শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রবীন্দ্র নাটকে নারী

‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী/ পূজা করে মোরে রাখিবে উর্ধ্বে/ সে নহি নহি/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/ সে নহি নহি।’ — রবীন্দ্রনাথের চিত্রঙ্গদার কন্ঠে এই বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে। সেই সুরে মিশে আছে রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার মহাসুর। নারীকে তিনি গৃহকোণে বন্দী করে রাখতে চান নি। কঠোর কঠিন বাস্তবের মাটিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার দিতে চেয়েছেন। তাঁর নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছে নারীর অসামান্যা, অনন্যা, প্রতিবাদিনী, বিদ্রোহিনী মূর্তি। পাশাপাশি নারী যে পুরুষের নিছক সেবাদাসী নয়, সে প্রেমিকা, রহস্যময়ী, গুণবতী-তারও ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর নাটকগুলিতে। নারীর একই অঙ্গে নানা রূপকে তিনি বর্ণময় করে এঁকেছেন। রবীন্দ্র-নাটকে নারীরা উঠে এসেছে কেউ পুরাণের জগৎ থেকে, কেউ ইতিহাসের পাতা থেকে, কেউ রাজন্য পরিবেশ থেকে, কেউ বা তাঁর কল্পনার মনোভূমি থেকে। আমরা খোঁজার চেষ্টা করব সেই নারীদের, যারা স্রষ্টার জীবনদর্শনের আলোয় উদ্ভাসিত। যাদের হৃদয়-স্পর্শে, প্রাণের ছোঁয়ায় বিগলিত হয় পাষাণ হৃদয়, বিচলিত হয় মানবসমাজ। যারা একান্তভাবেই নাটককার রবীন্দ্রনাথের মানসী। নিজ গুণেই তারা হয়ে উঠেছে রক্তমাংসের জীবন্ত মানবী।

চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী


রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক মানুষের অন্তরেই বাস করে আর এক ভালো মানুষ। সারা জীবন মানুষ থেকে ভালো মানুষে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্র-নাটকে এই বিষয়টি বার বার ঘটতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে নারীর অবদান অপরিসীম। নাটককার রবীন্দ্রনাথের যাত্রা শুরু ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ র(১৮৭৬) মাধ্যমে। দস্যু রত্নাকরের বাল্মিকী হয়ে ওঠার কাহিনি। লক্ষণীয় দস্যু রত্নাকরের নিষ্ঠুর অন্তরে আলোড়ন তোলে এক ভিখারিনী বালিকার করুণ আর্তি — ‘এ কেমন হল মন আমার/কী ভাব এ কিছুই বুঝিতে যে পারিনে/ পাষাণ হৃদয় গলিল কেন রে/”কেন আজি আঁখি জল দেখা দিল নয়নে।’ অপ্রকৃতস্থ, অত্যাচারী একজন মানুষ অতি সাধারণ এক বালিকার সংস্পর্শে মহামানবে রূপান্তরিত হলেন। এই বালিকারই যেন উত্তরসূরি ‘রুদ্রচন্ড’ নাটকের অমিয়া।

বাল্মিকী প্রতিভা


এই নাটকেও দেখি কন্যার হৃদয়ের স্পর্শে রুদ্রচন্ডের কঠোর হৃদয়ের জাগরণ ঘটে। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকেও এর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। অনাথিনী বালিকাকে সন্ন্যাসী তার সাধনার পথে অন্তরায় বলে মনে করতেন। তাকে নির্দয়ভাবে ত্যাগ করলেন বটে কিন্তু তার হৃদয়ে এক শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে। এই শূন্যতা, নি:সঙ্গতার মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করেন, মানুষের সঙ্গে মিলনেই তার মুক্তি। ফলে তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়—’ যাক রসাতলে যাক সন্ন্যাসীর ব্রত/ দূর কর, ভেঙে ফেল দন্ডকমন্ডল/ আজ হতে আমি আর নই যে সন্ন্যাসী।’-এই উপলব্ধি সন্ন্যাসীকে পরিপূর্ণ মানুষ করে তোলে। অস্বাভাবিকতা থেকে ফিরে আসে স্বভাবের মধ্যে। তিনটি নাটকেই নারী বালিকা মূর্তি ধরে এসেছে আমাদেরই গৃহপ্রাঙ্গনে। এরা সাধারণ হয়েও অসাধারণ অথচ আমাদের বড়ো চেনা, একান্তই আপনজন।

