শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

‘পুজোর গান’ এবং বাংলা বেসিক গানের স্বর্ণযুগের তিন অধ্যায়

Somen Dey

বাঙালির হয়তো তেমন ব্যবসাবুদ্ধি নেই, অর্থবান হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নেই, প্রতিষ্ঠা পাবার তীব্র বাসনা নেই। তাই জাত হিসেবে, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে; এটা সত্যি। কিন্তু বাঙালির প্রাণে চিরকাল গান ছিল ভরপুর। দুঃখে, শোকে, উৎসবে, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহে সবেতেই বাঙালি গান গায়। নৌকো বাইতে বাইতে, ধান রুইতে রুইতে, ছাত পেটাতে পেটাতে বাঙালি গান রচনা করেছে, এবং গলা খুলে সে গান গেয়েছে। সে গান বৈশিষ্ট্যের বিশালতায় পৃথিবীর যে কোনো দেশের গানের ধারাকে লজ্জা দিতে পারে। এ দেশে এসে জমিয়ে বসে একসময় সাহেবরা বাঙালির এই গানের খিদের মধ্যে যে একটা ব্যবসায়িক সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেটা বুঝে ফেললেন। গান বিক্রির ফন্দি ১৯০২ সালে এক ইংরেজ বণিক কোলকাতায় এলেন তাঁর গ্রামোফোন এন্ড টাইপরাইটার কোম্পানি লিমিটেডের শাখা খুলতে। তাঁর নাম ছিল – ওয়াটসন হড। হড সাহেব ছিলেন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। তিনি এ দেশে এসেই বুঝলেন যে এ দেশে গান সৃষ্টি হয় প্রচুর, ভালো গায়ক গায়িকা আছেন, গান লেখার, গান বাঁধার লোকও আছেন, কিন্তু গানের সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বিলেত থেকে ডেকে নিলেন ফ্রেড গেইসবার্গ নামে এক রেকর্ডিংয়ের কারিগরকে। অবশ্য হড সাহেবদের আগেও এ দেশে রেকর্ডিং শুরু হয়েছিল। তা শুরু করেছিলেন থিয়েটারের অমরেন্দ্র দত্ত আর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বোস। কিন্তু সে রেকর্ডিং-এর তাঁরা বাণিজ্যকরণ করেননি। হড সাহেবরা তাই ফাঁকা মাঠ পেয়ে গেলেন। সে কালে শহরের পয়সাওয়ালা বাবুরা গান শুনতে যেতেন হয় কোনো ঘরোয়া আসরে, শ্যামবাজারী থেটারে আর নয়তো জানবাজারের বাইজি বাড়িতে। নিজস্ব জলসাঘরওয়ালা জমিদার না হলে বাবুদের নিজেদের ঘরে বসে ইচ্ছে মতো গান শোনার কোনো উপায় ছিল না।


