
মঞ্চ ঘিরে গ্রামবাসীদের ভিড়। যাত্রাপালা দেখে সকলের রক্ত উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। প্রধান অভিনেতার একের পর এক গান দোলা দিচ্ছে তাঁদের হৃদয়ে। ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। স্বদেশী গানে মথিত রাতের আকাশ। ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, / মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে। কিংবা ‘বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও। তোমরা এখনো ঘুমাও।’ সেই গায়ক মঞ্চের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে ঘুরে গাইছেন ঘুমভাঙানিয়া গান। তাঁর পরণে গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় পাগড়ি। বুকে ঝুলছে মেডেল। পায় বিদ্যাসাগর চটি। তাঁর গানে উদ্বেল মানুষ। তিনিই হলেন মুকুন্দদাস। তিনি চারণকবি। তাঁর চারণ গানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের মনে বপন করে দেন স্বদেশপ্রেমের বীজমন্ত্র। তাঁর স্বদেশী যাত্রা ছিল গণজাগরণের হাতিয়ার। তাই তাঁর যাত্রাপালা পড়েছিল শাসক ইংরেজদের রোষানলে।

ছোটবেলায় নাম ছিল তাঁর যজ্ঞেশ্বর। অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তবে সন-তারিখ নিয়ে মতান্তর আছে। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে তাঁরা চলে আসেন বরিশালে। সেই যজ্ঞেশ্বরের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং আন্দোলনের বাসনা জাগিয়ে তুলেছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। বাল্যকালে পড়াশোনায় তাঁর মন বসেনি। কৈশোরে খুলে বসলেন মুদির দোকান। তার মধ্যেই চলতে লাগল স্বেচ্ছাচার জীবন। বন্ধুদের নিয়ে গুণ্ডামি করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আমরা জানি রত্নাকর হয়ে উঠেছিলেন বাল্মীকি। যজ্ঞেশ্বরেরও মুকুন্দ হয়ে ওঠা যেন এক অলৌকিক আখ্যান। রোজ তিনি ঘুমিয়ে থাকেন আর ভোরবেলা তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে নগরকীর্তনের দল পরিক্রমায় বের হয়। সেই গানে ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্ত হন যজ্ঞেশ্বর। রোজ তাঁর কানে সেই নামগান প্রবেশ করে। শুনতে শুনতে গানের কথাগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। মুদির দোকানে বসে সেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তিনি তন্ময় হয়ে যান। কী গভীর উপলব্ধি! এত প্রেম কৃষ্ণ নামে! ছুটে যান সান্ধ্য কীর্তনের আসরে। দু’চোখ ভেসে যায় তাঁর। তন্ময়তায় ডুবে যান। একদিন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে যে যাত্রা বা গানের আসর ভণ্ডুল করে দিয়ে আনন্দে হা হা করে হেসে উঠতেন। আজ তিনিই সঙ্গীত ও পালাকীর্তনের অকূল সাগরে আনন্দযাত্রী। একদিন সঙ্কোচের সঙ্গে গেলেন সেই নগরকীর্তনের দলের কাছে। দলের প্রধান বরিশালের বিখ্যাত কীর্তন গায়ক বীরেশ্বর গুপ্ত। যজ্ঞকে দেখে বললেন, ‘এসো। তোমাকে তো প্রায়ই দেখি আমার গানের আসরে। আমার দলে গান গাইবে?’
