শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

অরুন্ধতী একটি নক্ষত্রের নাম

শেষের কবিতায় অমিত রায় বলেছিলেন – কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার । পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি ।

অনেক মানুষের ক্ষেত্রে সেই কালচারের আলোর দীপ্তি দৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ হয় না, বোধ দিয়ে অনুভব করে নিতে হয়। কিন্তু এক একজন মানুষ শুধু উপস্থিতি দিয়েই এই রকম আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে পারেন। সে আলো শুধু বহিরঙ্গের রূপের নয়, অন্তরের ভিতর থেকে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক ঐ কমল হীরের দ্যুতির মতই। তেমনই একটি ব্যক্তিত্বের নাম অরুন্ধতী দেবী।

আসলে তিনি হয়ত হতে পারতেন একজন প্রথম সারির রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, হতে পারতেন একজন অধ্যাপিকা, হতে পারতেন একজন সাহিত্যিক, হতে পারতেন একজন চিত্রশিল্পী। কিন্তু ঘটনাচক্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাত হলেন বাংলা বানিজ্যিক সিনেমার নায়িকা হিসেবে। অবশ্য সেখানেও সুচিত্রা- সাবিত্রী-সুপ্রিয়ার মত তিন মহানায়িকার রমরমার দিনেও নিজের জন্যে একটা বিশিষ্টতার পরিসর ঠিক তৈরি করে নিয়েছিলেন।

তাঁকে নিয়ে কিছু বলার আগে আমরা বরং চলে যাই দুটি এমন ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যে যে দুটি তাঁর শিল্পী জীবনকে উত্তরিত করেছিল।

প্রথম দৃশ্য॥

স্থান – শান্তিনিকেতন

কাল – ১৯৩৭-৩৮

সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় শান্তিনিকেতনকে রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই তাঁর মনের মত করে গড়ে তুলেছেন। বয়সে পঁচাত্তরের কোঠা পেরিয়েও এই বিদ্যালয়ের সব কিছুর সঙ্গেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকছেন এখনো। মাঝে মাঝেই বিদেশ যাচ্ছেন নানা দেশ থেকে আসা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কিন্তু সেখানে গিয়েও মন পড়ে থাকে শান্তিনিকেতনে। অর্থাভাব মেটাতে মাঝে মাঝে দেশের নানান জায়গায় গিয়ে শান্তিনিকেতনের দল নিয়ে নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য করতে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন শান্তিনিকেতনে থাকেন, তখন এখানকার সব খুঁটিনাটিতেও তিনি মনোযোগ দেন, মতামত দেন। পাঠভবনের ছাত্রদের নিজে পড়ান। সঙ্গীতভবভনের ছেলেমেয়েদের নিজে গান শেখান। সঙ্গীতভবনে নতুন কেউ ভর্তি হতে এলে তিনি নিজেই তার পরীক্ষা নেন। আসলে হয়ত তিনি সাগ্রহে খুঁজে বেড়ান এমন সব ভবিষ্যৎ শিল্পীদের যারা তাঁর গানকে বহন করে নিয়ে যাবে উত্তরকালের কাছে। সেই রকম একটা সময়ে এক ছাত্রী এসেছে ঢাকা থেকে । বয়স এগারো বারো । একদিন বিকেলবেলায় ছাতিমতলায় বসে আছেন তিনি। ডেকে পাঠালেন নতুন ছাত্রীটিকে। বললেন গাও তো দেখি একটা গান। মেয়েটি গাইল তাঁরই একটি গান – ‘এবার উজাড় করে লও হে আমার যা কিছু সম্বল’। রবীন্দ্রনাথের এতটাই ভাল লাগল যে তিনিও গুনগুন করে করে গলা মেলালেন গানের সঙ্গে। গান শেষ হতে বললেন, আর একটা গাও । বালিকাটি গাইল আরো একটি রবি ঠাকুরের গান। সেটিও খুব ভাল লাগল তাঁর। তিনি আবার বললেন আরো একটা গাও দেখি। এবার বালিকাটি বলে উঠল, এই দুটোই তো শৈলজাদা’ আজ সকালে শিখিয়েছেন, আর তো জানি না ।

রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হলেন বালিকাটির পারদর্শিতা দেখে, সদ্য শেখা গান এমন সাবলীল ভাবে গাইতে দেখে। পরীক্ষায় পাশ তো সে হলই। রবীন্দ্রনাথ উলটে তাকে বললেন, দেখো, ওই অনেকেই যেমন একটু আধটু গান শিখেই ফুড়ুৎ করে পাখির মত উড়ে যায় এখান থেকে, তুমি যেন সেরকম কোরো না। তোমার গলায় গান আছে, তোমার হবে। তুমি আশ্রমে থেকে যেও।

দ্বিতীয় দৃশ্য ॥

স্থান – বার্লিন শহর

কাল – ১৯৫৭-৫৮ সাল

বার্লিন শহরের সবচেয়ে জমজমাট জায়গাটির নাম কুরফুরস্টেন্ডাম । এই জায়গাটি খুব ব্যস্ত অঞ্চল হলেও এখানে আছে বেশ কয়েকটি নিবিড় বনানী ঘেরা পার্ক। সেইরকম একটি পার্কে বসেছেন দুই বাঙালি। একজন নারী এবং একজন পুরুষ। নারীটি ইতিমধ্যে বাংলা সিনেমায় প্রখ্যাত নায়িকা এবং পুরুষটি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সিনেমা পরিচালক। এই পরিচালকের পরিচালিত একটি বাংলা ছবি বার্লিন সিনেমা উৎসবে দেখানো হবে। সেই সূত্রেই তাঁর বার্লিনে আসা। নায়িকার প্রথম বৈবাহিক সম্পর্ক, যে সম্পর্কটি তিনি তাঁর বাড়ির অমতে গিয়ে প্রায় বাড়ি থেকে পালিয়েই তৈরি করেছিলেন, সেটি তখন প্রায় ছিন্ন হতে চলেছে নানান কারণে। নায়িকার জীবনের এই অস্থির সময়ে এই পরিচালকের সঙ্গে গড়ে উঠেছে এক বন্ধুতার, এক সহমর্মিতার সম্পর্ক। তাঁরা দুজনেই বুঝেছিলেন তাঁদের দুজনের জীবনবোধে, রুচিশীলতায়, মননজীবিতায় আছে অদ্ভুত মিল। সেদিন বার্লিন শহরের নির্জন সন্ধায় সেই পার্কের বেঞ্চিতে বসে পরিচালক একটি গান শুনতে চাইলেন অভিনেত্রীর কাছে। সেদিন তিনি যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি হল –

পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে

পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে ?

এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি

সাড়া দাও সাড়া আঁধারের ঘোরে ।।

দুজনের মননের মধ্যে অনেক মিল থাকতেও হৃদয়ের যে সেতুটি কিছুতেই বাঁধা হয়ে উঠছিল না, দূর পরবাসের এক সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ অলক্ষে থেকে সেই সেতুটি বেঁধে দিলেন দু’জনের মধ্যে। তারপর যা হল, তা স্বল্পবাক পরিচালক তপন সিংহের কথায় –

“… বার্লিনের সেই সন্ধ্যায় এক গানেই মাত করেছিলেন অরুন্ধতী ।আমি কাত হয়ে গেলাম। তারপরের ইতিহাসে শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখার্জি হলেন অরুন্ধতী সিংহ ।”

