১
মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বারবার মনে হতো এই দুই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, পুশকিন, গোগোল, চেকভ, গোর্কির মতো বিশাল মাপের রুশ সাহিত্যিকরা। জড়িয়ে আছেন লেনিন, স্তালিন। সেটা ভাবতে ভাবতেই রোমাঞ্চিত হতাম। সেই কোন ছোটবেলায় ঝকঝকে রঙিন ছাপায় বাংলা ভাষায় রাশিয়ার রূপকথার বই পড়তাম। প্রগতি প্রকাশনী বা রাদুগার সেই সব রুশ উপকথার বইগুলি আমাদের শৈশবকে ঘিরে এক রূপকথার জগৎ তৈরি করেছিল। বাংলার রূপকথা ও রাশিয়ার রূপকথা ছিল আমাদের শৈশবের বেড়ে ওঠার ও সাহিত্য মননের মধ্য দিয়ে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানোর দু’টি ডানা। আরও বড়ো হয়ে পড়েছি অন্য সাহিত্যিকদের লেখা। আমার বারবার অপরিণত সাহিত্যবোধ নিয়েও মনে হয়েছিল দস্তয়েভস্কি এক অন্য ধারার সাহিত্যিক। তাঁর সঙ্গে তো কাউকে মেলাতে পারছি না। নতুন পথেই ছিল তাঁর পরিক্রমণ। তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টি বিশ্ব সাহিত্যকে একটা নতুন পথ দেখিয়েছিল। তাঁর ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ইডিয়ট’ বা ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’ দেড়শোরও বেশি বছর ধরে আবিষ্ট করে রেখেছে বিশ্বের পাঠকদের। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে দস্তয়েভস্কির জন্ম। আমাদের রাশিয়া সফর হয়েছিল ২০১৮ সালে।
রাশিয়ায় অসংখ্য ধরনের ট্যুর চালু আছে। তার মধ্যে একটি হল দস্তয়েভস্কি ট্যুর। অর্থাৎ দস্তয়েভস্কির সঙ্গে সংযুক্ত স্থানগুলি পরিভ্রমণ। এর মধ্যে আছে সেন্ট পিটার্সবার্গে দস্তয়েভস্কি মিউজিয়াম, তাঁর মূর্তি, তাঁর সমাধিস্থল এবং দস্তয়েভস্কি স্টেশন দর্শন। তবে মিউজিয়াম দর্শন করে অনেক কিছু দেখা গেলেও সেই হারানো সময়কে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর লেখার টেবিল, বসার ঘর, শয়ন কক্ষ ইত্যাদি দেখা যায়। সেখানে সব কিছু সযত্নে রক্ষিত আছে।
দস্তয়েভস্কির জন্ম মস্কোতে। সেখানে তিনি জীবনের প্রথম ১৬ বছর কাটিয়েছেন। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি চলে আসেন সেন্ট পিটার্সবার্গে। এখন যেটা মিউজিয়াম, সেখানেই থাকা শুরু করেন। তাঁর ছিল এক উচ্ছন্নে, বাউন্ডুলে জীবন। বারবার বদলে গিয়েছে তাঁর আস্তানা। আবার তিনি এখানে এসে ওঠেন ১৮৭৪-এর অক্টোবর মাসে। ছিলেন আমৃত্যু, অর্থাৎ ১৮৮১-র ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এখানেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর সুবৃহৎ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’। যে টেবিলে বসে তিনি লিখতেন, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যেন ইতিহাসের ভিতরে ঢুকে যাওয়া যায়। কারমাজোভ ভাইদের চরিত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনে হয়, কী করে তিনি এখানে একমনে বসে লিখতে লিখতে তলিয়ে যেতেন জীবনের অমন জটিল মনস্তত্ত্বের অতলান্তিক গভীরে! সে কি শুধু সাময়িক কোনও ভাবনার ফসল? নাকি তাঁর জীবনের ভিতরেই এই জটিল মনস্তত্ত্বের বীজ লুকিয়েছিল। দস্তয়েভস্কির অনিশ্চিত জীবন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, মৃগীরোগ, জুয়া প্রবৃত্তির জীবন পর্যালোচনা করলে মনে হয়, তাঁর জীবন দেবতাই তাঁকে দান করে গিয়েছেন এইসব সূক্ষ্মতম অনুভূতি, বোধ।
