বড়ো টিপ্, ডোকরার গহনা, তেলিয়া কটন পরণে। খুব হাসছে দুজনে। কেউ কেউ বলেছিলো ওকে আকাশদের কথা। সপাটে নিজের গালে যেন একটা চড় খায় শর্মিলী। টিনার থেকে আকাশকে ছিনিয়ে নেবার দিনটা চড় হিসেবে ফিরে আসে ওর মগজে। নিজেকে নিজে বকে বকে বলে – কর্মা ইজ এ বুমেরাং, বুঝলে মেয়ে? ঢোঁক গেলে শর্মিলী। কিছু কিছু অপমান ঢোঁক গিলে ফিরে আসতে হয়। উদ্গার করতে নেই।

এতটাও সহজ নয় ব্যাপারটা যদিও, তবে এখনকার জমানায় প্রেমট্রেম নিয়ে টাইম ওয়েস্ট করার মানে নেই। বিশেষত, যে সব কোনোদিন প্রেম ছিল না। নিজেকে বকে ধমকে সমঝিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে আসে শর্মিলী | তবুও যে কেন অকারণে চোখ ভরে আসে ও নিজেও বোঝে না। যা হোক, সেদিন বাড়ি ফিরেই অবশ্য মন খুশ হয়ে যায় শর্মিলীরl আকাশকে খরচের খাতায় এন্ট্রি করে ও আবার জীবনের মুখোমুখি হতে শুরু করে। খুশির কারণ মায়ের মধুপিসির আগমন। মামার বাড়িতে থাকার সুবাদে মায়ের যত রাজ্যের গুষ্টির আত্মীয়দের সঙ্গে দারুণ দহরমমহরম শর্মিলীর। তাছাড়া ও খুব মিষ্টি আর মিশুকে মেয়ে। ছোট থেকেই দাদু দিম্মার কাছে থাকে। মধুপিসি শর্মিকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরেন।
‘ওম্মা কত্ত বড়োটি হয়ে গেছিস ভাই, আমাকে মনে পড়ে কিনা ?’
‘খুব পড়ে মধুদিদি, তোমার সেই গপ্পো, মনে পড়বে না?’
‘হাহা তোর জন্যে কত্ত কী এনেছি, দেখবি আয়।’ ধুপ ধাপ করে দু’তলায় নিজের ঘরে গিয়ে ওঠেন মধুদিদি।
ফর্সা গোলগাল মধুদিদি যেন এক তাল ময়দা। সোনালী ফ্রেমের চশমাতে, সাদা ফুলফুলে নরুন পেড়ে থান শোভিত মধুদিদি যেন গপ্পের বই থেকে নেমে আসা এক চরিত্র।

কোলে তার রাধুমণি বিড়ালনী। সর্বস্ব নিয়ে আসেন বারাণসী থেকে বছরে এক বার। একবার এলে মাস ছয়েক কাটিয়ে যান। ওদিকটায় বড্ডো গরম পড়ে। তাই আম কাঁঠালের সময়টাতে বড়দার বাড়িটি তাঁর দিব্য থাকার জায়গা।
ঘরে ঢুকেই হায় হায় করে উঠলেন মধু দিদি। ‘ওরে আবার সেই আবাগীর ছেলেপেলেরা আমার সাদা পরিষ্কার বিছানায় আচারের হাত মুছেছে গো। ওই দেখো ঢাকা আয়নার খুনচিপোষ সরিয়ে ময়লা হাত মুছেছে ওরা।’ শর্মিলী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এই রে এ নির্ঘাত ছোট মামার ছেলে, মেয়েটার কান্ড, সত্যি এত্ত দুষ্টু না ওরা। চুপ করে রইলো, শর্মী, নীরবতা অনেক ব্যাপারে মহৌষধের কাজ করে, ও জানে।