রবি ঠাকুরের কথা মত ফুড়ুৎ করে উড়ে না গেলেও সেই বালিকাটির শান্তিনিকেতনে বেশি দিন থাকা হয়নি। সে সময়ে শৈলজানন্দের দুই প্রিয় ছাত্রী ছিল – মোহর এবং নুকু । সঙ্গীতভবনের পরীক্ষায় কিন্তু নুকুই এগিয়ে থাকত মোহরের চেয়ে। মোহর চিরজীবন রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনের ছায়ায় মায়ায়। নুকুর সে সুযোগ হয়নি। তিনি কিছুদিন পরেই চলে গেলেন অন্য জগতে। মোহরকে তো সবাই চেনেন কণিকা বন্দোপাধ্যায় নামে। আর নুকুর ভাল নাম তখন ছিল অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা।

বরিশালের গুহঠাকুরতা পরিবারের মেয়ে, শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ছোটো পিসি এবং পিসেমশাইয়ের উৎসাহে। তাঁরা তখন শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। অরুন্ধতীরা সতেরো জন ভাই বোন । এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খুব গুণী। পরে কলকাতায় এসে এই পরিবারের অনেকেই বাংলা সংস্কৃতির জগৎ আলো করেছেন ।

অরুন্ধতী এবং কণিকা একই সঙ্গে শান্তিনিকেতনে শৈলজানন্দের কাছে গান শিখতেন, তবে শুধু শৈলজানন্দ নয়, গান শিখেছেন সরাসরি ইন্দিরা দেবীর কাছে, যাঁকে স্বয়ং শৈলজানন্দ বলতেন ‘বিবিদি ছিলেন গানের খনি’। খুব স্বল্প সময়েই এই গানের খনি থেকে যতটা পেরেছেন আহরণ করে নিয়েছিলেন অরুন্ধতী। প্রায় ছ’শো গান তুলে নিয়েছিলেন । অরুন্ধতীর কথায় –

“তখন আমার কলেজ। অফ পিরিয়ড হলেই দৌড়ে চলে যেতাম ‘উত্তরায়ণ’। মাথার উপরে তখন ঝাঁ ঝাঁ রোদ, পথও অনেকটা। কিন্তু গানের নেশা এমন পেয়ে বসেছিল যে ওসব অসুবিধে গ্রাহ্য করতাম না। বিবিদি হয়তো খেতে বসেছেন, কি রান্না করছেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, ঐ টি-পয়ের ওপর খাতা পেন্সিল আছে। নোটেশন করে নাও। আমি সুর তোলার সঙ্গে সঙ্গে নোটেশন করে নিতাম… এই আদায় করার ব্যাপারে আমাদের যতখানি উৎসাহ ছিল, বোধহয় তার চেয়েও বেশি তাগিদ ছিল ওঁর নিজের। গান গাওয়ার যেমন আনন্দ ছিল, তেমনই ছিল গান শেখার।”

শুধু গান নয়, শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন নাচও শিখেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একবার ‘মায়ার খেলা’ মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। তাতে অরুন্ধতী নেমেছিলেন শান্তার ভূমিকায় আর কণিকা নেমেছিলেন প্রমদার ভূমিকায়।

শুধু গানবাজনা নয়, শান্তিনিকেতনে তিনি ছবি আঁকাও শিখতেন। গান শোনার কান তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নন্দলাল বসুর সংস্পর্শে এসে প্রকৃতিকে দেখার চোখও খুলে গিয়েছিল। নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে ইচ্ছে মত ছবি আঁকতেন। তাই বোধহয় তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথকে সব রকম ভাবে বুঝে নেওয়ার যে একটা আগ্রহের জন্ম হয়েছিল, যেটা আজীবন জাগ্রত ছিল। জীবনের শেষ বেলাতেও তিনি অন্তত শ’পাঁচেক রবীন্দ্রনাথের গান মুখস্থ বলে দিতে পারতেন ।

অরুন্ধতীর পিতা বিভূচরণ গুহঠাকুরতা একজন দার্শনিক মানুষ ছিলেন। নিজে ব্রাহ্ম ছিলেন, কিন্তু সব ধর্মের প্রতি সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই বাড়িতে একটা উদারতার পরিবেশ ছিল।

শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে অরুন্ধতী যখন রেডিওতে ডাক পেলেন গান করার জন্যে, তখন তাঁর মা আপত্তি জানালেন। কারণ তাঁদের বাড়িতে এইরকম একটা বিশ্বাস ছিল যে গানকে পেশা হিসেবে নেওয়া চলবে না। গান হাটে বিকোবার ধন নয় । সেই সময় স্বয়ং শৈলজানন্দ অরুন্ধতীর মাকে বোঝালেন যে, টাকার জন্যে নয়, আসলে রবীন্দ্রনাথের গান সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই অরুন্ধতীর উচিত রেডিওতে গান গাওয়া। প্রসঙ্গত, তখন একবার গান গাইলে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে পাঁচ টাকা করে পাওয়া যেত। কিন্তু তার পরেও গানকে পেশা হিসেবে কখনোই নেন নি। অরুন্ধতীর কথায়, ‘‘সঙ্গীত আমার প্রফেশন নয়, আনন্দের আকাশ। আর এ জন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আর্ট যখন জীবিকা হয়ে ওঠে তখন স্বাভাবিক সময়েই তার সঙ্গে এমন কতকগুলি বেসুরো ব্যাপার জড়িয়ে পড়ে যে, শিল্পীকেও অশিল্পীজনক আচরণ করতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি আমার জীবিকা হয়ে উঠত, হয়তো নানান ঘটনা ও পরিস্থিতির চাপে এমন কাজ করে বসতাম, যেটা হত অরাবীন্দ্রিক। আজ যে এমন স্বচ্ছ দৃষ্টিতে সব বিষয়কে দেখতে পাচ্ছি, কারো ওপর কোনো রাগ দ্বেষ না রেখে। তার কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার প্রফেশন নয়। এবং সেই কারণেই কোনো শিল্পী আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নন। সবাই আমার বন্ধু।’’

আসলে প্রথম জীবনে অনেকে শিল্পীই মনে করেন নেশাটাকে পেশা করে বসবেন না, কিন্তু একটু নামডাক হলে সেই প্রতিজ্ঞা আর রাখতে পারেন না। অরুন্ধতী সেই কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলেন।

শৈলজানন্দ বলেছিলেন – ‘‘নুকু যদি শুধু গান নিয়ে থাকত, তা হলে আমার দুই ছাত্রীর স্থান হত একই আসনে।’’ এখানে আরেক ছাত্রী বলতে তিনি কণিকা বন্দোপাধ্যায়কে বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাই মনে হয়, আমরা যে এখন অভ্যাস বশে এক নিঃশ্বাসে বলে থাকি সুচিত্রা-কণিকা, রবীন্দ্রগানের জগতে অরুন্ধতী আরো একটু বেশি করে থাকলে হয়তো আমাদের সেই রকম ভাবেই বলতে হত “সুচিত্রা-কণিকা-অরুন্ধতী” ।

অরুন্ধতী সিনেমায় আসেন বিয়ের পরে। হয়ত কিছুটা আর্থিক কারণে যখন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবি অভিনয়ের প্রস্তাব আসে, ফিরিয়ে দিতে পারেননি। কিন্তু যে ছবিগুলিতে তিনি অভিনয় করেছেন সবগুলিই ছিল সাহিত্যধর্মী ছবি, এবং প্রায় সব ছবির চরিত্রায়নেই তিনি তাঁর অভিজাত ব্যাক্তিত্বের ছাপ রেখেছিলেন । এর মধ্যে ভগিনী নিবেদিতা, কালামাটি, ছেলে কার, জতুগৃহ, বিচারক, চলাচল, এইসব ছবিতে নিজের বৌদ্ধিক অভিনয়ের জাত চিনিয়েছিলেন।

