শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বিস্মৃতিচারণা (ছয়)



সত্তরের দশকের প্রায় মধ্যভাগ। তখনও কলেজের গন্ডী পেরোইনি। একদিকে উত্তমকুমার, অন্যদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। বাকি সব মহীরুহসম শিল্পীদের কুর্নিশ করেও বলি, এক বিরাট সংখ্যক বাঙালির মতো এই দুজনকে নিয়ে আমাদের আবেগের আতিশয্য ছিল বেশি। তা, হেমন্তবাবুকে দেখা, একাধিক বার তাঁর গান শোনা, হয়ে গেছে। কিন্ত মহানায়কের সাক্ষাৎ দর্শন? তার সুলুক সন্ধান তখনও করে উঠতে পারিনি।


একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-তপনের বুদ্ধিদীপ্ত ছবির জগতের পাশাপাশি সাধারণ মানের ছবির পর্দা জুড়ে ওই অমোঘ রোম্যান্টিক ম্যানারিজম-সমৃদ্ধ অভিনয়ের দুর্নিবার বাঙালিসুলভ আকর্ষণও প্রবলভাবেই অনুভব করতাম। সুতরাং উত্তম-পাগল অভিন্নহৃদয় কলেজ-বন্ধু অমিত সেনের মদতে উত্তমকুমারের এক একটি ছবি দেখতাম আর আক্ষেপটা মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠত। সামনে থেকে কেমন দেখতে মানুষটাকে? কেমন তাঁর কণ্ঠস্বর? কেমন বাচনিক ক্ষমতা? ছবির পর ছবিতে পর্দায় যাঁর এমন সম্মোহক প্রবল উপস্থিতি, জনমোহিনী ক্ষমতায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার, ক্যামেরার বাইরের মানুষটি কি ঠিক ততটাই আকর্ষক? এমন হাজারো প্রশ্ন মনের মধ্যে ভিড় করে আসত।
সুযোগটা এসে গেল আশাতীতভাবে। সেই সময়ের নামী চিত্রপরিচালক শ্রী মঙ্গল চক্রবর্তী, তাঁর কন্যা শ্রীমতী রমা চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে খবর পাওয়া গেল যে মঙ্গলবাবু প্রখ্যাত সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি “আমি সে ও সখা”র একটি চলচ্চিত্ররূপ নির্মাণ করতে চলেছেন, যেটির মূখ্য ভূমিকায় রয়েছেন উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায় ও কাবেরী বসু। রয়েছেন তরুণ কুমারও। উত্তমকুমার ছাড়াও বাকি তিনজনেই আমার অতি প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী। শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে আলোড়ন চলছিল। কিন্তু কুণ্ঠাবশত উপযাচক হয়ে বলতে পারছিলাম না যে শ্যুটিংএর একটি দিন যদি স্টুডিওতে ঢোকার অনুমতি পেতে পারতাম!


