শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

স্বাধীনতা, তুমি কোন্‌ পথে?

স্বাধীনতা! লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত-রঞ্জিত স্বাধীনতা। কত কত একনিষ্ঠ দেশসাধকের বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত স্পন্দন তোলা স্বাধীনতা। হাজার হাজার
কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-দার্শনিকের মননসাধনায় জারিত স্বাধীনতা। কত কত নাম-না-জানা ইতিহাসে স্থান-না-পাওয়াদের সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা। এ’ স্বাধীনতা বড় যত্নে, বড় আদরে, বড় শ্রদ্ধায় লালন করারই তো কথা ছিল। কথা ছিল ওই নাম-না-জানাদের সামনের সারিতে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার।

কিন্তু আমরা সেই একাগ্রতা নিয়ে, নিষ্ঠা নিয়ে তা করতে পারলাম কই? – এই প্রশ্নটা সাতাত্তর বছর পেরিয়ে আজও মনকে তাড়িত করে,আলোড়ন তোলে। আক্ষেপও জাগায় বৈকি!

স্মরণ করা যেতে পারে, জীবনের অন্তিম পর্বে (১৯৪১ সাল, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) তাঁর আশি বছর পূর্তি উৎসবের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’-এ রবীন্দ্রনাথের অমোঘ উক্তি – “ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্‌ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে, কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে?”

সেই ‘লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনা’কেই কি আমরা আজও বহন করে চলেছি আমাদের আপাত সুখ ও সমৃদ্ধির আড়ালে? বিদেশি শাসক চলে যাওয়ার পৌনে এক শতক অতিক্রান্ত। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের তুলনায় একটি বড় সংখ্যার জনসাধারণের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য কম-বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চেতনায়, মননে, যাপনে, বোধে আমরা আজও কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবির আপ্তবাক্যের যাথার্থ্য প্রমাণ করে চলেছি?
স্বাধীনতার কাঙ্খিত স্বরূপের ছবি আঁকতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান প্রায় সিকি শতাব্দী পরে জন্মানো রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন –

“স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো” …
“স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।…”

এই স্বাধীনতাই তো শয়নে স্বপনে জাগরণে প্রত্যাশিত ছিল আমাদের পূর্বজদের।

তথাপি প্রথম লগ্নেই এই উপমহাদেশের বিয়োগান্ত এক ললাটলিখন লিখে দিয়েছিলেন ভারতভাগ্যবিধাতা। মরমী কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কলমে “খুকু ও খোকা” কবিতায় আগামী প্রজন্মের শিশুটি বলে উঠেছিল:

“তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ত ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী !
তার বেলা?”…

সেটাই কি ছিল ভারতবর্ষের পরবর্তী বিয়োগান্ত ইতিহাস নির্মাণের সূচীমুখ? স্বাধীন ভারতের শাসনভার যাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, জ্ঞানে, গুণে, পান্ডিত্যে, নিষ্ঠায় তাঁরা অনেকেই ছিলেন উচ্চ মার্গের। তবু ক্ষমতা হস্তান্তরের রাত্রিতে যে আশা জেগেছিল, তা পূরণ হল কই? দেশগঠনের নানান কর্মযজ্ঞ সত্ত্বেও বিপুল উদ্বাস্তু স্রোত, অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা, সর্বব্যাপী অশিক্ষা, প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রার্থিত ফললাভের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। উন্নয়নের পথে পর্বতের মতো সামনে এসে দাঁড়াল দেশভাগের ফলশ্রুতি – জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ও জটিলতা, যা আজও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
দেশটা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ কি অনিবার্য ছিল? কী রকম হোত, দেশটাকে অবিভক্ত রাখতে পারলে? তাতে কি আমরা সবাই শান্তিতে বসবাসের নিশ্চয়তা পেতাম? তদানীন্তন ভারতবর্ষে গৃহীত উদারতাভিত্তিক রাষ্ট্রধর্ম সত্ত্বেও অপর অংশটির ধর্মকে আঁকড়ে ধরে দেশটাকে দ্বিখন্ডিত করার চক্রীরা কিম্বা অনুরূপ ভাবনার এদেশী দোসররা কি তা আদৌ হোতে দিতেন? এ’রকম হাজার প্রশ্ন বুকে নিয়েই নিরুত্তর থেকে গেছে ইতিহাস। উত্তর দেবার দায়ও অবশ্য তার নেই।

