শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

‘নিজের সুর দেওয়া গান’

‘নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়’, ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’, ‘আঁধার শাখা উজল করি এবং ‘শুন নলিনী খোলো গো আঁখি’, এই গানগুলি রবীন্দ্রনাথ লেখেন আমেদাবাদে। ১৮৭৮ সালে, প্রথমবার বিলেত যাবার আগে কিছুটা সময় রবীন্দ্রনাথ আমেদাবাদে কাটান। আমেদাবাদ তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল তখন। ১৮৭৬ এর এপ্রিল থেকে এখানে ডিস্ট্রিক্ট্‌ অ্যান্ড সেশন্‌স জজ হিসাবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথের সরকারি বাসস্থান ছিল সাবরমতী নদীর ধারে শাহিবাগ প্রাসাদে। নদীতীরের দিকে প্রাসাদের সামনের ভাগে ছিল এক খোলা ছাদ। রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় ছিল প্রাসাদের চুড়ার একটি ঘরে।

শাহীবাগ প্রাসাদ, আমেদাবাদ


‘জীবনস্মৃতি’র ‘আমেদাবাদ’ শীর্ষক অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন – ‘শুক্লপক্ষের গভীর রাত্রে সেই নদীর দিকের প্রকান্ড ছাদটাতে একলা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ানো আমার আর-একটা উপসর্গ ছিল। এই ছাদের উপর নিশাচর্য করিবার সময়ই আমার নিজের সুর দেওয়া সর্বপ্রথম গানগুলি রচনা করিয়াছিলাম। “তাহার মধ্যে বলি ও আমার গোলাপবালা” গানটি এখনো আমার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আসন রাখিয়াছে’। জীবনস্মৃতি’র পান্ডুলিপিতে প্রসঙ্গটির আরও একটু সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায়। বাকি তিনটি গানের উল্লেখও পাওয়া যায় সেখানে। রবীন্দ্রনাথকে লিখতে দেখা যায়, “সকলের উপরের একটি ছোট ঘরে আমার আশ্রয় ছিল। রাত্রেও আমি সেই নির্জন ঘরে শুইয়া থাকিতাম। শুক্লপক্ষের কত নিস্তব্ধ রাত্রে আমি সেই নদীর দিকের প্রকান্ড ছাদটাতে একলা ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি এইরূপ একটা রাত্রে আমি যেমন খুশি ভাঙা ছন্দে একটা গান তৈরি করিয়াছিলাম……।“ নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়”… ইহার বাকি অংশ পরে ভদ্রছন্দে বাঁধিয়া পরিবর্ত্তিত করিয়া তখনকার গানের বহিতে ছাপাইয়াছিলাম কিন্তু সেই পরিবর্ত্তনের মধ্যে সেই সাবরমতী নদীতীরের সেই পাগল ক্ষিপ্ত বালকের বিনিদ্রাহারা গ্রীষ্মরজনীর কিছুই ছিল না। “বলি ও আমার গোলাপবালা” গানটা এমনি আর এক রাত্রে লিখিয়া বেহাগসুরে বসাইয়া গুন্‌গুন্‌ করিয়া গাহিয়া বেড়াইয়াছিলাম। “শুন নলিনী খোলো গো আঁখি”, “আঁধার শাখা উজল করি” প্রভৃতি আমার ছেলেবেলার অনেকগুলি গান এইখানে লেখা’।


এখন প্রশ্ন হল, এই যে ‘নিজের সুর দেওয়া সর্বপ্রথম গান’ এইরকম কতগুলি শব্দ রবীন্দ্রনাথ এখানে লেখেন, এরই বা তাৎপর্য কী? রবীন্দ্রনাথ কি এই যে নিছকই একটি স্বাধীন Melodic structure তৈরি করলেন, কেবল সেটুকুই বলতে চান? অবশ্য কেবলই এ কথা তিনি বলতে চেয়ে থাকতেই পারেন। কিন্তু আজকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে পরিপ্রক্ষিতে রেখে এই শব্দগুলিকে কী আর কোনওভাবে পড়তে চাওয়া সম্ভব? এর আগে লেখা তাঁর যে গানগুলির কথা জানা যায় সেগুলির সুরের ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকাকে কেন কোথাও তবে গৌণ বলে মনে হয় তাঁর?

