শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

হে পূর্ণ তব চরণের কাছে …(পর্ব ২) 

[পর্ব -২]

একসময়ে পৌঁছে গেলাম চিক্কা। এখানের উচ্চতা ৯৩০০ ফুট। নদীর পাশে একটুকরো সমতল জায়গা, সেখানে প্রচুর ভেড়া নিয়ে কয়েকজন মেষপালক, ভেড়াদের লোম কেটে বস্তাবন্দী করছে। পশমের বস্ত্র তো আমরা সকলেই গায়ে দিই, কিন্তু সেই পশম আহরণের একেবারে প্রাথমিক ধাপটা প্রথম চাক্ষুষ করলাম। বিশেষ একটা কায়দায় ভেড়াগুলোকে চেপে ধরে রেখে, একটা অদ্ভুত আকৃতির কাঁচি দিয়ে কি অনায়াস দক্ষতায় লোমগুলো কেটে তুলছে, প্রাণীটির গায়ে এতটুকুও আঘাত না দিয়ে! একপাশে পাথরের গায়ে প্রকৃতির সর্পিল কারুকার্য – স্থানীয় মানুষের কাছে পূজনীয় ‘তক্ষকনাগ” দেবতা হিসেবে। যুগ যুগ ধরে ভক্তদের প্রদীপশিখা ও সিঁদুরের অভিঘাতে আদতের quartz vein এর সাদা রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে! নইলে এই পাথরের রূপান্তরণ প্রক্রিয়ার এক সুন্দর সাক্ষ্য হতে পারত সেটি! অন্যদিকে একটা পাথর-ঘেরা জায়গায় শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল রাখা। পাথরের ওপরে লাল রঙের নিষেধাজ্ঞা – মহিলাদের বিশেষ সময়ে প্রবেশ মানা। অনুমান করলাম, বিদেশিনী পর্যটকদের জন্যই এই সতর্কবাণী। দুটো পাথরের ঘর রয়েছে, কোনো বিশেষ পার্বণের সময়ে নীচে জগৎসুখ থেকে পূজারী আসেন। একটি ঘর তালাবন্ধ, সেখানে নাকি পূজার সামগ্রী ইত্যাদি থাকে। অন্যটি খোলা, বোধহয় আমাদের মত মুসাফিরদের সুবিধার জন্যেই। সেখানেই আশ্রয় মিলল আজকের মত। মাঝারি মাপের ঘর, দুটি অসম্পূর্ণ জানালা – প্লাস্টিক শীট দিয়ে সেগুলি ঢাকা দেওয়া হল, হাওয়া ও সেইসঙ্গে ঠান্ডা আটকাতে। ঘরের মধ্যেই একপাশে মাটির উনুন করা রয়েছে, বাইরে থেকে শুকনো কাঠকুটো যোগাড় করে এনে, সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা করা গেল।