লিখতে লিখতে মন খারাপ হলে তিনি এসে বসতেন জানালার ধারে। বাইরে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতেন, আকাশ দেখতেন। আর মুহূর্তে তলিয়ে যেতেন জীবনের গূঢ় রহস্যের অন্ধকার আঁকিবুকি আঁকা অদৃশ্য, অধরা এক জগতে। কিংবা বাইরে যখন বরফ পড়ত, শহরের রাস্তা ঢেকে যেত বরফে, তখন তাঁর মনে পড়ত বস্তিবাসী মানুষের কথা। জন্তুদের মতো তাঁদের বেঁচে থাকা, তাঁদের প্রেম, ঘৃণা, হিংসা, যৌনতা, লোভ, অপভাষা—সব মিলেমিশে শব্দবন্ধনের মধ্য দিয়ে তৈরি করত এক মন্তাজ। সেগুলোই প্রকাশ পেত তাঁর সাহিত্যের পাতায়। সে যেন শব্দবন্ধনীর মধ্য দিয়ে এক চিরায়ত সাহিত্য অথবা সত্যের প্রকাশ।
শহরের এই রাস্তাটির নাম কুজনেচনি পেরেলুক। পেরেলুক মানে আমরা যাকে বলি লেন বা গলি। আর ওরা উলিৎসা বলে স্ট্রিটকে। যেমন, নিকোলোস্কায়া উলিৎসা, পেত্রোভস্কা উলিৎসা ইত্যাদি। এই কুজনেচনি পেরেলুক রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা দস্তয়েভস্কি মিউজিয়ামটি চালু হয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর সার্ধ জন্মশতবর্ষে। পাশের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে দস্তয়েভস্কির নামে, উলিৎসা দস্তয়েভস্কেগো। এই মিউজিয়ামে রয়েছে তাঁর জীবনের প্রচুর ছবি ও তথ্য। রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত সরঞ্জাম। রয়েছে তাঁকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে লেখা অসংখ্য বই। রয়েছে তাঁর কাহিনি নিয়ে তৈরি হওয়া অসংখ্য চলচ্চিত্রের প্রিন্ট।
এসবের সঙ্গে অবশ্যই দেখা উচিত মস্কোর দস্তয়েভস্কি মেট্রো স্টেশনটি। মস্কোর সবক’টি স্টেশনই দেখার মতো। একেবারে প্রাসাদসজ্জার মতো, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে হয়। কিন্তু দস্তয়েভস্কি স্টেশনটি যেন কারও সঙ্গেই মেলে না। সেটা একেবারে অন্যরকম, দলছাড়া। দস্তয়েভস্কি স্টেশন যেন আমাদের পৌঁছে দেয় অন্য জগতে। বিখ্যাত সাহিত্যিকের সাহিত্যের গভীর বিষাদমগ্নতা যেন তুলে আনা হয়েছে স্টেশন সজ্জার থিমের মধ্য দিয়ে। নিভু আলোর মধ্যে চারপাশে রয়েছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির চিত্রণ। দস্তয়েভস্কির লেখার থিম, চরিত্রগুলির জটিলতা, মননের আলো-আঁধারি তুলে আনা হয়েছে স্টেশনসজ্জার থিমের মধ্যে। পাশাপাশি এক অন্য দর্শনও প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে। সে যেন এক উত্তরণের দর্শন। স্টেশন থেকে বাইরের আলোয় এলে মনে হবে অন্ধকার, যন্ত্রণা, বিষাদ থেকে আলোয় এভাবেই বোধহয় ফিরে আসা যায়। তাই সেই বিষাদমগ্নতা কখনওই স্থায়ী নয়, তা যেন আশাবাদেরই এক অন্যরূপ।
এসবের মধ্যেই যেন তিনি আজও জেগে আছেন। যেভাবে জেগে আছে তাঁর সাহিত্যকীর্তি। সেই সাহিত্যকে জানতে গেলে জানতে হবে সাহিত্যিককেও। তাঁর জীবনটাই যেন তাঁর উপন্যাসের প্রচ্ছদ। সেই প্রচ্ছদটুকুর অর্থ অনুধাবন করতে না পারলে তাঁর সাহিত্যকে সম্যকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। কেননা তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা। মনে হয় যেন এ তো দস্তয়েভস্কি, তাঁর নিজের কথাই বলছেন। আর জানা দরকার সেই সময়টাকে। যে সময়ের মধ্যে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন একের পর এক মহান সাহিত্য।
২