মনের সুপ্ত বাসনাটা কেমন করে যেন জানতে পেরেছিলেন রমা! নিউ থিয়েটার্সের এক নম্বর স্টুডিওয় ছবির শ্যুটিং। শুরু হবার দিনে মহরৎ উপলক্ষ্যে আমন্ত্রণ জানালেন উনি। স্টুডিওর ভেতরটা কেমন, কিভাবে শ্যুটিং ব্যাপারটা ঘটে তখনও অজানা। তার ওপরে চর্মচক্ষে এতদিনের উপাস্য দেবদর্শনের অভাবনীয় সুযোগ! ফলে সে এক উত্তেজক পরিস্থিতি! মনের মধ্যে একটা চাপা আনন্দ।
সকাল দশটায় মহরৎ। মেট্রোবিহীন শহরে উত্তরের শহরতলী থেকে দক্ষিণের সিনেমা পাড়া, পথ বড় কম নয়। ঠিক সময়ে হাজির হতেই হবে। আক্ষরিক অর্থেই সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম। পৌঁছলাম সঠিক সময়ের আগেই।
একে একে আসছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রী ও অন্যান্য বিশিষ্ট জনেরা। পরিচালক তো বটেই, উপস্থিত ‘আমি সে ও সখা’র শিল্পীরাও। কাবেরী বসু, তরুণ কুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি ভট্টাচার্য প্রমুখ তারকারা। বহু বিশিষ্টজনের মধ্যে আমন্ত্রিত প্রখ্যাত সেন র‌্যালে সাইকেল কোম্পানির কর্ণধার সঞ্জয় সেন, সঙ্গে অপর্ণা সেন। রয়েছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, গায়ক শ্যামল মিত্র, হৈমন্তী শুক্লা, আরও কত কে! এক সকালেই কত শিল্পী ও খ্যাতিমান গুণীজনকে যে দেখা হয়ে গেল এক চৌহদ্দিতে, এক ছাদের তলায়! পরস্পরের সঙ্গে খোশগল্পে মাতোয়ারা তাঁরা। আমরা কতিপয় মাত্র বহির্জগতের মুগ্ধ দর্শক উপভোগ করছি সম্পূর্ণ অচেনা একটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি, সাদা কালো পর্দার বাইরে রূপোলী জগতের এতগুলো মানুষের কথোপকথন, হাসি-ঠাট্টা, আড্ডা। আসর রীতিমত জমিয়ে রাখছিলেন তরুণ কুমার ও অনিল চট্টোপাধ্যায়। উপস্থিত চিত্র সাংবাদিকরা মুহুর্মূহু ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানিতে তাঁদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন।
কিন্তু তিনি কোথায়? কোথায় সেই মূখ্য চরিত্রটি, মূলত যাঁর জন্যে আমাদের অধীর প্রতীক্ষা? ঘড়ির কাঁটা মধ্যদিনের সীমানার দিকে এগোচ্ছে। তখনও তিনি অনুপস্থিত। থমকে রয়েছে মহরতের ক্ল্যাপস্টিকের আওয়াজ। একটু যেন অধৈর্য্য হয়ে পড়ছেন সমাগত অতিথিরা। মুহূর্মুহু ঘড়ি দেখছেন বিড়ম্বিত পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী মশাই। সেটা তো মোবাইলের যুগ নয় যে চটজলদি খবর চলে আসবে! শেষ পর্যন্ত অবশ্য লোক মারফত খবর এসে পৌঁছল যে অনিবার্য কারণে কোথাও আটকে পড়েছেন তিনি। আর অল্পসময়ের মধ্যেই স্টুডিওতে ঢুকে পড়বেন উত্তম।


খবর আশা মাত্রই স্টুডিওটা হঠাৎ যেন চনমন্ করে উঠল। সাজে সাজো রব চতুর্দিকে, দাদা আসছেন, দাদা আসছেন, দাদা ঢুকছেন থেকে দাদা এসে গেছেন! ক্যামেরাম্যানেরা প্রস্তুত, তৈরী সংবাদপত্রের চিত্রসাংবাদিকরা। তখন ফ্ল্যাস বাল্বের আলোক প্রক্ষেপনে ছবি তোলার যুগ। আলোর ঝলকানির মধ্যে তড়িৎ গতিতে স্টুডিওর ফ্লোরে এক রাশ আলো ছড়িয়ে প্রবেশ করলেন উত্তমকুমার। ছোট ছোট ফুল ছাপের পুরো হাতা শার্ট, ছাই রঙের প্যান্ট, চোখে মুখে সেই ভুবনভোলানো হাসির ঝলক, করজোড়ে সকলের কাছে দেরি হওয়ার জন্যে দুঃখপ্রকাশ। একই সঙ্গে চিত্রগ্রাহকদের আবদার মেটাতে কাবেরী বসুকে ডেকে নিয়ে বিশেষ রোম্যান্টিক মুহুর্ত রচনা করে ছবি তোলা। বিদ্যুৎ গতিতে ঘটতে লাগল ব্যাপারগুলো। সামনে ফ্লোরে আমার প্রিয় নায়ক, ঠিক দশ/বারো ফুটের দূরত্বে বসে আমার চোখে তখন রীতিমত ঘোর। প্রথাগত অর্থে নিখুঁত সুন্দর না হয়েও যে একটা মানুষের মধ্যে এত গ্ল্যামারের ছটা বা ঔজ্জ্বল্য থাকতে পারে, মানুষটা চলনে বলনে এতটা মোহময় ও সপ্রতিভ হতে পারেন, সামনাসামনি না দেখলে হয়তো ভাবনায় এতটা আনতে পারতাম না।


