শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে …

[পর্ব -১]

দিল্লি পৌঁছোনো অবধি একটু দ্বিধা ছিল, কীভাবে এগোব পরবর্তী গন্তব্যে। ইন্টারনেট মারফৎ জানা গেছিল, দিল্লি থেকে হিমাচল প্রদেশের কুলু আকাশপথে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তার টিকিট এই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে বসে পাওয়া সম্ভব ছিলনা (বলে রাখি, সময়টা ছিল ২০০৩ সাল) । তাই টিকিটের অনুরোধ রেখেছিলাম আমাদের দিল্লি অফিসে, কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি। দ্বিধা সেই কারণেই – টিকিট না হয়ে থাকলে, ব্যবস্থা করতে হবে ট্রেনে-গাড়িতে চেপে চণ্ডীগড় হয়ে যাবার – সেক্ষেত্রে আমাদের পাহাড়বাসের সীমিত সময়সীমা থেকে আরো একটি দিন সঙ্কুচিত হবে!
কিন্তু দিল্লি অফিসে পৌঁছোতে, সংশ্লিষ্ট শ্রীমতী কমল লাঞ্চব্রেকের মাঝপথেই ঝলমলে হাসিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে দিলেন পরদিন সকালের ফ্লাইট টিকিটগুলো। আমরা চলেছি ONGC Himalayan Association, Rajahmundry – র ব্যবস্থাপনায়, লক্ষ্য পাহাড়ের একান্তে কয়েকটা দিন কাটানো, শহরের ভীড় ও ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে। আমাদের অফিসে এই একটি মস্ত সুবিধা আছে, অন্যান্য খেলাধূলার মতই, পর্বতারোহণেও কর্মীদের উৎসাহিত করা হয় – তার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ছুটি থাকে, আর খরচপত্রেরও সিংহভাগ অফিসই বহন করে। আমাদের এবারের গন্তব্য হিমাচল হিমালয়ের দেওটিব্বা শিখরের পাদদেশে। মানালি, আমাদের সকলেরই অতি পরিচিত একটি জায়গা। সেখান থেকে ৭ কিমি দূরে জগৎসুখ গ্রাম। সেখানেই গাড়ির রাস্তা শেষ, হাঁটাপথের শুরু। যেতে হবে খানোল, চিক্কা ও শেরি পার হয়ে, প্রায় ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায়। আমাদের ছয়জনের দলটাতে প্রায় সারা ভারতের প্রতিনিধিরা রয়েছেন – আসাম থেকে এসেছেন শ্রী বোরা, কর্ণাটকের শ্রী রমেশ, পার্বত্য উত্তরাঞ্চল থেকে শ্রী লাল ও শ্রী ধ্যানী। এছাড়া বঙ্গসন্তান দলপতি মন্ডলদা এবং আমি। যাত্রার সিংহভাগ প্রস্তুতিই সেরেছেন মন্ডলদা – পোক্ত পর্বতারোহী, প্রত্যেক খুঁটিনাটি ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি – বন্ধুমহলে তাঁর “হিমালয় মন্ডল” পরিচিতির সার্থকতা টের পেয়েছি যাত্রার প্রতিটি পদে। আমরা পাঁচ আনাড়িও তাঁরই ভরসায় সাহসী হয়েছি এই দুর্গমের আরোহণে, যাকে বলা হয় deadly sport – চলার পথে কোথাও একবার পদস্খলন ঘটলে, আর চিহ্নমাত্রও খুঁজে না-ও পাওয়া যেতে পারে!
দিল্লি থেকে কুলু/মানালি আকাশপথে পরিষেবা (সেইসময়ে) ছিল মাত্র একটিই বেসরকারী সংস্থার – Jagson Airlines – দৈনিক তাদের একটিই বিমান দিল্লি-সিমলা-কুলু এই পথে যাতায়াত করে। সরাসরি মানালি বা কুলুতে airport নেই, নামতে হয় Bhuntar-এ, এখান থেকে কুলু মাত্র ৯ কিমি, আর মানালি প্রায় ৫০ কিমি মত। ছোট্ট ডর্নিয়ার প্লেন, মাত্র ১৬ জন যাত্রী নিতে পারে। (প্রসঙ্গত, আমরা বোম্বে হাই যেতে সমুদ্রে যে MI-8 হেলিকপ্টার ব্যবহার করতাম, সেখানেও জনা কুড়ি যাত্রী ধরে যেত, মালপত্র তো অলগ!) এখানে আমরা ছয়জন ছাড়া বেশিরভাগই মনে হল ব্যবসায়ী শ্রেণির। দুজন বিদেশিনীও রয়েছেন, আলাপে জানলাম, কানাডা থেকে দু’মাসের ভারতভ্রমণের মাঝপথে চলেছেন মানালির আশেপাশে, আমাদেরই মত কোনও trekking-এ। এইবার দিল্লি এয়ারপোর্টে ঘটল একটা মজার ঘটনা। জীবনে প্রথমবার, এবং আজ অবধি একমাত্রবার, মাছের বাজারের মত দরাদরি করে প্লেনে চড়েছিলাম! হয়েছিল কি, ওই ছোট্ট Dornier প্লেনে যাত্রী বহন ক্ষমতাও যেমন সীমিত, তেমনই যাত্রী পিছু মাল বহনেরও খুবই নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, বোধহয় জনপ্রতি ৭ কেজি। তার থেকে বেশি হলে আবার একটা বড়সড় রকমের অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হবে। এদিকে