পশ্চিমের জানালার লাল প্লাস্টিক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো সারা ঘরটাকে রাঙিয়ে তুলেছে। আজ রমেশ ও লাল পায়ের ব্যথায় একটু কাতর, মলম লাগাচ্ছে। আমারও একটু altitude sickness এর মত লাগছিল, মন্ডলদার নির্দেশে কাঁচা রসুন খেয়ে আরাম পেলাম। ধ্যানী ও রমেশ এনেছে ছোট্ট রেডিও, এখন ক’দিন সেগুলোই আমাদের কাছে বহির্বিশ্বের একমাত্র সংবাদদাতা। বাইরে ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হাওয়ার দাপট শুরু হয়ে গেছে।
চিক্কাতে বিশ্রামের পর, পরেরদিন আবার চলা শুরু। এদিনের পথ বড় সুন্দর, অল্প অল্প চড়াই, একটানা চলেছে। ক্রমশঃ বড় গাছপালা শেষ হয়ে এল, এখন পায়ের নীচে শুধুই ঘাস, কদাচিৎ এক-আধটা কাঁটাঝোপ মতন। আবার কোথাও পথরেখা মিলিয়ে গেছে বড় বড় পাথরের স্তূপের মধ্যে। পাথরগুলির বেশীরভাগেরই আকারে গোলভাব রয়েছে, যার অর্থ এরা শুধুমাত্র পাহাড়ের ভগ্ন অংশবিশেষ নয়, অন্ততঃ বেশ খানিকটা জলবাহিত হয়েই এখানে এসেছে। মাপেও কোনোটাই দু-তিন ফুটের কম নয়। কি বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, এত বড় বড় পাথরকে এতখানি জলবাহিত করতে! তা-ও এই উচ্চতায়! নদীর দুপাশের খাড়া পাহাড়গুলি কম করেও হাজারখানেক ফুট উঁচু হবে, নদীগর্ভ থেকে। ভাবতে পারা যায়, কোনো এক অতীতে, হয়ত কয়েক লক্ষ বছর আগে, ওই পাহাড়ের ওপরটাই ছিল সমতল, বা প্রায় সমতল, আর এই নদী বয়ে যেত সেখান দিয়ে! সময়ের প্রভাবে, ক্ষয় পেতে পেতে, আজ এত গভীর উপত্যকার সৃষ্টি করে চন্দ্রনালা বয়ে চলেছে! আসলে, হিমালয় এত বিরাট হলেও, ভূতাত্ত্বিক সৃষ্টির জগতে, নেহাৎই ছেলেমানুষ – মাত্র ৫/৬ কোটি বছর বয়স তার; এখনও সম্পূর্ণ গড়ে ওঠেনি – প্রতি বছরেই কয়েক মিলিমিটার করে বাড়ছে! মাঝেমধ্যেই তার ভারসাম্যের হেরফের ঘটে, গিরিরাজ তখন হঠাৎ একদিন ধস নামিয়ে দেন, নদীকেও সেইসঙ্গে খুঁজে নিতে হয় নতুন কোনও গতিপথ!
Boulder zone পেরিয়ে আবার পথ চলি। ওপরে নীল আকাশ, দুপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝ দিয়ে চন্দ্রনালার জলতরঙ্গ। থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়ে উপভোগ করি – “চক্ষুভিরিব পিবন্তি” – সত্যিই যেন দুচোখ দিয়ে আকন্ঠ পান করে নিতে চায় মন। নদী কোথাও পাথরে বাধা পেয়ে অশান্ত, কোথাও বাধাহীন, আবর্তের সৃষ্টি হয়েছে – যাকে তটিনীসুন্দরীর নাভিকূপ বলে বর্ণনা করেছেন মহাকবি কালিদাস, তাঁর মেঘদূতম–এ। হঠাৎ দূরে বরফঢাকা কোনো শিখর দেখা দেয়, শ্রান্ত দেহ-মনে আবার উৎসাহ জাগে। ক্রমশঃ ইন্দ্রাসন শিখর আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। এসে পৌঁছলাম শেরিতে, উচ্চতা ১৩,২০০ ফিট। এতক্ষণ নদীখাত ধরে চলার পরে এসে পড়লাম হিমবাহ-উপত্যকায় – ইংরাজী “V” আকৃতির জায়গায়, এখন উপত্যকার প্রস্থচ্ছেদ নিয়েছে “U” আকার। আমাদের এখন তিনদিকে বিরাট উঁচু উঁচু সব শিখর, আর পশ্চিমে যে পথে উঠে এসেছি। ঠিক পিছনেই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, অন্ততঃ ৪০০০-৫০০০ ফুট উঁচু হবে। সামনেই, রাজকীয় মহিমায় বরফাবৃত ইন্দ্রাসন (২০,৪০০ ফিট)। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যে আগমন করলে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করেন। সেই থেকেই এই নামকরণ। তবে পর্বতারোহীদের কাছে এটি পীরপঞ্জল হিমালয়ের একটি অন্যতম দুর্গম শিখর মনে করা হয়, পদে পদে crevasse ও আরো নানা ঝুঁকি থাকে। ওদিকে দেওটিব্বা (১৯,৮০০ ফিট) অংশতঃ দৃশ্যমান।

