
বিস্মৃতিচারণা (১৪)
সচেতন তারুণ্যে আমার প্রথম বাংলা সাহিত্যের বনস্পতি সন্দর্শন যাঁর সঙ্গে, তিনি ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বনফুল।
আমার এই ক্ষুদ্র অতীতচারণার মুখবন্ধে বনফুল প্রসঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক আচার্য সুকুমার সেনের ‘বনফুলের ফুলবন’ গ্রন্থটি থেকে তাঁর দুটি উক্তি স্মরণ করতে ইচ্ছে করছে। তিনি বলেছিলেনঃ “তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে ’ফুল’ আছে, ‘বন’ অর্থাৎ উপবন – ফলপ্রসু ও ছায়াবৃক্ষও আছে। তাঁকে আমরা আমগাছের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, আমের ফল সর্বজনগ্রাহ্য, আমের ফুল মধুকর ও কবিগণ জ্ঞাত।“ তাঁর সম্পর্কে আচার্য সেনের অমোঘ উক্তি, “বলাই বাবু সাহিত্য়ের ক্ষেত্রে ঢুকেছিলেন ভয়ে ভয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে। তাই নামও নিয়েছিলেন তেমনি নিরহংকার, নিরীহ।“ – বনফুল সম্পর্কে আচার্য সেনের দুটি মন্তব্যই বড় অব্যর্থ বলে মনে হয়।
বলতে দ্বিধা নেই যে তদানীন্তন সময়ের এক সাহিত্য-পিপাসু তরুণ হিসেবে বাংলা সাহিত্যের এহেন প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা দূরস্থান, তাঁকে চাক্ষুষ দেখাও আমার স্বপ্নের অতীত ছিল।
সময়টা সত্তরের দশকের প্রায় মধ্যভাগ, ঊনিশশো চুয়াত্তর সালের জুলাই মাস। একটি সাহিত্য সভার প্রধান অতিথি হিসেবে বনফুল এলেন আগরপাড়ার প্রভাসতীর্থে। তখন তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রবীণ সব্যসাচী হিসেবে প্রবলভাবে দীপ্যমান। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গল্প রচনায় সমান দক্ষতা তাঁর । অন্যান্য আরও কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ছাড়াও কিছুকাল আগেই তাঁর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’, তপন সিংহের ‘হাটেবাজারে’র মতো কালজয়ী ছবি। ওই সময়কালেই প্রস্তুতি চলছে তাঁর মেডিকেল কলেজের কিম্বদন্তীপ্রতীম শিক্ষক ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবনকাহিনির ছায়ায় রচিত ‘অগ্নিশ্বর’ চলচ্চিত্রায়নের, যেখানে নাম ভূমিকায় কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পাব উত্তমকুমারের হৃদয় মথিত করা অভিনয়। অন্যদিকে অতি ছোট বা অনুগল্পের তো তিনি রাজাধিরাজ । বাংলা সাহিত্যে পোস্ট কার্ড আয়তনের বা ক্ষুদ্র অবয়বের অভিনব ও বুদ্ধিদীপ্ত ছোটগল্পের সফল উদ্ভাবক তিনি। সব মিলিয়ে একাধারে চিকিৎসক ও সাহিত্যিক বনফুলের সম্বন্ধে আমাদের আগ্রহের কারণ ছিল যথেষ্টই।

তখনও সভা শুরু হতে কিছু সময় বাকি। গ্রীষ্মের বিকেল। উদ্যোক্তারা তাঁকে বসালেন একটু নিরালায়। দূর থেকে তাঁকে দেখলাম, মনে হল, রাশভারি অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। প্রণাম করে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মৃদু হেসে পরিচয় জানতে চাইলেন। খবর নিলেন আমার সাহিত্য পাঠের আগ্রহ নিয়ে। সদর্থক উত্তর মনে হল খুশি করল ওঁকে।
কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম ওঁর ‘বনফুল’ ছদ্মনামের উৎস সম্পর্কে। বললেন, ‘তখন আমি বিদ্যালয়ের ওপরের দিকের ছাত্র। কবিতা লিখতে শুরু করেছি। বাবার ঘোর আপত্তি পড়াশোনা ছেড়ে ওইসব করায়। ওদিকে বিদ্যালয়ের এক স্নেহশীল সাহিত্যপ্রেমী মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশ স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য একটি কবিতা লিখতে হবে। তাঁকে খুলে বললাম আমার সমস্যা ও তজ্জনিত অক্ষমতার কথা। তিনি দাওয়াই দিলেন, ‘ছদ্মনামে লেখো। কবির নাম আড়ালে থাকবে।’ কথাটা মনে ধরল। ভাবতে লাগলাম, কি নাম নেওয়া যায়? মনে এল, ছেলেবেলায় আমি খুবই দুরন্ত ছিলাম। দুষ্টুমি করে দিনের অধিকাংশ সময়েই খেলে বেড়াতাম বনে-বাদাড়ে। আর বাড়ির পরিচারকরা আমার পেছনে দৌড়ে নাজেহাল হয়ে যেত। ওরাই আদর করে আমার নামকরণ করেছিল ‘জংলীবাবু’। তারপর হেসে বললেন, ‘বনফুল’ ওটারই একটা ভদ্র সংস্করণ। ওই নামেই লোকচক্ষুর আড়ালে শুরু হয়ে গেল আমার সাহিত্য-চর্চা। জনসমক্ষে রইল আমার পড়াশোনার জগৎ । কিন্তু যে নাম আমাকে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দিল, তাকে আর ছাড়তে পারলাম না ।
এবার আমার অটোগ্রাফের খাতাটি ওঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “একটু কিছু যদি লিখে দেন, সেটা আমার সম্পদ হয়ে থাকবে।”

খাতাটা হাতে নিয়ে লিখলেনঃ
“ভাল সাহিত্য পাঠক ভাল লেখকের মতই বিরল। ভাল পাঠক এবং ভাল লেখকের সমন্বয়ে সাহিত্যের প্রসার হয়।”
১৩।৭।৭৪ বনফুল
প্রায় অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে তাঁর অমোঘ উক্তির যাথার্থ্য আজও মর্মে গভীরভাবে অনুভব করি। কালের প্রলেপে বনফুলের বাণীসম্বলিত খাতার পাতাটি কিছুটা মলিন হলেও আজও সেটি আমার সযত্নরক্ষিত সম্পদ।

আমার বনফুল দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল শ্রদ্ধেয় ফনীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে।ওঁর আমন্ত্রণেই কামারহাটির একটি বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্য সভায় উনি এসেছিলেন। ঘরে ঢুকেই উনি ‘ ফনী কোথায়? ‘ বলে হাঁক দিয়েছিলেন।তারপর তো দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ চলেছিল কিছুক্ষণ।খুব রসিক মানুষ মনে হয়েছিল কথাবার্তা শুনে।এটা আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের কিছুটা আগের কথা মনে হয়।