আমরা চলেছি ট্রেকিং করতে, সঙ্গে লটবহর তো ভালোই আছে। এই মাল বহনের সীমার কথা আমরা কিছুই জানতে পারিনি, তাহলে হয়ত অন্যভাবে পরিকল্পনা হত। সে যাইহোক, আপাতত সব ব্যাগপত্র ওজন করে আমাদের অতিরিক্ত মাশুল দাঁড়াল প্রায় ১২০০০/- টাকার মত! সেদিনের হিসেবে অনেকগুলোই টাকা! তার ওপর, আমরা যাচ্ছি ট্রেকিং-এ, মাপা টাকাপয়সা সাথে নিয়ে। সেখানে আবার জানা-অজানা অনেক খরচা রয়েছে সামনে। আমরা একটু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম – অতিরিক্ত মাশুল দিয়েও যখন ওরা নিয়ে যেতে রাজি, তখন বিমানের মোট মালবহন ক্ষমতার সীমার মধ্যেই নিশ্চয়ই রয়েছে ব্যাপারটা। এদিকে, এদের সীমিত যাত্রী সংখ্যা, তার মধ্যে আমরাই মোট ছ’জন। কাজেই একটু কূটনীতি প্রয়োগ করতে হল। সরাসরি ওদের কাউন্টারের মেয়েটিকে বললাম, “ভাই, আমাদের এত পয়সা নেই, আমরা এই ছয়টা টিকিট এখুনি ক্যান্সেল করতে চাই, ওই অতিরিক্ত মাশুলেই আমরা আরামসে দুটো গাড়ি ভাড়া করে মানালি পৌঁছে যাব। আর সেইসঙ্গে, আগামী অমুক তারিখে আমাদের মানালি থেকে ফেরারও ছ’টা টিকিট আছে, সেগুলোও এখনই ক্যান্সেল করতে চাই।”
এইবার তারা পড়ল ফাঁপরে। কারণ এই ছ’টি টিকিট ক্যান্সেল করার অর্থ, ওদের পুরো ফ্লাইটই বাতিল করতে হবে! আর, সম্ভবত সেদিনের ফেরার ফ্লাইটটিও! ওদের ম্যানেজার ফটাফট এসে পড়ল, ওরাও ছাড়বে না, আমরাও বেশি টাকা দেব না! অনেক বাকবিতণ্ডার পরে, শেষে ৫০০০/- টাকায় রফা হল। এরপর আর বিশেষ কিছু অসুবিধে হয়নি। সমতল ছাড়াতেই আকাশ থেকে দেখা গেল দিগন্তবিস্তৃত নীল পাহাড়ের সারি, যেন হিমালয় উদ্বাহু হয়ে আহ্বান করছে। নিজের অভিজ্ঞতায় জানি, হিমালয় নিজের থেকে আহ্বান না করলে, তার কাছে যাওয়া যায় না – হাজার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ মূহুর্তে সব বাতিল করতে হয়। আবার যখন ডাক আসে, অগ্রাহ্য করার উপায় থাকে না – শত বাধার বন্ধন তুচ্ছ করেও যেতেই হয়। সিমলা ছুঁয়ে আমরা ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম Bhuntar এয়ারপোর্টে। এখানে এসে বুঝলাম কেন কেবলমাত্র ছোট বিমান ছাড়া এখানে আসতে পারে না। বিপাশা নদীর খুব সরু উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এখানে উড়ে আসতে হয়, দু’পাশে খাড়া পাহাড় আর নীচে বিপাশার জলতরঙ্গ, তারই মধ্যে একজায়গায় নদী একটা ‘দ’ আকৃতির বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকের পেটের কাছ থেকেই রানওয়ের শুরু। প্লেন নামার সময়ে নদীর জল প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ রানওয়েতে ঢুকে পড়ে। এখান থেকে দেখি মানালি পৌঁছানোর সোজা রাস্তায় কাজ চলছে কিছু, তাই আমাদের একটু ঘুরে যেতে হল বিপাশার পূর্বধার দিয়ে, যে পথ গেছে Naggar ও পাথরিকুল হয়ে। এ পথেই পড়ে Roerich Estate, অতীতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী দেবিকারানীর রুশ স্বামী, চিত্রশিল্পী Nikolai Roerich-দের পরিবারের ব্যক্তিগত বাসগৃহ ও সংগ্রহালয়, মানালি বেড়াতে গেলে একটি অবশ্যদ্রষ্টব্য স্থান।
মানালি আমি প্রথম দেখি এর প্রায় বছর পঁচিশ আগে, ১৯৭৮ সালে। আমূল বদলে গেছে সবকিছু – তখন ছিল উত্তাল কলরোলে বয়ে যাওয়া বিপাশা নদীর ধারে একটিমাত্র যাত্রীনিবাস ও গুটিকয় দোকানপসার নিয়ে ছোট্ট, শান্ত একটি জনপদ। যেন চীর-পাইনের ঘোমটায় কোনো লজ্জাশীলা গ্রামবধূ। আর আজকের মানালি যেন লাস্যময়ী এক যুবতী – এত আলো, এত বাড়ি, পাহাড়-বন তছনছ করে কয়েকশো হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান-বাজার, কী নেই! প্রচুর ট্যুরিস্ট, এবং তার ৯০ শতাংশ বাঙালি – পায়ে চাকা লাগানো এ জাতের সত্যিই জুড়ি মেলা ভার! [আমি এর পরেও, ২০২০-তে আরেকবার গেছিলাম মানালিতে, হিমালয়ের বাণিজ্যিকীকরণ যেন আরো দ্রুতগতিতে হয়ে চলেছে, দেখলেই মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে!]