অতঃপর মহরৎ। ক্ল্যাপস্টিক পড়ল সশব্দে। উজ্বল হাসিতে উত্তম-কাবেরী জুটি। স্বল্প সময়ের একটা শট দিলেন তাঁরা। সমবেত করতালির মধ্যে ঘোষিত হল ‘আমি, সে ও সখা’ ছবির নির্মাণবার্তা। সমাগত অতিথি ও কলাকুশলীদের হাতে তুলে দেওয়া হল খাবারের প্যাকেট।
মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির পর আবার শুরু হল শ্যুটিংয়ের কাজ। সত্যি কথা বলতে কি, দর্শক হিসেবে কিছুটা মোহভঙ্গই ঘটল। একটি নিটোল বাধাবিঘ্নহীন চলচ্চিত্রের ধারণা নিয়ে চিত্রায়ণের কাজ দেখতে বসলে এটাই যে স্বাভাবিক, সে জ্ঞানগম্যি তখনও ছিল না। খন্ড বিখন্ড অসংখ্য দৃশ্যের চিত্রগ্রহণকে সম্পাদনা করে যে ছবিটি দর্শকের সামনে পরিবেশন করা হয়, সেটি দেখে অভ্যস্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে ধারণাহীন দর্শকের পক্ষে শুটিং দর্শন যে এক বিড়ম্বনা, সে অভিজ্ঞতা সেদিন অর্জন করেছিলাম।
কয়েকটি দৃশ্যের খন্ডিত চিত্রগ্রহণ দেখে বিদায় নিলাম সেদিনের মত। কিন্তু অদম্য উৎসাহে পরিচালক মশায়ের অনুমতি চেয়ে নিলাম আর একটি দিনের জন্য। সেটি সেদিনের, যেদিন উত্তম ছবিতে গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাবেন ও অভিনয় করবেন। অর্থাৎ গানে লিপিংয়ের শ্যুটিং, যে কুশলতায় তদানীন্তন সময়ে উত্তমকুমার শুধু বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষে অদ্বিতীয় বলে চলচ্চিত্রের বিদগ্ধ মহলে জনশ্রুতি ছিল।

এরপরের কাহিনি সঙ্গীত-দৃশ্যের শুটিংয়ের দিনের। সেদিনও সকাল সকালই হাজির হয়েছি। স্টুডিওতে ঢুকে যে দৃশ্যটি নজর কাড়ল, তা হল, উত্তমকুমার স্টুডিওর ভেতরেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে একটি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট চিত্তে বড় আকারের একটি টেপ রেকর্ডারে শুনে চলেছেন শ্যামল মিত্রর কণ্ঠের একটি গান “এই হাসি মানায় না তো চন্দ্রাণী মুখ ছাড়া…”। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে, যদিও কণ্ঠস্বরবিহীন। বুঝলাম, নীরবে মহড়া চলছে। শরীরী ভাষায় একটা তন্ময়তা লক্ষ করলাম। কারুর সঙ্গেই বিশেষ কথা বলছেন না। বাকি তারকারা অবশ্য গল্পগুজবে মশগুল।
শুরু হল চিত্রগ্রহণ। একটি ঘরোয়া পার্টিতে অতিথিদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গানটি গাইলেন উত্তম। গানটির মূল লক্ষ নায়িকা কাবেরী বসু, কাছাকাছি অসূয়াভরা দৃষ্টি নিয়ে সহনায়িকা আরতি। এক অদ্ভুত সাবলীলতা গানটির দৃশ্যে উত্তমের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের স্বরবিহীন গায়নে। অত্যন্ত উপভোগ্য দৃশ্য। দর্শক হিসেবেও সেদিন ভাল লাগল শ্যুটিং পর্বগুলো। বিশেষ করে নজর কাড়ল চিত্রায়নের ফাঁকে ফাঁকে প্রবীণ পরিচালকের সম্মতিক্রমে ছবিতে উপভোগ্য দৃশ্য রচনায় সহঅভিনেতাদের উত্তমকুমারের পরামর্শ দান, যা দৃশ্যগুলোতে অন্য মাত্রা যোগ করছিল। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সীয়ানার পরিচয় পেয়েছিলাম সেদিন। অল্প দিনের মধ্যেই শিল্পী সংসদের প্রযোজনায় তাঁর পরিচালিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’ সেই কুশলতার সাক্ষ্য বহন করেছে।


