শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

আরব সাগর তীরের সাহিত্য বাসরে সুনীল, সন্তোষকুমার, সমরেশ এবং শরৎচন্দ্র

বিস্মৃতিচারণা (পাঁচ)

সালটা ১৯৭৬। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শতবর্ষ পূরণের উদযাপন উপলক্ষ্যে সুদূর বোম্বাইতে বসেছে বাংলা সাহিত্যের তিন দিন ব্যাপী রাজসূয় সাহিত্য বাসর। তখনও বাণিজ্য নগরী দেশী নামকরণে মুম্বাই হয়ে যায়নি আর বঙ্গ সাহিত্যেরও এমন নক্ষত্রবিহীন ম্যাড়ম্যাড়ে দুর্দশাগ্রস্ত হালচাল হয়নি।

প্রখ্যাত ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কণিষ্ঠ ভ্রাতা স্বনামধন্য প্রবাসী সাংবাদিক সলিল ঘোষের আহ্বানে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের বার্ষিক সেই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলার প্রবীণ ও নবীন বহু অগ্রগণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী। প্রবোধ সান্যাল, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, মনোজ বসু, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সুমথনাথ ঘোষ, গোপাল হালদার, ব্যঙ্গচিত্রী রেবতীভূষণের মত প্রবীণদের এবং সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মত মধ্যবয়সী ও নবীনদের উপস্থিতিতে সমাবেশ হিসেবে সে ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক চাঁদের হাট! তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের মূল সভাপতি ছিলেন সমরেশ বসু, চলনে-বলনে, দর্শনে, জনশ্রুতিতে, বর্ণময়তায় ও জনপ্রিয়তায় তাঁর সমকক্ষ সে সময়ে বাংলার সাহিত্য জগতে আর কেউ ছিলেন বলে মনে করতে পারছি না। শ্রোতা হিসেবে চোখ ধাঁধানো সেই সমাবেশে হাজির থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

প্রথম দিনের প্রভাতী অধিবেশন। আলোচ্য বিষয়ঃ শরৎ সাহিত্যে আধুনিকতা। অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্তে বাংলা সাহিত্যের দিকপালেরা বিশালকায় মঞ্চে উপবিষ্ট। মালার লকেটের মত মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন অনুষ্ঠান সভাপতি সমরেশ বসু, পরনে গরদের পাঞ্জাবী, কারুকার্যখচিত উত্তরীয় ও ধাক্কা পাড়ের ধুতি। চোখে পড়ার মত শ্যামবর্ণ আকর্ষক ব্যক্তিত্ব। মাথায় ঘন কালো চুলের বাহার, অসামান্য উজ্জ্বল দুটি চোখে বাঙ্ময়তা। দিনের শুরুতে প্রভূত জনসমাগম সভাস্থলে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একত্রিত হওয়া প্রায় দেড় হাজার বাঙালির সমাবেশ।

সাহিত্যিকদের আলোচনায় নানা ভাবে উঠে আসছে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বিবিধ চরিত্রের সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা, সাধারণ মানুষের দরবারে তাঁর উপন্যাসের সীমাহীন গ্রহণযোগ্যতা, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে চরিত্রগুলির বিচার বিশ্লেষণ। প্রিয় সাহিত্যিকদের মুখে এই বিশ্লেষণগুলোর আবেদন তদানীন্তন সময়ে সাহিত্যপিপাসু ও আটপৌরে বাঙালি শ্রোতাদের কাছে পরম প্রাপ্তি ছিল, কারণ তাঁদের কাছে তখনও পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর সুগভীর প্রিয়তা ও আকর্ষণ অটুট।

জন্মশতবার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠান, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির সৃষ্টিকর্মের প্রশস্তিমূলক আলোচনাই চিরাচরিত রেওয়াজ। কিন্তু অধিবেশনের অন্তিম পর্বে এসে যেন কিছুটা বেসুরো গাইলেন দুই বিশিষ্টজন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সন্তোষ কুমার ঘোষ। আলোচনার ফাঁকে ওঁদের দুজনের দুটি মন্তব্যে যেন কিছুটা আহত হলেন একটা গরিষ্ঠ অংশের সমবেত শ্রোতারা।

লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের অসামান্য জনপ্রিয়তা স্বীকার করে নিয়েই সুনীল বললেন, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যেন রূপকথার কাহিনি, মনকে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীনভাবে আবিষ্ট করে রাখে। সুনীলের ভাষ্যে যে কথাটি প্রচ্ছন্নভাবে অকথিত রইল, তা হল শরৎ সাহিত্য বাস্তবের সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। কিছুটা অলীক গোত্রীয়।

এরপর সন্তোষ কুমার ঘোষ। প্রাথমিক কিছু প্রশস্তিবাক্যশোভিত আলোচনার শেষ পর্বে কিঞ্চিৎ সমালোচনার সুরেই সন্তোষ বাবু বলে ফেললেন, এতৎ সত্ত্বেও শরৎচন্দ্রকে আমি আধুনিক ভাবনার সাহিত্যিক বলব না। সভাস্থল আকস্মিকভাবে যেন বজ্রাহত হল। উনি বললেন, উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, শরৎচন্দ্র তাঁর ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে রমা ও রমেশের প্রেম দেখালেও তাদের বিবাহ, অর্থাৎ বিধবার বিবাহ দেবার সাহস দেখাতে পারলেন না! কী করে বলি যে তিনি খুব আধুনিক মননের ও ভাবনার সাহিত্য রচনা করে গেছেন?