মানালিতে একদিন acclimatization – পাহাড়ে ওঠার আগে তার উচ্চতায় শরীরকে সইয়ে নেওয়া। তারই মধ্যে কেনাকাটার মূলপর্ব সারা হল – রান্নার বাসনপত্র, স্টোভ, কেরোসিন থেকে চাল-ডাল-তেল-মশলা-আটা, ওদিকে rucksack, sleeping bag, carrymat, কিছু কিছু শীতবস্ত্র – সবই সেই দলপতির নিখুঁত নির্দেশে।
অবশেষে এসে পড়ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১১ই অক্টোবর, ২০০৩, শনিবার সকালে মানালি থেকে গাড়িতে পৌঁছলাম ছোট্ট গ্রাম, জগৎসুখ। এখানে বিপাশা নদীতে এসে মিশেছে চন্দ্রনালা – তারই পাশ দিয়ে আমাদের চলার পথ। মানুষের অন্তরে স্থান পেতে হলে যেমন প্রীতি-প্রেমের ধারা বেয়ে চলতে হয়, হিমালয়ের অন্দরে পৌঁছতেও তেমনই গিরি-নির্ঝরিণীর গতিপথ ধরে এগোতে হয়। শৈলশিখর থেকে পার্বত্য নদী আপন প্রবাহে পাথর কেটে, পাহাড় ধসিয়ে নিজের পথ খুঁজে নেয়। সেই প্রবাহ-পথ অনুসরণ করে পথিকেরও পথ চলা শুরু হয়।
জগৎসুখ থেকে সব তোড়জোড় সেরে বেরোতে বেশ বেলাই হয়ে গেল। মালপত্রের জন্য কয়েকটা ঘোড়া, আর পথপ্রদর্শক, এরাও সময়মতোই এসে পড়ল। আগেরদিনই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে রাখা হয়েছিল। আমাদের পথপ্রদর্শক প্রকাশ বয়সে নবীন, তার বাবাও নাকি একসময়ে এই কাজ করতেন, এখন সেও করছে। রান্নার জন্য আছে লালবাহাদুর, আর ঘোড়াদের দেখাশোনার জন্য আরো দু’জন।