তাঁরা ব্যবসার দৃষ্টি দিয়ে তাক করলেন এই অবস্থাকে। তাঁরা বিলেত থেকে এমন প্রযুক্তি নিয়ে এলেন যা দিয়ে গান গালার চাকতিতে রেকর্ড করে বাবুদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যায়। বাইজিবাড়িতে গিয়ে গান শোনার চেয়ে নিজের বাড়িতে ফরাস পেতে, সুগন্ধি তামাক সেবন করতে করতে, নিজের সুবিধা ও পছন্দ মতো গান শোনাটা বাবুদের নিশ্চয় পছন্দ হবে এই ভেবে তাঁরা ব্যবসায় নামলেন। সম্পন্ন বাঙালি বাবুদের ঘরে ঢুকল একটি নতুন আসবাব- যার নাম গ্রামোফোন। নতুন গ্রামোফোন কোম্পানির স্লোগান হল – ‘সুখী গৃহকোণ – শোভে গ্রামোফোন’। একেবারে জব্বর ক্যাচলাইন।
বাঙালি সুখী গৃহকোণের মাপকাঠি হিসাবে গ্রামোফোনকে সত্যি সত্যিই দেখতে আরম্ভ করল। ক্রমে উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও গ্রামোফোনের চাহিদা বাড়তে থাকল। একবার এক গৃহস্থের ঘরে একটি গ্রামোফোন যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া মানেই সে ঘরে ডিস্ক রেকর্ডের স্থায়ী চাহিদা তৈরি করে দেওয়া, এটা সাহেবদের বুঝতে অসুবিধা হল না। সুতরাং গ্রামোফোনের সঙ্গে সঙ্গে ডিস্ক সঙ্গীতের চাহিদা ক্রমে বাড়তে লাগলো। এই নতুন পণ্যটি বাঙালির অবসরযাপনের ধারাকে অনেকখানি পাল্টে দিল। গোড়ার দিকে গান রেকর্ড করার জন্যে যাঁদের পাওয়া গেল, তাঁরা সবাই পেশাদার শিল্পী। সে সময় শহরে গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু সামাজিক ট্যাবু ছিল। তাই যাঁরা রেকর্ডে গান গাইতে এলেন, তাঁরা মূলত বাইজি শ্রেণির। যেমন গওহর জান, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, কৃষ্ণভামিনী ইত্যাদি। যে কোনো সামাজিক ট্যাবু চিরকাল থাকেনা। সময় একটু একটু করে তা ভেঙ্গে দেয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। গ্রামোফোন কোম্পানি সচেষ্ট হলেন ভদ্রসমাজ থেকে শিল্পী খুঁজে বের করে আনার। এক-দু’জন করে আসতেও লাগলেন। কিন্তু প্রাথমিক সংস্কার কাটানোর জন্যে, তাঁরা যে পেশাদার নন সেটা বোঝাবার জন্যে রেকর্ডের লেভেলে তাঁদের নামের পাশে ব্র্যাকেটে ‘অ্যামেচার’ শব্দটি লিখে দেওয়া হত। হায় বাঙালির সংস্কার, গানকে পেশা হিসাবে কখনো নিতে নেই, মনুসংহিতায় নাকি এ রকম বিধান দেওয়া আছে! তবে মনুর অনেক বিধানের মতো এ বিধানটিকেও সময় বাতিল করে দিল। এমন কি অভিজাত পরিবার থেকেও কেউ কেউ এগিয়ে এলেন রেকর্ডে গান গাইবার জন্যে। যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভগ্নী অমলা দাশ এলেন ‘মিস দাস (অ্যামেচার )’ নাম নিয়ে। চোঙ্গাওয়ালা গ্রামোফোনে দম দিয়ে কালো চাকতির ডিস্ক গ্রামোফোনে চাপিয়ে আরামকেদারায় বসে গান শুনে অবসর বিনোদন বাঙালির সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ল। গ্রামোফোন কোম্পানির ব্যবসা হু হু করে বাড়তে লাগল। কিছু বাঙালিও রেকর্ড ব্যবসায় নেমে পড়লেন। রেকর্ডে গান আসার ফলে বাঙালি সমাজে তিনটি পরিবর্তন ঘটল। এক নম্বর, গান, সে যে কোনো ধরনের গানই হোক, চণ্ডীমণ্ডপ, থিয়েটার, বাইজীবাড়ি আর জলসাঘর থেকে বাঙালির অন্দরমহলে প্রবেশ করল। রেকর্ডের গান শুনতে শুনতে গৃহস্থবাড়ির মহিলারাও রান্না করতে করতে গুনগুন করে দু’ কলি গাইতে আরম্ভ করলেন। দু’ নম্বর হল, গান সঠিক ভাবে সংরক্ষণের একটা উপায় বেরোল। দীর্ঘকালের স্মৃতি ও শ্রুতিবাহিত পরম্পরায় গানের যে বিকৃতি ঘটে যেত, তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।


তিন নম্বর, গানের গুণাগুণ বোঝার একটা মাপকাঠি তৈরি হল। রামপ্রসাদ, ভোলা ময়রা, নিধুবাবু, যদুভট্ট, গোপাল উড়ে এঁরা কেমন গান গাইতেন, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু গওহর জান থেকে লোপামুদ্রা মিত্রের গানের ডকুমেন্টেশন আমাদের কাছে রয়ে যাবে চিরকাল।

পুজোর গান- প্রথম অধ্যায়:

সে সময় সাধারণত রেকর্ডের গানগুলি বেরোত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। হয়তো শারদোৎসবের কথা মাথায় রেখেই। কিন্তু ঠিক ‘পুজোর গান’ বলে কিছু ছিল না। কোম্পানির মাথায় ফন্দি এল, এমনিতে গাঁয়ে-গঞ্জে তো বাঙালি আগমনী গান গেয়েই থাকে এই সময়টায়, তাই শহরের বাঙালির উৎসবের মুডের সঙ্গে যদি রেকর্ডের গানটাকে জুড়ে দেওয়া যায়, তা হলে ব্যবসার বেশ সম্ভাবনা আছে। ১৯১৪ সালে তাঁরা নেমে পড়লেন ‘পুজোর গান-এর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে। সে বছর তাঁরা ১৭টি রেকর্ড বের করে বিজ্ঞাপনে লিখলেন – ‘শারদীয়া পূজা উপলক্ষ্যে’। বিজ্ঞাপনের পোস্টারটি ছিল অভিনব। এক নবীনা বাঙালিনীদের মতো শাড়ি পরে নত মস্তকে, নম্র নেত্রে দু’হাতে পদ্ম ফুল বাড়িয়ে দিয়ে, অঞ্জলির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক পুষ্করিণীর ধারে। এক পাশে দেখা যাচ্ছে কাশ ফুল, অন্য পাশে পাহাড়ের ফাঁকে সূর্যোদয় বুঝিয়ে দিচ্ছে সময়টা সকাল বেলা। ইনলেতে লেখা ‘শারদীয়া পূজা উপহার’, September, 1914। নূতন ১০ ইঞ্চি ডবল সাইডেড ভায়োলেট (ধূমল বর্ণ ) – বাঙালা গ্রামোফোন রেকর্ড।’