রাজা ও রাণী


‘রাজা ও রাণী’ নাটকে রানি সুমিত্রা এক ব্যক্তিত্বময়ী নারী চরিত্র। অন্তরে প্রেয়সী, বাইরে মহিষী এই নারী ব্যক্তিপ্রেমকে তুচ্ছ করেছেন। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে বিপদগ্রস্ত রাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাজা বিক্রমদেবকে তার রাজকর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—’ আমারে বসো না ভালো রাজশ্রীর চেয়ে’। বিক্রমদেব রাজধর্ম পালনে উদাসীন হলে উদাসীন হলে তিনি নিজেই দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হন। অত্যাচারী রাজন্যবর্গকে শাস্তি দেওয়ার জন্য দেবদত্তকে আদেশ দেন—’ সৈন্য লয়ে/যাও অবিলম্বে, রক্তশোষী কীটদের/ দলন করিয়া ফেল চরণের তলে’। ন্যায়পরয়নতা, সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্বের প্রতিমূর্তি মহীয়সী নারি রানি সুমিত্রা নাটকের শেষে মৃত্যুবরণ করেন। তার এই আত্মত্যাগ তার প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই নাটকে ইলা চরিত্রটিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কুমারসেনের প্রতি তার প্রেম অকৃত্রিম, একনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ন। তার প্রেম রাজা বিক্রমদেবের হৃদয়েও ঢেউ তোলে। প্রতিহিংসাপরায়ন রাজার মনে শুভবোধের উদয় হয়। এই তরুণীর বিশুদ্ধ প্রেম সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। রাষ্টের কল্যাণে উৎসর্গিত হয়। এখানেই ইলা চরিত্রটি আমাদের সমীহ আদায় করে নেয়। আত্মসুখের উন্মাদনায় মেতে উঠলে সত্যিকারের প্রেম মেলে না, সুখও দূরে সরে যায়। এই সত্যই ব্যক্ত হয়েছে ‘মায়ার খেলা’ নাটকে মায়াকুমারীদের গানে:
‘এরা সুখের লাগি চাহি প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায় – এমনি মায়ার ছলনা।’
আসলে রবীন্দ্রনাথ আত্মসুখপরায়ন প্রেমের ভয়ঙ্কর রূপ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেন। যে প্রেম চিরন্তন, শাশ্বত তাকেই তিনি কুর্নিশ জানিয়েছেন আজীবন। সকল প্রেমের ধারা উন্নীত হয় বৃহত্তর মানবপ্রেমে—এই বার্তাই তিনি দিতে চেয়েছেন তাঁর নাটকে। তাই দেখা যায়,’চন্ডালিকা’র প্রকৃতি, ‘মালিনী’ নাটকের মাইন, ‘রাজা’ নাটকের সুদর্শনা—এরা নিজেদের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্যই প্রেমের প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নাটককার রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুকৌশলে শেষপর্যন্ত তাঁর নায়িকাদের অন্ধত্বের,অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোকিত বোধিতে পৌঁছে দিয়েছেন।
‘বিসর্জন’ নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন, ‘যে শক্তি এই নাটকে জয়ী হয়েছে অপর্ণা তাকেই প্রকাশ করেছে। বাইরে থেকে যাকে দুর্বল মনে হয়, কিন্তু কার্যত তারই জয় হল।’ এই নাটকে প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্ব শুরু হয় অপর্ণার প্রতিবাদেই। আজন্ম লালিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণত্বের অহংকারের বিরুদ্ধে ধর্মকারার প্রাচীরে সে আঘাত আনতে চেয়েছ। বলিদানের নামে জীবহত্যাকে সে মেনে নিতে পারে নি। নারীর হৃদয়ের গোপন দূর্গে লুকিয়ে থাকা শক্তির মাধ্যমেই অপর্ণা প্রতিবাদিনী হয়ে উঠেছে। ভিখারিনী অপর্ণা রাজা গোবিন্দমানিক্যের কাছে কৈফিয়ত চেয়েছে। আত্মসচেতন অপর্ণা সরাসরি জয়সিংহকে জানিয়ে দিয়েছে— ‘জয়সিংহ, আমি তব তরুলতা নহি/আমি নারী।’ আর রঘুপতির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মুখের উপর বলে দিতে পারে:
‘নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ, ধিক
থাক্ ব্রাহ্মণত্বে তব। আমি ক্ষুদ্র নারী
অভিশাপ দিয়ে গেনু তোরে, এ বন্ধনে
জয়সিংহে পারিবি না বাঁধিয়া রাখিতে।’