যজ্ঞেশ্বর বললেন, ‘আমি কি পারব? আমি মুদির কারবারি আর আমাকে তো সবাই বলে যজ্ঞাগুণ্ডা।’
বীরেশ্বর বললেন, ‘বাইরে তুমি যাই হও, ভিতরে তুমি গৌরাঙ্গ। তোমার মধ্যে আমি গৌরভাব দেখতে পাচ্ছি।’
ঢুকে পড়লেন কীর্তন দলে। শুরু হল শিক্ষা। চলল শাস্ত্র পাঠ। বদলে গেলেন আমূল। শৌখিন পোশাক ছেড়ে ধরলেন শ্বেতবস্ত্র। বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে শুনতে লাগলেন পালাকর্তাদের গান।
এখান থেকেই একদিন তিনি হয়ে উঠলেন মুকুন্দদাস। সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূতের কাছ থেকে দীক্ষা নেন। তিনিই যজ্ঞার নামকরণ করলেন মুকুন্দদাস। বৈষ্ণব সাধক মুকুন্দ একদিন হয়ে উঠলেন কালীভক্ত। শ্যাম থেকে শ্যামার পদতলে আশ্রয় নিলেন তিনি। বরিশালের সনাতন ঠাকুর বা সোনা ঠাকুরের কালীমন্দিরে বসে তিনি গান গাইতেন। সেই গান শুনে অশ্বিনী দত্ত বললেন, ‘যজ্ঞা, তুই শক্তির গান বাঁধ। যে শক্তির উল্লাসে মানুষ উজ্জীবিত হবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্ত করতে।’ নতুন দিশা পেলেন মুকুন্দদাস। বুঝে গেলেন পথ তাঁর কোনদিকে।

১৯০৫ সালে দেশ উত্তাল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। এই সময় তিনি লিখলেন ‘মাতৃপূজা’। সেই পালা মানুষের কাছে পৌছে দিতে নতুন দল গড়লেন। কিন্তু বায়না নেই তো! পালা আসরস্থ হবে কী করে! মায়ের নাম করে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। দুর্গাপুজোর মহাসপ্তমীর রাতে নবগ্রামের পুজোমণ্ডপে অভিনীত হল সেই পালা। তারপর একে একে বায়না আসতে লাগল। খোরাকি বায়নাতেই আসরে আসরে অভিনয় করতে লাগলেন। ফরিদপুর, ইদিলপুর, চাঁদপুর। নৌকা এগিয়ে চলল। ছড়িয়ে পড়তে লাগল মুকুন্দদাসের নাম। বাংলার মানুষ সেই পালা দেখে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা পেলেন। ‘ভেঙে দাও রেশমী চুড়ি, বঙ্গনারী কভু হাতে আর পোরো না।’ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে সেই গান। স্বদেশী বর্জনের যে ডাক নেতারা দিয়েছিলেন, মুকুন্দদাসের গান তাতে ঘৃতাহুতি দিল। তাঁর স্বদেশী যাত্রা নতুন করে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিল বাংলার বুকে। ইংরেজ শাসক ভীত হয়ে তাঁর ‘মাতৃপূজা’নাটকটি বাজেয়াপ্ত করল। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল। কিছুদিন বরিশাল জেলে রাখার পর ইংরেজদের মনে হল এখানকার জেলে তাঁকে রাখা ঠিক হবে না। তাই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লি। তিন বছরের কারদণ্ড শেষে মুক্তি পেলেন। বেরিয়ে দেখেন তাঁর জীবন শূন্য করে চলে গিয়েছেন তাঁর পত্নী সুভাষিনী। জেলে যাওয়ার পরপরই সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যু হয় সুভাষিনীর।
ভাঙা মন। বুঝতে পারেন না, এখন উপায় কী! দল গড়ার মতো টাকাও হাতে নেই। জীবনযাপনের জন্য আবার খুলে বসলেন মুদির দোকান। কিন্তু প্রতিবেশী ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী একদিন তাঁকে ডেকে নিজের গয়না তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘ভাই, এই নাও এগুলো বন্ধক দিয়ে আবার দল খোলো। মুদির দোকান চালানো তোমার কাজ নয়। তুমি মানুষকে জাগিয়ে তোলো।’ উৎসাহিত হয়ে মুকুন্দদাস আবার দল খুললেন। আবার শুরু করলেন পালা লেখা। লিখলেন ‘সমাজ’ নামের একটি পালা। বুঝলেন কলকাতায় যেতে হবে। সেখানকার মানুষকে শোনাতে হবে তাঁর গান। ততদিনে আবার ডাক আসতে শুরু করেছে। একদিন চার টাকায় আসরে পালা গাইতেন। এখন নাম হয়েছে। রেট দাঁড়িয়েছে পঁচিশ টাকায়। ‘সমাজ’ পালায় তিনি বিষয়বস্তু করে তুললেন সমাজের বিভিন্ন খারাপ দিকগুলিকে। পণপ্রথা, জমিদারদের অত্যাচার অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি।