অনাকাঙ্খিত দেশভাগের প্রেত হয়তো তাড়া করে ফিরছিল অপর প্রান্তের দেশটিকে। তার মাসু্লই বোধহয় তাকে চোকাতে হল মাত্র চব্বিশটি বছরের তফাতে? ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত হতে হল ইতিহাসের অমোঘ বিধিলিপিতে । সৃষ্টি হল বাংলাদেশ। একটি উপমহাদেশ ভেঙে রূপ নিল তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রে।
কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যা প্রার্থিত ছিল, তা ধরা দিল না কোনো প্রান্তেই। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-দীর্ণ সম্পর্ক, সীমান্ত-যুদ্ধ,ধর্মান্ধতা, সীমানার অপর পার থেকে ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু বিতাড়নজনিত উদ্বাস্তু স্রোতে বিপর্যস্ত উন্নয়ন-যজ্ঞ, প্রথমে দুটিকে, পরবর্তীতে তিনটি খন্ডকেই পুরোপুরি ভাল থাকতে দিল না।

সত্তরের দশকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে এক কবি লিখেছিলেন:

“স্বাধীনতার
খুলল দ্বার –
চমৎকার
চটকদার।
শিকলটাই
ছিঁড়ল ভাই –
কী ফলটাই
ফলল ছাই!…”
“এ’ অবসাদ,
এই বিষাদ
এখনো কেন
যায় না যেন?
এখনো মন
কেন এমন?
এখনো প্রাণ
কেন উজান?… “

(প্রভাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা: ‘বাজে গুজব’ থেকে উদ্ধৃত)

সময়কাল এগিয়েছে। নানা ক্ষেত্রেই হতাশা কাটিয়ে ভারতবর্ষ আজ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙে উপনীত বিশ্বসভায়। তবু সর্বাঙ্গীন সাফল্য, সর্বজনের মঙ্গল আজও অধরা। দুরারোগ্য কিছু ব্যাধি সমাজে আজ মহীরুহের রূপ পরিগ্রহ করেছে, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনায় আক্রান্ত আজ সামাজিক নৈতিকতা-বোধ। পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি আজ আর জনসমাজে অনৈতিক বলে চিহ্নিত হচ্ছে না। অর্থ আজ শাসন ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচনের চালিকাশক্তি।

একটা দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সামনের সারিতে থাকা আমাদের রাজ্য়ের অবস্থা যেন আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা মরুভূমির প্রতীক। সরকারি জনশিক্ষা আজ প্রায় অবলুপ্ত। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। শিল্প অন্তর্হিত। একের পর এক পাশবিক নারীনিধন যজ্ঞ অবাধ ও অপ্রতিহত। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। আমাদের যে কন্যাটি আমাদের প্রাণ বাঁচানোর অঙ্গীকার করেছিল, তাকে আমরা বাঁচতে দিলাম না, বরং তার হন্তারকদের প্রতি করুণা প্রদর্শনে, আড়ালে রাখার অপচেষ্টায় আমরা কার্পণ্য করলাম না। স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পূর্তির প্রাক্কালে যেন এক আদিগন্ত অন্ধকারে আজ মসীলিপ্ত আমাদের চতুর্দিক। সর্বাত্মক নৈরাশ্য, নিষ্ফল যন্ত্রণা আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী।

এই তমসার মধ্যে এক ঝলক রূপোলী রেখা এক প্রতিবাদী তরুণীর ১৪ অগাস্টের মধ্য রাত্রে নারীদের রাত দখলের প্রতীকী আহবান, যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, শহরতলিতে, রাজ্যের সীমানা, এমনকি দেশের সীমারেখা পেরিয়ে। একটি কণ্ঠের সঙ্গে গলা মেলালেন লক্ষ লক্ষ প্রতিবাদী নারী। এমন স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বল অরাজনৈতিক জনজাগরণ দেশ কখনো দেখেছে বলে মনে হয়না। যে প্রতিবাদের ভাষা বাংলা হারিয়ে ফেলেছিল, তার যেন পুনরুদ্ধার ঘটল এক ললনার নিগ্রহের প্রতিবাদে আর এক ললনার হাত ধরে। অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এ’ আমাদের এক অসামান্য প্রাপ্তি।

[চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল]

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.