শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

স্মৃতির চিঠি : ভবতোষ দত্ত

ভবতোষ দত্ত নামটি শুনলেই বাঙালি সুধীজনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাঁর কথা মনে পড়ে তিনি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ লেখক অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত। কিন্তু তাঁরই সমকালে যে একই নামে আরেকজন বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন ছিলেন, যিনি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক এবং লেখক হিসেবেও যথেষ্ট যশস্বী, সে কথা হয়তো সবাই জানেন না।এই শেষোক্ত ভবতোষ দত্তই আমার এই লেখাটির উপজীব্য বলে প্রথমেই এই কথাটা উত্থাপন করলাম।

আমাদের আলোচ্য এই ভবতোষ দত্তের (১৯২৫-২০১০) আদি নিবাস ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জে। স্কুলে ছাত্রজীবনেই তাঁর কবিতা লেখায় হাতে খড়ি হয়। এসময় তাঁর রবীন্দ্ররচনাপাঠেরও অভ্যাস গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের রচনা ও ভাবনার চর্চাতেই তাঁর সারস্বত জীবনের বহুলাংশ ব্যয় হয়েছিল। ১৯৪১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আই এ ক্লাসের ছাত্র। স্নাতক স্তরের ছাত্র হিসেবে ঢাকাতে মোহিতলাল মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থ পড়তে গিয়ে তাঁর রবীন্দ্র-অবগাহন শুরু হয় বলা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স, এবং এম এ পাশ করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট হন।

ছাত্রজীবন শেষ হবার পরেই তিনি সাহিত্যের অধ্যপনাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রবীন্দ্র-অধ্যয়নও অব্যাহত ছিল ও নানা পত্রপত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে শুরু করে তিনি রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন ‘বিদ্যাসাগর অধ্যাপক’ ও সবশেষে ১৯৭৮ সালে তিনি বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র-অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রবিষয়ক তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ পরে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছে, যেমন রবীন্দ্র চিন্তাচর্চা, রবীন্দ্রসাহিত্য প্রসঙ্গ, ঐতিহ্য ও রবীন্দ্রনাথ, কবি তব মনোভূমি ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি বই:- মোহিতলাল মজুমদার : কবি ও সমালোচক, রবিবাসরে রবীন্দ্রনাথ, দেশ কাল সাহিত্য, বাংলা গীতিকাব্যের আদিপর্ব, চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র, কাব্যবাণী, বাঙালির সাহিত্য, কীর্তির্যস্য, বাঙালির সাহিত্য, সাহিত্যের কথা, আমার স্কুল, আশিতে পৌঁছে (স্মৃতিকথা) ইত্যাদি।

এ ছাড়া তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য, যেমন :- মোহিতলাল মজুমদারের ‘রবীন্দ্রনাথ’, আজহারউদ্দিন খানের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত ‘মোহিতলালের পত্রগুচ্ছ’ ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত ‘কবিজীবনী’। এ ছাড়াও রাধাকান্ত দেব, ক্ষিতিমোহন সেন, মোহিতলাল মজুমদার, সুশীলকুমার দে প্রমুখকে নিয়েও তিনি লিখেছেন।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় কীর্তিমান এই মানুষটির সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূচনার কাহিনীটি এবার বলা যাক। আমরা স্কুল পর্যায়ে যেসব বাঙালি কবিদের রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার কখনোই ছিলেন না। স্কুলজীবন পার হবার পরেও নানা প্রবন্ধে সম্পাদক, সমালোচক ও কবি হিসেবে তাঁর নানা উল্লেখ দেখেছি বটে, কিন্তু অনেকদিন তাঁর কোন রচনা সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেনি। এই পরিচয়ের জন্য একটি আকাঙ্ক্ষা বা কৌতূহল তাই মনের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল। ছাত্র জীবন শেষ হবার আরো ক’বছর পরে জামশেদপুরের একটি লাইব্রেরীতে পেয়ে যাই মোহিতলালের একটি কাব্যসংগ্রহ। সেটি থেকে তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কে আমার একটি ধারণাই শুধু তৈরি হয়ে যায়নি, কিছু কিছু কবিতার পটভূমি নিয়ে মনের ভেতর তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের জিজ্ঞাসা।