ভোর তখন পাঁচটা। সেদিন ২২ ডিসেম্বর, ১৮৪৯। শীতের কনকনে ভোর। তখনই তাঁর সেলে এসে ধাক্কা দিয়ে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন গভর্নর। নির্বিকার শীতল কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘দশটার সময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। সুতরাং উঠে পড়ো। একটু পরেই ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে। কফি, মাংসের টুকরো এবং যদি চাও এই কনকনে ঠান্ডায় সামান্য মদ পরিবেশন করাও হবে।’ সব শুনে শীতল কণ্ঠে দস্তয়েভস্কি বললেন, ‘একটু সময় দিতে হবে বাপু। মৃত্যুর ভয় নয়, যেন জীবনের এক অন্যপ্রান্তে তাঁকে হেঁটে যেতে হবে। অনেকটা পথ। তাই তার প্রস্তুতি শুরু হল। যেন নিজের মনকেই বললেন, ‘চলো মুসাফির, বাঁধো গাঁঠোরিয়া।’
আটমাস নির্জন কুঠুরিতে কাটানোর পর তাঁকে এবং অন্য ৯ জনকে নিয়ে আসা হয় সেমিওনোভোস্কি প্যারেড গ্রাউন্ডের বধ্যভূমিতে। সেখানে দস্তয়েভস্কির পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বন্ধু সের্গেই দুরোভ।
দস্তয়েভস্কি বললেন, ‘আমার মন বলছে, আমরা বেঁচে যাব। ওরা আমাদের হত্যা করতে পারবে না।’ বধ্যভূমির অদূরে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে দুরোভ বললেন, ‘তোমার আশাটা একটু বেশি ওস্তাদ। ওইদিকে তাকিয়ে দেখো। সারি সারি কফিন। ওর একটার মধ্যেই আমরা একটু পরে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ব।’
অন্যদিকে দাঁড়ানো এক সঙ্গী নিকোলাই স্পেশনেভের দিকে তাকিয়ে দস্তয়েভস্কি বললেন, ‘তোমার কী মনে হয়?’ নিকোলাই বললেন, ‘একটু পরেই পুরোহিত এগিয়ে এসে আমাদের প্রভু যিশুর ক্রশ চুম্বন করাবেন। স্বস্তিবচন পাঠ করাবেন। আর ফায়ারিং স্কোয়াডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনার বন্দুকের একটা গুলিতেই আমাদের জীবনপালা সাঙ্গ হবে। তারপর আমাদের দেহটা একটা সাদা কাপড়ে মুড়ে কফিনে ভরে ফেলবে।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম তিন ব্যক্তি পেত্রাশেভস্কি, মোমবেলি এবং গ্রিগোরিয়েভকে তিনটে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলা হল। তাঁদের চোখে একটা কালো কাপড় বেঁধে ফেলা হল। প্রতিটা খুঁটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন একজন করে সেনা। তাঁদের হাতে তাক করা বন্দুক। এর পরেই দস্তয়েভস্কিদের পালা। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন সেই মুহূর্তকথা। ‘দ্য ইডিয়ট’এর মিশকিন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ পেয়েছিল। ‘আমি তখন ভাবতে চেষ্টা করছি, মৃত্যুর রূপটি ঠিক কেমন? আর তো মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর অতীত হয়ে যাব। অনেক দূরে একটা গির্জার সোনালি ধাতব মাথার ওপর ছিটকে এসে পড়েছে সকালের সূর্য। সেটা চকচক করে উঠল। আমার চোখের ওপর এসে পড়ল তার ছটা। একটা শূন্য অনুভবের ভিতর অবস্থান যেন।’
শুধু চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায় সেনারা। ঠিক তখনই দু’জন ঘোড়সওয়ার ছুটে এলেন। অশ্ব থেকে নেমে জেনারেলের হাতে তুলে দিলেন রাজার সিলমোহর মারা নয়া হুকুমনামা। সেখানে লেখা রয়েছে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ করা হল। পরিবর্তে তাঁদের যেতে হবে নির্বাসনে। সাইবেরিয়ার ওমস্কে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
কী ভয়ঙ্কর সেই বন্দিজীবন! চার বছরের বন্দিজীবনের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর পায়ের বেড়ি খোলা হয়নি। সেখান থেকেই তাঁর শুরু হয় মৃগীরোগ। মাঝে মাঝে ভুগতেন। তখন হাসপাতালে ভর্তি হতেন। চিকিৎসার পর ছাড়া পেলে আবার সেই কষ্টের জীবন। এই বন্দিজীবন, জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে নতুন করে চেনা, তীব্র যন্ত্রণার জীবনের মধ্যেও বেঁচে থাকার স্বপ্নবিলাস, ভাবনার জটিল বিন্যাসের মধ্য দিয়ে দূরের কোনও আলোকরেখাকে প্রত্যক্ষ করার উদগ্র বাসনা, এসব রূঢ় সাহিত্যধর্মী বাস্তবতার ভ্রুণ তাঁর মনে জন্ম নিয়েছে ওই নির্বাসন কালেই।