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘গীতবিতান কালানুক্রমিক সুচী’ বইটিতে এই চারটি গানের রচনাকাল নির্ণয় করেছেন ১২৮৫ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ, ১৮৭৮ সাল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ আমেদাবাদ যাত্রা করেন ১৫ মে, ১৮৭৮। এই চারটি গান সম্পর্কে প্রভাতকুমারকে লিখতে দেখা যায় – ‘গান চারিটি কবির বিলাত যাত্রার পূর্বে আহমদাবাদ ও বোম্বাই বাসকালে রচিত’। দেখা যাচ্ছে প্রভাতকুমার গানগুলির রচনাকালের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করছেন না। বস্তুত, এ’ যাবৎ এই গানগুলির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তারিখ অনির্ণীতই। একটি গান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বোম্বাই অবস্থিতি’র উল্লেখ করেছেন প্রভাতকুমার। সেটি, ‘শুন নলিনী খোলো গো আঁখি’। ইতিমধ্যেই দেখা গেছে এই গানটি প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’র পান্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথের বয়ান বোম্বাইয়ের কথা বলছে না। প্রশান্তকুমার পালও এই প্রসঙ্গে প্রভাতকুমারেরই পক্ষে। তাঁরও ধারণা গানটি বোম্বাই অবস্থানকালেই লেখা। এঁদের এই ধারণার ভিত্তি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আনা তড়খড়ের সম্পর্ক।

আনা তড়খড় ও রবীন্দ্রনাথ

প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত, এখানে সবিস্তার না গেলেও চলে। কেবল এইটুকু বলার, এই আনা প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ একদা লেখেন- ‘কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম যুগিয়ে- সেটা ভালো লাগল তাঁর কানে। ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাঁথুনিতে; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে;’ প্রভাতকুমারের অনুমান রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সেই ডাকনাম ছিল – নলিনী। প্রসঙ্গত বলা যাক, রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ভাদ্রে’র গোড়াতেই, অর্থাৎ, অগাষ্ট ১৮৭৮ নাগাদ বোম্বাই পৌঁছন। আশ্রয় নেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ডা আত্মারং পাণ্ডুরঙের পরিবারে। আত্মারং-এর কন্যা আনা তড়খড়- এর উপর ন্যস্ত হয় তাঁর শিক্ষার দায়িত্ব। কীরকম শিক্ষা! যাকে আজকের ভাষায় আমরা বলি Grooming। সেদিনের বিলাতি সমাজে মানানসই হয়ে ওঠার মতো মাপে। এই আমেদাবাদ পর্বের আগে, রবীন্দ্রনাথের ১৩ বছর বয়স থেকে তৈরি হওয়া গানগুলির কালানুক্রমিক এক তালিকা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী’ বইটিতে পাওয়া যায়। মোট এগারোটি গান। রচনাকালীন বয়ঃক্রম, প্রকাশকাল এবং স্বরলিপিকারদের নামোল্লেখ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের তালিকাতেই পাওয়া যায়।পরবর্তী সময়ে নানা সূত্রে কোনও কোনও গানের ক্ষেত্রে অন্য কোনও স্বরলিপিকারের নাম পাওয়া যাচ্ছে এমন ঘটনা কম হলেও একেবারে ঘটেনি এমনও নয়। সব মিলিয়ে ব্যাপারটিকে একটি তালিকার আকারে সাজালে তা খানিকটা এইরকম দাঁড়ায়।…


[১] ১৩ বছর বয়সে লেখা –
‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, ৪৫ সাম্বৎসরিক মাঘোৎসবে (১১ মাঘ, ১২৮১, ১৮৭৫, ২৫ জানুয়ারী) কলকাতার আদি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে গীত। ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি’( সাধারণ, ১৩৫৬ মাঘ) বইটিতে এর রাগ তাল হিসাবে পাওয়া যায় জয়জয়ন্তী ঝাঁপতালের উল্লেখ। আদি এবং সাধারণ দুই সমাজ থেকেই প্রকাশিত স্বরলিপির বইতে এর রচয়িতা হিসাবে পাওয়া যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। স্বরবিতান ৬৪ খন্ডে পরবর্তীকালে এটির স্বরলিপিকার হিসাবে পাওয়া যায় কাঙ্গালীচরণ সেনের নাম। এখানে গানের রাগ ‘দেশ’, তাল ‘ঝাঁপতাল’।