সেদিন কিন্তু উত্তমকুমারের গানের চলচ্চিত্রায়ন দেখার পাশাপাশি আমার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হল তাঁর স্বাক্ষর সংগ্রহ, যেটিতে আমার প্রবল আগ্রহ ছেলেবেলা থেকে। সুতরাং আমার অটোগ্রাফের খাতাটি সঙ্গে নিয়েছি। সকাল বেলা শ্যুটিং শুরুর আগেই বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সই সংগ্রহ হয়ে গেছে। কিন্তু আসল মানুষটি যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চেষ্টা করেও তাঁর অটল গাম্ভীর্য ও আত্মমগ্নতা ভেদ করে কাছে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। মনে মনে ভাবছি, যে করেই হোক মানুষটিকে একটু একলা ধরতে হবে। কী যে প্রতিক্রিয়া হবে তা নিয়েও একটু ধন্দে আছি!
ধন্দে থাকার কারণ, কিছুদিন আগেই এক কেতাদুরস্ত নায়কোচিত চেহারার উত্তম-ভক্ত বন্ধুর অটোগ্রাফ চাইতে গিয়ে জনসমক্ষে তার নাকাল হবার কাহিনি শুনেছিলাম। কোনো এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে তার ইষ্টদেবতাসম উত্তমকুমারকে মঞ্চে ওঠার আগে হাতের নাগালে পেয়ে সে একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল এবং সটান তাঁর সামনে হাজির হয়ে তাঁকে ‘গুরু’ সম্বোধন করে অটোগ্রাফ চেয়েছিল। পরিণতিতে তার পিঠ চাপড়ে উত্তম বলেছিলেন, ‘আমার অটোগ্রাফ না নিয়ে বাড়ি গিয়ে ভাল করে পড়াশোনা কর। সেটা ভবিষ্যতে কাজে দেবে।’ বেচারার ঈশ্বরের অটোগ্রাফ পাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।