কিন্তু কেন তাঁদের এই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল? আসলে তাঁদের লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী জার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। তখন সিংহাসনে বসে জার প্রথম নিকোলাস। তাঁর কাছে রাজতন্ত্রের অর্থই ছিল স্বৈরশাসন। তিনি সব স্বায়ত্ত্বশাসন রদ করে নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। লেখকদের স্বাধীনতা কেড়ে নিলেন। চেষ্টা হল কণ্ঠরোধের। নিষিদ্ধ করা হল বহু বই। এর বিরুদ্ধে গোপনে গড়ে উঠল এক র্যাডিকাল গোষ্ঠী, পেত্রাশেভস্কি সার্কল। সেই গোষ্ঠীর সদস্যরা গোপনে মিলিত হয়ে প্রতিবাদী সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। নিষিদ্ধ হওয়া বিপ্লবী চিন্তামূলক বইগুলি পড়তেন। সেই সঙ্গে আলোচনা হতো, সাহিত্যের শর্ত কী, সাহিত্যকে কীভাবে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বন্ধ করা যায় ইত্যাদি। একদিন জার সেনাদের অভিযানে ধরা পড়ে গেলেন দস্তয়েভস্কি এবং তাঁর সাথীরা। তাঁদের আটমাস কারাবাসের পর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে যখন শুরু মৃত্যুর প্রহর গোনা। তখন কিন্তু তাঁর জীবনদেবতা বোধহয় অন্যরকম ভেবেছিলেন, তাই নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেলেন।
দস্তয়েভস্কির বাবা ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা ছিলেন একজন নরম মনের মানুষ। কিন্তু মাত্র ৩৩ বছর বয়সে দস্তয়েভস্কির মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের অকাল মৃত্যুর জন্য বাবার ওপর চাপা ক্ষোভ ছিল দস্তয়েভস্কির। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দস্তয়েভস্কির বাবার জীবনের উচ্ছৃঙ্খলা বেড়ে যায়। জীবনের শেষদিকে তিনি একটা জমিদারি কিনেছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি তাঁর জমিদারির প্রজাদের হাতে খুন হয়ে গেলেন। বাবার লোভ, তৃষ্ণা, খুন হওয়া তাঁর সাহিত্যে ফিরে এসেছে। ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’-এ বাবা চরিত্রটির খুন হওয়া, তাঁর লোভ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বাবার লোভ ও খুন হওয়ার চিত্র এঁকেছেন বলে সমালোচকরা বলেন। তাঁর বাবা তাঁকে সেন্ট পিটার্সবার্গের সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ১৮৪৩ সালে সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে দস্তয়েভস্কি সরকারি অফিসে চাকরি পান। কিন্তু লেখার টানে পরের বছরেই ছেড়ে দিলেন সেই চাকরি।
৩
নির্বাসন কাল থেকে ফিরে আসার পর একটু থিতু হতে চাইলেন দস্তয়েভস্কি । ১৮৫৭ সালে তিনি বিয়ে করলেন মারিয়া দিমিত্রিয়েভাকে। মারিয়া ছিলেন সরকারি পদস্থ কর্মী আলেকজান্দার ইভানোভিচের বিধবা স্ত্রী। বিয়ের আগে বেশ কয়েকবছর চলেছিল তাঁর সঙ্গে দস্তয়েভস্কির প্রেমপর্ব। আলেকজান্দারের অনুপস্থিতিতে দু’জনের সাক্ষাৎ হতো।