আমাদের চলার পথে জগৎসুখ-ই শেষ জনবসতি। এরপরে শুধুই চন্দ্রনালাকে ডানহাতে রেখে অস্পষ্ট পথরেখা অনুসরণে পূর্বমুখী এগিয়ে চলা। প্রথমেই খানিকটা খাড়া চড়াই, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা নানা আকারের পাথর ও কাঁটাঝোপের পাশ কাটিয়ে। পাশে নিত্যসঙ্গী চন্দ্রনালার অবিরাম কলধ্বনি, যেন “নদী আপন বেগে পাগলপারা”! দুপাশে আকাশচুম্বী পাইনের সারি। মাঝেমধ্যেই ডেকে যাচ্ছে নাম-না-জানা কোনো পাখি। জগৎসুখ গ্রামের শেষ বাড়িটিও পিছনে পড়ে রইল তার আপেলবাগান আর গোশালা নিয়ে। পিছনে পশ্চিমে, বহু দূরে, বোধহয় মানালিও পেরিয়ে, দেখা যাচ্ছে একটি বরফঢাকা শিখর। এই শৃঙ্গটিকে আমরা বরাবর দেখতে পেয়েছি, আমাদের গন্তব্যের প্রায় শেষ অবধি। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পথরেখা কোথাও স্পষ্ট, কখনো হারিয়ে গেছে ঝোপঝাড় অথবা পাথরের আড়ালে। নদী কখনো পথের খানিকটা কাছাকাছি, কোথাও অনেকটাই নীচে। ভেঙে পড়া গাছের গুঁড়ি পড়ে রয়েছে কোথাও, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, জলের ওপর। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে খানিক বসে বিশ্রাম নিয়ে, আবার পথ চলা। মাঝেমধ্যেই পিছিয়ে পড়ছি আমি, রমেশ আর বোরা। প্রথমদিনের চলা, পিঠে রুকস্যাকের বোঝা যেন দ্বিগুণ ঠেকছে। তার ওপর আমি ও রমেশ দু’জনেই বিশালতনু। ধ্যানী ও লাল আদতে পাহাড়ী মানুষ, বেশ তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আর মন্ডলদার কথা তো বলাই বাহুল্য! প্রায় ঘন্টাতিনেক চলার পরে পৌঁছলাম খানোল, উচ্চতা ৭৩০০ ফুট। কোনো লোকবসতি নেই, শুধু নদীর ধারে খানিকটা প্রায়-সমতল জমি, সেখানেই আমাদের তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থা হল। একপাশে দুটো বড় পাথরের ফাঁকে প্লাস্টিকের ছাউনি লাগিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। দলপতি মন্ডলদার নির্দেশে লালবাহাদুর চটপট বানিয়ে ফেলল স্যুপ, তারপর পকোড়া, চা। মন্ডলদার কড়া নজর, এই উচ্চতায় শরীর সুস্থ ও সবল রাখার জন্য ঠিক কেমন খাওয়া-দাওয়া প্রয়োজন – বিশেষতঃ altitude sickness বুঝতে ও ঠেকাতে নানা পরামর্শ দিয়ে চলেছে।