[২] ১৪ বছর বয়সে লেখা –
‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’, ‘সরোজিনী নাটক’, প্রকাশ ১৮৭৫ নভেম্বর। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত, ‘বাঙ্গালীর গান’ ( ১৩১২) বইটিতে এই গানের রচয়িতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে গানটি ছত্রিশ পংক্তির। গীতবিতানে যা ১৬ পংক্তির। বাঙ্গালীর গানে এর রাগ ‘অহং’, তাল ‘একতাল’। স্বরবিতান ৫১ খন্ডে এই গানটির স্বরলিপিকার হিসাবে পাওয়া যায় ইন্দিরা দেবীর নাম। প্রভাতকুমার জানান, ‘স্বরলিপি ইন্দিরা দেবীর পান্ডুলিপি হইতে সংকলিত। এখানে গানের রাগ ‘ভুপালি’, তাল ‘একতাল’।


[৩] ১৬ বছর বয়সে লেখা-
(ক) ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’, প্রথম প্রকাশ ‘ভারতী’ পত্রিকায়, ১২৮৪ আশ্বিনে। রাগ ‘জয়জয়ন্তী’, তাল ‘চৌতাল’। স্বরলিপিকার, সরলা দেবী। স্বরবিতান ৪৭ খন্ডে, এটির রাগ ‘দেশ’, তাল ‘একতাল’।
(খ) শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, প্রথম প্রকাশ, ভারতী, ১২৮৪ আশ্বিন। ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয় ‘সজনি গো, আঁধার রজনী ঘোর ঘনঘটা’ এই পাঠে। রাগ ‘মল্লার’। স্বরলিপিকার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বরবিতান ১১ এবং ২১ খন্ডে প্রকাশিত। তাতে এর সুর পিলু, তাল, ত্রিতাল।
(গ) ‘সাধের কাননে মোর’ প্রথম প্রকাশ, ‘ভারতী’, ১২৮৪ অগ্রহায়ণ। জয়জয়ন্তী, ঝাঁপতাল। স্বরলিপি নেই।
(ঘ) ‘গহনকুসুমকুঞ্জ -মাঝে’ , প্রথম প্রকাশ , ‘ভারতী’, ১২৮৪ অগ্রহায়ণ, বিহাগড়া। স্বরলিপিকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, স্বরবিতান ২১ খন্ডে সংকলিত। এখানে সুর কীর্তন, তাল একতাল।
(ঙ) ‘বজাও রে মোহন বাঁশি’, প্রথম প্রকাশ, ‘ভারতী’, ১২৮৪ পৌষ। মুলতান। স্বরলিপিকার, ইন্দিরা দেবী, স্বরবিতান ২১ খন্ডে সংকলিত। সেখানে এটির সুর পিলু কীর্তন।
(চ) ‘হম সখ দারিদ নারী’, প্রথম প্রকাশ ‘ভারতী’, ১২৮৪ মাঘ, রাগ ভৈরবী। স্বরলিপি নেই।
(ছ) ‘সতিমির রজনী, সচকিত সজনী’, প্রথম প্রকাশ, ‘ভারতী’, ১২৮৪ ফাল্গুন। মিশ্র জয়জয়ন্তী, স্বরলিপি, ইন্দিরা দেবী। অন্য এক সূত্রে ( রবীন্দ্র গানের স্বরলিপিকার/ পীতম সেনগুপ্ত) স্বরলিপি সরলা দেবী। এই সুত্রে এর রাগ তাল, দেশ কীর্তন ত্রিতাল।
(জ) ‘সখী রে পিরীত বুঝবে কে’, প্রথম প্রকাশ, ‘ভারতী’, ১২৮৪ ফাল্গুন। রাগ ‘টোড়ি’। স্বরলিপি নেই।
(ঝ) ‘বাদর বরখন, নীরদ গরজন’, প্রথম প্রকাশ, ‘ভারতী’, ১২৮৪ চৈত্র। রাগ ‘মল্লার’। স্বরলিপি নেই।