মধুদিদিকে দেখতে পেয়ে খাটের উপর বসে থাকা রাধুমণি ম্যাও ম্যাও করে উঠলেন। তাঁর গায়ের রঙ বরফ-সাদা, ইয়া বড়ো বড়ো রোঁয়া ওয়ালা, পারসিক বিড়ালনী তিনি, তাঁর কদর আলাদা। মধুদিদি বালবিধবা। আমিষ মুখে না তুললেও, এ বাড়িতে এলে বিড়ালনীর মাছখানি, দুধটুকু বরাদ্দ থাকে। দিম্মু, দাদুর নজর বাঁচিয়ে সাপ্লাই করেন যথাসাধ্য। বেনারসী চুড়ি, মিষ্টি মশলা সব আদরের নাতনীকে চালান করলেন মধু মধুদিদি। রাতে এখন থেকে এ ঘরেই শোবে শর্মী। মধুদি এলে, তাই হয়ে থাকে। তখন তিনি ফুলেল তেল মাখিয়ে দেন শর্মীর চুলে, তেল মালিশ করে দেন পায়ে, পিঠে। ওই তাঁর আদরের ধরণ আর কি । শর্মীর পোয়া বারো। এ ক’মাস আরামে থাকে।
তা সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত গপ্পো চলছে মধুদিদি আর নাতনিতে। এই তিন মহলা মামারবাড়িটা রাতে বড়ো অদ্ভুত আকার ধারণ করে । রাত বারোটা একটা ঘড়িতে বেজে গেলে যখন সারা বাড়িটা নৈঃশব্দ্যে তলিয়ে যায়, তখন সব শব্দ প্রকট হয়ে আসে শর্মীর কানে। এমনিতেই ছোট থেকে সে একটু বেশি শোনে, বেশি বোঝে, দিম্মি বলেন। তখন বাগানের অন্ধ গিরগিটিটা ডাকে, তক্ষক ডেকে ওঠে – ভক্ষক ভক্ষক ভক্ষক, ব্যাঙদের মকমক আর ঝিল্লি পোকাদের ডাক শোনায় যায় অবিরত। আর শর্মীর মনে হয় এই বাড়ির কোনো বন্ধ ঘরে, কোথাও যেন, ইঁট পাথরে, কে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।
এসব কথা মধুদিদিকে বললে, মধুদিদি ভারী অদ্ভুত গলাতে বলে ওঠেন – ‘তা হবেও বা, সেজো পিসি গলায় দড়ি দিয়েছিলো পিসেমশাইয়ের অত্যাচারে, নতুন মামী পুড়ে মরেছিল স্টোভ বার্স্ট করে, তারা কী আর এমনি থাকে রে, কাঁদবে নে? অতৃপ্তি আছে না ওদের মধ্যে?’ অতৃপ্তি ? তবে স্বপ্ন মাসিও অতৃপ্ত বুঝি? ও নিশ্চয়ই কাঁদে, ওই বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে। একবার ভাবে, সব খুলে বলে মধুদি’কে। তারপর দিম্মির ভয়ে চেপে চুপে শুয়ে পড়ে। বলা চলবে না, যদি গপ্পো বানায় মধুদিদি ওই ঘটনা নিয়ে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে শর্মিলী। স্বপ্ন দেখে, স্বপ্না মাসি এক ঢাল কালো চুল মেলে বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে ওদের ছাদে বসে গান গাইছেন, “কে যাবি পারে, ওগো তোরা কে, আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে।” পেছন থেকে পুঁটু দিদা এসে ওকে এক ঠেলা দিলেন। আর ও গড়িয়ে পড়ে গেলো ছাদের থেকে নিচে। আঁক করে ঘুম থেকে উঠে বসে শর্মিলী। ওমা পাশে মধুদিদি নেই তো। ঘরের মধ্যে ফোঁস ফোঁস ও কিসের আওয়াজ? রাধুমণিই বা গেলো কই? শুনতে পায়, মেঝেতে শুয়ে ফিসফিস করে মধু দিদি বলছেন – ‘সুন্দরমোহন, তুমি এসেছো? এস আমার কাছে এস,’ তারপর আরও কত কী। চুপ করে শুয়ে থাকে শর্মী নিথর হয়ে। সুন্দরমোহন কে? জানতে খুব ইচ্ছে হয় ওর। অনেকক্ষণ ওই রকম শীৎকার চলতেই থাকে। কোনো পুরুষ ঘরে এসেছে তা মনে হয় না শর্মিলীর। টের পায়, রাধু বিড়ালনী, পায়ের কাছেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে। শর্মিলী প্রায় নিঃশাস বন্ধ করে শুয়ে থাকে। তারপর কখন যেন মধু দিদি এসে পাশে শোন। নির্ঘাত বোঝেননি শর্মিলী জেগে আছে। পরদিন আলো ফুটতেই সব আগের মতো। যেন কিছুই হয়নি। শর্মী সুযোগ বুঝে দেখে, খাটের তলাতে একটা ঢাকা দেওয়া বাস্কেট। কী হতে পারে ভেবেই পায় না ওl