দিনের বেলায় পথ চলার জন্য টের পাইনি, একটু ফাঁকা জায়গায় বসতেই, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া শুরু হল। আর সূর্যাস্তের সাথে সাথেই যেন হুড়মুড়িয়ে নেমে এল অন্ধকার। চটপট রাতের খাওয়া সেরে আশ্রয় নিলাম তাঁবুর ভিতরে। সমতলের হিসেবে তখন হয়ত ৬ ১/২টা কি ৭টা বাজে। কাজেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন রাত দেড়টা। এমনিতেই পাহাড়ে ঘুম খানিকটা কমে যায়, উচ্চতায় অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে। বাইরে তখন চাঁদের আলোয় চরাচর উদ্ভাসিত, দুদিন আগেই ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। কিন্তু তাঁবু একটু ফাঁক করতেই ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট বোঝা গেল। বাইরের তাপমাত্রা তখন বোধহয় ৬-৭° এর বেশি নয়।


সকাল ছ’টায় লালবাহাদুর চা নিয়ে এল। ব্রেকফাস্ট সারা হল ন্যুডলস দিয়ে। নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম দ্বিতীয় দিনের পথে। আজকের পথ প্রায় পুরোটাই পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে – প্রথমে বেশ খানিকটা চড়াই, অল্প উতরাই পেরিয়ে আবার খানিকটা চড়াই। মাঝেমধ্যে পথ কেটে গেছে ঝর্ণার ধারা, পেরোতে হচ্ছে পিছল পাথরের ওপর সাবধানে পা রেখে। পথের দু’পাশে বিশাল সব বনস্পতি – তার সবুজপাতার জালি-পথে ওপরে দেখা যায় ফালি ফালি নীল আকাশ। গায়ে লাগে হেমন্তের প্রশান্ত বাতাস। সকালের রোদে চারিদিক ঝলমল করছে, যেন স্নান সেরে পুষ্পপাত্র হাতে জননী বসুন্ধরা স্মিতবদনে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে পথের পাশে ঘাসের মধ্যে দুটো-একটা ছোট্ট হলুদ ফুল নীরবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তাদের নতুন অতিথিদের। দেখা হয়ে গেল দু’জন ফিরতি-পথের যাত্রীর সঙ্গে – পুণে থেকে দু’বন্ধু এসেছিল চন্দ্রতাল-এর উদ্দেশ্যে, কিন্তু শেরিতে প্রচন্ড তুষারপাতের ফলে, সেখান থেকেই ফিরতে হচ্ছে। আমাদেরও সাবধান করে দিয়ে গেল।
একটা ফাঁকা জায়গায় খানিক বিশ্রাম, তারই মধ্যে লালবাহাদুর এনে ফেলল সবার জন্যে গরম স্যুপ। পাশেই একটা খাড়া পাহাড়, তাই দেখে মন্ডলদার একটু rock climbing করার শখ হল। কিন্তু একটুখানি চড়েই ফিরতে হল – খালি হাতে যদিবা কোনক্রমে ওঠাও যায়, নামার পথ পাওয়া যায় না!


পাথরের গায়ে নানা চিত্র-বিচিত্র নকশা সেগুলির গঠনের ইতিহাসের কিছু কিছু হদিস দেয়। ভূতাত্ত্বিক মতে, এগুলো সবই রূপান্তরিত শিলা – বেশিরভাগই granite gneiss, আর কিছু quartzite ও mica schist রয়েছে। প্রকৃতির জঠরে প্রচন্ড চাপ ও তাপে রূপান্তরের ফলে, সেগুলির গায়ে বিভিন্ন ধরণের ভাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও ফাটলের মধ্যে ঢুকে গেছে quartz-এর শিরা। কোনো একসময়ে (মানে, ভূতাত্ত্বিক সময়কালে, কয়েক কোটি বছরের ব্যাপ্তিতে) একটা বিরাট নাড়াচাড়ার ফলে, সেগুলি এখন উঠে এসেছে পৃথিবীর উপরিভাগের খুব কাছাকাছি। আর আজ স্রোতস্বিনীর ধারা সেগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে এনে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের পথের পাশে।

[ছবি – লেখক]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
5 months ago

ভ্রমণ বৃত্তান্তটি ভাল লাগল।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
5 months ago

বর্ণনা খুব সুন্দর।পড়ে মন কল্পনায় পৌঁছে যায় সেখানে।