শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

কোম্পানি-আমলের কোলকাতা এবং বাঙালির কারিগরি কেরামতি

রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে সীতানাথ ঘোষ নামের এক ব্যাক্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন। সীতানাথ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের প্রাকৃত বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাঁর নেশা ছিল নানা রকমের কলকব্জা বানানো। ১৮৭০ সালের হিন্দু মেলায় সীতানাথ ঘোষ তাঁর নিজের তৈরি এয়ার পাম্প এবং যন্ত্র-চালিত তাঁত প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা বিশেষ জানা না গেলেও সেই সময়ে খবরের কাগজ মারফৎ তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্র-চালিত তাঁতের বিষয়ে এইটুকু জানা যায় যে – ‘‘একজন লোক একদমে এই কল দ্বারা বিশ হাত কাপড় বুনিতে পারে”।

হিন্দু মেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সে সময়ের যারা বিদেশী দ্রব্য বর্জন করে বাঙালিকে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করানোর চেষ্টা করছিলেন তাঁদের কথা একটু ব্যঙ্গাত্মক ভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। সকলেরই মনে আছে সেই সব স্বদেশী সাবান, দেশলাই, গামছা নিয়ে নানান মজার কথা। যেমন যে স্বদেশী দেশলাই তৈরি করা হয়েছিল তার সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য – “আমাদের এক বাক্সে যে-খরচ পড়িতে লাগিল তাহাতে একটি পল্লীর সংবৎসরের চুলা ধরানো চলিত। আরও সামান্য একটু অসুবিধা এই হইয়াছিল যে নিকটে অগ্নিশিখা না থাকিলে তাহাদিগকে জ্বালাইয়া তোলা সহজ ছিল না।”
তবে সেই সময়ে বাঙালির কারিগরি বিদ্যায় স্বাবলম্বী হবার সব প্রচেষ্টাই যে এই রকম হাস্যকর ছিল তা নয়। অনেক বাঙালি নানা কলকব্জা উদ্ভাবনে, অভিনব ব্যাবসায়িক উদ্যোগে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের কথা আমরা বিশেষ মনে রাখিনি।
উনিশ শতকটা ছিল বাঙালি জাতির জন্যে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শতক। এই সময়ে বাঙালির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জগতে বড় বড় ওলট পালট তো হয়েছেই। সেই সঙ্গে কোলকাতার নগরায়নও জোরকদমে শুরু হয়েছে। এই শহরের আকার, চরিত্র, রাস্তাঘাট, বসতি-বিন্যাস, ব্যবসাবাণিজ্য, জীবনযাত্রা, যানবাহন, বিদ্যাচর্চা, লোকসংখ্যা এই সব ক্ষেত্রেই বদল আসতে লাগল। একদিকে কলকাতা ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মুনাফা-শিকারের লীলাভূমি হয়ে উঠল, অন্যদিকে কলকাতায় এক নতুন বাঙালি নাগরিক সমাজের উন্মেষ হল যেখানে দেখা গেল বাঙালির সাবেকী বংশগত বা জাতিগত পেশা বা বৃত্তির বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যেতে লাগল এবং বাঙালির সামনে নানারকমের স্বাধীন ব্যবসা বাণিজ্য এবং নতুন ধরনের কাজকর্মের মুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হল। এই সময় কারিগরি ক্ষেত্রেও নানা রকমের অগ্রগতি ঘটতে লাগল।
বৃটিশরা পুরোপুরি ভারতকে সব ক্ষেত্রে কব্জা করে নেবার পর তারা চেষ্টা করতে লাগল ভারতের নিজস্ব শিল্প এবং প্রাচীন প্রযুক্তি বিনাশ করে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফসলগুলিকে ভারতে বেছে বেছে প্রয়োগ করে তা থেকে নিজেদের মুনাফা তোলার। যেহেতু আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প এবং কারিগরি ক্ষেত্রের মধ্যে যন্ত্রের প্রয়োগ ছিল খুব সামান্য, তাই সে সব পণ্য উৎপাদন খরচা অনেক বেশি ছিল। বলা যেতে পারে আন্তর্জাতিক বাজারের বিচারে আমরা শিল্পের ক্ষেত্রে অনগ্রসর ছিলাম। বৃটিশরা সেই সুযোগটি কাজে লাগাল। রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ, এই দুই প্রযুক্তি এ দেশে এনে তারা গোটা দেশের মধ্যে একটা সংযোগের সেতু বানাবার চেষ্টা করল, মূলত তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে। ইংরেজরা যেহেতু কলকাতা শহরকেই তাদের রাজধানী করবেন বলে ভেবেছিল, তাই এ শহরটাকে তারা তাদের মনের মত করে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে লাগল। একে একে নানা রকমের প্রযুক্তি আনতে লাগলেন এখানে। কলকাতার বাঙালিরা নানাভাবে ইংরেজদের সংস্পর্শে আসতে লাগলেন এবং এর মধ্যে দিয়ে তারা ইয়োরোপীয় সভ্যতার আলোতটা নিজেদের আলোকিত করার সুযোগও পেতে লাগল।
এই সময়ে বেশ কিছু বাঙালি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনী শক্তি, কারিগরি দক্ষতা, এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা আমরা একটু স্মরণ করার প্রয়াস করব।