বিসর্জন


এমনকি রঘুপতি যখন ত্রিপুরেশ্বরীর মুখ ফিরিয়ে জনতাকে উত্তেজিত করতে চেয়েছেন এই বলে, দেবী বিরূপ হয়েছেন সাধারণ মানুষের প্রতি তখনও সাহসে ভর করে অপর্ণা সত্যকে সামনে এনেছে। মন্দিরে উঠে প্রতিমার মুখ সামনে ঘুরিয়ে বলেছে, ‘ এই দেখ/মুখ ফিরায়াছে মাতা।’ রঘুপতি তাই অপর্ণাকে ‘পাষাণী’, ‘মায়াবিনী’, ‘সর্বনাশী’ বলে গালমন্দ করেছেন। কিন্তু নাটকের শেষে তাকে রঘুপতি ডেকে নিয়েছেন, ‘মা অমৃতময়ী’ বলে। এখানেই সত্যের, নির্ভীকতার, স্পষ্টবাদিতার জয় হয়, সার্বিক জয় হয় অপর্ণার।
‘বিসর্জন’ নাটকে রানি গুণবতীকে আপাত দৃষ্টিতে খলনায়িকা মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যখন ভাবি, গুণবতী তার অন্তরে বহন করে চলেছেন, সন্তানহীনা মায়ের দু:সহ যন্ত্রণা তখন তার সংস্কার, পূজার্চনা, আচরণ অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ সূক্ষ্মভাবে তার হৃদয়েও প্রতিবাদের শিখাটি প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছেন। রাজা গোবিন্দমাণিক্য মন্দিরে পশুবলি বন্ধের আদেশ দিয়েছেন। এই সংবাদে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তেজোদৃপ্ত ভঙ্গীতে স্বামীর আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে বলেন—’ মন্দিরের/বাইরে তোমার রাজ্য, যেথা তব /নাহি চলে, সেথা আজ্ঞা নাহি দিয়ে।’ – তার এই প্রতিবাদের সঙ্গে আমরা সহমত হতে পারি কিংবা না হতে পারি। এমন কি তার পরবর্তী আচার আচরণ মেনে নিতে পারি। কিন্তু গুণবতীর ওই প্রতিবাদ একান্তভাবেই তার নিজের; তার বিশ্বাসমতে তা সত্য। ‘গান্ধারীর আবেদন’ নাটকে গান্ধারীও প্রতিবাদ করেছে তার মতো করেই।’ নটীর পূজা’ নাটকে রাজনটী শ্রীমতী প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে তার প্রতিবাদের ধ্বজাটিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
সাহস ও ভক্তির জোরেই সে রাষ্টনৈতিক বাধাকে তুচ্ছ করেছে। মৃত্যুই তাকে মহৎ ও স্বতন্ত্র বোধে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
‘মুক্তধারা’ নাটকে অম্বার উপস্থিতি খুব অল্প সময়ের জন্য। অথচ নাটকে তার প্রতিবাদ অন্য এক মাত্রা যোগ করে। মুক্তধারার বাঁধ নির্মাণের কাজে সে হারিয়েছে তার একমাত্র সন্তান সুমনকে। নাটকের শুরু থেকেই অম্বা পাগলের মতো খুঁজে বেড়ায় তার প্রাণের নি:শ্বাস সুমনকে। অম্বার করুণ আর্তি পরিবেশকে ভারী করে তোলে। সে উত্তরকূটের রাজশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়— ‘ভৈরব কি কেবল ডেকেই নেন? /ভৈরব কি কখনও ফিরিয়ে দেন না?’ রাজশক্তির অমানবিকতা, ক্ষমতার দম্ভ, ধর্মপ্রাণ সরল মানুষদের সহজ ভক্তিকে পদদলিত করার দিকেই সে আঙুল তুলেছে।


