শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ

এমন একটা ভূখণ্ড, একদিন যার সব ছিল। রাজা ছিল, পন্ডিত ছিল, কবি ছিল, শিক্ষাবিদ ছিল, বিজ্ঞানী ছিল, শিল্পী ছিল, বিপ্লবী ছিল, সাধক ছিল, বীর সন্ন্যাসী ছিল, বিদ্রোহী দেশনায়ক ছিল। এদের সক্কলের ভুবন-জোড়া খ্যাতিও ছিল। এক কথায়, নানা রঙের আলোয় ঝলমল করত ভূখণ্ডটা।
দেশজোড়া মানুষজন চেয়ে চেয়ে সমীহের দৃষ্টিতে দেখতো ভূখণ্ডটাকে। বলত – ‘তোমাদের মাটি রত্নগর্ভা। তোমরা সৌভাগ্যবান। তোমরা আজ যেটা ভাবো, আমরা সেটা ভাবি আগামীকাল।‘
মাথার ওপর তখন বিদেশী শাসকের ভ্রুকুটি, তর্জন-গর্জন। দেশটাকে ওরা বজ্রমুষ্ঠিতে শাসন করেছিল দু’টি শতক ধরে। সেই শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, আন্দোলন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। যারা সর্বস্ব পণ করা নেতা ছিল, তারা পথ দেখাত। বহু মানুষ জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে, জীবনের পরোয়া না করে ঝাঁপ দিত সেই বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে কারণ তাদের নেতারা সৎ ছিল, ঐহিক সমৃদ্ধির থেকে তারা পরাধীন দেশের মর্মবেদনাকে অনেক বেশি মূল্যবান জ্ঞান করত। অন্যদিকে এই ভূখণ্ডটার দুর্বার স্রোত রক্তসঞ্চার করত, মিশে যেত সারা দেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে।
কালের প্রবাহে বিদেশীরা পাততাড়ি গোটালো। ভূখণ্ডটাও দু’খণ্ড হল কালনেমীর লঙ্কাভাগের অবিমৃশ্যকারিতায়। যারা আপন স্বার্থটি আগলাতে বাড়ি ও হাঁড়ি আলাদা করল, তারা নিজের প্রাপ্তিটুকুতে সন্তুষ্ট রইল না। যেনতেনপ্রকারেণ প্রসারিত করতে চাইল তাদের চাহিদাটিকে। সুতরাং ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত পদে পদে। যাক সে কথা।
হাজার আপদ-বিপদ, সমস্যাকে সঙ্গী করে এ’ প্রান্তে শুরু হল নতুন লড়াই। বেঁচে থাকার দৈনন্দিন সংগ্রাম। পাওয়া আর না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব ঝড় তুলল প্রতিদিনের নাগরিক জীবনে। সব চেয়ে বেশি বিড়ম্বিত হল পশ্চিম পারের ভূখণ্ডটি, লাগামহীন, বিরতিহীন মাটি-ঘর-দুয়ার হারানো ছিন্নমূল জনসমাগমে। এই নবাগত জনতা ফেলে আসা স্মৃতিকে বুকে আগলে রেখে অসীম বেদনা ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নতুন করে নতুন মাটিতে তাদের শেকড় প্রোথিত করতে ব্রতী হল। বদলে যেতে লাগল এই ভূখন্ডের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি।