নীলমণি মিত্র


যেমন ধরা যাক নীলমণি মিত্র-র কথা।
জগৎ-বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ ক্যান্টাকুজিনো একবার কলকাতায় এসে এখানকার বাড়ির স্থাপত্যের ধরণ দেখতে বেরিয়েছিলেন। বাগবাজারে গিয়ে তিনি পশুপতি বোসের ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের স্থাপত্যের অভিনবত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই বাড়িটি ছিল নীলমণির মিত্র-র স্থাপত্য। এ’রকম কলকাতা জুড়ে তিনি অনেক বাড়ির ডিজাইন করেছিলেন। যেমন ‘বেলগাছিয়া ভিলা’, মেট্রোপলিট্যান স্কুল, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রাসাদ, মোহনবাগানের কীর্তিচন্দ্র মিত্রের বাড়ি ইত্যাদি। মাহেশের লোহার রথ তাঁর ডিজাইন করা। ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরটিও তাঁর পরিকল্পিত। বাঙালির যে এককালে মধুপুরে চেঞ্জে যাওয়ার ধুম পড়েছিল, তার পিছনেও নীলমণি মিত্রের ভূমিকা আছে। তিনিই প্রথম মধুপুরে এক ধরণের বিশেষ স্থাপত্যের স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলা শুরু করেছিলেন। সে রকম কিছু বাড়ি আজও হয়তো সেখানে রয়ে গেছে। কলকাতায় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা হবার পাঁচ বছর আগে, ১৮৫১ সালে রুরকির টয়াসন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৫৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি বিভাগের সহকারী আর্কিটেক্ট পদে কাজ করেছেন। ১৮৯৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে কলকাতা ইউনিভারসিটির ভাইস চ্যান্সেলর বলেছিলেন – The mansions of many wealthy inhabitants of Calcutta and other important buildings of public character, bear witness to the originality and success of his ideas.