রবীন্দ্র-নাটকের অন্যান্য নারীদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে নন্দিনী। রবীন্দ্র-নাটকে এক ব্যতিক্রমী, পরিপূর্ণ নারী চরিত্র। দমবন্ধ করা যক্ষপুরীর পরিবেশে নন্দিনী বয়ে এনেছে খুশির হাওয়া, প্রাণের আবেগ। এই নন্দিনীর জন্যই গান বাঁধে বিশুপাগল। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে তারজন্য রক্তকরবী ফুল নিয়ে আসে কিশোর। জালের আড়ালে থাকা রাজামশাই তার মাথার খোলা চুলে হাত ডুবিয়ে রাখতে চায়। প্রবীণ অধ্যাপকও নন্দিনীর প্রেমে হাবুডুবু খান। অথচ নন্দিনী ভালোবাসে রঞ্জনকে। রঞ্জনের প্রেমই নন্দিনীকে করে তোলে দুর্বার। সে যক্ষপুরীর বাসিন্দাদের শেখায় রাজার শাসন, ত্রাসনকে তুচ্ছ করার অভয় মন্ত্র। দোর্দন্ডপ্রতাপশালী সর্দারকে অবলীলায় জানিয়ে দেয়— ‘আমি নারী বলে আমাকে ভয় কর না? বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন। আমি সেই বজ্র বয়ে এনেছিল। ভাঙবে তোমার সর্দারির সোনার চূড়া।’ রাজাকে সে জালের বাইরে আসতে আহ্বান জানায়। রাজশক্তি রঞ্জনকে মেরে ফেললে নন্দিনী দু:সাহসী হয়ে ওঠে। রাজার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে বলে— ‘রাজা, এইবার সময় হল।… আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।… আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।’ শেষপর্যন্ত রাজা বাধ্য হন জালের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসতে। উপলব্ধি করেন, তারই তৈরি প্রশাসন তাকে আর মানছে না। নন্দিনীর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান মুক্তির দিশা। যক্ষপুরীর বন্দিশালা ভাঙনের রাস্তা প্রশস্ত হয়। নন্দিনী প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আলো-বাতাসকে আটকানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো রাজার নেই। নন্দিনীর বিভাতেই আলোকিত ‘রক্তকরবী’ নাটক। এই কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন— ‘ রক্তকরবী’ র সমস্ত পালাটি নন্দিনী বলে একটি মানবীর ছবি। চারদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ।’

রবীন্দ্রনাথের আঁকা রক্তকরবীর ছবি


শুরু করেছিলাম, চিত্রাঙ্গদার উক্তি দিয়ে, সেই চিত্রাঙ্গদা যে নিজের ব্যক্তিত্বের মহিমায় নিজেকে করে তুলেছে অনন্যা। তার জন্মটাই যেন অন্ধদৈবভক্তির বিরুদ্ধে জ্বলন্ত জেহাদ। দেবাদিদেব মহাদেবের মহাবরকে মিথ্যা প্রমাণ করেই সে পৃথিবীর আলো দেখেছে। রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা যুবরাজের মতোই লালিত-পালিত হয়েছে। আবার বাহ্যিক রূপ-মাধুর্য ত্যাগ করে নারীর বেশে অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল— ‘যদি পার্শ্বে রাখ মোরে/সংকটে সম্পদে/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/সহায় হতে/পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’ —চিত্রাঙ্গদার এই বীরাঙ্গনা মূর্তি আমাদের আকর্ষণ করে। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা তো শুধু বীরাঙ্গনা স্ত্রী নয়, বীরমাতাও বটে। তাই ভাবী সন্তানকে ‘দ্বিতীয় অর্জুন’ রূপে গড়ে তোলার সংকল্প নেয়। এভাবেই সে পুরুষদের সমকক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘স্বদেশ ও সমাজ’ গ্রন্থে বলেছেন— ‘গণনায় মানুষের পরিমাণ পাওয়া যায় না, পূর্ণতাতেই তার পরিমাণ। আমাদের দেশেও কৃত্রিম বন্ধনমুক্ত মেয়েরা যখন আপন পূর্ণ মনুষ্যত্বের মহিমা লাভ করবে, তখন পুরুষও পাবে আপন পূর্ণতা।’ রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নাটকগুলিতে। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে অসামান্য সব নারী চরিত্র। যাদের স্বাধিকার, সমানাধিকার ও আত্মমর্যাদাবোধ অপরিসীম। যারা প্রতিবাদে ও প্রেমে সমভাবেই উজ্জ্বল। রবীন্দ্র-নাটকের নারীরা সমস্যার অনল শিখায় তাদের অহংবোধ, বুদ্ধিহীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতাকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন। রক্তমাংসের জীবন্ত মানবী হয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে ঘোষণা করেছেন। প্রমাণ করেছেন, কাঞ্চনমূল্যে তাদের ব্যক্তিত্বকে কেনা যায় না কিন্তু ভালোবাসায় সহজেই পাওয়া যায়। তারা নিজেদের মধ্যে বৃহতকে, বৃহতের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে আমাদের শ্রদ্ধা ও সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.