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে বয়ঃক্রমে বিন্যস্ত করেছেন এই তালিকাটি সে প্রসঙ্গে একেবারে গোড়ার অর্থাৎ, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র’ গানটি সম্পর্কে প্রশান্তকুমার পালকে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায়। প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য এখানে রাখা যাক। এই গানের মূলের শিখ ভজনটি ‘গগনময়ী থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ১২৭৯ ভাদ্র, ১৮৭২ সালে, বঙ্গাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের বাংলা পাক্ষিক মুখপত্র ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকায়। এর পর ‘তত্ত্ববোধিনী’র ফাল্গুন সংখ্যায় গানটি ছাপা হয় একটি গদ্যানুবাদ সহ। প্রশান্তকুমারের মনে হয়, এই গদ্যানুবাদটি রবীন্দ্রনাথের আগেই পড়া ছিল এবং উপনয়নের পর দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে হিমালয় যাত্রা পর্বে, অমৃতসরে এই গানটি তাঁর শোনারও সুযোগ হয়। এ দুয়েরই যোগফল গগনের থালে গানটি। মার্চ, ১৮৭৩ এঁরা অমৃতসর পৌছন, সেখান থেকে ডালহৌসি যান এপ্রিলে। অতএব, যা হওয়ার তা এই সময়পর্বের মধ্যেই হয়ে থাকবে। প্রশান্তকুমার, যে ক্রমে প্রভাতকুমার এই গানটিকে ‘গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী’তে রেখেছেন, সেদিকে তাকিয়ে লেখেন- ‘আমাদের মত গ্রাহ্য হলে সেখানে বয়স ও সালটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে, লিখতে হবে বয়স ১১’। আগে যে তালিকাটি পেশ করা হল, তার যে চারটির স্বরলিপি নেই সেগুলি বাদ দিয়ে বাকি সাতটির ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভুমিকাটি এই গানগুলির ইতিহাসের এক গুরুত্বময় বিষয়। বিশেষত এই পর্বে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গানের কাজে এক উল্লেখনীয় নাম। সে ব্রাহ্মসমাজের গান, থিয়েটারের গান যেদিক দিয়েই ভাবা যাক। এই গানটির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের Authorship কে মান্যতা দেওয়ার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় পরে। এই গানটির রচয়িতা কে আসলে, এ নিয়ে দীর্ঘদিন একটা তর্ক ছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি দ্বিতীয় ভাগ এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত বইটির সূচীপত্র, দু’ জায়গাতেই এর রচয়িতা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ

এরই সঙ্গে সঙ্গে আদি ব্রাহ্মসমাজের স্বরলিপি বইতে এ গানের রচয়িতা যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সে কথা স্বীকার করার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে মনে করেন এ গান তাঁরই রচনা, সে কথাও লেখা হয়েছে রবীন্দ্র রচনাপঞ্জীতে। এবং সেটা তাঁর জীবদ্দশাতেই মাঘ ১৩৪৬ অর্থাৎ, ১৯৩৯ সালে। ‘রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেনীসংগম’ বইটিতে ইন্দিরা দেবীর মত ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পক্ষে। এ’প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘কেউ কেউ ভুল করে ভাবেন এটি রবীন্দ্রনাথের’। এই লেখার তারিখ মাঘ চৈত্র ১৩৫৬, [বিশ্বভারতী পত্রিকা/ ৮ম বর্ষ/ ৩য় সংখ্যা] অথচ, আশ্বিন ১৩৫৭য় ‘গীতবিতান’ তৃতীয় খন্ডে [পূজা ও প্রার্থনা] গানটি নেওয়া হয়। মনে রাখা দরকার, এই সংকলনের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন ইন্দিরা দেবী।