তাঁর নায়িকা-জীবনের দৈর্ঘ্য মাত্র বারো বছর। ১৯৫২ সালে কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত “মহাপ্রস্থানের পথে” অভিনয় করে সিনেমার জগতে আসা । ব্যক্তিত্ব এবং আভিজাত্যের একটা বিভা তাঁকে ঘিরে থাকত বলেই বোধহয় বাংলা ছবির স্টিরিওটাইপ নায়িকার রোলের জন্যে পরিচালকেরা ভাবতেন না। একটু ক্ল্যাসিকধর্মী ছবির জন্যেই তাঁর কথা ভাবা হত। তাই খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি। কিন্তু যে ক’টি করেছেন তাতেই তাঁর controlled এবং celebral acting-এর নিদর্শন রেখেছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর নির্বাক অথচ গভীর সংবেদনশীল অভিব্যক্তি বাংলা সিনেমায় খুব কমই দেখা গেছে। আর ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে হয়েছিলেন ঝিন্দের রাণী কস্তুরীবাই, ছোট্ট পরিসরে তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এক সম্রাজ্ঞীর সম্ভ্রান্ততা ।

ধরা যাক জতুগৃহ ছবিটির কথা । ১৯৬২ সালে নির্মিত এই ছবিতে আমরা দেখতে পেলাম এক জন বিবাহবিচ্ছিন্না নারীকে , ঘটনাচক্রে একটি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু এখানে আমরা তাঁকে দেখলাম যাবতীয় নাটকীয় আবেগকে সংযত রেখে, কিছু বিষণ্ণতা, কিছু একাকীত্বের অভিব্যাক্তির সঙ্গে অসামান্য এক আত্মাভিমানের দূরত্বে থাকার প্রয়াসকে তিনি মিশিয়ে দিলেন, মাত্র কয়েকটি সংলাপের সাহায্য নিয়ে। এই জাতীয় অভিনয় বোধহয় বাংলা সিনেমার অন্য কোনো অভিনেত্রীর কাছ থেকে পাওয়া যেত না । হয়ত খুব সচেতনভাবেই এই ছবির পরেই তিনি তাঁর নায়িকা-জীবনের ইতি টানলেন । তখন তাঁর বয়স মাত্র চল্লিশ বছর । তবে বাংলা সিনেমার এলাকা ছেড়ে গেলেন না। তিন বছর পর ফিরে এলেন চিত্রপরিচালক হয়ে।

যখন শোনা গেল বিমল করের লেখা ‘খড়কুটো’ গল্প থেকে একটি ছায়াছবি হবে এবং সেই ছবিটি পরিচালনা করবেন অরুন্ধতী দেবী, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, আসলে নেপথ্য থেকে তপন সিংহই এ ছবি পরিচালনা করে দেবেন ।কিন্তু এই ছবিটির ফর্ম এবং কনটেন্ট দুইয়েতেই কিন্তু অরুন্ধতী একেবারে একটি নিজস্ব ঘরানার পরিচয় রাখলেন। সম্পূর্ণ নতুন দুটি ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তৈরি করলেন একটি মায়াময় বিষণ্ণতার ছবি। একটি আসন্ন মৃত্যুর পটভূমিতে একটি অনুচ্চারিত কিশোর প্রেমের উন্মেষের গল্প এমন লিরিক্যাল প্রকাশভঙ্গী্তে চিত্রায়িত হল যা বাংলা চলচ্চিত্রে এই প্রথমবার দেখা গেল। ১৯৬৭ সালের জাতীয় পুরস্কার এবং BFJA award পেলেন প্রথম ছবিতেই ।