সভস্থলে বসে অনুভব করলাম যে সাহিত্যপিপাসু সাধারণ শ্রোতা, যাঁরা তখনও পর্যন্ত শরৎ্‌ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও গল্পের আবেশে সিক্ত ও প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেন, অগ্রগণ্য আধুনিক সাহিত্যিকদের সদ্য শতবর্ষ পেরোনো জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্যে তাঁদের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ।

আলোচনা পর্বের অন্তিম পর্যায়ে প্রথা অনুযায়ী মূল সভাপতির ভাষণ। সভায় বিতর্কের আবহে পোডিয়ামে উঠে এলেন সমরেশ বসু। সপ্রতিভ চেহারাটির মতোই ঋজু বাচনভঙ্গী। প্রত্যয়ী শব্দচয়নে তাঁর লেখার মতোই ঝরঝরে নির্মেদ উচ্চারণ, যা শ্রোতাকে মনোযোগী করে তোলে।

শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকৃতী নিয়ে বিগত প্রায় তিন ঘন্টা ধরে আলোচকদের আলোকপাতকে একটা সংহত রূপ দিলেন সমরেশ। অতঃপর সন্তোষ কুমার ঘোষের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সন্তোষদা, একজন বড় মাপের সাহিত্যিক আপনি। শরৎবাবুর আধুনিক ভাবনার পরিমাপ করতে গিয়ে ভুলে গেলেন অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সময়ের চরিত্রটিকে? বিয়ে হয়তো দিতে পারেননি শরৎচন্দ্র, কিন্তু কোন্ সময়কালে দাঁড়িয়ে পল্লীগ্রামের এক বিধবা তরুণী রমা ও তরুণ সমাজসেবী রমেশের প্রেম দেখিয়েছিলেন তিনি? কি করে আমরা মেনে নেব যে তাঁর সময়কালে শরৎচন্দ্র আধুনিক ছিলেন না?

শ্রোতাদের প্রবল করতালির মধ্যে অগ্রজ সন্তোষ কুমার সেদিন স্মিতহাস্যে নীরবে ও নত মস্তকে প্রতিবাদহীন ছিলেন অনুজ সমরেশের যুক্তির বিপরীতে।

এরপর সমরেশ সুনীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর সুনীল, আমি স্বীকার করি, শরৎচন্দ্র আমাদের সমাজজীবনের রূপকথার গল্প বলেছেন। অবশ্যই ওরা রূপকথা। কিন্তু তাঁর ওই রূপকথার কাহিনিগুলো কি ছাপ ফেলে যায়নি আজকের সুনীল, সমরেশের সাহিত্যকৃতীতে? একবার ভাব তো, ঠাকুমা দিদিমার কোলে শুয়ে রামায়ণ মহাভারতের রূপকথার কাহিনিগুলোর গভীর শ্রবণ কি আমাদের মননকে গড়ে তোলেনি? এত সহজে কি ওদের নস্যাৎ করা যায়? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্বের দাবি তিনি হয়তো করবেন না, কিন্তু বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের ওই সময়কাল তাঁকে এক মহান ঔপন্যাসিকের মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করবে না, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

প্রকাশ্য জনসভায় সমসাময়িক দুই ঘনিষ্ঠ দাদা ও বন্ধু সাহিত্যিকের বিপ্রতীপে মত প্রকাশ করে বিগত দিনের অগ্রজ ঔপন্যাসিককে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে যে মর্যাদা সেদিন মধ্যাহ্নে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু দিয়েছিলেন, তাতে দৃশ্যত আপ্লুত ও বিমুগ্ধ শ্রোতৃকূলের বিপুল শ্রদ্ধা তিনি নিজে অর্জন করেছিলেন।

বিস্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল শ্রোতাদের জন্যে। সমরেশ বললেন, আসুন, শরৎচন্দ্রের একটি অদ্যবধি অপ্রকাশিত উপন্যাস ‘সতী’ শোনাই আপনাদের। কোনো বক্তৃতা মঞ্চে স্মৃতি থেকে একটি উপন্যাসের শ্রুতি-পাঠ আগে কখনও শুনিনি। পরবর্তীকালেও না। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আজও যেন কানে বাজে।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.