এর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘হেমন্ত গোধূলি’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় কোন অনামা বন্ধুকে স্মরণ করে কবি লিখেছেন, “বন্ধু তোমারে ভুলি নাই আজও যদিও দুদিন তরে/ দেখা হয়েছিল মর্ত্য-মরুর পথহীন প্রান্তরে।…” তারপর – ‘পরম আদরে সে ফুল-মুকুল তুলি লয়ে সবগুলি/ তুমি ‘ভারতী’-র অঙ্কে রাখিলে কাঁপিল না অঙ্গুলি।” ইত্যাদি। এই কবিতাটি পড়ে প্রশ্ন জেগেছিল, কে এই কবি-বন্ধু! উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে ভারতী নামটি দেখে আমার মনে হয়েছিল তিনি ভারতী পত্রিকা গোষ্ঠীর কোনও সাহিত্যিক হতে পারেন।

মোহিতলালের কবিতা ছাড়াও তাঁর কিছু চিঠিপত্র পড়ার সুযোগ হয়েছিল অমৃত, প্রতিক্ষণ, চতুরঙ্গ ইত্যাদি পত্রপত্রিকায়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি তাঁর বিরোধিতার কথা নানা প্রবন্ধে পড়ার পর মানুষ মোহিতলালকে আমার বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়েছিল। এই মানুষটিকে ও তাঁর নিজস্ব সাহিত্য-পরিমণ্ডলটিকে বুঝবার তাগিদে এরপর আমি কলকাতা থেকে কিনে ফেলি ‘মোহিতলালের পত্রগুচ্ছ’ নামে পূর্বোল্লিখিত বইটি, যার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন ভবতোষ দত্ত। এটিতে মোহিতলালের কিছু কবিতার ইতিহাস সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনাও তিনি করেছিলেন। সেটি থেকে এবং সাহিত্য আকাদেমী প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ রচিত তাঁর নাতিবৃহৎ জীবনীটি থেকেও প্রাথমিকভাবে তাঁর জীবন ও রচনার বিষয়ে নানা তথ্য পেয়েছিলাম।

আমার এই যৎসামান্য মোহিতলালচর্চা শুরু হবার পরে ১৯৮৮ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর সময় আমি মোহিতলাল সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম। এরকম একটি নিবন্ধের বিষয় ছিল মোহিতলালের কবিতার পূর্বোল্লিখিত বিভিন্ন আবৃত প্রসঙ্গ, অর্থাৎ কিনা সেই সব কবিতায় উল্লিখিত এমন কিছু ব্যক্তি বা প্রসঙ্গ, যা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই, তার পেছনের ইতিহাসটুকু নিয়ে যথাসাধ্য খোঁজখবর করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এইভাবে পড়াশোনা ও তথ্য সংগ্রহ করতে করতে কেটে যায় আরো দুই বছর। এই সূত্রে পূর্বোক্ত প্রবন্ধটি লেখার সময় কয়েকটি কবিতাপ্রসঙ্গে আমার মনে জেগে ওঠা কিছু জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল নিরসন করার যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে আমার ভবতোষবাবুর কথাই মনে হয়েছিল, কারণ তিনি লেখক হিসেবেই শুধু যে মোহিতলাল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, ব্যক্তিগতভাবেও মোহিতলালের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ও তাঁদের মধ্যে পত্রবিনিময়ও হয়েছিল। এই কারণে আমার জিজ্ঞাস্যগুলি উল্লেখ করে আমি শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় ভবতোষবাবুকে একটি চিঠি লিখি, যদিও সেই চিঠির জবাব এসেছিল বেশ কয়েক মাস পরে।