নীলমণি মিত্রের স্থাপত্য – টেগোর ক্যাসেল

কলকাতার প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যদি নীলমণি মিত্রকে বলা যায়, তাহলে প্রথম ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা যায় শিবচন্দ্র নন্দীকে। তিনি অবশ্য ঠিক ডিগ্রিধারি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না। ইংরেজি ভাষাটা ভালো জানতেন। সেই সুবাদে চাকরী পান কলকাতা ট্যাঁকশালের রিফাইনার বিভাগে।এখানে কাজের সূত্রে পরিচয় হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম রসায়ন ও মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপক উইলিয়াম ব্রুক ও’সাগনেসির সাথে। কিছুদিন পরে ও’সাগনেসি যখন বৃটিশ ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ যন্ত্র স্থাপনার ভারপ্রাপ্ত হন। তিনি কলকাতা ট্যাঁকশালে শিবচন্দ্রের কারিগরি দক্ষতায় এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি শিবচন্দ্রকে নতুন প্রাপ্ত দায়িত্বে সহকারী করে নেন। এখান থেকেই শিবচন্দ্রের নতুন যাত্রা শুরু হয়। শিবচন্দ্র এই নতুন কাজে নিজেকে দ্রুত তৈরি করে নেন। টেলিগ্রাফ সংক্রান্ত নানান বইপত্র জোগাড় করে তা পড়ে টেলিগ্রাফের কাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা হতে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত পরীক্ষামূলক প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনায় সফলকাম হন। ১৮৫১ সালে এই প্রকল্পটি যখন শেষ হয় তখন শিবচন্দ্রই ডায়মণ্ড হারবার থেকে প্রথম বার্তাটি প্রেরণ করেন কলকাতায়। অন্য প্রান্তে তখন ও-শাগনেসির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং লর্ড ডালহৌসি। বড়লাট লর্ড ডালহৌসি সাংকেতিক ধ্বনিতে তাঁকে অভিনন্দিত করেন। এটা উল্লেখযোগ্য যে ওই একই বছরে আমেরিকাতে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে টেলিগ্রাফ লাইন পাতা হয় ওয়াশিংটন থেকে বালটিমোর অবধি। শিবচন্দ্রের কাজে সরকার বাহাদুর এতটাই সন্তুষ্ট হন যে এরপর তিনি প্রথমে টেলিগ্রাফ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর হন এবং কিছুদিন পরে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পদে উন্নীত হন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে দুর্বার গতি পদ্মার নিচে দিয়ে সাবমেরিন কেবল পাতার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। সেই সময় টেলিগ্রাফের খুঁটি আমদানী করতে হোত ইংল্যান্ড থেকে। শিবচন্দ্র অনেক কম খরচে তার বিকল্প বের করেন তাল গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে।

টেলিগ্রাফ ম্যান শিব নন্দী

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণের আগে বৃটিশ সরকার তাঁর কাজে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে।
১৮৮০ সালে প্রথম কলকাতায় পরীক্ষামূলকভাবে ইলেকট্রিক লাইট জ্বালানো হয় হাওড়া স্টেশনে। এটা অবশ্য ঠিক একট সুইচ টিপে আলো জ্বালবার মত সহজ ছিল না ব্যাপারটা। অনেক রকমের জটিল ব্যবস্থা করে আলো জ্বালানো হয়েছিল। কলকাতা শহরে ঘরে ঘরে বিজলি বাতি এসেছে অনেক পরে।
কিন্তু ১৮৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে চিৎপুরের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল একটি শোভাযাত্রা। সেই শোভাযাত্রায় দেখা গিয়েছিল বিজলি বাতি, যা ১৫০০ ক্যান্ডেল পাওয়ারের সেরিন ল্যাম্প অত্যন্ত উজ্বল এবং স্থির ভাবে আলো বিতরণ করছিল। এই কাজটি সম্ভব হয়েছিল জনৈক মিস্টার শীল নামক এক বাঙালির দ্বারা যিনি ‘দে, শীল এন্ড কোম্পানি’র অংশীদার ছিলেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় যে কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম গান গেয়েছিলেন, সেই সভাটি বিজলি বাতি দিয়ে উজ্বল করার ব্যবস্থা করেছিল এই ‘দে , শীল অ্যান্ড কোম্পানি’। পরের বছর রানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি অনুষ্ঠানে মিডলটন স্ট্রিটে দ্বারভাঙ্গার মহারাজার বাড়িতে এই কোম্পানিই বিজলি আলো দিয়ে সাজাবার ব্যবস্থা করেন। এই কোম্পানির তৈরি মোটর-চালিত সেলাই কল এবং টেবিল ফ্যানও কলকাতায় সে সময়ে খুব আলোড়ন তুলে ছিল।
জগদীশ চন্দ্র বোসের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলি কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তিনি কলকাতায় প্রথম এক্স-রের দ্বারা আলোকচিত্রও নিতে সমর্থ হন। যখন তিনি রন্টজেনের আবিষ্কারের কথা বই পড়ে জানতে পারেন, তখন তিনি তাঁর ল্যাবোর‍্যাটারিতে বেরিয়াম প্ল্যাটিনোসাইনাইড স্ক্রিনের সাহায্যে এক্স-রে চিত্র তুলতে উদ্যোগী হন এবং সফলও হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবোর‍্যাটরিতে জগদীশ বোসের নির্দেশনায় এই শহরে প্রথম এক্স-রে মেশিনটি যিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর নাম জগদিন্দু রায়। শ্রীরামপুর নিবাসী এই জগদিন্দু রায় ছিলেন জগদীশচন্দ্রের গবেষণাগারে ল্যাবোর‍্যাটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট।