সক্কালসক্কাল আর কাউকে কিচ্ছু বলেনা শর্মী। ততক্ষণে রান্নাঘরে বামুনদি চা চাপিয়েছে। মামা মামীদের ঘরে ঘরে চা পৌঁছে দিয়ে আসে শর্মী। এমন সে ছোট থেকেই করে আসছে। দিম্মির শেখানো এ’সব। একবার ভাবে দিম্মিকে খুলে বলে, গত রাতের কথা। আবার ভাবে আজ রাতে সিওর হয়ে নেওয়া দরকার। যদি ওর কোনও ভুল হয়? যদি দাদু শুনে বকাবকি করে? আজ কলেজে থাকতে আকাশের ফোন অনেকবার বেজে ওঠে। ও তোলে না। আগে হলে তুলতো, গোছা গোছা অভিমান করতো তারপর অনেক কাঁদাকাটার পর আকাশের সঙ্গে আবার ভাব হতো, আবার কবিতা লেখা, আবার সিনেমা দেখা, ফুচকা খাওয়া, আবার চুম্বন, আবার আলিঙ্গন। চলতো অমনভাবেই। আজ ঘুরে দাঁড়াবে শর্মী। আর না। ও ফেলে দেওয়া কাঠপুতলি নয়।
সেদিন রাতেও চুলে তেল মেখে দেয় মধুদিদি। শর্মী তক্কেতক্কে আছে, আজ দেখতে হবে যা হোক। ব্যাপারটা কী ঘটে। একটু পর, মধুদিদি আবার পাশ ফিরে শর্মীকে বলে, ‘কি রে ছুঁড়ি, ঘুমুলি বুঝি ?’ শর্মী মড়ার মতো পড়ে থাকে। রা করে না। অনেকক্ষণ পর নিশ্চিন্ত হন পিসি, পা টিপে টিপে নেমে যান বিছানা থেকে। অনুভবে শর্মী টের পায় রাধুমণিও যেন নিচে নেমে মেঝেতে শু’লো। এরপর খস খস আওয়াজ, ‘সুন্দরীমোহন, সুন্দরীমোহন বেরিয়ে এসো,’ ফিসফিসে গলায় দয়িতের উদ্দেশ্যে বলেন পিসি দিদু। শর্মী যেন হিস্ হিস্ শব্দ শোনে। ওর মনে হতে থাকে সারাটা বাড়ি জুড়ে ওই প্রচন্ড সর্পিল হিসহিসানি ছড়িয়ে পড়েছে। স্বপ্নের সেই দৃশ্যের মতো একটা সর্পসংকূল কিলবিলে দীঘিতে অবগাহন যেন আর কত সব কি কি। এইভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটেছিল জানে না শর্মী। কেবল একটা সময়ে ওই হিস্ হিস্ থেমেছিল, ওই শীৎকার গলে জল হয়ে এসেছিলো আর পিসিদিদু দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ঘর থেকে চুপি চুপি পায়ে। এরপর আর চুপ করে শুয়ে থাকেনি শর্মী। পা টিপে টিপে ছাদে উঠে গিয়েছিলো সে। জানে পিসি দিদুকে ওখানেই পাবে। গিয়ে দেখে ছাদের শেষ প্রান্তে আলসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মধুদিদি। চোখ বন্ধ, চোখে বইছে জলের অবিরাম ধারা – আর মুখে ওই ‘সুন্দরীমোহন, সুন্দরীমোহন।’ তারপর যে কি করে দাদুভাই দিম্মিকে ঘুমের থেকে উঠিয়ে এনে পিসি দিদুকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানে না শর্মী। তবে ওই করেছিল সে সব, আর দাদুভাই ওকে পরদিন অনেক সাবাসী দিয়েছিলেন এর জন্যে। মধুদিদি যদি কোনোভাবে ছাদ থেকে পড়ে যেতেন, কি হতো ?