এত দেরিতে আমাকে চিঠি লেখার কারণটি ভবতোষবাবু আমাকে অবশ্য ওই চিঠিটিতে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই কারণটির সঙ্গে জড়িত ছিল ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার একটি প্রবন্ধ। ভবতোষবাবুর চিঠিতে উল্লিখিত আমার সেই প্রবন্ধটি সম্পর্কে এখানে দু একটি কথা না জানালে পাঠকের চিঠিটির বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় অজিতকুমার চক্রবর্তী, ক্ষিতিমোহন সেন ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে সেখানে কিছু ভারতীয়ের বেদান্তপ্রচার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর ভাষায় এরা ছিলেন ‘স্বামীনামধারী কিছু অযোগ্য লোক’, যারা বেদান্ত সম্পর্কে যা তা ব্যাখ্যা করে সে দেশের চোখে “ভারতের স্থানকে অত্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে।” রবীন্দ্রনাথ এদের কখনো ‘বিবেকানন্দের পরবর্তীরা’, কখনো বা ‘বিবেকানন্দের চেলারা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তাঁর অভিযোগ ছিল, এই বক্তারা ‘বিবেকানন্দের বুলি’ ওলট-পালট করে ভাষণ দিয়ে অল্পশিক্ষিত চাষাভুষো শ্রেণী ও মেয়েদের মধ্যে প্রভাববিস্তার করেন।

এই চিঠিগুলোর প্রাসঙ্গিক অংশের উল্লেখ করে আমি খ্যাতনামা বিবেকানন্দ-গবেষক শংকরীপ্রসাদ বসুকে একটি চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলাম যে, রবীন্দ্রনাথের উদ্দিষ্ট এই ব্যক্তিরা বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসীরা হতে পারেন কিনা। তা হয়ে থাকলে এ প্রসঙ্গটি তাঁর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ গ্রন্থমালায় আলোচিত হওয়া উচিত বলে আমি তাঁকে লিখেছিলাম এবং তা না হয়ে থাকলে তাঁরা কে বা কারা হতে পারেন, তা জানতে চেয়েছিলাম। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি আমাকে লেখেন যে, তাঁর মতে এরা রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসী নন। সে সময় কিছু ভণ্ড সাধু আমেরিকায় প্রচারকার্য চালাচ্ছিলেন বলে প্রবাসী পত্রিকায় নাকি লেখা হয়েছিল। তাই এ প্রসঙ্গটি তাঁর গ্রন্থে তিনি আলোচনা করবেন না। আর রবীন্দ্রনাথের উদ্দিষ্ট এইসব ব্যক্তি যদি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতে হবে, যা তিনি করতে চান না।

এই প্রসঙ্গটি নিয়ে শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় [বৈশাখ – আষাঢ় ১৩৯৭] আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আমার ওই প্রবন্ধে স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিগুলি সম্পর্কে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ওই অভিমতের উল্লেখ ছিল এবং বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা না করে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে তাঁর রামকৃষ্ণ মিশনকে সবরকম সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার এই প্রবণতার সমালোচনাও করা হয়েছিল। ভবতোষবাবু আমাকে লেখা চিঠিটির প্রথম অংশে আমার জিজ্ঞাসাগুলির উত্তর দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। চিঠির শেষ অংশে তিনি আমার জিজ্ঞাসা-তে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এই মূল্যবান চিঠিটির সম্পূর্ণ বয়ান ছিল এই রকম।

ভবতোষ দত্ত
কুন্দকলি, রতন পল্লী
শান্তিনিকেতন
পিন ৭৩১২৩৫
পশ্চিমবঙ্গ
১৮- ৯- ৯০
মহালয়া
শ্রী অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
প্রীতিনিলয়েষু
প্রথমেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার চিঠি পেয়েছিলাম গত এপ্রিল মাসে। সে সময় উত্তর দেব দেব করে দেরি করে ফেলেছিলাম। তারপর মে মাসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। শল্যচিকিৎসা করতে হল এবং তারপর পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্রাম নিতে হল বেশ কিছুদিন। সে -সময় আমি শান্তিনিকেতনের বাইরে ছিলাম। ততদিনে আপনার চিঠিখানা কাগজপত্রের আড়ালে পড়ে গেল। কয়েকদিন আগে ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় আপনার লেখা পড়ে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। তখন আপনার চিঠিখানা খুঁজে বের করে ঠিকানাটি রপ্ত করলাম। জিজ্ঞাসার প্রবন্ধটি নিয়ে আপনাকে নতুন করে চিঠি লেখার প্রেরণা পেলাম। আপনি যেসব প্রশ্ন মোহিতলালের কবিতা প্রসঙ্গে করেছিলেন তার যথাসম্ভব উত্তর এইসঙ্গে দিচ্ছি। সবগুলি কবিতার উদ্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে পারব না। যে কথা জানি আপনাকে জানাই।