১৮৫৫ সালে স্বামী আলেজান্দার ইভানোভিচের মৃত্যুর পর মারিয়াকে বিয়ে করেন ফিওদর দস্তয়েভস্কি। মাত্র সাত বছরের সেই দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। একদিকে দস্তয়েভস্কির মৃগীরোগ, অন্যদিকে টিবি রোগে আক্রান্ত মারিয়া। দিনরাত তাঁদের খিটিমিটি লেগেই থাকত। তাঁদের সেই প্রেম বা বিবাহ কখনওই ভালোবাসার স্তরকে ছুঁতে পারেনি। ১৮৬৪ সালে মৃত্যু হল অসুস্থ মারিয়ার। তার দু’মাসের মধ্যেই মারা গেলেন দস্তয়েভস্কির ভাইও। জীবনের এইসব সম্পর্কের ছিন্নতা, এই অনিত্য সম্পর্ক, মানসিক অস্থিরতাগুলো যেন এক অবয়ব পাচ্ছিল ভাবনার মধ্যে। ক্রমেই সেখানে তৈরি হচ্ছিল একটা নিজস্ব জগৎ। আবার তিনি লিখতে শুরু করলেন। শুরু হল তাঁর সাহিত্যের বিজয় যাত্রা।
দস্তয়েভস্কি তাঁর নতুন উপন্যাসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উপন্যাসের নাম ‘দ্য গ্যাম্বলার’। রুশ ভাষায় ‘ইগরোক’। বয়স তাঁর তখন ৪৫ বছর। বইটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। প্রকাশক তাড়া দিচ্ছেন। দাদা প্রচুর দেনা করে মারা গিয়েছেন। তাছাড়া তাঁর নিজেরও ছিল জুয়ার নেশা। সুতরাং পাওনাদারদের ঠেলা ছিল। সব নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁকে শোধ করতে হবে। শোধ করতে না পারলে পাওনাদাররা তাঁকে পুলিশে দেবেন। প্রকাশকের কাছে হাত পাতলেন। তিনিও দেখলেন এই মওকা, কম পয়সায় দস্তয়েভস্কিকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া যাবে। তিনি শর্ত দিয়ে বললেন, চার সপ্তাহের মধ্যে একটা বই লিখে দাও, টাকা দিচ্ছি। আর যদি না পারো, তবে তোমার সব বইয়ের সত্ত্ব আমাদের হাতে চলে আসবে। তাই লিখতে হবে দ্রুত। কিন্তু তিনি তাড়াতাড়ি লিখতে পারেন না, অসুবিধা হয়। হাত কাঁপে। দ্রুত লিখতে গেলে ভাবনাগুলো জড়িয়ে যায়। সে কারণে তাঁর একজন স্টেনো দরকার। যিনি শুনে শুনে সব লিখে রাখবেন। দস্তয়েভস্কির বন্ধু একজন তরুণীর সন্ধান দিলেন। অ্যানা স্নিৎকিনা। বয়স ২০ বছর। অ্যানা তো উল্লসিত, তাঁর বাবার প্রিয় সাহিত্যিকের কাছে কাজ করবেন বলে। সেই সঙ্গে কিছু হাত খরচও মিলবে।
দস্তয়েভস্কি বলে যান, অ্যানা লিখে চলেন। মাঝে মাঝে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলে দস্তয়েভস্কি আলোচনা করেন অ্যানার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগে লেখকের। গল্পে রয়েছেন এক বৃদ্ধ চিত্রশিল্পী। সেই শিল্পী এক তরুণীর প্রেমে পড়ে যান। তিনি সেই তরুণীটির কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু মেয়েটি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করবে, না ফিরিয়ে দেবে! বুঝতে পারেন না লেখক। কোনদিকে তিনি নিয়ে যাবেন উপন্যাসের গতিকে? আলোচনা করেন অ্যানার সঙ্গে। নভেম্বরের শীতের সকাল। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। দস্তয়েভস্কি অ্যানাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ধর, আমি সেই বৃদ্ধ চিত্রশিল্পী, আর তুমি সেই তরুণী। আমি তোমায় প্রস্তাব দিয়ে বললাম, ইয়া ভাস লুবলু। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। তি ভুইজিস জা মিনিয়া। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’
অ্যানার মুখের ভাব বদলে গেল। একটু সময় নিয়ে তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি এবং সারা জীবন ভালোবেসে যেতে চাই। নে রাজোচেরোভি মিনিয়া। তুমি যেন আমাকে অস্বীকার কোরো না। ’
দু’জনেই বাকরুদ্ধ। দস্তয়েভস্কি বুঝতে পারেন না, এই উত্তর কার! এই স্বরের মধ্যে তো কোনও অভিনয় নেই! সেটা কি তাহলে অ্যানার অন্তরের কথা! অপ্রস্তুত দস্তয়েভস্কি। তখন লেখকের হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিলেন অ্যানা। বাইরে তখন তুষার পড়ছে। বুকের ভিতরেও তখন দু’জনেরই ভালোবাসার উষ্ণ তুষার ঝরে পড়ছে। সেই সময় অ্যানার উষ্ণ হাতটা পরম আপনজনের মতো মনে হচ্ছিল। দস্তয়েভস্কির মনে হল, এই হাত যেন অ্যানা কখনও না ছাড়েন।
