শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

‘রাঢ় বঙ্গের কবি’ পৌঁছলেন একশ’ পঁচিশে

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ। রবীন্দ্রনাথ ত্রিশের কোঠা না-পেরোনো বাংলা সাহিত্যের উজ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে চিহ্নিত। ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ ইতিমধ্যেই তাঁকে তরুণ কবি হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছে; তখনো পর্যন্ত তাঁর দুটি মাত্র উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ প্রকাশিত। সদ্য বিশোর্ধ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখনও ভাগ্যান্বেষণে ভ্রাম্যমাণ, সেভাবে লেখনী ধারণ করেননি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বছর পাঁচেকের বালক মাত্র। জন্মদিনের নিরিখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমণের তখনো দশটি বছরের অপেক্ষা।

এই পটভূমি ও সময়কালে অবিভক্ত বাংলা পেয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর জন্মদিন ২৩ জুলাই, ১৮৯৮। আগামী দু’দিন পরে ১২৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে বাংলা সাহিত্যের চিরজীবী এই কথা-সাহিত্যিকের।

বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী মাত্রেই জানেন যে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের রাঢ় বাংলাকে ও সেখানকার নিম্ন বর্গের মানুষের গ্রামজীবন অসামান্য সংবেদনশীলতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন তাঁর উপন্যাসে ও গল্প-কাহিনিতে। আঞ্চলিক উপন্যাস রচনায় তারাশঙ্কর যে সময় অগ্রসর হন, সেই সময় বাংলা সাহিত্যে গ্রামীণ জীবনকে উপজীব্য করে আধুনিক উপন্যাস বিরল ছিল। এই পটভূমিতে তারাশঙ্কর তাঁর জীবনব্যাপী সাধনায় আপন পরিচিত ভূখণ্ডের জনজীবন থেকেই নিজের সাহিত্য সৃষ্টির উপাদান সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যে একটি ভিন্ন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর রচনায় একদিকে যেমন উঠে এসেছে অন্ত্যজ শ্রেণীর দুলে, বাগদি, কাহার, বোস্টম, বাউরি, ডোম, কবিয়াল সম্প্রদায়রা, তেমনি আবার রয়েছে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধিস্থানীয়েরাও। গবেষক সুরেশচন্দ্র মৈত্র লিখেছেন, তারাশঙ্কর হলেন “রাঢ়ের অকৃত্রিম একনিষ্ঠ শিল্পী; চণ্ডীদাসের পর বাংলা সাহিত্যে রাঢ়ের এত বড় নাগরিক দেখা দেননি। রাঢ়ই তাঁর পৃথিবী, বসুন্ধরা।… তারাশংকর রাঢ়ের আদিম প্রকৃতির আধুনিক প্রতিভূ।”

কথাশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি অর্জন করলেও তারাশঙ্কর তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। কবিতা রচনায় পত্রিকা সম্পাদকরা তাঁকে উৎসাহ দেন এবং কবিতাগুলি ছাপাও হতে থাকে। কিন্তু কবিতা লিখে যেন মন ভরে না তাঁর। অতঃপর শখ জাগল নাটক লেখার। লিখেও ফেললেন। এক আত্মীয়-বন্ধু তখন নাট্যকার হিসেবে নাম করেছেন। তারাশঙ্করের নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত তিনি। বললেন, ‘তোমার এই নাটক মঞ্চস্থ হলে চারদিকে হইহই পড়ে যাবে!’ কিন্তু সে নাটক কলকাতার এক নামকরা গ্রুপের ম্যানেজারকে জমা দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত ও অপমানিত হতে হল তারাশঙ্করের সেই আত্মীয়-বন্ধুকে। ঘটনা শুনে এতটাই বিড়ম্বিত ও লজ্জিত বোধ করলেন তারাশঙ্কর যে বাড়ি ফিরে নাটকের পুরো খাতাটাই উনুনে গুঁজে দিলেন। পুড়ে ছারখার হয়ে গেল নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন। যদিও পরে তিনি আবার নাটক লিখেছেন, কিন্তু এবার শুরু হল গল্প-কাহিনি লেখায় মনোনিবেশ।

১৯৩২ সালে ‘চৈতালী ঘূর্ণী’ দিয়ে শুরু তাঁর উপন্যাস রচনার জয়যাত্রা। এরপর একের পর এক জনচিত্তজয়ী উপন্যাস ও ছোটগল্পের ফল্গুধারা প্রবাহিত তাঁর প্রয়াণ অবধি। তিরিশ থেকে সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত তাঁর কলম থেকে উৎসারিত হল ‘রাইকমল’, ‘ধাত্রী দেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘অভিযান’, ‘কবি’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘চাঁপাডাঙার বৌ’, ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘মহাশ্বেতা’, ‘না’, ‘নাগরিক’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘কীর্তিহাটের কড়চা’, ‘ ফরিয়াদ’, ‘সুতপার তপস্যা’, ‘একটি কালো মেয়ের কথা’র মতো অসামান্য সব উপন্যাস।