শিল্পীদের তালিকা এ রকম – মানদাসুন্দরী দাসী, নারায়ণ চন্দ্র মুখার্জী, কে. মল্লিক, কৃষ্ণভামিনী, সরলা বাই, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শশীভূষণ দে, বেদানা দাসী প্রমুখ। সে বছর শ্রীমতী অমলা দাশ দুটি রবিবাবুর গানও গেয়েছিলেন – ‘হে মোর দেবতা’ আর ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’। এখান থেকেই ‘পুজোর গান’ শুরু করল তার যাত্রা। এরপর আমাদের দুর্গোৎসবের সঙ্গে গ্রামোফোন ডিস্কের গানের একটা অলিখিত আত্মীয়তা গড়ে উঠল এবং সেটা ক্রমশ গভীর হতে থাকল। গেরস্ত বাঙালির পুজোর বাজেটে ধুতি, শাড়ি, কামিজ, সেমিজ, ফ্রক, স্নো, পাউডার, আলতা, সিঁদুর-এর সঙ্গে পছন্দের শিল্পীদের দু’-একটা রেকর্ডও ঢুকে পড়ল। রেকর্ডের বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন গুণী সঙ্গীতশিল্পীরা রেকর্ড করতে আসতে আরম্ভ করলেন। শিল্পীদের গান গেয়ে অর্থ উপার্জনের একটা নতুন রাস্তা খুলে গেল। বিশ শতকের প্রথম দশকে এলেন গওহর জান, লালচাঁদ বড়াল, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা। সেই সঙ্গেই এলেন কয়েক জন নতুন শিল্পী, যেমন বিনোদিনী, কুমুদিনী, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি।


বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে যা ঘটল, তাকে বলা যেতে পারে বাংলা গানের জগতের এক রেনেসাঁ। কেন বলছি সেটা নামগুলি শুনলেই বোঝা যাবে, কেন এ সময়টাকে নবজাগরণ বলা হয়েছিল। আশ্চর্যময়ী দাসী, এম. এন. ঘোষ, ইন্দুবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ। এঁরা রেকর্ডের বাংলা গানকে এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের উচ্চস্তরের সাংগীতিক প্রতিভা দিয়ে।
কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৯১৭-তে পুজোর গান করলেন ‘মা তার মুখ দেখে কি’। সেকালে সুপার হিট। এ ছাড়া তাঁর কণ্ঠে যে সব পুজোর গান পরবর্তী কালে জনপ্রিয় হয়েছিল সেগুলি : ‘স্বপন দেখিছে রাধারানী’, ‘আমি চন্দন হয়ে’, ‘সখী লোকে বলে কালো’ ইত্যাদি।
১৯২২-এ আঙ্গুরবালা গাইলেন – ‘কত আশা করে তোমারি দুয়ারে’। ১৯২৩-এ ইন্দুবালা গাইলেন ‘তুমি এসো হে তুমি এসো হে, ওরে মাঝি’। ১৯২৫ সালে দিলীপ কুমার রায় পুজোতে রেকর্ড করলেন – তিনি গাইলেন দুটি গান- ‘ছিল বসি সে কুসুম কাননে’, ‘রাঙ্গাজবা কে দিল তোর পায়ে’।
১৯২৫-এ সাহানা দেবী গেয়েছিলেন অতুলপ্রসাদের দু’টি গান – ‘কত গান তো হল গাওয়া’, ‘শুধু দু’দিনেরই খেলা’।
সম্ভবত কাজী নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ডটি বেরোয় ১৯২৫ সালের পুজোয় – হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে, তার পরে নজরুলের গান করেন ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, হরিমতী, মৃণালকান্তি দাস,যূথিকা রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রমুখ। কমলা ঝরিয়া ১৯৩০ সালে পুজোতে প্রথম রেকর্ড করলেন – ‘প্রিয় প্রেম ভুলো না’, ‘নিঠুর দয়াবান কেন হানো’। ১৯৩১-এ ধীরেন্দ্রনাথ দাস গাইলেন সেই বিখ্যাত গান যা আজও গাওয়া হয়ে থাকে – “শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও”। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ধীরেন্দ্র নাথ দাসের গাওয়া পুজোর গান – আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও।
কনক দাস ১৯৩১ সালে অতুলপ্রসাদের দু’টি গান গাইলেন – ‘কী আর চাহিব বল’, ‘তব চরণ তলে সদা রাখিও’। তিনি ১৯৩৬-এর পুজোতে গেয়েছিলেন দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত – ‘কাছে থেকে দূর রচিল’, ‘সেদিন দুজনে’। তখনও পর্যন্ত বাংলা আধুনিক গান বলে কোনো গানকে চিহ্নিত করা হয়নি। এই আধুনিক গানের তকমাটি কখন থেকে লাগল, এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। একটি মত বলছে, ১৯৩০ সালের ২৭শে এপ্রিল কলকাতা বেতারে শ্রী হৃদয়রঞ্জন রায় নামক এক গায়ক অনুষ্ঠান প্রচারের সময় আধুনিক গান শব্দটি ব্যবহার করেন। তার কিছুদিন পর থেকেই এই নামটি বাঙালি গ্রহণ করে নেয়। অবশ্য রবি ঠাকুর তার অনেক আগেই ইন্দিরা দেবীকে লিখিত একটি চিঠিতে তাঁর নিজের গানকে ‘আধুনিক গান’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৩০ সালে বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হল। বাংলা সিনেমায় দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রচুর গান ব্যবহার করার প্রয়োজন হল। নতুন সুরকার, গীতিকার, গায়কদের দরকার হয়ে পড়ল। নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হল| ডিস্ক কোম্পানিগুলিরও ব্যবসা বাড়তে লাগল| একদিকে চলচ্চিত্রের গান, অন্যদিকে বেসিক বাংলা গান, দু’রকম রেকর্ড বের হতে থাকল। বেসিক বাংলা গানগুলি বেশির ভাগই আধুনিক গান। ক্রমশ পুজোর সময় প্রকাশিত বেসিক বাংলা গানের সংখ্যা বাড়তে লাগল| প্রতি মাসে গানের রেকর্ড না বের করে পুজোর সময়েই সব সুরকার, গায়কেরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ গানগুলি প্রকাশ করতে শুরু করলেন। সিনেমায় তখনও স্টার প্রথা শুরু হয়নি। কিন্তু বাংলা গানে বহু উজ্জ্বল তারকা আলোকিত করলেন বাংলা আধুনিক গানের আকাশ।