একদিন জোড়াসাঁকোয় কবিগুরুর বাড়িতে গিয়ে তিনি গান শোনালেন। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে মোহিত রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁকে শিখিয়ে দিলেন তাঁর ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ এই গানটি। বললেন, মঞ্চে মঞ্চে তুমি এই গানটি গেও। মুকুন্দদাসের সঙ্গে দেখা হল নজরুল ইসলামের। তিনিও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ। কবি নিজেও শোনালেন তাঁর গান। ‘কারার ওই লৌহকপাট’ ও অন্য কয়েকটি গান। মুকুন্দদাসকে উপহার দিলেন তাঁর দুটি বই। ‘অগ্নিবীণা’ এবং ‘বিষের বাঁশি’। তাতে লিখে দিলেন, ‘চারণসম্রাট মুকুন্দদাসকে উপহার’। মুকুন্দদাস হয়ে গেলেন চারণকবি।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মেয়ের বিয়ে। দেশবন্ধু চিঠি লিখলেন অশ্বিনী দত্তকে। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তিনি পালাগানের আসর বসাবেন। সেখানে মুকুন্দদাসকে গাইতে হবে। সেই আসরে গান গেয়ে সাড়া ফেলে দিলেন তিনি। সেখানে তিনি ইংরেজ বিলাসিতায় আসক্ত আধুনিক মহিলাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছিলেন। গানের শেষে দেশবন্ধু তাঁকে পরিয়ে দিলেন সোনার মেডেল। সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন কবি প্রিয়ংবদা দেবী। তিনি কবির প্রশংসা করে তাঁকে উপহার দিলেন সোনার সেফটিপিন। সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তিনি আড়ালে ডেকে মুকুন্দদাসকে বললেন, ‘দারুণ গান করেছেন। তবে আর নয়। এবার কলকাতা ছাড়ুন। আপনাকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা চলছে।’ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও তাঁর গান পছন্দ করতেন। তিনি মুকুন্দদাসকে উপহার দিয়েছিলেন একটি রুপোর লাঠি।
তাঁর ‘পল্লিসেবা, ‘কর্মক্ষেত্র, ‘পথ, ‘সাথী, ‘ব্রহ্মচারিণী’ প্রভৃতি পালার মধ্য দিয়ে তিনি ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিদ্ধ করেছেন অসাম্য, অন্যায় আর কুশিক্ষাকে। জমিদার বাড়িতে গানের আসরে তিনি জমিদারি ব্যবস্থার খারাপ দিকগুলিকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেও ভয় পেতেন না।
আসর থেকে আসরে ছুটছে দল। এদিকে শরীর আর নিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই জ্বর হয়। সবক্ষেত্রে পুরো পালায় অভিনয় করতে পারেন না। একটি-দুটি গান করেন মাত্র। কিন্তু গান বন্ধ করা যাবে না। কালীপুজোর সময়। অনেক বায়না। তাঁর উপর নির্ভর করছে দলের সকলের পরিবারের ভরণপোষণ। কলকাতায় এসে জ্বর বাড়ল। ১৯৩৪ সাল। অনেকগুলি পালার বায়না আছে শহরে। কিন্তু তিনি নিজেই চলে গেলেন সব পালার অভিনয় অসম্পূর্ণ রেখেই।
তাঁর যাত্রাপালা ছিল ভিন্নধারার। ব্রজমোহন রায়, মতিলালা রায়ের মতো তিনি পালা রচনা করেননি। তাঁর পালায় ছিল গানের আধিক্য। সেই গানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলে তিনি যেন নবনাট্যের প্রস্তাবনাও করে গিয়েছিলেন।
২
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান চলে গেল কয়েক বছর আগে। কিন্তু কেউ কোথাও এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্মৃতিচারণায় যাত্রাশিল্পের অবদান নিয়ে একটি কথাও বলেননি। অথচ স্বাধীনতার কালে যাত্রাশিল্প এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তারপর আলিপুর বোমা মামলা, ক্ষুদিরামের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে বাংলায় জ্বলে উঠেছিল বিপ্লবের আগুন। সেই আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে গ্রামে গ্রামে পরিবেশিত হতো নানা ধরনের পালা। সেই পালাগুলি মানুষের নিস্পৃহতাকে মুছে ফেলে তাঁদের অগ্নিমন্ত্রে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল।