ইন্দিরা দেবী

আমরা জানি, কিভাবে পাঠরত কিশোর রবীন্দ্রনাথ পাঠ স্থগিত রেখে একদিন শুনে ফেলেন রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী নাটকটি পড়ে শোনানো। নাটকের পক্ষে একটি দীর্ঘ বক্তৃতাধর্মী সংলাপ বেমানান লাগে তাঁর। তৈরি হয়ে ওঠে ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণে’র মতো এক গান। এই গানটি তৈরি হওয়ার পরবর্তী সময় অন্যরকম এক গানের কাজে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে নেবেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সে তথ্যও অজানা নয় আজ অনেকেরই। মাঝে একটি পিয়ানো, রবীন্দ্রনাথ আর অক্ষয় চৌধুরীকে নিয়ে এক নতুন নিরীক্ষায় মেতে উঠবেন। এরই ফল, ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’। সুরের এক ভিন্ন দর্শন। তালিকার তৃতীয় গান, সঞ্জীবনী সভার উদ্দীপনায় লেখা, ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’ অথবা, ষষ্ঠ গান, ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকা তালিকা থেকেই বোঝা যায়। ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অশ্রুমতী’ নাটকে মলিনা’র গান হিসাবে পাওয়া যায়। ‘অশ্রুমতী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৯’র জুলাইয়ে। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। সুর অথবা স্বরলিপি কি এরই মধ্যে করা হয়েছে এটির? হয়ে থাকলে তা নিশ্চয় ১৮৭৮ এর মে মাসের আগেই হয়েছে। নইলে এর মাঝে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে পাচ্ছেন কোথায়? যদি না কোনওভাবে রবীন্দ্রনাথের সুর কল্পনা’র ছকটি জেনে, অথবা, না জেনে তিনিই বসিয়ে থাকেন এর সুর। স্বরলিপির আনুপুর্বিক প্রকাশের তালিকা এক্ষেত্রে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে বোঝার সহায়ক হতে পারে। উপরন্তু, স্বরলিপি’র সুর সংগঠন , সুরের Signature, সেও দিশা দেখাতে পারে একরকম করে। দেখা যাচ্ছে, তালিকার প্রায় সব গানগুলিই ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ আমেদাবাদ পৌছনর আগেই। স্বাভাবিক নিয়মে এর সুর গুলি বা স্বরলিপি তার আগেই তৈরি হয়েছে এমনটা ধরে নেওয়াই যায়। এক্ষেত্রে দুটি তথ্য প্রশ্ন জাগায়। পীতম সেনগুপ্ত’র ‘রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার’ বইটিতে। ‘তোমারি তরে মা’ এবং ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ এই দুটি গানের ক্ষেত্রে স্বরলিপিকার হিসাবে সরলা দেবী’র নাম পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম গানটির ক্ষেত্রে একক ভাবে, এবং দ্বিতীয় গানটির ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে যৌথভাবে। পীতম সেনগুপ্ত কী এই গান দুটির প্রথম করা স্বরলিপিটির কথা বলতে চান? তাই যদি হয়, তাহলে জানতে ইচ্ছে করে সরলা দেবী কতবছর বয়স থেকে স্বরলিপি করা শুরু করেন? মনে রাখা ভালো আলোচ্য পর্বে ১৮৭২ এর জাতিকা এই মানুষটির বয়স হওয়ার কথা ছয়। ঠিক এই কারণেই স্বরলিপি প্রকাশের আনুপূর্বিক ইতিহাসটা জরুরি। এই তালিকা, আবারও বলতে হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকাটিকে বুঝিয়ে দেয়। বাকি সম্ভাবনাগুলি এই উপাদানগুলিকে এক জায়গায় জড়ো না করলে সঠিক ভাবে কিছুতেই বলা সম্ভব নয়। কল্পনা করা ভিন্ন উপায় নেই কোনও।



এমন কী হতে পারে, প্রৌঢ় বয়সে ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘নিজের সুর’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেন ওই চারটি গান প্রসঙ্গে, তখন একটা Melodic structure এর কথা যেমন বলেন, তারই সঙ্গে সে পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকার জায়গাটি না বলেও জাগিয়ে রাখতে চান কোথাও? এরকম একটা দিক থেকেও কী পড়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের লেখা শব্দগুলিকে?

সূত্রনির্দেশ
১ জীবনস্মৃতি , রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তদশ খন্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ১ ফাল্গুন, ১৩৫০
২ গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট কলকাতা, ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৯
৩ রবিজীবনী, ১ম ও ২য়, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২২ শ্রাবণ, ১৩৯১
৪ রবীন্দ্র- গানের স্বরলিপিকার, পীতম সেনগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, জানুয়ারি ২০১৮

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
4 months ago

খুব ভাল লাগল।

SHOUVIK DE
SHOUVIK DE
4 months ago

অনেক তথ্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাত্তিকের কাছে মহার্ঘ্য রচনা। আমরা অর্থাৎ ফাঁকিবাজেরাও চেখে নিলাম সর টুকু। চমৎকার।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
4 months ago

লেখাটি খুব মন দিয়ে পড়লাম।অনেক কিছু জানতে পারলাম।বুঝলাম,এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় থাকতে হবে অনুসন্ধানী মানুষদের।

সমুদ্র মিত্র- শান্তিনিকেতন
সমুদ্র মিত্র- শান্তিনিকেতন
4 months ago

খুবই ভালো লাগল। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে থাকা বিভিন্ন মানুষের লেখা থেকে একাধারে সংগীতকার ও সুরকার সাথে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির স্বরলিপিকার দের বিশ্লেষণ লেখকের মুন্সীয়ানার পরিচায়ক ।