তারাশঙ্করের সাহিত্য-জীবনের ব্যাপ্তি কিঞ্চিদধিক চল্লিশ বছরের। ১৯২৯-৩০ থেকে ১৯৭১। তাঁর প্রয়াণ ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর। মূলত সাহিত্য রচনাকে অবলম্বন করে চারটি দশক ব্যাপী তাঁর ফলবান জীবনের ফসল ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটগল্প সঙ্কলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ-সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, ১টি কাব্যগ্রন্থ ও ১টি প্রহসন।
চলচ্চিত্রে তারাশঙ্করের গল্প, নাটক ও উপন্যাসের অসামান্য গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ৪০টির বেশি কাহিনির চিত্ররূপের তথ্যটিতে। সত্যজিৎ রায়, দেবকী বসু, অজয় কর, তপন সিনহা, অসিত সেন, তরুণ মজুমদার সহ তদানীন্তন বহু বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে তারাশঙ্করের অমর সৃষ্টিসম্ভার।


জীবনে নানা পুরস্কারে ভূষিত হন তারাশঙ্কর। ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য ১৯৫৫ সালে তিনি পান ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ ও ১৯৫৬ সালে ‘সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার’। ১৯৬৭ সালে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্য ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারে ভূষিত হন। অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ১৯৬২ সালে অর্জন করেন ‘পদ্মশ্রী’ ও ১৯৬৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান। রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী-জামাতা কৃষ্ণ কৃপালনী ১৯৭০ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুইডিশ একাডেমির কাছে পেশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে নোবেল কমিটি জানিয়েছেন যে ১৯৭০ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলেও সঠিক অনুবাদের অভাব এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের কারণে সেই নোবেল তাঁর পাওয়া হয়নি। সে বছরে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন চিলির খ্যাতিমান কবি পাবলো নেরুদা।

বাংলা কথাসাহিত্যের এই জীবনশিল্পীর ১২৫ বছরের জন্মবার্ষিকীতে রবিচক্রের সশ্রদ্ধ প্রণতি।

(তথ্যসূত্র সহায়তাঃ উইকিপিডিয়া)

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Alak Baauchoudhury
Alak Baauchoudhury
2 months ago

এই মহান সাহিত্যিকের ১২৫ বছর স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। প্রসঙ্গত কৃষ্ণ কৃপালানি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী-জামাতা। নন্দিতা কৃপালানি রবীন্দ্র-কন্যা মিরা দেবীর মেয়ে।
Like · Reply · Delete · 1m

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
Reply to  Alak Baauchoudhury
2 months ago

যথার্থ বলেছেন। অমোনযোগী ভ্রমটি প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ধন্যবাদ। উনি কবির কণিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর জামাতা ও কবির দৌহিত্রী নন্দিতার স্বামী। ভুলটি সংশোধিত হল।

Tapan Kumar chatterjee
Tapan Kumar chatterjee
2 months ago

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যিক তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রকশ পঁচিশতম জন্মদিন উপলক্ষে যে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে।

সুলতা ভট্টাচার্য্য
সুলতা ভট্টাচার্য্য
2 months ago

সাহিত্যসৃষ্টিতে তারাশঙ্করের অসামান্য অবদান, যখন শিক্ষিত বাঙালীর মন থেকেও অবলুপ্তপ্রায়, তখন আপনার অনতিদীর্ঘ মনোজ্ঞ সম্পাদকীয়টির মূল্য প্রশ্নাতীত।
এই নিবন্ধটি আমাকে উদ্বোধিত করেছে বলেই তাঁর সাহিত্য সম্বন্ধে দুচারটি কথা, যা কেবল আমার একান্ত অনুভূতি, তা এখানে প্রকাশ করতে ইচ্ছে হল। তারাশঙ্করের ছোটগল্পের হাত ধরে, তাঁর সাহিত্যের প্রতি আমার যে মুগ্ধতা, তার রেশ এখনও বহন করে চলেছি। ভাষার ঋজুতায়, বিষয় নির্বাচনে ও পরিমিতি বোধে তিনি অনন্য। আর ছোট্ট উপন্যাস ‘কবি’তে তিনি যেন নিজেই হয়ে উঠছেন কবি, না হলে এক গ্রাম্য দরিদ্র কবিয়ালের ভাবমধুর রূপময়, ছবি এমন দ্যোতনাময় হয়ে উঠল কেমন করে। আর সামন্তপ্রথার শেষ প্রতিভৃ বিশ্বম্ভর রায়, যাঁর শিরায় শিরায় নীল রক্তের অহংকার, তাঁকেই বিস্মৃত হওয়া যায়। এই রূপবৈচিত্র্য উপহার দেবার বিধিদত্ত ক্ষমতা তাঁর সাহিত্যকে করেছে অমর। তাঁর কোন পূর্বসূরী ছিল না। আপনার সম্পাদকীয়ের রাঢ় বাংলার কবির প্রতি রইল আমার প্রণতি। আর আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।