শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

অদূরে কোর্ট-বাড়িটা নানা লোকের ভিড়ে আর তাদের আওয়াজে গমগম করছে। এ-পাশটায় মাঠে টেবিল পেতে বসা কিছু লোকজন খাতাপত্র লেখায় ব্যস্ত, তাদের ঘিরেও থোকা থোকা কিছু লোকের ভিড়। আর এক পাশে কিছু খাবারের দোকানের ছাউনি, তার সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা । সেই দোকানের সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা গাবগাছের ঝাঁকড়া ছায়া, লোকজনের ভীড় কম। সেই ছায়ায় একটা প্লাসটিকের চেয়ারে সুধারানীকে হাত ধরে বসিয়ে রেখে গেল তার বড় মেয়ে আর এক নাতি। মেয়ে বুঝিয়ে বলল – “তোমার কাজটা হয়ে গেছে, এখন আরাম করে বসো। আর সবার সইসাবুদ হতে কিছুটা তো সময় লাগবেই।” এইটুকু বলেই সে মিলিয়ে গেল অদূরের ঐ রহস্যময় বাড়িটায়, যার নাম নাকি আদালত।

কর্তার মৃত্যুর পর থেকেই যেন ভাঙনের চেহারা প্রকট হতে শুরু করেছিল সুধারানীর সংসারে। তাঁর দুই মেয়ের অবশ্য তার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি আছেন দুই ছেলের তদারকিতে, যদিও বিশেষ ভাবে কেউ যে তাঁর তদারকি করে, এমনটা বলা যাবেনা । একই ছাদের তলায় সবাই একসঙ্গে বসবাস করছে, এই পর্যন্ত। বড় ছেলে ভালো চাকরি করে বিদেশী মার্কেন্টাইল ফার্মে, সে নিজে ফ্ল্যাট কিনে আলাদা হবার রাস্তা তৈরি করেই রেখেছিল। বছর দু’য়েক হলো, সে তার সেই নিজস্ব ইন্দ্রলোকে চলে গেছে– অবশ্যই পৈতৃক বাড়ির ভাগের দু’টো ঘরে তালা দিয়ে। এই বাপের ভিটে বিক্রি করে নিজের ভাগের টাকাটা নিয়ে যাবার জন্য নানা রকম প্রচারাভিযান শুরু করেছিল সে-ই।

মেজ ছেলে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়েছে, তার বৌয়েরও এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে নেই। বেশির ভাগ সময় থাকেও না। মেজ প্রকাশ্যে এতদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা বলতে না পারলেও সবাই জানে, একদিন সে শ্বশুরের কোনো একটা বাড়িতেই গিয়ে উঠবে। এখন বড় ভাইয়ের বাড়ি বিক্রির প্রস্তাবে সে জোর পেয়েছে।

সুধারানীর ভরসা ছিল ছোটছেলে। তিনি জানতেন যে, সে অন্তত বাড়ি ছাড়বে না, কারণ তার ফ্ল্যাট নেই, আপাতত শ্বশুরবাড়িও নেই। যতদিন সে চাকরি খুঁজছিল, ট্যুশনি করে আর মা’র সঙ্গে গল্পগুজব করেই তার দিন কাটত। সুধারানীর ভরসা ছিল, সে কখনই এই বাড়ি ছাড়বেনা – বাড়ি ছাড়া মানে তো তাঁকেই ছাড়া। ছোটও একবছর হল চাকরি পেয়েছে। তার জন্য এখন মেয়ে খোঁজা চলছে। এখন বড় বলছে যে, বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা শরিকদের মধ্যে ভাগাভাগি হোক, অথবা ছোট ছেলে চাইলে সে পুরো বাড়ি কিনে নিয়ে সবাইয়ের টাকা মিটিয়ে দিক । ছোট ছেলের নতুন চাকরি, তার সেই ক্ষমতা নেই যে, এত বড় বাড়ি কিনে নেয়। তাই অনিচ্ছাসত্বেও তাকে মেনে নিতে হয়েছে বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব। একতলার ভাড়াটেকেই বাড়িটা বেচে দেওয়া স্থির হয়েছে শেষ পর্যন্ত। যেহেতু মূল প্রস্তাবটা বড় ছেলের, উৎসাহ বা স্বার্থ তারই বেশি। তাই সে-ই কথাবার্তা চালিয়ে বন্দোবস্ত পাকা করেছে।