মুকুন্দদাসের অনুপ্রেরণায় তখন গ্রাম বাংলায় বহু স্বদেশি যাত্রার সূচনা হয়েছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই মৃত্যু ঘটে মুকুন্দদাসের। কিন্তু তাঁর প্রেরণায় তখন উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন বাংলার তৎকালীন পালাকাররা। তাঁদের কলমে এসেছিল স্বদেশি ভাবনার জোয়ার। তখন বহু নাট্যকার ‘মাতৃপূজা’নামে পালা লিখেছিলেন। সেই সময় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার মতো পালা যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁরা হলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়, কুঞ্জবিহারী মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনারায়ণ রায়, পার্বতীচরণ কাব্যতীর্থ, কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ (বড় ফণী), বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ভোলানাথ রায় নস্কর কাব্যশাস্ত্রী, অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থ, নন্দগোপাল রায়চৌধুরী, শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
পুলিস বহুবার চেষ্টা করেও তৎকালীন পালাকার ও অভিনেতাদের কণ্ঠরুদ্ধ করতে পারেনি। নন্দগোপাল রায়চৌধুরী তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, ‘পুলিস বাধা দিলেন, নাটকের কপি কেড়ে নিয়ে অত্যাচারের দৃশ্য এবং অগ্নিক্ষরা বাণীগুলি বাদ দিতে নির্দেশ দিলেন। নাটকের কপিতে বাদ হল বটে, কিন্তু অভিনেতাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলেন না।’ অভিনেতারা কিন্তু বাদ দেওয়া সংলাপ ও দৃশ্যগুলি মঞ্চে অভিনয় করতেন।
বহু নাট্যকারের পালা থানায় নিয়ে গিয়ে কেটেকুটে সেন্সর করা হতো। তারপর বলা হতো ওইসব সংলাপ ও সিক্যুয়েন্স বাদ দিয়ে অভিনয় করতে। কিন্তু পালা অভিনয়ের সময়ে অনেকেই ওইসব সংলাপ বলতেন। তখন যেসব পালা গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে জোয়ার এনেছিল বা যেসব পালা ইংরেজ শাসকদের সিংহাসন কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেগুলি হল— ‘দাদা’, ‘সোনার বাংলা’, ‘সমাজ’, ‘দেশের ডাক’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘যুগের দাবি’, ‘বিপ্লবী বাংলা’, ‘ধর্ষিতা’, ‘মায়ের দেশ’ ‘পলাশীর পরে’, ‘প্রবীরার্জুন’, ‘লীলাবসান’, ‘চাষার ছেলে’, ‘মায়ের ডাক’ ইত্যাদি। এই সব পালায় গান ও সংলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলা হতো।

পালাকারদের মধ্যে বিনয় মুখোপাধ্যায় তাঁর অসংখ্য পালার মধ্য দিয়ে বিপ্লব চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর লেখা পালাগুলি ছিল ‘যুগের দাবি’, ‘পুষ্পাঞ্জলি’, ‘সংগ্রাম’, ‘জয়যাত্রা’ প্রভৃতি। সেসব পালা পুলিস এসে মাঝেমাঝেই বন্ধ করে দিত। নাট্যকারের উপরও চলত লাঞ্ছনা। আর একজন পালাকার ছিলেন কুঞ্জবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘মাতৃপূজা’ পালায় একটি গান সেই সময় দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ‘আর আমরা পরের মাকে মা বলিয়া ডাকব না।