উপেন্দ্রকিশোর


উনিশ শতকের শেষের দিকে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী বিলেত থেকে ছাপাখানা বিষয়ে নানান বই আনিয়ে পড়া শোনা শুরু করেন। এ’দেশে তখন হাফটোন ব্লক তৈরি করার প্রযুক্তি আসেনি। উপেন্দ্রকিশোর প্রসেস ক্যামেরার ব্যবহার নিয়ে যে গবেষণা করেন তা বিলেতের পেনরোজ নামের পত্রিকা, যা মুদ্রণ জগতের বাইবেল বলে মানা হত, সেখানে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় তাঁর ন’টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা বিলেতেও সাড়া জাগিয়েছিল। শুধু গবেষণা নয়, তিনি নিজে হাতে কলমে উচ্চমানের হাফটোন ব্লক তৈরির মেশিন তৈরি করেন। ১৮৯৫ সালে ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ নাম দিয়ে ছাপাখানা খোলেন। সে সময়ের ছাপাখানা নিয়ে সব চেয়ে বিখ্যাত বইটি ছিল J. Verfasser-এর লেখা। এই বইটিতে উপেন্দ্রকিশোরের আবিষ্কার নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করে লেখা হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ থেকেই কলকাতায় যাবতীয় হাফ-টোন ব্লক-কুশলীদের হাতে খড়ি হয়। পরবর্তীকালে তারা কলকাতায় নানা জায়গায় স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেন।

১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্রথম মোটর গাড়ি আসে। কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে সি বসাক নামের এক অভিজাত বাঙালি প্রথম মোটর গাড়ি কেনেন। বিশ শতকের প্রথম থেকেই কলকাতায় মোটর গাড়ি আসতে শুরু করে। ১৯০৪ সালে কলকাতায় আটোমোবাইল এসোসিয়েশন প্রতিষ্টিত হয়। তখন কলকাতায় রেজিস্ট্রি করা গাড়ির সংখ্যা ছিল গোটা ষাটেক।

হেমেন্দ্রমোহন বসু


১৯১০-১১ সালে হেমেন্দ্রমোহন বসু মোটর গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য হেমেন্দ্রমোহন বসুই এ দেশে প্রথম সাইকেল, গ্রামাফোন, গ্রামাফোন রেকর্ড-এর ব্যবসা শুরু করেন। এমন কি তিনি প্রথম ফোনোগ্রাফ এবং সিলিন্ড্রারিক্যাল রেকর্ডে কলকাতায় প্রথম রেকর্ডিং শুরু করেন। তিনিই প্রথম স্বদেশী সুগন্ধি দ্রব্যের উৎপাদন এবং ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর গাড়ির ব্যবসার কোম্পানির নাম ছিল ‘গ্রেট ইনডিয়ান মোটর কোম্পানি’। ৮৮ নং পার্ক স্ট্রিটে এই কোম্পানির শো রুমে আড়াইশোটি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা ছিল। তবে তখন পর্যন্ত সব গাড়িই বিদেশ থেকে আনা হত অথবা যন্ত্রপাতি এনে এখানে জুড়ে নেওয়া হোত।

কিন্তু বিপিন বিহারী দাস নামের এক বাঙালি বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে তাঁর নিজের গ্যারেজে একটি পনেরো অশ্বশক্তির সম্পূর্ণ স্বদেশী গাড়ি প্রস্তুত করেন। এটি হয়েছিল ১৯৩১ সাল নাগাদ। যতদূর খবর পাওয়া যায়, তিনি অন্তত তিনটি গাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। তার একটি কিনেছিল বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য এটি ব্যবহার করতেন। দ্বিতীয়টির ক্রেতা কলকাতা করপোরেশন। তৃতীয়টি সম্ভবত কিনেছিল গোয়ালিয়র স্টেট। বিপিন বিহারী সম্পুর্ন নিজের চেষ্টায়, দেশীয় প্রযুক্তিতে এই গাড়িগুলি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা কেই বা মনে রেখেছে!

বিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতায় টাইপরাইটার মেশিন নিয়ে আসে রেমিংটন কোম্পানি। এই মেশিনে ইংরেজিতে টাইপ করা যেত। ময়মনসিংহ জেলার ধনকুড়া গ্রামের নিবাসী সত্যরঞ্জন মজুমদার বাংলাতে টাইপ করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। ইংরেজি টাইপ রাইটার মেশিনে বিয়াল্লিশটি চাবি ছিল। মাত্র একটি একটি চাবি বাড়িয়ে তিনি এক অভিনব পদ্ধতিতে বাংলা অক্ষর টাইপ করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতির জন্যে তিনি পেটেন্টও রেজিস্ট্রি করেছিলেন।

সে’যুগের টাইপরাইটার

শুধু কলকাতায় নয়, কলকাতার আশেপাশেও এই রকম উদ্যোগী বাঙালি কারিগরের নাম পাওয়া যায়। কাঞ্চননগরের প্রেমচাঁদ মিস্ত্রীর তৈরি ছুরি কাঁচি সারা ভারতে ব্যবহার করা হত। প্রেমচাঁদ একটি নতুন ধরনের লেদ মেশিন উদ্ভাবন করেন।

আমরা জানি, ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফারমাসেটিক্যাল ওয়ার্কস’ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত। তিনি বাঙালিকে ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন এবং স্বদেশীয়ানাকে উৎসাহ দিতেন । ঐ কোম্পানিতে চাকরি করতেন সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত। একবার নিজেদের কোম্পানিতে যখন নলকূপ বসানোর দরকার পড়ে, তখন এদের একটি ইংরেজ সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়, কারণ এই প্রযুক্তি তখন এ’দেশে কারো জানা ছিল না। ইংরেজ সংস্থা এই কাজ করার জন্য অত্যধিক টাকা দাবী করে। সতীশবাবু ঠিক করেন যে তাঁরা নিজেরাই এই কাজটি করবেন। তাঁর নেতৃত্বে এই কাজ সফলভাবে সমাপন করা হয়। শুধু তাই নয়, কিছুদিনের মধ্যে বেঙ্গল কেমিক্যাল কলকাতার নানা জায়গায় নলকূপ বসানোর অর্ডার পেতে থাকে। সতীশবাবু কিছু ওড়িয়াবাসীকে এই কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, কিছু কিছু ওড়িয়া নিজেরাই এই ব্যবসা শুরু করে। আজকের দিনেও এই ধরনের কাজে ওড়িয়াদের আধিপত্য দেখা যায়। এর পিছনে ছিল সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত মশাইয়ের অবদান।

সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত


উনিশ শতকে রাজকৃষ্ণ কর্মকার নামের এক ব্যক্তি নেপালে রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কারিগরি বিদ্যায় তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ছিল। তিনি নেপালে ট্যাঁকশালে মুদ্রা নির্মান যন্ত্র বসান, অস্ত্রশস্ত্র আধুনিকীকরণের কাজ করেন, ঝর্ণার জল থেকে চলে এমন পানিচাক্কি নির্মাণ করেন, বৈদ্যুতিক আলো জ্বালবার ব্যবস্থা করেন, এমন কি নেপাল সরকারের জন্যে মেশিনগানও নির্মাণ করেন।

এ ছাড়া কাঁচ শিল্পে বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়, পেন শিল্পে ডঃ আর, এন, সাহা, সুগারকেন মিল তৈরিতে ফকির চন্দ্র দাশ, দেশলাই শিল্পে মহেন্দ্রনাথ নন্দী এই রকম অনেক বাঙালি কারিগরি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