আরেক পাশে দেখা যাচ্ছে নরবু, তারও উচ্চতা অনেক, অথচ বরফ বিশেষ জমতে পারেনি, বোধহয় খাড়া আকৃতির কারণে। নরবুর পাশ দিয়ে গেছে মালানা গিরিখাতের পথ। আমাদের সামনে অনেকখানি বিস্তীর্ণ সমতল, বা tableland, গোটাদুয়েক ফুটবল মাঠ স্বচ্ছন্দে ঢুকে যাবে। বছরের বেশীরভাগ সময়েই জায়গাটা থাকে বরফের আচ্ছাদনে, ফলে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ঘাস, আর জলে কিছু শ্যাওলা ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদ নেই! বেশিরভাগ জায়গাটাই ন্যাড়া। তার দুপাশ দিয়ে তিরতির করে ছোট ছোট নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর দুটি ধারা। চন্দ্রনালার উৎপত্তি বলা যায় এখান থেকেই। চারপাশের বিভিন্ন পাহাড় থেকে অনেকগুলি ঝর্ণার ধারা এই সমতলে এসে হঠাৎ স্তিমিতগতি হয়েছে। আবার একটু নীচে গিয়েই, রূপ পেয়েছে চন্দ্রনালায়। শুনেছিলাম শেরিতে একটা পাহাড়ের গায়ে গুহা আছে, সেখানে ২০-২৫ জন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেল সেটা জলের ধারার থেকে এতটাই দূরে, যে ঠিক সুবিধে হবেনা। তাই জলের কাছাকাছি জায়গা দেখে তাঁবু ফেলা হল। এখানে ঠান্ডা আরো তীব্র, কোনোসময়েই টুপি, মোজা বা গ্লাভস খোলার উপায় নেই। আজকের পথচলায় সকলেই ক্লান্ত, প্রায় ৬/৭ ঘন্টা চলতে হয়েছে, উঠতে হয়েছে প্রায় ৪০০০ ফুট। তবু, পড়ন্ত সূর্যের আলো যখন দেওটিব্বার মাথায় সোনা ঢেলে দেয়, সব শ্রান্তি যেন নিমেষে উধাও হয়ে যায়!
স্পেন থেকে এসেছে যুবক পেদ্রো এবং তার বন্ধু, গন্তব্য সামনের পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রতাল লেক। পথে তাদের সিগারেট ফুরিয়েছে। খুব কুন্ঠার সঙ্গে আমাদের তাঁবুতে এসে জানতে চাইল, আমাদের কাছে উদ্বৃত্ত আছে কিনা। ওরা পয়সা দিয়েই কিনবে। তাকে বসিয়ে চা-সহ বিস্তারিত আলাপ করলাম। বুঝলাম কুন্ঠার কারণেই পয়সার উল্লেখ। আমাদের সীমিত স্টক থেকে কিছু দেওয়া হল। পরদিন সকালেও কয়েকটা নিল। সে ও তার বন্ধু সেদেশে কোনো পানশালায় বেয়ারার কাজ করে, আর অন্য সময়ে water rafting ও surfing এর প্রশিক্ষণ দেয়। এখন এসেছে একমাসের ভারতদর্শনে। হাতে বেশী সময় নেই, কালই চন্দ্রতাল দেখে, নেমে যাবে চিক্কাতে।
আমাদের সঙ্গের পাহাড়ী মানুষগুলোর সারল্য আর সেবা দেখে শহুরে তথাকথিত সভ্যতার দীনতা প্রকট হয়। এরাই আমাদের যাত্রাপথে সর্বাধিক পরিশ্রম করছে – সেই কোন ভোরে চা দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙানো থেকে, আমরা হাঁটতে শুরু করার পরে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঘোড়াদের পিঠে চাপিয়ে, আবার আমরা পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে, সব জিনিস নামিয়ে চা/কফির ব্যবস্থা করা, পরে রাতে সবার খাওয়া-দাওয়ার পরে বাসনপত্র ধুয়ে, ওই ঠান্ডায় খাবার জল এনে দেওয়া অবধি, সারাদিনই খাটছে! আবার সর্বদাই হাসিমুখে আমাদের সব আবদারও পূরণ করে চলেছে!
শেরিতে ঠান্ডা এতই বেশী যে সূর্যাস্তের পরে আর তাঁবুর বাইরে থাকাই গেল না। রাতের খাওয়াও সারতে হল তাঁবুর ভিতরেই। বোরাদা আজ একটু বেশী কাহিল, চুপচাপ একপাশেই পড়ে রইল। আজ আর চন্দ্রনালার অবিশ্রাম ছলাৎছল শব্দ নেই, কিন্তু সে অভাব পূরণ করে দিল তাঁবুর ভিতরে রমেশের নাসিকাগর্জন। ভীমপলশ্রী থেকে ভৈরবী, সব রাগ-রাগিণীই শোনা হয়ে গেল সারা রাতে, ঘুম হল অল্পই!
সকালে উঠে দেখি, তাঁবুর বাইরের দিকে পাতলা বরফের আচ্ছাদন জমে গেছে। নদীর জলেও স্বচ্ছ বরফের আস্তরণ। ঘাসের একেকটা ফালির মধ্যে বরফ জমে, অপূর্ব সুন্দর ফুলের আকার নিয়েছে। ধূসর আকাশ ও চারিদিকের বরফের পটভূমিতে ইন্দ্রাসন শিখরের চূড়াটুকুকে উজ্জ্বল করে তুলেছে অন্তরাল থেকে প্রথম সূর্যের আলো। তখনও তাপমাত্রা শূন্যের নীচেই। একটু বেলা বাড়ার পরে, প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ, সেটা দাঁড়াল ২ ডিগ্রীতে!


