শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

গাছের ডালে দোলনা টাঙিয়ে দোল দিচ্ছে সদ্যজাত শিশুটিকে নয়না l আর একটি হনুমান ছানার মত তার বুকের কাছে লেপ্টে রয়েছে l রাস্তায় ঘর সংসার নয়নার l এর মধ্যেই সে একটা পথের হোটেল চালায় l পথের হোটেল মানে লজঝরে টেবিল, ঝজ্ঝরে চেয়ার, প্যাকিং বাক্স কেটে তৈরী l বসতে গেলে যদি পেরেক ফুটে যায় তাই রেক্সিন বিছানো রয়েছে l এদিকে বাসনপত্র যা ধোয়াধুয়ি সব রাস্তার ধারের ‘টিপকলে’ l এইখান থেকে নয়নাকে বার দুই উঠেও যেতে হয়েছে বটে, তবে সে নাছোড় l আবার এনে সব সাজিয়ে বসেছে, পার্টির দাদাদের যা দেবার তাই দিয়েটিয়ে l চুলা দাউ দাউ জ্বলছে নিচে আর একটু দুরেই গাছের ডালে দোলনায় শিশুটি l দোলা থামলেই চিল চিৎকার জোড়ে অথচ হাত তো থামবেই l ভাতের ফ্যান গালতে, কুটনোটুকু কুটে নিতে, চাল ধুইতে, মসলা করতে, দুই হাত লাগেই l

এর জন্যেই রাস্তায় থাকা লোকজন ধরে রান্না জোগাড় দেওয়ায় নয়না l না করেই বা করবে কি? এই রাস্তায় থেকেই যাদের দিন গুজরান, তারা ভিক্ষে না মেগে যদি এই রাস্তায় থাকা মানুষদের জন্যে আজকের দিনেও দশ টাকার মাছভাতের হোটেল চালায়, ক্ষতি কি তাতে? তা নয়নার আছে একজন দুখীর মা, যার জীবনে সুখ মানে নয়নার ভাতের দোকানে একটুকু খাওয়া আর মুখে গুল দেবার জন্যে ক’টি পয়সা l

সক্কাল সক্কাল এসে চুলো ধরায় দুখীর মা l গতরাতের শেষ বাজার থেকে যে পচা গলা সব্জী কিনে আনে নয়না সেগুলোকে কেটেকুটে বেছেবুছে সাইজ করে রাখে একরকম l নিজের ঝোপড়ের বাচ্চা কাচ্চা সামলে নয়না এসে হাল ধরবে বলেই l ‘বলি ও নয়না, এই যে আলু আর কুমড়ো, আজ কি রান্না করবি এ দিয়ে, বলি সেইরকম তো কাটবো?’নয়না চেঁচিয়ে বলে, ‘কিছুটা রেখে দাও ভাতে দিয়ে দেব, জগু রিস্কার আবার গ্যাসটিক, ওর পেটে কিছু সয় নে, আর বাকি দিয়ে একটা আলু কুমড়োর ছক্কা কেটে দাও দিকিন, যাই দেখি কোথায় একটু ছোলা ভিজানো আছে l’ আহা আলু কুমড়োর ছক্কা খুব মুখের স্বাদে খায় সহদেব l ওর বড়টার বাপ l খায় মানে খেত, এখন আর বড়ো ইদিকপানে আসে না সে l ‘যাক সব যাক, বেঁচেছি, এখন আমোদ করুক ওই নচ্ছার জলার পেত্নীর সঙ্গে l’ ছোট ছেলের হিসি হাগার কাঁথা বদলাতে বদলাতে সর্পিনীর মতো গর্জায় নয়না l

প্রথম ব্যাচ বসিয়ে দেয় বেলা বারোটায় সে l আর তারপর থেকেই পর পর l মাঝে মাঝে রেগে পেছনে এক চাপড় মারে দুধ খাওয়া নেইআঁকড়ে কোলেরটিকে l ‘ঝা না রে শানতির ছেলে …’ তারপরেই জিভ কাটে l এ সব গালাগাল গুলতির মতো নিজের দিকেই এসে পড়ে যে l