তবে আমরা যদি আরও একটু পিছিয়ে যাই, মানে সেই যখন উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে এ দেশে, প্রথম ছাপাখানার প্রবর্তন হয়। ১৭৯৯ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে শ্রীরামপুরে শ্রীরামপুরের মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা যখন মিশনের হয়ে বাইবেল ছাপবার চেষ্টা করেন তখন তারা নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে তারা তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে কোনো সাহায্য পাচ্ছিলেন না। প্রেসের কাজ ক্রমশ বাড়তে থাকায় এরা বুঝতে পারলেন স্থানীয় বাঙালিদের সাহায্য ছাড়া তারা সব সামলাতে পারবেন না। মিশনারি ওয়ার্ড, ফেলিক্স, উইলিয়ম কেরী ছাড়াও একজন মুদ্রাক্ষরিক, পাঁচজন মুদ্রণকর্মী, একজন কাগজ ভাঁজ করার কাজে নিয়োজিত কর্মী ও একজন গ্রন্থবাঁধাইকার প্রেসের কাজে নিযুক্ত করেন এবং কিছুদিনের মধ্যে দক্ষ হরফ শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুর প্রেসে যোগ দেন এবং হরফ তৈরি করার একটি কারখানা স্থাপন করেন। পঞ্চানন, তাঁর জামাতা মনোহর এবং নাতি কৃষ্ণচন্দ্র হরফ শিল্পের একটি বিরাট কারখানা গড়ে তোলেন, যেখান হতে তিরিশ বছরের মধ্যে ১৮টি বিভিন্ন ছাঁচের মুদ্রাক্ষরে ৪৫টি ভাষার বই মুদ্রিত হয়। এঁরা সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হরফ প্রস্তুতকারী ছিলেন। পঞ্চানন শ্রীরামপুরে একটি হরফ তৈরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে তোলেন। প্রাচ্যে যন্ত্রবিদ্যার এটিই হচ্ছে প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছাপাখানায় বাংলা বর্ণমালার অক্ষর নির্মাণ করে পঞ্চানন কর্মকার ইতিহাসে স্মরণীয় থাকবেন।

পঞ্চানন কর্মকার

১৮০৪ খৃষ্টাব্দে পঞ্চাননের মৃত্যুর পরে তাঁর কাজ এগিয়ে নিয়ে যান তাঁর জামাতা মনোহর। ইনি পনেরোটি ভাষায় হরফ তৈরি করেছিলেন। পরে ১৮৩৪ সালে তিনি নিজে শ্রীরামপুরে চন্দ্রোদয় প্রকাশনালয় স্থাপনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র এই প্রেস চালাবার ভার নেন। তিনি শ্রীরামপুর মিশনের অনুকরণে নিজে একটি লোহার মুদ্রণযন্ত্র তৈরি করেছিলেন।

তবে ছাপাখানার ইতিহাসে আর একজন বাঙালির অবদান ভুলে গেলে চলবে না। তিনি গোলকচন্দ্র। প্রাথমিকভাবে ছাপাখানার কাগজ তৈরির জন্যে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন আনা হয়েছিল ১৮২০ সাল নাগাদ। সে বছরের মার্চ মাসে এটিতে প্রথম আগুন দেওয়া হয়েছিল। জানা যাচ্ছে, এই আগুন-কল দেখতে নানান শ্রেণীর ভারতীয়রা ভিড় করেছিল। এই ইঞ্জিনটি চালু হওয়ার পর শ্রীরামপুরে আর কাগজের অভাব রইল না। তবে গোলক চন্দ্র নামে টিটাগড়ের একজন পেশায় কামার বাঙালি এই ইঞ্জিনটি শুধু চোখে দেখেই সে নিজেই একটি স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করে ফেলেন। এই ইঞ্জিনটি কলকাতার টাউনহলে একটি প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছিল এবং ইংরেজ সরকার গোলকচন্দ্রকে ৫০ টাকা পুরষ্কারও দিয়েছিলেন। কলকাতা গেজেটে এই খবরটি বড় ছাপা হয়েছিল। তাতে লেখা হয়েছিল – A curious model of steam engine, made by Goluk Chunder, blacksmith of Titagarh, near Barrackpur, without any assistance whatever from European artists, was likewise exhibited, and although not coming within the immediate sphere of society’s exertions was considered so striking and striking instance of native ingenuity and initiative skill as to deserve acknowledgement . A donation of fifty rupees was therefore presented to the ingenious blacksmith.
গোলক চন্দ্র তাঁর নির্মিত ইঞ্জিনটি দিয়ে পাম্প চালিয়ে জল তুলে সবাইকে বিস্মিত করেন।