পুজোর গান- দ্বিতীয় অধ্যায়:

চল্লিশের দশক থেকেই শ্রোতাদের মধ্যে পুজোর গানের জন্য এক উন্মাদনা সৃষ্টি হওয়ার সূচনা হল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই উন্মাদনা একেবারে তুঙ্গে উঠল। বাংলা আধুনিক গানের তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ শুরু হল পঞ্চাশের দশকে। যেমন সব স্বর্ণকণ্ঠের গায়ক গায়িকারা এলেন, তেমনই এলেন অসামান্য সুরকারেরা। আর সেই সঙ্গেই এলেন অসাধারণ গুণী গান লিখিয়েরা। শুধু এই চল্লিশ থেকে সত্তর দশকের সময়সীমায় যা সব যুগান্তকারী পুজোর গান বেরিয়েছে, তা নিয়ে লেখা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব হবে না। তাই কয়েকটি মাত্র মাইলস্টোন গানের কথাই উল্লেখ করছি ।

১৯৩৭-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটল – ‘জানিতে যদি গো তুমি’ আর ‘বল গো বল’ এই দু’টি গান গেয়ে। তার পর যে কী করে বাঙালির সব ঋতুই হেমন্তকাল হয়ে উঠল সে এক অন্য ইতিহাস। প্রথমে কিছুটা পঙ্কজ মল্লিক ধাঁচে আরম্ভ করলেও অচিরেই নিজের এক ঋজু, মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠের স্বকীয় স্টাইল তৈরি করে ফেললেন। বলা যায়, সমগ্র পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশক জুড়ে ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘রানার’, ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘আমায় প্রশ্ন করে’, ‘শোনো কোনো এক দিন’– পুজোর এই সব সলিল-হেমন্ত সম্মেলনের গানগুলি বাংলা গানের ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় দাবি করে। সলিল চৌধুরী ছাড়াও পুজোতে গাওয়া কিছু মৃত্যুহীন গান – নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘কোন পাখি ধরা দিতে চায়’ ‘যদি জানতে চাও’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই’, নিজের সুরে ‘অলির কথা শুনে’ ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’ ইত্যাদি। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান – ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’।)

১৯৪২ সাল আর একটি সুললিত রোম্যান্টিক কণ্ঠ পেল, যাঁর নাম জগন্ময় মিত্র। তাঁর গাওয়া ‘চিঠি’ গানটি তো হইচই ফেলে দিয়েছিল। নিবিড় প্রেমসঙ্গীতের একটি নিজস্ব স্টাইলে হিন্দিতে জগমোহন এবং বাংলাতে জগন্ময় নামে তিনি অনেক কাল আধিপত্য করেছেন। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত জগন্ময় মিত্রের গাওয়া পুজোর গান – ‘তুমি আজ কত দূরে (চিঠি)’।

শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে ছিল লোকগানের ভঙ্গির সঙ্গে এক নেশা ধরানো, অননুকরণীয় স্টাইলাইজেশনের মিশ্রণ। ১৯৪৪-এ তিনি বোম্বাই পাড়ি দিলেন হিন্দি ফিল্মে সুরকার হওয়ার জন্য এবং সেখানে গিয়ে সাড়া ফেলে দিলেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই পুজোর গান করে যাচ্ছিলেন কখনো হিমাংশু দত্তের সুরে, কখনো নিজের সুরে| ১৯৩৬ সালের পুজোয় গাইলেন ‘মম মন্দিরে’, ১৯৩৮ সালে – ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’ আর ১৯৫৬ সালে সেই চিরনবীন গান – ‘মন দিল না বঁধু’ ইত্যাদি। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত শচীন দেব বর্মনের গাওয়া পুজোর গান – ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’।