আসল গপ্পোটা হলো এই, তার দুই ছেলের দুই জন বাপ, খরচ খরচা নাম মাত্র যোগায় তারা l এই অবরে সবরে একবার যখন রাত কাটাতে আসে তখন এটা ওটা, দু দশ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে যায় ছোটটার বাপ l তবু রাগ করতে পারে না নয়না l কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে নয়নার ওদের উপর l হাজার হোক, ব্যাটার বাপ l এর থেকে মিঠে সম্পক্ক আর কিই বা হতে পারে ! একবরে কি দোজবরে ও’সব মানে না নয়না l বড় ছেলের বাপটার বউ এসে মুখ নাড়া দিতে গিয়েছিল বটে l এমন চিল্লেছিল নয়না সেবার যে বড় রাস্তায় গাড়ি ‘দায়ঁড়ে গিসলো l’ ভয় পেয়ে সেই বউ দৌড় মারে শেষে l তারপর থেকে সহদেবের সাথে সব সম্পক্ক শেষ l ছোট ছেলেটার বাপের সাথে এখনের ঘরবসত l তা সে আসে মাঝে মধ্যে l রিস্কাওয়ালা রাকেশের দেশে বউ আছে l

যাক গে, যা বলছিলুম, আজ হাওয়া বড় জ্বালাচ্ছে l এদিকে ছোট ছেলে আর বড় ছেলে সমান তালে কান্না জুড়েছে l কি করবে … দিশা হারা নয়না হনুমানজীকে ডাক পাঠায়, হুই গাছের তলায় তার থান l হেই হনুমান জিউ বাবা তোমাকে কলা বাতাসা দেব, ছেলেদের কান্না থামিয়ে দাও l আজ মালতী পিসি বুড়িটাও যে কোন চুলোয়, এট্টু দোল দিয়ে উপকার করবে তাও নয় l এই সময় পাড়ার ছেলে বুড়ো মেয়েছেলে সব ‘কাগজ গুড়োতে’যায় l কারও দেখা নেই l নড়বড়ে দুখীর মা কোনোমতে লেট্ প্যাসেঞ্জার ট্রেনের বগির মতো ধিকিধিকি জোগাড় দিচ্ছে একরকম l নয়নার রাগ হলেও সে কিছু বলে না এই সব সাহায্যকারীদের, বলা তো যায় না, হুট্ করে ক্যাজুয়াল লিভ নিলেই হলো l ওদিকে বারোটার ভাত না দিতে পারলে, কাস্টমার ফেল হয়ে যাবে, বড় ‘লোশ্কান’ সে সব l এমন সময় হঠাৎ এদ্দিন পরে বড় পক্ষের বাবা, সহদেব এসে হাজির l অবস্থা ভালো না, বেশ টলায়মান ; একবার তাকে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে নয়না l কিন্তু এসেই নয়নার কোল থেকে নিজের ছেলেটাকে টেনে নেয়, কি একটা মিষ্টি দিয়ে তাকে ভোলাতে থাকে উলু লালা উলু লালা হেই দ্যাখ কাক, হুই দ্যাখ পাখি করে করে আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোলা দিতে থাকে অপরের ছেলের দোলাতে l বেশ যত্ন করেই দোল দেয়, আবার সুর করে এক ঘুমপাড়ানিয়া সুর গুনগুনায় l অবাক কান্ড, দুই ছেলেই চুপ l

নয়না হাঁ করে চেয়ে থাকে সেই বাপের পানে l

উল্টে সহদেব বলে – ‘হাঁ করে দেখছিস কি হারামজাদী … নে রাঁধ, আমি দেকচি এদের l

দুটো ভাত দিস না হয় আজ, তোর্ এখেনে না হয় দুটি খেয়েই যাব l বেশ করে একটু কুমড়োর ছক্কা আর কচি মাছের কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঝাল l তোর হাতের l আহ! মধু মধু l’ জিভের জলে শেষ দিকে লালা বেরিয়ে যায়, খক খক কাশতে থাকে সহদেব l

আজ ধোঁয়াটা বড় জোরে উঠেছে গো l নয়নার চোখে অসময়ে জল আসে কেন!

[চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.