যাই হোক, গানের অভিনয়ের শ্যুটিং শেষ হল প্রথমার্ধে। মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। ফ্লোরের বাইরে পা রাখলেন উত্তম। পাশে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র। তাঁর কাঁধে হাত রেখে লাঞ্চ রুমের দিকে এগিয়ে চললেন উত্তম। তখনও গুনগুন করে গাইছেন। মনে হল, এটাই সুযোগ। হাতে অটোগ্রাফের খাতাটি নিয়ে পিছু নিলাম ওঁদের। কিছুটা পথ এগোতেই একটু দ্রুত হেঁটে এগিয়ে পাশে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘অনুগ্রহ করে একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’… এক মুহূর্ত থমকালেন, তারপর স্বভাবসুলভভাবে ঘাড়টি একটু টেরচা করে ঘুরিয়ে কিছুটা বিরক্তি সহকারেই যেন বললেন, ‘এখন না ভাই, এখন না। পরে এসো।’
একটু মনক্ষুণ্ণই বোধ করলাম।… একটা অটোগ্রাফ বৈ তো নয়! তার আবার এখন তখন!… ভক্তের ভক্তি যেন একটু টলে গেল, হয়তো বা ঘা লাগল আত্মসম্মানবোধে।… ভাবলাম, নেবই না আর অটোগ্রাফ। হোন না তিনি উত্তমকুমার! এমন সময় পাশ থেকে এক স্টুডিওর কর্মী বললেন, ‘সন্ধ্যে পর্যন্ত থাকলে তবেই ওঁর অটোগ্রাফ পাবেন ভাই। একাগ্রতা নষ্ট হয় বলে শ্যুটিং শেষ করে বাড়ি যাবার সময় ছাড়া দাদা অটোগ্রাফ দেননা।’ কথাটা শোনার পর মনের ক্ষতে যেন একটু প্রলেপ পড়ল।
যাই হোক, সন্ধ্যে পর্যন্ত থেকে উত্তমকুমারের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না বলে বুঝলাম এবং তা মেনে নিয়েই দর্শক আসনে কিছুক্ষনের জন্যে আবার শ্যুটিং দেখতে বসলাম। বিরতির পর ফ্লোরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। শিল্পীরা এসে গেছেন। ফ্লোরে রয়েছেন পরিচালক, উত্তম, কাবেরী ও আরতি। ক্যামেরাশিল্পীকে নির্দেশ দিচ্ছেন পরিচালক। শ্যুটিং শুরু হবার ঠিক আগের মুহূর্ত।
ইতিমধ্যে মঙ্গল চক্রবর্তী-তনয়া রমা আমাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন আমার সই সংগ্রহের ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত। আমি তাঁকে জানালাম, ‘আজ আর হবে না। পরে কখনও নেওয়া যাবে।’… আমার কথার ভঙ্গিতে কিঞ্চিত হতাশা বোধহয় ধরা পড়েছিল।
শ্যুটিং স্পটের সামনের সারিতেই বসেছিলাম শিল্পীদের মুখোমুখি। হঠাৎ দেখলাম রমা উঠে গিয়ে তাঁর বাবাকে ফ্লোরের সামান্য বাইরে ডেকে একান্তে কিছু বলছেন। পরক্ষণেই দেখলাম, মঙ্গল বাবু আমাকে ফ্লোরের ভেতরে ডাকলেন এবং মুখোমুখি দাঁড়ানো উত্তমকুমারকে বললেন, ‘এই উত্তম, ছেলেটি অনেক দূর থেকে এসেছে তোমার একটা অটোগ্রাফের জন্যে। চলে যাবে। একটু দিয়ে ছেড়ে দেবে ওকে?’… তাঁর কণ্ঠস্বরে যেন কিছুটা কুণ্ঠা আমার শ্রুতিতে ধরা দিল।
অতীব সুভদ্র প্রবীণ মানুষ মঙ্গল চক্রবর্তী। এমন করে ভদ্রলোককে বিব্রত করতে সত্যিই আমি চাইনি! আমার অবস্থা তখন রীতিমত সঙ্গীন। কিছুক্ষণ আগেই সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। তারপরেই পরিচালক মশাইয়ের সাহায্যে ছবির নায়কের একেবারে সামনে গিয়ে হাজির হওয়া, যদিও আমার তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না! বেশ সঙ্কুচিত হয়েই ফ্লোরে ঢুকলাম। হাতে অটোগ্রাফের খাতা।
আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে উত্তম হাত বাড়িয়ে খাতাটি চাইলেন, ‘দেখি ভাই’!… মুখে ঈষৎ গাম্ভীর্যের ছায়া, হয়তো একটু কাঠিন্য। খাতা বাড়িয়ে দিতেই পেলাম কাঙ্খিত স্বাক্ষরটি। সন্ত্রস্ত কণ্ঠেই অনুরোধ করলাম, ‘আজকের তারিখটা যদি সইয়ের নিচে একটু দিয়ে দেন…’! আর একবার বড় বড় চোখে দৃষ্টিপাত করলেন আমার ওপর। কিন্তু অনুরোধটি রক্ষিত হল… ৩রা অগাস্ট ১৯৭৪। ফ্লোর থেকে বেরিয়ে এলাম কিছুটা সঙ্কোচ এবং বাকিটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ নিয়ে।…


সেদিনের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে হয়তো ছেলেমানুষীর প্রাবল্য ছিল, কিন্তু আজ তাঁর মৃত্যুর চার দশক পেরিয়েও যখন তাঁকে সজীব দেখি বাঙালির মনে ও স্মরণে, তখন কুড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছোন এক তরুণের সেদিনের প্রাপ্তিটাকে আজও মহার্ঘ বলেই মনে হয়। উদ্যম ও আকুতিটাকেও অর্থহীন বলে ভাবতে পারি না।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.