চল্লিশের দশক ছাড়িয়ে পঞ্চাশের দশক পড়তেই একে একে পুজোর গান করতে আসতে লাগলেন এক-এক জন সব দিকপাল গায়ক গায়িকারা। ১৯৫৩ সালের পুজোয় প্রথম বাংলা আধুনিক বেসিক রেকর্ড করলেন মান্না দে। নিজের সুরে তিনি দুটি গান গাইলেন – ‘হায় হায় গো’ আর ‘কত দূর আর’। বোম্বের বাসিন্দা হয়েও পরবর্তীকালে প্রধানত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, কখনো নিজের সুরে, কখনো বা নচিকেতা ঘোষের সুরে তিনিও পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে গেয়ে গিয়েছেন অসংখ্য পুজোর গান।

১৯৫৯-এ গীতা দত্ত গাইলেন কানু ঘোষের সুরে – ‘ওই সুর ভরা দূর নীলিমায়/ আয় আয় আয় রে ছুটে আয়’। তিনিও বোম্বে সিনেমার জগত প্লাবিত করলেন তাঁর মায়াবী কণ্ঠে। কিন্তু পুজোয় বাংলা গান গাওয়া ছাড়েননি।

১৯৫২ সালের পুজোয় শ্যামল মিত্র সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে গাইলেন – ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’। বাংলা গানের চল্লিশের দশকের ন্যাজাল স্টাইলে পরিবেশনের তিনিই সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি। আজীবন তিনি সেই স্টাইলটি বজায় রেখেছিলেন।

১৯৫৩-র পুজোয় পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত বেরোল, যা নিতান্ত নাস্তিক প্রাণেও ভক্তিরস সঞ্চার করতে পারে – ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে’।

১৯৫০-এর পুজোতে সন্ধ্যা মুখার্জী গাইলেন – ‘ওগো মোর গীতিময়’, যা আজও আমাদের হৃদয় দ্রবিত করে। পরবর্তীকালে সিনেমায় সুচিত্রা সেনের লিপে তাঁর গানগুলি এক যুগ ধরে একচেটিয়া রাজত্ব করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে পুজোতে গেয়ে গিয়েছেন এমন অনবদ্য সব গান, যা শুধু তাঁর পক্ষেই গাওয়া সম্ভব।

১৯৫৭-তে মানবেন্দ্র মুখার্জী গাইলেন সেই ভাসিয়ে দেওয়া অতীন্দ্রিয় রোম্যান্টিক গান – ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। কণ্ঠে ধ্রুপদী অলঙ্করণ নিয়েও তিনি গেয়েছেন অসাধারণ রোম্যান্টিক সব গান। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’।

১৯৫২-তে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীর সুরে ভরাট গলায় গাইলেন – ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’। সত্যিকারের ব্যারিটোন কণ্ঠে গাওয়া তাঁর গানগুলিতে কিছুটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদল ছিল, আবার কিছুটা ভিন্ন একটা ধরনও ছিল। ১৯৫২তে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় মরমিয়া কণ্ঠে গাইলেন – ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’। তাঁর গানে এক ধরনের বিষণ্ণতা থাকত, যা তাঁকে আলাদা করে রাখত।
১৯৫২-তে তালাত মাহমুদ এক অদ্ভুত ট্রিমেলো দেওয়া স্টাইলাইজড কণ্ঠে গাইলেন – ‘চাঁদের এত আলো, তবু সে আমায় ডাকে’। তিনি অবাঙালি এবং মূলত হিন্দি গানের শিল্পী হয়েও প্রায় প্রতি বছরে পুজোর গান গেয়ে গেছেন।
১৯৫৮-তে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় মধুক্ষরা কণ্ঠে গাইলেন – ‘মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে’। তারপর তিনি অজস্র হিট গান গেয়েছেন।
১৯৫৩-র পুজোয় উৎপলা সেন ঈষৎ হাস্কি গলায় গাইলেন সলিল চৌধুরীর সুরে একটি অনবদ্য সলিল-ঘরানার গান – ‘মেঠো সুরের গান আমার’।
১৯৫৮তে লতা মঙ্গেশকর গাইলেন হেমন্তের সুরে একটি শান্ত ছায়াচ্ছন্ন গান – ‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে’।
আশা ভোঁসলে ১৯৫৯-র পুজোয় রেকর্ড করলেন মান্না দে-র সুরে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাওয়ার মতোই গান – ‘আমায় তুমি যে ভালবেসেছো, জীবনে যে তাই দোলা লাগল’।
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত আশা ভোঁসলের গাওয়া পুজোর গান –আমায় তুমি যে ভালো বেসেছ ।