১. ‘বিস্মরণী’ কাব্যের উৎসর্গ-কবিতা (চলেছিনু ক্লান্তপদে) কবি করুণানিধানকে নিয়ে লেখা। করুণানিধান ছিলেন বয়সে বড় এবং মোহিতলালের সাহিত্যজগতে প্রবেশের প্রধান উৎসাহদাতা।

২. হেমন্ত গোধূলির কবিতাটির উদ্দিষ্ট কে জানিনা। আপনি যে অনুমান করেছেন ভারতী গোষ্ঠীর কেউ হবেন — তা ঠিক নয় বলে মনে হয়। কারণ কবিজীবনের ‘হেমন্তে’ বসন্ত এল বলেছেন অর্থাৎ মোহিতলালের যৌবনশেষের কথা। ভারতীর যুগটা কবিজীবনের হেমন্তকাল নয়। ভারতী মানে এখানে সরস্বতী। আমার অনুমান ইনি এমন কেউ যিনি কবির শেষজীবনে হেমন্তগোধূলি প্রকাশের পূর্বেই কবিতা লিখে মোহিতলালের প্রীতিলাভ করেছিলেন। হেমন্তগোধূলি মনে হচ্ছে ১৯৪১-৪২-এ বেরিয়েছিল ১৯২৮-৪০ এর কবিতা নিয়ে। তার বহু আগেই ভারতী পর্ব শেষ হয়েছে।

৩. হেমন্তগোধূলির অন্য কবিতা ‘প্রশ্ন’ — এটি আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন যতীন দাসের আত্মদান উপলক্ষে লেখা।

৪. হেমন্তগোধূলির ‘যৌবনমুগ্ধা’ কবিতা কার উদ্দেশে লেখা অনুমান করতে পারছি না।

‘জিজ্ঞাসা’র প্রবন্ধে আপনি যে সংশয় উত্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত যথাযোগ্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারকারী সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আপনি আভাস দিলেও সেসব সন্ন্যাসী যে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী সেটা ‘পাথুরে প্রমাণের’ অভাবে জোর করে বলতে পারেননি। কিন্তু তখন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী ছাড়া আর কোন সম্প্রদায় আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার করছিলেন বলে জানি না। আপনি রামানন্দ পত্রাবলী (চিঠিপত্র ১২) থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং চিঠিতে কিছু বাদ দেওয়া হয়েছে জানিয়েছেন। সেই বাদ দেওয়া অংশে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে কিছু লিখেছিলেন কিনা জানি না। চিঠিপত্র ১২ যদিও আমি সম্পাদনা করেছি, কিন্তু মূল চিঠিপত্রের বেশির ভাগ অংশেই ছাপার দায়িত্বে ছিলেন স্বর্গীয় পুলিনবিহারী সেন মহাশয়। সে-কথা বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে।
সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে বিরূপতা প্রকাশ করেছেন সেটা আমি যতদূর বুঝি অপ্রত্যাশিত বা অস্বাভাবিক নয়। এটা সত্য সত্যই সন্ন্যাসীদের বিকৃত বেদান্ত প্রচার বলেও মনে করি না। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী (যারা সত্যই জ্ঞানী এবং পড়াশুনা করা) বেদান্তের ভুল ব্যাখ্যা করবেন এটা ভাবতে পারিনা। এটা আমার অন্ধ ভক্তি বলে বলছি না। শঙ্কর-প্রবর্তিত ব্যাখ্যা অনুসরণ করে বিবেকানন্দ বেদান্ত প্রচার করেছিলেন — তার সঙ্গে বিবেকানন্দের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এসব সন্ন্যাসীরা সেসব অধ্যয়ন করেই তৈরি হয়ে উঠতেন।