এর পরে তিনি আরো দুটি ছবি পরিচালনা করেন লীলা মজুমদারের গল্প অবলম্বনে ‘পদি পিসির বর্মি বাক্স’ এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘মেঘ ও রৌদ্র’। দুটি ছবিই বিদগ্ধজনের প্রশংসা পায় । আরো একটি ছবি তিনি পরিচালনা করেছিলেন। সেটির নাম ছিল ‘দীপার প্রেম’ । কিন্তু ছবি শেষ হওয়ার পর প্রযোজকের সাথে হল তাঁর মতান্তর । প্রযোজক তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ফাইন্যাল প্রিন্ট থেকে প্রায় চোদ্দোশো ফিট বাদ দিয়েছিলেন। তাতে অরুন্ধতী মামলা করে নিজের ছবি থেকে নিজের নাম বাদ দিয়ে দেন। প্রযোজক কিন্তু যে সে নয়। তখনকার দিনের খুব নাম করা প্রযোজক যিনি সত্যজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটা ছবিরও প্রযোজক ছিলেন। তাঁর নাম আর ডি বনশল । কিন্তু আত্নমর্যাদার প্রশ্নে তিনি এতটাই আপোষহীন ছিলেন যে অন্য কিছুর কথা ভাবেন নি । হয়ত সম্মানের প্রশ্নে এই অনমনীয়তার কারণেই তারপর তাঁর আর ছবি পরিচালনা করা হয়ে ওঠেনি।

তবে তাঁর জীবনে তপন সিংহের সঙ্গে পথ চলার সময়টাই তিনি পূর্ণ ভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ।’

নায়িকা-জীবনে ইতি টানবার পর একবার তাঁকে পুনশ্চ বলে ক্যামেরার সামনে আসতে হয়েছিল, তপন বাবুর বিশেষ অনুরোধে । সে ছবির নাম ‘হারমোনিয়াম’। এই ছবির এই চরিত্রটি তপনবাবু তাঁর কথা ভেবেই যেন লিখেছিলেন। এক বিগতযৌবনা একাকিনী নারী, যাঁকে সব সময়ে ঘিরে থাকে এক সম্ভ্রমের আবরণ , স্নিগ্ধতার আলো। তাঁর ছাত্রীর একাকী পিতার চরিত্রে অভিনয় করা অনিল চ্যাটার্জির সঙ্গে তাঁর মানসিক ভাবে কাছে আসার যে কয়েকটি রুচিস্নিগ্ধ মুহুর্ত এই ছবিতে দেখা যায়, তেমনটা বাংলা ছবিতে খুব কমই দেখা গেছে।

আর সে ছবিতে যা আর কেউ পারেনি তপন সিংহ তাই করতেই সফল হলেন। তিনি সিনেমার জন্যে এই প্রথম দুটি গান গাইলেন, সেটা অবশ্য তাঁর নিজের লিপেই। একটি ছিল রজনীকান্তের গান – ‘কেন বঞ্চিত হব চরণে / আমি কত আশা করে বসে আছি / পাব জীবনে না হয় মরণে’ । আর একটি তপন সিংহ-র লেখা এবং সুরারোপিত মিষ্টি গান – ‘মন বলে আমি মনের কথা জানিনা’।

শুধু অভিনয় বা পরিচালনাই নয় , তিনি পাঁচটি ছবিতে তিনি সুরসৃষ্টিও করেছিলেন । তার মধ্যে চারটি তাঁর নিজের পরিচালিত ছবি আর একটি পীযুষ বসু পরিচালিত ‘শিউলিবাড়ি’। এই সব ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুচারু প্রয়োগ তো ঘটেই ছিল, সেই সঙ্গে তিনি কিছু প্রচলিত বা পুরাতনী গানকে উজ্বল উদ্ধার করেছিলেন । এর মধ্যে ‘ছুটি’ ছবির ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ এবং ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’, যে দুটি গান বহুকাল আগে আঙ্গুরবালা কন্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল, সেই দুটি গান নতুন করে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে গাইয়ে সারা বঙ্গদেশের শ্রোতাদের হৃদয় প্লাবিত করে দিয়েছিলেন। এছাড়া ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে একটি লালন ফকিরের গান – ‘সোনার মানুষ ভাসছে রথে’, ‘শিউলিবাড়ি’ ছবিতে প্রচলিত প্রভাতী গান ‘রাই জাগো , রাই জাগো’ খুব চমৎকার ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন ছবিতে। এ ছাড়া মেঘ রৌদ্র ছবিতে মান্না দেকে একটি রবীন্দ্রনাথের গান গাইয়েছিলেন, যা এর আগে কোন চিত্রপরিচালক করে উঠতে পারেন নি ।