এই দুই কিংবদন্তী বোন তার পর চার দশক ধরে আমাদের গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে এসেছেন, তার বিবরণ এক আলাদা অধ্যায় দাবি করে। ১৯৫৮তে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন – ‘ও আমার ছোট্টো পাখি চন্দনা’। গায়ত্রী বসু গাইলেন – ‘আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ’।
১৯৫৯-এ বোম্বে থেকে মহঃ রফি সাহেব এসে গাইলেন – ‘কথা ছিল দেখা হলে দু’জনে’।
ষাটের দশকেও পুজোতে এই সব গায়ক গায়িকারা তো মাতিয়ে রাখলেনই প্রত্যেক বছর পুজোর গানের সম্ভার, সেই সঙ্গেই বাঙালি পেল আরো অসাধারণ কিছু শিল্পীদের – ইলা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, গায়ত্রী বসু, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, ভূপেন হাজারিকা, পিন্টু ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অখিলবন্ধু ঘোষ, মৃণাল চক্রবর্তী এবং আরও অনেককে|
আর ষাটের দশক মেলোডির যাদুতে মাতিয়ে রাখলেন সুরকার সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রতু মুখোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এ সময়ে অসংখ্য সাড়া জাগানোর গান হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র এঁরা তো এই সময়েই গেয়েছেন অবিস্মরণীয় সব গান। তার সব উল্লেখ করতে গেলে তালিকা দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। বরং অন্য কিছু শিল্পীর কয়েকটি জনপ্রিয় গানের উল্লেখ করি। অখিলবন্ধু ঘোষ – ‘ও দয়াল বিচার কর’ (১৯৬২), মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘কেন জানি না যে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে’ (১৯৬৫), শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের – ‘ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা’ (১৯৬৫), ইলা বসু- ‘শুধু একটি দিনের চেনা’ (১৯৬৫ ), পিন্টু ভট্টাচার্যের – ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে’ (১৯৬৮ ), সুমন কল্যাণপুরের – ‘বাদলের মাদল বাজে’ (১৯৬৮ ), মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের – ‘ওই যে সবুজ বনবীথিকা’, মুকেশের –’মন মাতাল সাঁঝ সকাল কেন’ (১৯৬৮ ), সুবীর সেনের – ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’ (১৯৬৭ ), নির্মলা মিশ্রের ‘কাগজের ফুল বলে’ (১৯৭৪ ), অনুপ ঘোষালের – ‘এমনি চিরদিন তো কারো যায় না’, বনশ্রী সেনগুপ্তের ‘আজ বিকেলের ডাকে’ (১৯৭৩ ) ইত্যাদি। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত সুবীর সেনের পুজোর গান – ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’।


১৯৬৭-তে হৈচৈ সৃষ্টি করে পুজোর গানের জগতে প্রবেশ করলেন কুমার রাহুল দেব বর্মন। কিশোরকুমার, যিনি এতকাল কোনো অজানা কারণে পুজোর গান গাওয়া থেকে বিরত ছিলেন, তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন – ‘এক দিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’। আর আর ডি বর্মন নিজেই গাইলেন পরের বছর ১৯৬৮-তে – ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত আর. ডি. বর্মনের পুজোর গান – ‘মনে পড়ে রুবী রায়’ (নীচে ক্লিক করুন)।

এই দুটি গান দিয়ে বাংলা গানে এক নতুন যুগের শুরু হল। বলা যেতে পারে বাংলা গান চিরাচরিত ধুতি, শাড়ি ছেড়ে জিনস পরা শুরু করল এখান থেকেই। অর্কেস্ট্রেশন, রিদম, শব্দ পরিক্ষেপণ এ সব কিছুর মধ্যেই একটা তাজা হাওয়া নিয়ে এলেন তিনি। এর পরে একের পর এক আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ালেন অনবদ্য সব গান। সেই আর.ডি.-র বদলে দেওয়া স্টাইলের প্রভাব আজও চলছে।

একশো বছরে বাঙালি সমাজ যেমন অনেক পাল্টেছে তেমনি বাংলা গানেরও স্বভাব-চরিত্র অনেকটা পাল্টেছে। বিশ-তিরিশ দশকের পুজোর বাংলা গান যে স্টাইলে গাওয়া হত, তা শুনলে আজকের যুবক যুবতীদের হয়তো হাসি পাবে। সে সময়ের পুজোর গানে রেকর্ডিং এর গুণমান তো দুর্বল ছিলই, সেই সঙ্গেই উচ্চারণে কিছুটা কালোয়াতি ধরন, একটু বেশি রকমের গলার কাজ (গিটকিরি) দেখানোর প্রবণতা, একটু বেশি রকমের আনুনাসিকতা আর মন্দ্র সপ্তক এড়িয়ে তার সপ্তকে কণ্ঠ নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, এই সব মিলে সে সময়ের গানগুলিকে পরবর্তী সময়ের গানের থেকে আলাদা করে রেখেছে। এ ছাড়া গানে অর্কেস্ট্রেশন করার নানারকম যান্ত্রিক অসুবিধা থাকার ফলে ইণ্টারলিউড, প্রিলিউড বাজনা প্রায় থাকতই না। সে সময়ের শিল্পীদের নানা আসরে খালি গলায় গান গাইতে হত বলে এঁরা সব সময়েই ফুল থ্রোট ভয়েসে গান গাইতেন। তাতে গানের বাণীকে ব্যক্ত করার জন্যে পেলবতা দরকার হত সেটা এই সব গানে পাওয়া যেত না। আসলে গানের বাণীকে ততটা পাত্তাই দেওয়া হত না। রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতন ভাবে নিজের গান থেকে কালোয়াতি প্রবণতাকে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা সে সময়ের সঙ্গীতকারেরা করেননি। তার আরম্ভ হয় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। তবু এই সময়ের গানগুলি আজও শুনতে ইচ্ছে করে গায়ক গায়িকাদের কণ্ঠসম্পদের জন্য। দিলীপকুমার রায়ের ‘সমস্ত সুর হন্ত দন্ত’করা গান, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কীর্তনাঙ্গের গানের আর্তির মধ্যেও ধ্রুপদ সঙ্গীতের অনায়াস নৈপুণ্য, যূথিকা রায়ের কণ্ঠে জুঁই ফুলের সৌরভের সঙ্গে সূক্ষ্ম অলঙ্করণ, এ সবই আমাদের পরম ঐশ্বর্য হয়ে আছে এবং থাকবে।