রবীন্দ্রনাথ যদি মনে করেন এরা বেদান্তের ভুল ব্যাখ্যা করছেন তবে সত্য ব্যাখ্যা কোনটাকে মনে করেন তিনি? মধ্বাচার্য মনে করতেন শংকরাচার্য ঠিক ব্যাখ্যা করেননি। বল্লভাচার্য মনে করেন মধ্ব ঠিক ব্যাখ্যা করেননি। চৈতন্য মনে করতেন শংকরাচার্য ঠিক ব্যাখ্যা করেননি। তাই বলে একে অপরকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করলে তাকে সুরুচিসঙ্গত মনে করি না। ভারতবর্ষে নানা ব্যাখ্যাতে বিভিন্ন philosophical system গড়ে উঠেছে।

আপনি শঙ্করীপ্রসাদ বসু মহাশয়কেও বিবেকানন্দের প্রতি অতি ভক্তিতে অন্ধ বলেছেন। শঙ্করীবাবুর সংকটটা আমি বুঝি। তিনি বিবেকানন্দকে যেমন শ্রদ্ধা করেন রবীন্দ্রনাথকেও তেমনি করেন। রবীন্দ্রনাথের মনোভাবটি খোলাখুলি বলতে পারছেন না তিনি। আপনিও রবীন্দ্রনাথকে ভক্তি করেন বলে স্পষ্টাস্পষ্টী বলতে পারছেন না যে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দকে পছন্দ করতেন না।

এই বিষয়টা যে আপনি আলোচনা করেছেন, এজন্য আপনাকে সাধুবাদ দিই। আপনার লেখায় অবশ্য চিঠিপত্র ১২-র একটি চিঠির নম্বর দিতে ভুল হয়েছে। সেটা মারাত্মক কিছু নয়।

প্রীতি নমস্কার নেবেন। ইতি ভবতোষ দত্ত।

সবশেষে এই চিঠিটিতে উল্লিখিত দু’টি বিষয় প্রসঙ্গে পাঠকদের অবহিত করা প্রয়োজন। প্রথম বিষয়টি হল, মোহিতলালের কবিতা প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে আমি ভবতোষ দত্তকে চিঠি লিখেছিলাম ১৯৯০ সালের এপ্রিলে। তারপর বেশ কয়েকমাস তাঁর কোনো পত্রোত্তর না পেয়ে আমি ‘মোহিতলালের কাব্যে আবৃত প্রসঙ্গ’ শিরোনামে আমার পরিকল্পিত প্রবন্ধটি লিখে ‘অমৃতলোক’ নামে একটি পত্রিকাতে পাঠিয়ে দিই এবং সে বছর শারদ সংখ্যায় [জুলাই – অক্টোবর ১৯৯০] সেটি প্রকাশিতও হয়। এর ফলে সে বছর মহালয়ার দিন লেখা ওই চিঠিটিতে ভবতোষবাবু কবিতাগুলি সম্পর্কে তাঁর যে-অভিমত জানিয়েছিলেন, সেগুলি আমার প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিষয়টি হল, জিজ্ঞাসা-য় প্রকাশিত আমার লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির উদ্ধৃতিতে যে ভুল পত্রসংখ্যার কথা ভবতোষ দত্ত মশাই উল্লেখ করেছেন, সেটি আসলে ছিল ওই পত্রিকাটির মুদ্রণ-প্রমাদ। এ কথা বলা বাহুল্য যে, আমার জিজ্ঞাস্য বিষয়টির উত্তর ছাড়াও আমার প্রবন্ধ সম্পর্কে তিনি যে স্বতঃপ্রবৃত্ত মন্তব্য করেছিলেন, সেটি ছিল আমার উপরি-পাওনা। নিজের লেখা সম্পর্কে ভবতোষ দত্তের মতো একজন বিদগ্ধ পাঠকের অযাচিত ও প্রশস্তিসূচক অভিমত পাওয়া — একজন নবীন লেখকের পক্ষে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
20 days ago

গুণীজনের পত্র যোগ্য অনুরাগীকে। ভাল লাগল। বিশিষ্ট জনের এমন পত্রভিত্তিক আলোচনা খুবই সুখপাঠ্য।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x