সুধারানীর দুই মেয়ে শুধু নামেমাত্র শরিক। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাপের বাড়ি বলতে তারা এখনও এই ভাইয়েদের বাড়িকেই জানে। স্বভাবতই তারা কেউ চায়না যে, বাবার স্মৃতিচিহ্ন এতদিনের বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাক। কিন্তু নিজেদের শ্বশুরবাড়ি বা সংসার হবার পর ভাইয়েদের সংসারে তারা বিশেষ মাথা গলায় না। তাদের সংসারে অশান্তি হবে বলে এই বাড়ি বিক্রির প্রচেষ্টার তারা বিরোধিতাও করেনি।

ছেলেরা কিন্তু সুধারানীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার মনে করেনি। তিনি তো একজন শরিকমাত্র। ভাড়ার টাকাতেই তাঁর একার পেট চলে যায় ভালোভাবে। পূজোপার্বনে ছেলেমেয়েদের পোষাক-আষাক উপহার দেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো কর্তব্য বা দায়দায়িত্ব নিতে হয়না তাঁকে । পঁয়ষট্টি বছর পার করেও তাঁর স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো, না হলে এই গরম আর ধুলোর মধ্যে তাঁকে একলা বসিয়ে রেখে যেতে কি ভরসা পেত তাঁর ছেলেমেয়েরা!

মেয়েরাই তাঁকে জানিয়েছিল যে, বাড়ি বিক্রির জন্য আদালতে মালিকানা সংক্রান্ত একটি সম্মতিপত্রে সই করতে হবে তাঁকে ও সব ছেলেমেয়েকেই। তবেই বাড়ি বিক্রির আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে। আজ সেই প্রক্রিয়া সম্পাদন করতেই তাঁকে আনা হয়েছে আদালতের এই দপ্তরে। এটা যে সত্যিই তাঁকে করতে হবে, তা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি বলেই হয়তো কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছেন সুধারানী ।

মেয়েদের কাছে বাড়ি বিক্রি পাকা হয়ে যাবার কথা শুনে তিনি প্রতিবাদ করারও জোর হারিয়ে ফেলেছিলেন, শুধু অসহায়ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন– “তোদের বাবার রক্ত জল করে তৈরি ভিটে তোরা বেচে দিবি!” মেয়েরা তাঁকে বুঝিয়েছিল যে, এটা তাদের ইচ্ছে নয়, কিন্তু ভাইয়েরা চাইছে বলেই এটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে তাদের। তাঁকেও দুই মেয়ে পরামর্শ দিয়েছিল– ভাইয়েদের সংসারেই যেহেতু তাঁকে থাকতে হবে, তাদের ইচ্ছে মেনে নেওয়াই ভালো। না মেনে নিলে যে অশান্তি হবে, সেটা মেয়েরা তো চায়না, সুধারানীই কি চান! চিরদিন নিজের ইচ্ছে, সাধ, আহ্লাদকে অন্যের ইচ্ছের সামনে বলি দিতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, মেয়েদেরও সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।

ছোট ছেলেকে শেষ কুটো হিসেবে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় সুধারানী একবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, বাপের স্মৃতিচিহ্ন এই বাড়িটাকে কি বাঁচাবার কোনোই উপায় নেই ! বাবা কতটা পরিশ্রম আর ত্যাগের বিনিময়ে এই বাড়িটা খাড়া করেছিলেন, সেটা অবশ্য তার ব্যক্তিগত স্মৃতির মধ্যে পড়েনা, এ-সবই তার শোনা কথা, কিন্তু এই বাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়াটা আটকানোর সাধ্য যে তার নেই আর্থিক ক্ষমতার অভাবেই, সে-কথা সে মা’কে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এর পর সুধারানীর মুখে আর কথা সরেনি। তীব্র অভিমান যেন তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। বাড়ি বিক্রির পর তাঁর বা তাঁর ছোট ছেলের ঠিকানা কী হবে, সে-কথা জিজ্ঞাসা করারও ইচ্ছে হয়নি তাঁর!