এই প্রেক্ষাপট রচনা করল স্থিতাবস্থার অবসানের, নতুন যুগের নতুন প্রয়োজনের বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, আন্দোলনের। শহরে ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল আধুনিক চেতনাজারিত সাম্যবাদী আন্দোলনের ঢেউ, নতুন রাজনৈতিক ভাবনার তরঙ্গ। এভাবেই দেশ ও রাজ্য পেরিয়ে এ্ল স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী এক দশক। ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল পশ্চিম পারের রাজনীতির ঢেউ। তার ছোঁয়া লাগল তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। উঠে এলেন নতুন দিনের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সুরকার, গায়ক, ছবি-করিয়েরা। গড়ে উঠল নবজোয়ারের সংস্কৃতি-চেতনার সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড, সাধারণ মানুষ যার ভরকেন্দ্র। গানে, কবিতায়, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে, রাজনীতিতে, স্লোগানে, মিছিলে, হরতালে, জনসভায়। দিশায় এবং দিশাহীনতায় সে এক অ-ভূতপূর্ব জন-জাগরণ।
এই উত্তাল সময়-পর্ব চলল দু’টি দশক। তারপর এক নতুন স্থিতাবস্থায় এল শাসন-যন্ত্র। সাধারণ মানুষের কিছু অলীক স্বপ্নের বাস্তবায়নের রঙিন প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
এর পরের তিন দশক একছত্র শাসন-ব্যবস্থার।
এই দীর্ঘ সময়ে সকলের অগোচরে বাঙালি ধীর লয়ে খুইয়ে বসল তার মনীষার দীপ্তি, সৃষ্টিশীলতার উত্তরাধিকার, মননের আভিজাত্য। এক অতি সাধারণ গতানুগতিক যাপন-প্রক্রিয়া ও ভোগবাদের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল সে। ভুবনায়ন এল তার শয়ন ও স্বপনের অপরিহার্য চালিকা শক্তি হয়ে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতার বিরুদ্ধে, অন্যায় ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন তখন তার কাছে আর প্রয়োজনীয় তো রইলই না, বরং হয়ে দাঁড়াল অতি ব্যবহারে জীর্ণ, অপ্রয়োজনীয় ও বিস্মৃত এক অতীত মাত্র। এই আবহে জন্ম নিল একদিকে প্রত্যহের জীবন-সংগ্রামে জর্জরিত এক নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, অন্যদিকে ভোগবাদে বিশ্বাসী মধ্য ও উচ্চবিত্ত এক নতুন প্রজন্ম, যাদের দেশ, কাল, সমাজ নিয়ে ভাবার সময় ও ইচ্ছে কোনোটাই নেই। এই জীবনপ্রবাহে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে, নীতিহীনতা বা দূর্নীতির বিরুদ্ধে বাঙালির সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের অবলুপ্তি ঘটে গেল।
ইতিমধ্যে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল বাঙালি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিপরীত মেরুর ও দর্শনের শাসক সম্প্রদায়, যারা বাঙালির সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়কে তাদের রাজ্য শাসন-প্রক্রিয়ার হাতিয়ার করে তুলল। বিদ্বজ্জনেরা ভয়ে বা নানা প্রলোভনে মূক ও বধির হলেন। সাধারণ মানুষ সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালেন। ইতিমধ্যে সব-হারানো বাঙালি এবার প্রকৃতই সর্বহারা হল।
এই পরিস্থিতিতেই প্রায় দেড় দশকের কাছাকাছি যখন অতিক্রান্ত, আকস্মিক এক ভূকম্পন অগ্নুৎপাত ঘটিয়ে দিল বাঙালির পূঞ্জীভূত পাপের পাহাড়ে। মর্মান্তিক এক অঘটনে নিভে গেল একটি উজ্জ্বল প্রাণের প্রদীপ। আমাদেরই ঘরের চিকিৎসক মেয়েটি তার কর্মস্থলে এক অভাবনীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দুর্বিষহ অত্যাচারের বলি হল। প্রাণ দিয়ে সে জানিয়ে দিয়ে গেল যে এবার অন্তত ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে বাঙালির।


অতঃপর আমরা দেখলাম, পথে প্রান্তরে, শহরে, শহরতলীতে, গ্রামে-গঞ্জে বাঙালির সংঘবদ্ধ রোষ কশায়িত কণ্ঠস্বর। সমস্বরে সে শাসককে জানান দিল, বাঙালির প্রতিবাদী সত্তা এখনো মরেনি, নির্দ্বিধায় নীরবে সে সব কিছু আর মেনে নেবে না। উন্মত্ত শাসকের রক্তচক্ষুকে অস্বীকার করার শক্তি সে অর্জন করেছে। এমনকি, সর্বোচ্চ শিখর থেকে ভেসে আসা কোনো অন্যায় নির্দেশনাকেও সে অস্বীকার করতে আর পিছুপা নয়।
নতুন শক্তি ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির নবীন প্রজন্মের এই রূপ কতকাল যে বাংলা দেখেনি! সর্বজনীনতায়, সহৃদয়তায়, দৃঢ়সঙ্কল্পতায় ইতিপূর্বে আদৌ দেখেছে কী?

[চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল]

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mridul Kanti Majumder
Mridul Kanti Majumder
20 days ago

অসাধারণ সম্পাদকীয়! খুব ভালো লাগলো।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x