শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

অন্ত্যজের গান

দুখিরামের রবি প্রণাম।
এক কবিতা ও সুর প্রয়াস।

সমবেত সুধী – সুজন,
প্রগাঢ় রবীন্দ্র প্রেমী – উপস্থিত দর্শক জন –
তত্ত্বজ্ঞ – জ্ঞানী – বোদ্ধা –
সাংস্কৃতিক সকল যোদ্ধা –
সবাই আমার শ্রদ্ধাস্পদ, সুবিনীত প্রণাম নেবেন।

আসলে জানেন –
আজকের এই সভায় – আমি অনধিকার প্রবেশকারী।
চোর-শিকারি – যেমন ঢোকে গভীর বনে,
চুপিচুপি সংগোপনে –
অতর্কিত আক্রমণে –
বনের পশুর প্রাণ নিয়ে নেয়।
আর বিনিময় –
তার জুটে যায় এক দু মুঠো অন্নদানা –
আমিও সেই বাঁশের বনে এক্কেবারে ধাঙড় কানা।

রবীন্দ্রনাথ – রবীন্দ্রনাথ,
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত সূর্য সনাথ।
গৃহকোনে বা ভুবনে,
একলা চলার চারণ গানে –
এখনো বিষণ্ণ মনে – আনন্দ প্রভাত।

এত বিপুল সৃজন ভূমি
এত-ব্যাপক সত্তা তুমি,
এত ক্ষুদ্র দীন আমি –
কিছুই বোঝা হল না যে।
আজন্ম সচেষ্ট মনন তবু হৃদয় পেল না যে
তোমার পরশ জীবন স্বামী।
সে জন্যেই বলছিলাম আমি,

“কইতে কি চাই কইতে কথা বাধে,
হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে,
আমায় তুমি ফেলেছ কোন ফাঁদে,
চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি , তুমি …’।

এমন বেসুরো গান আগে শুনেছেন? না আমি তো শুনিনি।
তবু গাই । অবাক সেটাই।

প্রথাগত শেখা তো হল না।
সুর তাল স্বরলিপি কিছুই জানি না।
যারা তার সঙ্গীতের সাধক – পূজারী –
তাঁরা রাগ করে ভারি।
সগর্জনে বলে চুপ অর্বাচীন –
ঠাকুরের গান নিয়ে রাত্রি দিন – ভাঙনের খেলা?
আমি মেনে নিই তার বলা।
মূর্খ বড় – সড়্গড় –
নই – তবু জানি –
সঙ্গীত শৃঙ্খলার বানী –
তাকে ভাঙা অপরাধ – তবুও বিসংবাদ –
নিজপক্ষ মতবাদ –

কিছু কি রয়েছে?

রাজা যদি যদি থাকে – বিশু পাগল ও তো আছে।
দুঃখ জাগানীয়া রাতে স্বপন পারের ডাক আসে,
চিদাকাশে।
চোখ যায়, খোলা জানালায় –
চাঁপা করবীর ডালপালা, সহসা উতলা,

হে জীবনস্বামী, পদ প্রান্তে শোনপাংশু আমি।
কত দিন?
পূর্ণ জীবন বাঁধা – এত ঋণ।

একদিন কোনো সভা স্থলে,
ধূপ দীপ মালার আড়ালে –
চন্দন ছোঁয়ান তার ছবি।
বাবা বললেন ইনি কবি –
রবীন্দ্রনাথ।
মুগ্ধতার প্রথম প্রভাত।
তার পর তাঁর গান – কত শিল্পী, সুর-প্রাণ,
শোনালেন এখানে ওখানে।
কিছু বোঝা গেল – আর
কিছু না বোঝার ভার –
অধরা মাধুরী হয়ে রয়ে গেল।
তা হোক। তাতে কি হল ?
প্রখর বৈশাখে যদি দগ্ধ দুপুরে একা থাকি,
আঙিনায় ক্লান্ত পাখি কি বলে প্রলাপে?

“প্রখর তপন তাপে,
আকাশ তৃষায় কাঁপে,
বায়ু করে হাহাকার,
দীর্ঘ পথের শেষে ডাকি মন্দিরে এসে
খোলো খোল খোলো দ্বার’।

কিম্বা আকাশ জুড়ে সজল শ্যামল ঘনঘটা,
ঘন ঘন বিদ্যুৎ ছটা – কি গান জাগিয়ে দেয় প্রাণে?

“আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে,
আমার ভাবনা – যত উতল হল অকারণে – আমার মনে -“।

মনেরই তো যত পাগলামি।
তাঁকে কি দুয়ার এঁটে রেখে দেব আমি?
পারি না। হয় না। ওই শরতের সোনা রোদ্দুরে –
সবুজে ভরেছে মাঠ নবান্ন প্রহরে –
নদী তীরে কাশের ঝালর আর খুশির পেয়ালা –

“নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ,
বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা”

শুধু কি জানিনে গান , এই ভয়ে করবো না বাসন্তী প্রণাম?
অপরাধ হবে কি আইনে – যদি গেয়ে ফেলি আনমনে –

“ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে,
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোনে কোনে।
ওরে ভাই -“।

সবি যে হারাই –
যদি কেড়ে নাও এ সুধা সাগর।
জীবিকা সাধনে ঘুরি শহর নগর,
গ্রামে গঞ্জে হাটে মাঠে
এ ভাবে জীবন কাটে ?
অনন্ত পথ বেয়ে বিচিত্র রূপিণী।
সুখে দুঃখেই তাঁকে চিনি।
যদি চাই এড়াতে আঘাত
আরো যে গভীর হয় হৃদি সংঘাত – তাই রবীন্দ্রনাথ।

“সারা পথের ক্লান্তি আমার, সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা,
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমার এই কথা বলিও”।

হে বন্ধু হে প্রিয়,
সারা দিন বিষয় কঠিন গ্রহে ঘুরে ঘুরে নষ্ট হয়ে যাই।
কিছু পেতে সবই যে হারাই।
তাই – গান গাই।
নিজেকে শোনাই।
রিক্ত দু হাত মেলে পূর্ণ প্রাণের কাছে যাই।

তোমরা অনেক জেনে ডানার পালকে
ঘিরে রাখো বিশ্বকবিকে।
যে কবি বিশ্বের নয় – যে কবি আমার প্রাণে থাকে –
আমি তাঁর গান গাই।
সন্ধ্যা হল কি? তবে যাই।
শেষ প্রার্থনা সেই কবির চরণে
জেগে থাকো প্রাণে – অন্ত্যজের গানে –

“সংসার গহনে নির্ভয় নির্ভর নির্জন সজনে সঙ্গে রহো,
চির সখা হে ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না”।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sourav Howlader
Sourav Howlader
4 months ago

কবিগানের মোড়কে কবি প্রণাম! আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, এ এক অভিনব প্রয়াস। অত্যন্ত উপভোগ্য একটি রচনা।