এ দেশে রেল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রথম থেকেই তাতে বাঙালির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। রোন্যাল্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিভেন্সন যখন এ দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করেন, তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রস্তাব দেন কলকাতা থেকে কয়লাখনি অধ্যুষিত রাণীগঞ্জ অবধি রেল পথ স্থাপনের এক তৃতীয়াংশ খরচা তিনি জোগাড় করে দেবেন। পরে অবশ্য তিনি কোনো কারণে তাঁর মত পরিবর্তন করে নিজেই উদ্যোগ নেন একটি আলাদা কোম্পানি খোলার। তাঁর কোম্পানির নাম হয় বেঙ্গল গ্রেট ইস্টার্ন রেলওয়ে। এই দুটি কোম্পানিই ১৮৪৪ সালে লন্ডনে রেজিস্ট্রি করা হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই দ্বারকানাথ লন্ডনে মারা যান। তাঁর কলকাতাকেন্দ্রিক একটি দেশীয় রেল কোম্পানি খোলার পরিকল্পনা রূপায়িত করা গেল না। তবে এখানেই শেষ নয়। ১৮৯০ সালে হোপ প্রত্রিকার সম্পাদক অমৃত লাল রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলওয়ে কোম্পানি। এই কোম্পানি তারকেশ্বর এবং রুদ্রাণীর মধ্যে রেল চলাচল ব্যবস্থা শুরু করে। সতেরোটি স্টেশন সহ এই রেলপথে তিনটি ইঞ্জিন ও ষাটখানি বগি দিনে ছ’বার করে যাতায়ত করত। এই কোম্পানির অন্যতম পরিচালক ছিলেন রামগতি মুখোপাধ্যায়। তিনি একজন রুরকি থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এর আগে তিনি তীরহুত স্টেট রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। তা দক্ষতায় বৃটিশরা এতটাই খুশি ছিলেন যে তাঁর নামে একটি ইঞ্জিনের নাম দেওয়া হয় – রামগতি।

রামগতি

আর একজন রুরকি থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন অন্নদা প্রসাদ রায়। তাঁর তত্ত্বাবধানে চারটি সেতুসহ তেত্রিশ মাইল লম্বা একটি রেলপথ পাতা হয়েছিল।

মনে রাখতে হবে ইংরেজরা এ’ এদেশে নেটিভদের ঠিক ততটুকুই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে চেয়েছিল যতটুকু করলে তাদের কাজের এবং ব্যবসা সম্প্রসারণের সুবিধা হয়। তাই কলকাতায় কারিগরি শিক্ষার স্কুল কলেজ শুরু হয় অনেক পরে। ইংরেজরা প্রধানত পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের চাহিদা মেটানোর জন্যে স্থাপন করে তিনটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ – রুরকি, পুনে এবং কলকাতায়, যা পরে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

যাঁদের কথা উল্লেখিত হল তাঁর প্রায় সকলেই প্রায় স্বশিক্ষিত ছিলেন, অথবা প্রথাগত শিক্ষার বাইরে গিয়ে তাঁর নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
সংস্কৃতি-প্রিয় বাঙালি কারিগরি বিদ্যাকে খুব একটা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে নি। এবং ইংরেজ আমলে বাঙালি শিক্ষিত হবার পরে সৃষ্টি হল এক চাকুরিজীবী শ্রেণি। বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি থাকা সত্বেও, বাঙালিকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে উদ্যোগী হতে বিশেষ দেখা যায় নি।

আমাদের ‘বাঙালি চরিতাভিধান’ জাতীয় বইগুলি ঘাঁটলে বোঝা যাবে বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, সংগীত-ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক, সিনেমা বা নাটকের জগতে খ্যাতিমানদের তালিকার বাইরে কারিগরি জগতের কৃতিদের নাম সেখানে উল্লেখিত হয়নি বললেই চলে। আজকাল সমাজমাধ্যমে বাঙালির অতীতচর্চা এবং গুণীজন স্মরণের চল হলেও এঁদের নিয়ে বিশেষ চর্চাও হয় না।

এই নিবন্ধে যাঁদের কথা বলা হল তার বাইরেও অবশ্য আরও অনেক বাঙালির সেই সময় কারিগরি দক্ষতায় এবং উদ্ভাবনী শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন যাদের সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। তাই তাঁরা বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন। আসলে আমরা চিরকালই আত্মবিস্মৃত জাতি হয়েই রয়ে গেছি।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.