চল্লিশের দশকে এমন সব সুরকারেরা এলেন যাঁরা ধ্রুপদ এবং দেশজ গানের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে পশ্চিমের জানলা খুলে দিলেন। এল একটা বদলের হাওয়া। বাংলা গান শুধুমাত্র রাগনির্ভর সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে অনেকটা মেলোডি-নির্ভর হয়ে উঠল। গানের বাণীকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হল। রেকর্ডিং ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার ফলে একাধিক বাদ্যযন্ত্র গানের সঙ্গে বাজিয়ে রেকর্ড করার ব্যবস্থা হল। শুধুমাত্র এস্রাজ, সারেঙ্গী, বেহালা, আড় বাঁশি এই অল্পসংখ্যক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের মধ্যে আটকে না থেকে কিছু বিদেশী বাদ্যযন্ত্র, যেমন- পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ান, গীটার, অর্গ্যান, ম্যান্ডোলিন এসবের ব্যবহার প্রচলিত হল। সব মিলে পুজোর গানের একটা নতুন চেহারা দেখা গেল। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলাম এই দুই মহান সুরকারের প্রভাব পড়ল বাংলা আধুনিক গানে। সেই সঙ্গেই কিছু পাশ্চাত্য সঙ্গীতেরও প্রভাব পড়ল। নতুন সুরের ডালি নিয়ে এলেন কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, সুবল দাশগুপ্ত, রবীন চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ দত্তগুপ্তরা। পরে তাঁদের কাছ থেকে রিলে রেসের ব্যাটন নিয়ে শুরু করলেন রতু মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ভূপেন হাজারিকা, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের মতো সুরকারেরা। এ ছাড়া একত্রে গায়ক-সুরকার হয়ে এলেন হেমন্ত মুখার্জী, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা।


আর গানের লিরিক্সেও ঘটল অনেক পরিবর্তন। অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরী, শ্যামল গুপ্ত, প্রবীর রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত এঁরা বাংলা গানের লিরিক্সকে নতুন চেহারা দিলেন। এ ছাড়া সলিল চৌধুরী তো একাই একশো। তিনি গানের কথায় অনেকটা আধুনিকতা নিয়ে এলেন। বিশের দশক থেকে ষাটের দশক অবধি চলল পুজোর গানে ডিস্কের জয়যাত্রা। এই সময়ের ডিস্কে প্রকাশিত পুজোর গান নিয়ে একটি আলাদা করে ইতিহাস রচিত হলে সেই সব গুণী মানুষদের প্রতি কিছুটা সম্মান জানানো হত। কিন্তু বাঙালির তো নিজেদের ইতিহাস রচনায় ভয়ানক অনীহা। হয়তো কোনো এক সাহেব এসে এই কাজটায় হাত দেবে কোনোদিন।

পুজোর গান – অন্তিম অধ্যায়:

সত্তরের দশকে প্রযুক্তির কল্যাণে এক ধাপ এগিয়ে গেল শব্দ রেকর্ডিয়ের জগত। স্টিরিও রেকর্ডিং এল। তার কিছুদিন পরেই সেই গালার বড় বড় চাকতিকে সরিয়ে চলে এল অডিও ক্যাসেটের যুগ। গান রেকর্ডিং করা অনেক সহজ হয়ে গেল। আর একটি ক্যাসেটে দশ থেকে বারোটি গান অনায়াসে ধরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর ডিস্ক নয়, এবার বেরোতে লাগল অ্যালবাম।
ভিনাইল রেকর্ডিং করা বেশ খরচসাপেক্ষ ছিল বলে রেকর্ড কোম্পানিগুলি খুব সাবধানে পুজোর গান বাছাই করতেন। যার ফলে অনেক শিল্পীকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে পুজোর গান পাওয়ার জন্যে। মৃণাল চক্রবর্তী, আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতন শিল্পীদের বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরেও পুজোর গান গাইবার সুযোগ পাওয়ার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই রকম একটা নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে পুজোর গানের একটা মান বরাবরই বজায় ছিল। প্রত্যেক গায়ক, গায়িকা, সুরকার, গীতিকারেরা চেষ্টা করতেন পুজোর গানে তাঁদের সেরা কাজটি উপহার দেওয়ার। এই সুস্থ প্রতিযোগিতাই জন্ম দিয়েছে শত শত কালজয়ী গানের।