এখানেই দু’জনের বিয়ে হয়েছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি। দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর সময় অ্যানার বয়স ছিল ৩৫। তাঁর সংস্পর্শে এসে দস্তয়েভস্কি পেয়েছিলেন অন্য জীবনের স্বাদ। বড় যত্নশীল স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীকে দিয়েছেন তৃপ্তি। অসম বয়সের সেই দাম্পত্যজীবনের ভিতরে আকাঙ্ক্ষিত সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। তাই পরবর্তীকালে তাঁর লেখক জীবনের মধ্যে এসেছিল একটা পারিপাট্য। দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর পর আর তিনি বিয়ে করেননি। স্বামীর সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি আজীবন প্রয়াসী হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ছিল অ্যানার মৃত্যুশতবার্ষিকী। এই দু’জনের সাক্ষাৎ, দি গ্যাম্বলার লেখা এবং তাঁদের প্রেম নিয়ে ১৯৮১ সালে তৈরি হয়েছিল একটি রুশ ছবি, Twenty Six Days from the Life of Dostoyevski. সেবছর ছিল সাহিত্যিকের মৃত্যুশতবর্ষ।
দস্তয়েভস্কির জীবনে প্রেম ছিল এক স্বর্গের অনুভূতি। বারবার তাঁর লেখায় এসেছে প্রেমের প্রসঙ্গ। নরকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, সেটাই নরক, যেখানে প্রেমের কোনও অনুভূতি থাকে না। এছাড়াও তিনি মনে করতেন ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছাড়া কারও মনে প্রেমের অনুভূতি সঞ্চারিত হতে পারে না। সেই প্রেমের পথ সবসময় বন্ধুর। ‘To love is to suffer and there can be no love otherwise’. ভালোবাসার ওই আনন্দঘন কষ্টটুকু পাওয়ার জন্য তিনি প্রেমে পড়তে চান। তারপরেই তিনি বললেন, কারও প্রেমে পড়া মানেই কিন্তু তাকে ভালোবাসা নয়। সেই প্রেমের মধ্যে বিরক্তিও থাকতে পারে। কেউ অপরাধী বা পাপী জেনেও যদি ভালোবাসতে পারেন, তবে সেই ভালোবাসার মধ্যে স্বর্গের অনুভূতিকে স্পর্শ করা যায়। এভাবেই তিনি তাঁর সাহিত্যে প্রেমকে নানা আঙ্গিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
মারিয়া এবং অ্যানা স্নিতকিনাকে বিয়ে করা ছাড়াও দস্তয়েভস্কির জীবনে চকিত চমকের মতো দেখা দিয়েছিলেন আরও তিনজন নারী। তাঁরা হলেন ইয়াকোভলেভনা পানায়েভা, ইভানোভনা স্যুবার্ত এবং প্রোকোফিয়েভনা সুস্লোভা। এরমধ্যে সুস্লোভার সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মারিয়ার সঙ্গে তাঁর অশান্তির জীবনে একটু শান্তির হাওয়া এনেছিলেন সুস্লোভা। ১৮৬১ সালে দু’জনের পরিচয়। সুস্লোভা চেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করে তাঁকে বিয়ে করুক। কিন্তু অসুস্থ স্ত্রীকে দস্তয়েভস্কি ছেড়ে যেতে পারেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুস্লোভা অন্য এক যুবককে বিয়ে করেন। এক চিঠিতে তিনি যা তা বলে তিরস্কার করেছিলেন দস্তয়েভস্কিকে। তিনি বলেছিলেন, ‘ও একটা পাষণ্ড, আমি ওকে ঘৃণা করি।’
এভাবেই বোধহয় তাঁর সাহিত্যে প্রেমের মধ্যে ঘৃণা আর অবিশ্বাস এসেছে। এভাবেই বোধহয় তাঁর সাহিত্যে সুস্লোভা এক চরিত্র হয়ে ওঠে। ‘দ্য ইডিয়ট’-এর নাতাশিয়া ফিলিপোভনার মধ্যে যেন আমরা সুস্লোভাকেই খুঁজে পাই।
(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব পরের সংখ্যায়)
বেশ লাগল পড়ে।