/ জয় জননী জন্মভূমি তোমার চরণ ছাড়ব না। এছাড়াও কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রানা প্রতাপ’, অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থের ‘শান্তি’, হারাধন রায়ের ‘মীরা উদ্ধার’, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গাসুর গীতাভিনয়’, ‘রণজিতের জীবনযজ্ঞ’ পালাগুলির মধ্যে মানুষের ঘুম ভাঙানোর গান গাওয়া হয়েছিল। ভোলানাথ রায় নস্কর কাব্যশাস্ত্রীর ‘জরাসন্ধ’ পালাটি ইংরেজরা নিষিদ্ধ করেছিল। পালাকাররা বিভিন্ন পৌরাণিক, ঐতিহাসিক বা সামাজিক পালার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বা দেশমাতৃকার বন্দনাকে প্রকাশ করতেন। কখনও সংলাপের মধ্য দিয়ে, কখনও আবার গানের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ পেত। ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র ‘ধরার দেবতা’ পালার একটি গান ছিল, ‘তোর দেশের কুকুর মাথায় নে ভাই / বিদেশের ওই ঠাকুর ফেলে।’ ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদের ‘বাসুদেব’ পালার একটি গান হল, ‘যদি নিতে চাও তার প্রতিশোধ, করিতে চাও তার প্রতিকার / তবে মন্ত্রে জাগাও অস্ত্র তোমার অলসতা কর পরিহার।’
ব্রজেন্দ্রকুমার দে ছিলেন একজন ধ্রুপদী পালাকার। তিনি সেই সময় সমাজটাকে এবং সময়টাকে ভালো করে চিনেছিলেন। তাই একেবারে যুগোপযোগী পালা লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ভাসিত তাঁর পালাগুলি হল ‘লীলাবসান’ এবং ‘প্রবীরার্জুন’। নাট্যকারের পুত্র তথা যাত্রা বিশেষজ্ঞ তরুণকুমার দে আমায় বলেছিলেন, ‘তিনি শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্যই ডাক দেননি। বরং ইংরেজরা আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ঘটিয়ে যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। এছাড়া অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের দ্বন্দ্ব এসবের বিরুদ্ধেও তিনি গর্জে উঠেছিলেন। বারবার তিনি বলেছেন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি, সম্প্রীতির কথা।’
পালাকারদের পাশাপাশি বহু অভিনেতা ও অভিনেত্রী সেই সময় এই সব পালার মধ্য দিয়ে বিপ্লব চেতনাকে পুষ্ট করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বড় ফণী, নন্দগোপাল রায়চৌধুরী, শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিত বিশ্বাস, জনার্দন রানি, রাখাল রানি প্রমুখ। তাঁরাও নিজেদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সৈনিক বলে মনে করতেন। যাত্রার ধর্ম তখন হগে উঠেছিল জনজাগরণ। লোকশিক্ষার এটাও একটা পর্যায় ছিল। সেই সব পালার মূল সুরই ছিল, ‘লাথি খেয়ে আর কতদিন মরবি তোরা, একবার রুখে দাঁড়া, একবার রুখে দাঁড়া।’
স্বাধীনতার পরেও চিৎপুরের যাত্রাপালায় এই ধরনের দেশাত্মবোধক পালার বহু অভিনয় হয়েছে। বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবেন নাথ, অমর ঘোষ, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কানাই নাথ, উৎপল দত্ত, মধু গোস্বামী সহ আরও বহু পালাকার দেশাত্মবোধক পালা লিখেছিলেন। আর এই সময় এবং প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই সূচিত হয়েছিল বাংলা যাত্রার স্বর্ণযুগ।
বাংলার উত্তাল সময়ের এক উজ্বল চরিত্র মুকুন্দদাস মাটির কাছাকাছি থেকে তাঁর লোকধারার শিল্পকে অস্ত্র করে বাংলার গ্রামে গঞ্জে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে। লেখক চমৎকার মুন্সিয়ানায় সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্রটিকে।
চারণকবি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম। খুব ভাল লাগল।
আক্ষরিক অর্থে বাংলার বাল্মীকি-ই বটে। উচ্ছৃঙ্খল জগা থেকে সাহসী দৃপ্ত উদারমনা ভক্তিরসে সিক্ত চারণ কবি মুকুন্দে উত্তরণ….!