তারপরের ঘটনার জন্য ঠিক তৈরী ছিল না শর্মী। দাদু, ছোটদাদু সবাই মিলে ডাক্তার দেখিয়ে আনলেন, মধুদিদিকে। আর অনেক অনুনয় বিনয় করে হরিদার বন্ধু পিনাক ওঝাকে এনে ওই ঝুড়ি খোলানো হলো। কেমন সাপ ওই ঝুড়িতে কে জানে? এক বাড়ি লোক এক্কেরে ঝুড়ি খোলা দেখতে চলে এলো তখন। সেজো মামা, বুঁচকি মাসি, সেজো মামী, মেজো মামী, মেজো মামীর এক-গা-গয়না-পরা মা, সেজদি, মেজদি, বাড়ির ঠাকুর, চাকর, বামনী, দাদুরা দিদিমারা, কে নয়? এত্ত করে পিনাক ওঝা বেশ করে মন্ত্র পড়ে, ঘুরে ঘুরে বাক্সটাকে মন্ত্রসিদ্ধ করে যেই না খুলেছে – ওমা জ্যাক ইন দা বক্সের মতো করে বেরিয়ে এলো ইয়া একখানা রবারের সাপ। যার নাম কিনা সুন্দরীমোহন? পিসি দিদুর বরের নামেই। হুম তখন মেজদি বলে উঠলেন, ‘ওরে মধুমালতীর বরের বড্ডো সাপের শখ ছিল, শুনেছি রাখতো একটা নাকি বাক্সে।’ এ সব হলো যখন মধুদিদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডাক্তার দেখতে। ডাক্তারি পরামর্শ তো দরকারই। ওই সাপের সঙ্গে হিসহিসানি কি বাপু যে সে কথা। তা কি এক গেরেম্ভারি মনের অসুখ যে তার করেছিল সে তো বটেই। তবে রবারের সর্প আর পিসি দিদু ক্রমেই একসঙ্গে সহাবস্থান করতে লাগলেন। সাপ বটে, তবে কাল সাপ তো নয়। ডাক্তারের চিকিচ্ছের ওই দাওয়াই … ওই নাকি দরকার আর তার সঙ্গে কিছুমিছু ওষুধপত্রও চলতে লাগলো।
এ’দিকে শর্মিলী আকাশকে সাফ সাফ বলে দিলো, ‘নেহি মাঙতা ও’রকম বয়ফ্রেন্ড।’ দিদুও বললো, ‘ঠিক বলেছিস দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষে হবে কি?’ শর্মী হাসলো। মানুষের জীবনে, একবার না একবার, কেন যে ঘোরতর আয়রনির মতোই কালসাপ সেঁধিয়ে যায়, কে জানে। কখনও ইচ্ছে করে, আর কখনও ভাগ্যের ফেরে।
সে রাতে পিসি দিদুর হিসহিস শুনতে শুনতে ঘুমোলো শর্মী। তবে রাতে কোনো সাপের স্বপ্ন দেখলো না।