‘শিউলিবাড়ি’ ছবিতে তিনিই নায়িকা ছিলেন। কোনো ছবিতে সেই ছবির নায়িকা অভিনয়ের সঙ্গে ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, এ রকম উদাহরণ বোধহয় ভারতীয় চলচ্চিত্রে আর দ্বিতীয়টি নেই ।

তপন সিংহের স্মৃতিচারণে তিনি বলে ছিলেন তাঁরা দুজনে যে একত্র হতে পেরেছিলেন তার মূলেও সেই রবীন্দ্রনাথ । তিনি স্বীকার করেছেন তাঁর মধ্যে রবীন্দ্রভাবনাটাকে অরুন্ধতী আরো বেশি করে উদ্দীপ্ত করে দিয়েছিলেন । তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষ। এক এক সন্ধ্যায় অরুন্ধতী রবীন্দ্রগান গাইতেন আর সন্তোষবাবু বলতেন সে গানের পটভূমি, ইতিহাস আর অন্তর্নিহিত অর্থ। এই রকম সংস্কৃতি চর্চায় , তপনবাবু নিজেই জানিয়েছেন, তিনি সম্বৃদ্ধ হতেন।

এক জীবনে সফলতার অনেক গুলি উচ্চতা তিনি ছুঁতে পেরেছিলেন ।দেশে-বিদেশে পুরস্কার, সম্মান,খ্যাতি,স্বীকৃতি সবই পেয়েছিলেন। কিন্ত এক অনন্য আত্নশক্তিতে তিনি নিঃস্পৃহ থেকেছেন সব কিছু থেকে। জীবনের অন্তিম পর্বে শুধু একটা কথাই তিনি অহঙ্কার করে বলতে ভালবাসতেন – স্বয়ং রবি ঠাকুর আমার গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়েছিলেন ।

সত্যিই তো, বঙ্গদেশে সুন্দরী নায়িকা অনেকেই হয়েছেন, সিনেমার পরিচালিকাও হয়েছেন আরো কয়েকজন, তাঁরা অনেক গুণেই উজ্বল। তবে রবীন্দ্রনাথ কারো গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়েছেন, এমন বিরলতম সৌভাগ্য এই বঙ্গদেশে আর কার ভাগ্যেই বা জুটেছিল !

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shouvik
Shouvik
3 months ago

পর্দায় এলে সব চোখ যাবে তার দিকে,
আভিজাত্যের সেতার বাজবে চৌদিকে।
দুটি চোখ তার বাঙময় আর সংলাপে –
সংযম আর পরিমিতি বোধ ছেয়ে থাকে।

কি মাধুরী রয়েছে সেই কণ্ঠের যাদুঘরে,
মুদ্ধ জগৎ নীলিন সে সুর পারাবারে।
লেখক ? না কি সে খনির মজুর খুঁজে আনে –
হীরের আংটি প্রভূত শ্রম ও সমাদরে।

Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
3 months ago

অরুন্ধতী দেবীর ব্যক্তিত্ব আভিজাত্য ও ভাবপ্রকাশের সংযম বরাবরই আকৃষ্ট করেছে

আমাদের। আপনার বিচার বিশ্লেষণের চারুতায় উজ্জ্বলতর হয়ে
ধরা দিলেন তিনি।

সৌরভ হাওলাদার
সৌরভ হাওলাদার
3 months ago

এমন একজন প্রতিভাময়ী শিল্পীকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত খুব কম আলোচনা হয়। ওঁর সম্পর্কে অনেক নতুন কথা জেনে খুব ভালো লাগল।