আজ আমাদের চলতে হবে নদী পেরিয়ে, ইন্দ্রাসনকে পাশে রেখে, দেওটিব্বা শিখরের পাদদেশের পথে। আজ আর তাঁবু গোটানোর ব্যাপার নেই, শুধু অত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিস ও জল নিয়ে রওনা দিলাম। প্রথমেই নদী পেরোনো – জুতো-মোজা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে জলে পা দিতেই মনে হল, পায়ের নীচের অংশটা বোধহয় আর আমার নয়! পথপ্রদর্শক প্রকাশের দেখানো জায়গা দিয়ে পিছল নুড়িপাথরের ওপর পা রেখে নদী পেরিয়ে এলাম। হাঁটুজলের বেশী নয়, কিন্তু স্রোত ভালই রয়েছে। এবারে, গিরিসানু দিয়ে শুধুই চড়াই। বিক্ষিপ্ত পাথরে পাশ দিয়ে চলা, নির্দিষ্ট কোনো পথরেখা নেই, তাই প্রায়ই দলছুট হয়ে পড়ছিলাম। ধ্যানী ও লাল খানিকটা এগিয়ে গেছে, মন্ডলদার সঙ্গে। আমি আর বোরাদা অন্য একদিকে এসে পড়েছি, আর রমেশ বোধহয় চড়াই এড়াবার চেষ্টায় একদম নীচেই রয়ে গেছে। ঝর্ণার ধারাগুলিতে আর জল নেই, সবই বরফ! কোথাও আবার সেই বরফের নীচে দিয়ে ক্ষীণ জলধারাও রয়েছে। একটা সময়ে বরফের ওপর দিয়েই চলা শুরু হল। এ পথটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক – নরম বরফের ওপরে পদস্খলনের সম্ভাবনা প্রতি পদে! বরফের মধ্যে এখানে-ওখানে মাথা বের করে রয়েছে কালো কালো পাথর। ক্রমশঃ সব পাথরও ঢেকে গেল, শুধুই বরফের ওপর দিয়ে কিছুটা চড়াই উঠে, পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে। এখানের উচ্চতা প্রায় ১৫,৪০০ ফিট। চারিদিকে নরম দুধসাদা বরফ। দলপতি মন্ডলদা ও ধ্যানী আগেই পৌঁছে আমাদের ONGC Himalayan Association এর পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে।

একে একে আমরা সবাই সমবেত হলাম। এতদিনের পরিশ্রম আজ সার্থকতা পেল। উজ্জ্বল হাসিতে দেওটিব্বা শিখর যেন তারই স্বীকৃতি জানাচ্ছে! তাকে সেলাম জানিয়ে, এবং প্রথামাফিক পূজার পর্ব সেরে, রওনা দিলাম ফেরার পথে। মনে এক মিশ্র অনুভূতি – গন্তব্যে ঠিকমত পৌঁছানোর আনন্দ, আবার ভারাক্রান্ত এই ভেবে যে, এই তো সেদিন এলাম, এরই মধ্যে এসে গেল ফেরার পালা? আবার সেই শহর, সেই গতানুগতিকের জীবনযাত্রা – অপেক্ষায় থাকতে হবে, কবে আবার নতুন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা হবে, কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ডাক পাঠাবে দেবতাত্মা হিমালয়!

[পর্ব -১]

[ছবি – লেখক]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.