কত না জানা কথা তথ্য! কত বিশিষ্ট চরিত্রের আনাগোনা! প্রাক স্বাধীন বাংলার ছোটবড় কত ঘটনা ছবির মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে।
ছেলেবেলায় সম্ভবত প্রথম মুকুন্দদাসের গান শুনি বেতারে কলকাতা কেন্দ্রের প্রভাতী দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠানে। সেখানে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দু একটি গান গাওয়া হত, যেমন “করমেরই যুগ এসেছে/ সবাই কাজে লেগে গেছে/ তোরাই শুধু রবি কি শয়ান!” কিংবা – “বান এসেছে মরা গাঙে” আর “ভয় কি মরণে!”
সে সময় বাবার কাছেও মুকুন্দদাসের স্বদেশী যাত্রা দেখার স্মৃতিকাহিনী শুনেছি। তিনি আমাদের দেখাতেন কীভাবে মুকুন্দদাস মঞ্চে গানের সঙ্গে নাচতেন। জামশেদপুরেও মুকুন্দদাস এসেছেন এবং আমার বাবা ছেলেবেলায় সেখানে তাঁর গান শুনেছেন বলে জেনেছিলাম।
আরো পরবর্তীকালে আমাদের সামনে জীবন্ত মুকুন্দদাস রূপে আবির্ভূত হলেন সবিতাবব্রত দত্ত। তিনি যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেই মুকুন্দদাসের মতই তিনিও আজ বিস্মৃত। মুকুন্দদাসের ভূমিকায় নাটকে ও ছায়াছবিতে তাঁকে দেখেছি, সে দৃশ্য ভুলবার নয়। প্রথম দেখি ‘বালিকা বধূ’ ছবিটির স্বদেশী যাত্রার একটি দৃশ্যে, যেখানে সবিতাব্রত গেয়েছিলেন, “ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী”। এর কিছুদিন পরেই তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় একটি গোটা সিনেমা, সেখানেও নাচে গানে সবিতাবব্রতর অবিস্মরণীয় অভিনয় মনে গেঁথে আছে। এসব কাহিনী মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই।
তবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার কাহিনীগুলির তথ্যসূত্র থাকলে আরো ভালো হত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে কখনো দেখা হয়েছিল, এমন তথ্য সমসাময়িক কারো স্মৃতিকথায় বা রবীন্দ্রনাথের নিজের চিঠিপত্রে পাইনি। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবীর বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল এ কথা সম্ভবত সরলা দেবীর স্মৃতিকথাতেই পড়েছি। নজরুলের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটি সবিতাবব্রতের নাটকে ছিল, তবে লিখিতভাবে কোথাও পাইনি। লাঠি উপহার দেবার কাহিনীটি কোথাও পড়েছিলাম লাঠির সঙ্গে নাকি দু ছত্র কবিতাও লেখা ছিল, সেগুলি এখন আর মনে নেই।
সম্প্রতি ইন্টারনেট টিভির বড়পর্দায় বহু বছর আগে দেখা ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ ছবিটি আবার দেখলাম। আবারও মনে হল, স্বদেশী যাত্রার দৃশ্যগুলিতে সবিতাব্রতের অভিনয়ের কোন জুড়ি নেই।
চমৎকার একটী প্রতিবেদন। আপনাদের এই প্রযাস এই জন্য আরও প্রশংসনীয় কারণ আপনারা আমাদের বাঙলা সংস্কৃতির অনেক অজানা তথ্য ও অতীতের অনেক নায়কের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করাচ্ছেন যাদের উল্লেখ লিখিত ইতিহাসে নেই।
পুনঃ আপনাদের প্রযাস কে ধন্যবাদ জানাই।