ক্যাসেট যুগ আসার পর সে সব নিয়ন্ত্রণ একটু করে ঘুচে গেল। এ ছাড়া ডিজিটাল রেকর্ডিং, ট্র্যাক রেকর্ডিং-এ খণ্ড খণ্ড করে একটি গানকে রেকর্ড করার ব্যবস্থা, আরো বহু রকমের বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির ব্যবহার করার সুবিধা চলে এল। সুসাধ্যতা যেমন জীবনযাত্রায় অনেক নতুন সুবিধা এনে দেয়, ঠিক তেমনি তা মানুষের সৃষ্টিশীলতার উপরও কিছুটা আক্রমণ চালায়। ব্যাঙের ছাতার মতন ক্যাসেট কোম্পানি বাজারে চলে এল। তারা নানা শিল্পীদের খুঁজে এনে তাদের লঞ্চ করতে লাগল। প্রচার এবং প্যাকেজিং করে গানকে হিট করিয়ে দিতে পারলে তাঁরা দু’ পয়সা কামাতে পারবেন। তাতে গান ভাল হল বা নাই হল, কী আর আসে যায়?
এন্তার বেনোজল ঢুকে পড়ল গানের জগতে। সারা বছর ধরে অনেক অ্যালবাম বেরোতে শুরু করল। Quality আর Quantity-র বিরোধ অন্য কোথাও থাক বা না থাক, শিল্পের জগতে অবশ্যই আছে। তাই গানের মান ক্রমশ পড়তে লাগল। তার মানে এই নয় যে বাংলা গানের জগতের সর্বনাশ হয়ে গেল। তার পরেও অনেক ভাল গান তৈরি হয়েছে, অনেক গুণী শিল্পীরা এসেছেন। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মতন বাংলা গানের জগতের game changer-দের আবির্ভাব তো এই ক্যাসেটে অ্যালবাম বের করেই হয়েছে। নচিকেতা-অঞ্জনের মত নতুন ধারার শিল্পীরা, ভূমি-চন্দ্রবিন্দুর মত গানের দলেরা তো এই ক্যাসেট-যুগেই এসেছেন এবং দীর্ঘদিনব্যাপী ধরে রেখেছেন তাঁদের এই জনপ্রিয়তা। তবে বাঙালির সেই পুজোর গানের জন্যে সারা বছর অধীর অপেক্ষার দিন আর রইল না, তাঁদের পুজোর গান শোনার আবেগও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল। আরো কিছুদিন পরে এলো কম্প্যাক্ট ডিস্ক, যা আর উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন। এলো এম পি থ্রি। একটি ছোট্ট রূপালি চাকতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর মতো শিল্পীদের সারা জীবনের সাধনার ফসল অনায়াসে ধরিয়ে দেওয়া যায়। এবং তা যখন তখন কপি করে বিশ পঁচিশ টাকায় বিক্রি করা যায়। ভয় হয় এই কারিগরির কেরামতি এক ধরনের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ছদ্মবেশ নয় তো?

আজও হয়তো পুজোর গান নাম দিয়ে কিছু অ্যালবাম সিডি আকারে বেরোয়| কিন্তু কেউ সেগুলোর জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে থাকেন না। তেমন করে খবরও রাখেন না। সারা বছর শয়ে শয়ে নতুন গান শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়ে। বিক্রিও হয়, অতি আধুনিক হাই ফাই মিউজিক সিস্টেমে কোথাও কোথাও বাজে কিছু দিন| ইউটিউবে আপলোড করা হয়। শ্রোতারা শুনে লাইক দেন। সেই লাইকের সংখ্যা দেখে গান কতটা হিট হল বোঝা যায়। তার পর স্মৃতি থেকে কোথায় যে তারা হারিয়ে যায়, কে জানে!


‘অনুরোধের আসর’-এর মৃত্যু তো ঘটেছে কবেই। পুজো প্যান্ডেলে পুজোর নতুন গান বাজানোও এখন ধূসর স্মৃতি। যে নতুন প্রজন্ম হাজার খানেক গান আইপড-মোবাইলে ভরে কানে হেডফোন গুঁজে পথ চলতে চলতে শোনে বা মোবাইল স্ক্রিনে গান দেখে, তাদের কাছে একটি ৭৮ আর পি এমের গালার চাকতিতে ধরা দুটি মাত্র গান যে কতখানি মূল্যবান হতে পারে, তা বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা। তবু যদি কেউ অনুসন্ধানী হয়ে একটি মেলোডির ছায়া ঘেরা , খাঁটি বঙ্গজ মায়ামেদুরতায় সিক্ত হারানো গানের ইতিহাসের সন্ধানে যেতে চায়, তাদের জন্যে এই লেখাটি একটি সহজপাঠ মাত্র হতে পারে।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x