“মা, তোমার কি জল তেষ্টা পেয়েছে ? জল বা চা খাবে কিনা, বলো !” ছোট মেয়ের প্রশ্নে ভাবনায় ছেদ পড়ল তাঁর। তিনি সংক্ষেপে জানালেন যে, তাঁর তেষ্টা নেই। আদালতের কাজকর্ম এখনও যে কিছুটা বাকি আছে, সেটা সে জানিয়ে আবার চলে গেল থার্মোফ্লাক্স নিয়ে।

তাঁর বাড়ি যে কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আজও সুধারানী জানেন না ! ছেলেদের বা মেয়েদের সে-কথা জিজ্ঞাসা করতে প্রবৃত্তি হয়নি তাঁর। তিনি শুধু তাদের ইচ্ছের সামনে যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছেন। ছোট ছেলে ভাড়া বাড়ি খুঁজছিল, পেয়েছে কিনা, তাও তিনি জানেন না। তাঁকে শুধু জানানো হয়েছে, আজ এই বহু স্মৃতিবিজড়িত তাঁর স্বামীর ভিটে হস্তান্তরিত হয়ে যাবে! এটা আজও তিনি ঠিকমতো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর চোখের সামনে খেলা করে বেড়াচ্ছে নয় নয় করেও তিরিশ বছরের স্মৃতি!

অল্প বয়সে অখিলেশ ব্যানার্জির হাত ধরে তাঁর সংসারে যখন সুধারানী প্রবেশ করেছিলেন, তখন এ-বাড়ির জমি কেনা হলেও বাড়ি তৈরি শুরু হয়নি। যে অপরিসর ভাড়াবাড়িতে তাঁর শাশুড়ি তাঁকে বরণ করে এনেছিলেন, সে বাড়ির ছবি আজও সুধারানী চোখ বুজলেই দেখতে পান। তাঁর মনে আছে, ঐ জমিতে একতলা একটা বাড়ি কোনোরকমে তৈরি করে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে সেখানে উঠে যেতে যে বছর পাঁচেক সময় লেগেছিল, সে-ক’বছরই শুধু নয়, তার পরও আরো দশ বছর, যতদিন এই তিনতলা বাড়ি তৈরি হয়েছে, ততদিন কী কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছিল অখিলেশ ব্যানার্জির পরিবারকে।

যেহেতু চাকরির উপার্জন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো আয়ের রাস্তা ছিলনা অখিলেশবাবুর, তাই সেই মাগ্গির বাজারে নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিল তিল করে বাড়ি তৈরি করা আর বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলা খুব সহজ কর্ম ছিল না। সুধারানীর মনে আছে, অফিসে ছুটি নিয়ে মাঝেমাঝেই বাড়ি তৈরির কাজ তদারক করতে হত তাঁর স্বামীকে। বহুদিন অফিসের পর বিকেলবেলা বাসায় না ফিরে তিনি সোজা চলে যেতেন বাড়ি তৈরির কাজ দেখাশোনা করতে। সুধারানী তাঁকে বেশি করে জলখাবার গুছিয়ে দিতেন। তাঁর জানা ছিল, মানুষটা ঘরে ফিরবে সন্ধ্যের পর ক্লান্ত হয়ে। ঘরে ফিরে বাড়ির কাজ কতটা এগোল, সেই গল্প যখন তিনি করতেন, তাঁরা শাশুড়ি-বৌ তা’ মন দিয়ে শুনতেন। আর অখিলেশবাবুর যখন দিনের পর দিন দেরি হত অফিসের পর বাড়ি ফিরতে, তাঁরা দু’জন নিজের বাড়ি তৈরি হলে তার চেহারা কেমন হবে, কোথায় বাগান হবে, কোথায়ই বা ঠাকুরঘর– এসব জল্পনাতেই সময় পার করে দিতেন৷

সুধারানীর বড় ছেলে আর মেয়ে ততদিনে সংসারে এসে গেছে। তাঁদের নতুন বাড়িতে উঠে যাবার সময় তাঁর বৃদ্ধা শাশুড়ি মা’র আনন্দ-উদ্ভাসিত মুখের চেহারা তাঁর আজও মনে পড়ে। গৃহপ্রবেশের ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো – এসব দৃশ্যও টুকরো টুকরো ভেসে আসছে তাঁর সামনে। তাঁর শাশুড়ি বলতেন, এ তো বাড়ি নয়, এ তাঁর শরীরের টুকরো! বড়ো মায়ায়, বড়ো গর্বে এ বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ পাথরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বৃদ্ধা। এ যে তাঁর নিজের ভিটে! সেই ভিটেতেই পরম শান্তিতে চোখ বুজেছিলেন তিনি। তার আগে পুত্রবধূর হাত ধরে বলে গিয়েছিলেন, এ ভিটের ভার আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম বৌমা!” –

তারপর এই বাড়ি কবে তিনতলা হয়েছে, তাঁর ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে– সবেরই নীরব সাক্ষী এই বাড়ি! এ যে তাঁর প্রতিটি পাঁজরের মতোই অবিচ্ছিন্ন এক সত্তা, একথা তাঁর শাশুড়ির মতো তিনিও উপলব্ধি করেছিলেন। তরুণ বয়সে বিশেষ কোনো সাধ-আহ্লাদ চরিতার্থ করার সুযোগ তিনি বা আখিলেশ ব্যানার্জি না পেলেও সে-নিয়ে কোনো আফসোস তাঁদের হয়নি। একটা সাধনার মতোই যেন এই তিনতলা বাড়ি তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর স্বামীও যখন এই বাড়িতেই চোখ বুজেছিলেন, তখন এই প্রশান্তি তাঁর চোখে লেগে ছিল যে, তাঁর ছেলেদের জন্য তিনি রেখে যাচ্ছেন একটা মাথা গোঁজার আশ্রয়।

কিন্তু অদূরে ঐ চায়ের দোকানে বসে নিশ্চিন্তভাবে আজ যারা কথাবার্তা বলছে, তাঁর ঐ ছেলেমেয়েদের কাছে এতটা দাম সম্ভবত এই বাড়ির নেই। এটা তো তাদের বুকের পাঁজর নয়! এটা তাদের কাছে একটা সম্পত্তি মাত্র ! এটাও যে আজ থেকে একটা অনস্তিত্বে পরিণত হবে, সেকথা এখনো সুধারানী ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না! এখনো তাঁর কানে বাজছে তাঁর শাশুড়ির সেই অন্তিম আকূতি – “এ ভিটের ভার আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম বৌমা!”

– “চলো মা, এবার উঠতে হবে, সব কাজ হয়ে গেছে এখানকার।”– বড় মেয়ের এই তাগিদে যেন তাঁর মনের ফ্রেম থেকে শাশুড়ির ছবিটা মিলিয়ে যায়। সুধারানী চকিতে ফিরে আসেন রূঢ় বাস্তবে। তাঁর মেয়ের ডাক তাঁর কানে ঢুকলেও মাথায় ঢুকেছে কিনা, সেটা তিনি বুঝতে পারেন না। সত্যি তা’ হলে এই বাড়ি এখন আর তাঁর নয়! ততক্ষণে মেজ ছেলে আর ছোট মেয়েও তাঁর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । ছেলে বলছে, “এবার আমরা যাব, চল মা!” সুধারানীর চোখে তখন অসহায় দৃষ্টি। সে দৃষ্টিতে যেন শেকড়-ওপড়ানো গাছের ছায়া। ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকান তিনি, প্রশ্ন করেন, “কিন্তু আমি যাব কোথায়?”

– “কেন, বাড়িতে!” — তারা সমস্বরে জবাব দেয়। সুধারানী বলেন, “কোন্ বাড়িতে যাব– আমার বাড়ি তো বিক্রি হয়ে গেছে!”

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.